মুহাম্মাদ শাহ আনিস বেদার - হাটহাজারী, চট্টগ্রাম
Question
ক) ‘আশরুন’ এবং ‘আশারাতুন’ শব্দ দুটির ক্ষেত্রে দেখা যায়, শীনকে কখনো সাকিন দিয়ে আবার কখনো যবর দিয়ে পড়া হয়। লেখার ক্ষেত্রেও এমন দেখা যায়। এ বিষয়ে কি কোনো কায়েদা আছে? জানালে উপকৃত হব।
খ) আরবী ভাষায় লিখিত কুরআন মজীদের শানে নুযূল সম্পর্কে লিখিত কোন কিতাবটি মুতালাআয় রাখতে পারি?
Answer
ক) প্রশ্নকৃত ক্ষেত্রে নিয়ম হল- وأحد عشر رجلا وعشر نساء وإحدى عشرة امرأة. অর্থাৎ মা’দুদ মুযাক্কার হলে শীন মাফতুহ আর মা’দুদ মুয়ান্নাছ হলে শীন সাকিন হবে। যেমন আরবী উদাহরণগুলোতে দেখা যাচ্ছে। ‘আহলে লুগাত’ আরো বলেছেন, মা’দুদ মুয়ান্নাস হলে আরবের নজদবাসীদের মতে শীনকে মাজরুরও পড়া যায়। তবে এই ব্যবহার খুবই কম। (আসসিহাহ, জাওহারী ২/৭৪৬; তাজুল আরূস ৩/৩৯৯; জামেউদ দুরূসিল আরাবিয়্যাহ ১৪)
খ) শানে নুযুল তাফসীরুল কুরআন এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং প্রায় সব তাফসীরের কিতাবে তা কমবেশি আলোচিত হয়। তাছাড়া আসবাবুন নুযূল বা শানে নুযূল শিরোনামে অনেক আগে থেকেই আলাদা কিতাবপত্র লিখিত হয়েছে। কয়েকটি কিতাবের নাম উল্লেখ করছি। ১. আসবাবুন নুযুল, ইমাম আবুল হাসান আলী ইবনে আহমদ ওয়াহেদী রাহ. (৪৬৮ হি.) ২. আসবাবুন নযুল ওয়াল কিসাসিল ফুরকানিয়া, আবুল মুজাফ্ফর ইবনে আসআদ ইরাকী হাকীমী রাহ. (৫৬৭ হি.) ৩. আজাইবুন নুকূল ফী আসবাবিন নুযূল, আবু ইসহাক ইবরাহীম ইবনে ওমর আলজুবুরী রাহ. (৭৩২ হি.) ৪. আলউজাব ফী বয়ানিল আসবাব, হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. (৮৫২ হি.)। কিতাবটি তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। সূরা নিসার কিছু অংশ পর্যন্ত মুসাওয়াদা করেছিলেন। ইতিমধ্যেই তাঁর ইন্তিকাল হয়ে যায়। ঐটুকুই ‘দারু ইবনিল জাওযী’ থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ৫. লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবিন নুযূল, জালাল উদ্দীন সুয়ূতী রাহ. (৯১১ হি.)। এছাড়াও সমসাময়িক অনেকে এই বিষয়ে সতন্ত্র্য কিছু কিতাবও সংকলন করেছেন। তন্মধ্যে ‘দারু ইবনিল জাওযী’ থেকে তিন খণ্ডে প্রকাশিত সালিম ইবনে আলহিলালী ও মুহাম্মাদ ইবনে মুসা আলে নাসর সংকলিত‘আলইসতিআব ফী বয়ানিল আসবাব’ উল্লেখযোগ্য। এখানে কয়েকটি কথা মনে রাখা উচিত। প্রথম কথা হল, উল্লেখিত প্রায় সবকটি কিতাবই শানে নুযূলের রেওয়ায়েত সংক্রান্ত। কোন আয়াত কোন প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছিল-এ সম্পর্কিত রেওয়ায়েতগুলো এসব কিতাবে সংকলিত হয়েছে। ‘দিরায়াতে শানে নুযূল’ এসব কিতাবের বিষয়বস' নয়। শানে নুযূল এর হাকীকত ও আহাম্মিয়ত আয়াতের মর্ম ও নির্দেশনা অনুধাবনের ক্ষেত্রে এর প্রভাব এবং এ সংক্রান্ত মূল নীতিসমূহ দিরায়াতে শানে নুযূলের অন্তর্ভূক্ত। রিওয়ায়েত এর চেয়ে দিরায়াত কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এজন্য সে বিষয়েও সচেতন থাকা আবশ্যক। দ্বিতীয় কথা হল, আয়াতের শানে নুযূল নির্ধারিত হবে রিওয়ায়াত দ্বারা। এখানে আক্বলের কোনো দখল নেই। এজন্য সংশ্লিষ্ট রেওয়ায়েতের ‘ছিহহত-যা’ফ’ এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েত ছাড়া শানে নুযূল বর্ণনা করার অবকাশ নেই। আল্লামা ওয়াহেদী রাহ. তাঁর কিতাবের ভূমিকায় বলেন, ‘কুরআনের আসবাবে নুযূল সম্পর্কে কোনো কথা বলা ঐ সময় পর্যন্ত বৈধ নয় যতক্ষণ না মুত্তাসিল সনদে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কিংবা সাহাবায়ে কেরাম থেকে রেওয়ায়াত পাওয়া যাবে, যারা কুরআন নাযিল হওয়ার পরিবেশ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং এর কারণ, ঘটনা ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগত ছিলেন। উপরন' তারা এই ইলম অর্জনে অক্লান্ত পরিশ্রমও করেছেন। আমাদের সালাফ এ বিষয়ে খুবই সতর্ক ছিলেন। কিন্তু আজকাল লোকেরা আসবাবে নুযূলের নামে মনগড়া কথা বলে এবং মিথ্যা ও কাল্পনিক কথা বর্ণনা করে।’ হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. ওয়াহেদী রাহ.-এর উক্তি উদ্ধৃত করার পর বলেন- بالرواية ما لا يثبت لوهاء بعض رواته ‘আমি ওয়াহেদীর এই খুতবাটি পাঠ করার পর তাঁর কিতাবটি অধ্যয়ন করলাম। আল্লাহ তাঁকে রহম করুন। তিনি নিজেও ঐ একই ত্রুটির শিকার হয়েছেন। এ সংক্রান্ত অনেক কিছুই তিনি বর্ণনা করেছেন বিলকুল সনদ ছাড়া। অথচ তিনি নিজেই স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, আসবাবে নুযূলের ক্ষেত্রে রিওয়ায়েত ও সামআ ছাড়া কোনো কথা বলা যাবে না। তদ্রূপ রিওয়ায়েত ও সামআর মাধ্যমেও যা কিছু বর্ণনা করেছেন তাতেও এমন অনেক রেওয়ায়েত রয়েছে, যা রাবীদের অতিশয় দুর্বলতার কারণে অগ্রহণযোগ্য। (আলউজাব ১/১৯৯-২০০;আলমাদখাল লি দিরাসাতিল কুরআনিল কারীম, মুহাম্মাদ আবু শাহবা ১২৩) অথচ পরবর্তীতে যারাই আসবাবুন নুযূল-এর উপর কিতাব লেখেছেন হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ছাড়া প্রায় সকলেই ওয়াহেদীর কথাগুলোকে শানে নুযূল-এর মর্যাদা দিয়েছেন। এমনকি সুয়ূতী রাহ.-এর কিতাবেরও অধিকাংশ স্থানে রেওয়ায়েতের যাচাই-বাছাই ও মান উল্লখ করা হয়নি। হাফেয ইবনে হাজার রাহ. যদি তাঁর কিতাবটি পূর্ণ করে যেতে পারতেন তাহলে একটি শূন্যতা পূরণ হত। তিনিই একমাত্র মুসান্নিফ যিনি এই বিষয়ের কিতাবে রেওয়ায়েতের মান বিশদভাবে আলোচনা করার প্রয়াস পেয়ে ছিলেন। কথা দীর্ঘ হয়ে গেল, আপনার প্রশ্নের উত্তরে সুয়ূতী রাহ.-এর লুবাবুন নুযূল-এর কথাই বলতে হত কিন্তুরেওয়ায়েত সম্পর্কিত যাচাই-বাছাই এখানে কম থাকায় তার স'লে পূর্বে উল্লেখিত ‘আলইসতিআব’-এর কথাই আপনাকে বলব। মাশাআল্লাহ, হাদীসের তাখরীজ ও মান বর্ণনার জন্য তারা খুব মেহনত করেছেন। এটি আপনি সংগ্রহ কওে পড়তে পারেন। তবে মনে রাখা উচিত, হাদীসের মান নির্ণয়ে তাঁদের তাহকীকের সাথে অন্যদের দ্বিমতও হতে পারে। এ ধরনের কোনো সমস্যা মনে করলে আহলে ফনের সাথে যোগাযোগের মাধ্যামে সমাধান করে নিতে হবে। দিরায়াতু শানিন নুযুল সম্পর্কেও মুতালাআ করা উচিত। শানে নুযূল শিরোনামের কিতাবগুলোতে যদিও বিষয়টি নেই এবং এই বিষয়ে আলাদা কোনো কিতাব আমার জানা নেই, তবে উলূমুল কুরআন-এর প্রায় সব কিতাবেই এই আলোচনা রয়েছে। আপাতত উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম-এর কিতাব উলূমুল কুরআন কিংবা ড. আবু শাহবার ‘আলমাদখাল লিদিরাসাতিল কুরআনিল কারীম’ থেকে প্রসঙ্গটি অধ্যয়ন করুন। পরবর্তীতে সুযোগ হলে উলূমুল কুরআনের অন্যান্য কিতাব এবং ইবনে তাইমিয়ার মাজমুউল ফাতাওয়া ও আল্লামা শাতেবীর ‘আলমুওয়াফাকাত’ কিতাবের সহায়তা নিলে এই বিষয়ে ভালো মা’লূমাত হাসিল হবে ইনশাআল্লাহ।