মুহাম্মাদ সাঈদ - ঢাকা
৬১৫৩. Question
সম্মানিত মুফতী সাহেবের নিকট আমার জানার বিষয় হল, উলামায়ে কেরাম বলেন, ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিতে চাকরি করা হারাম। সাধারণ মুসলিম হিসেবে আমরা আলেমগণের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখি এবং তাঁদের কথা ও ফতোয়া এবং দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে থাকি। কিন্তু হারাম হওয়ার কারণগুলো স্পষ্টভাবে জানা না থাকার কারণে বাস্তব জীবনে ফাতাওয়ার উপর আমল করতে গিয়ে পরিবার ও সমাজের কিছু লোকের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে পরিবারের লোকেরা বিষয়টির প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করে। এমতাবস্থায় মুফতী সাহেবের নিকট আকুল আবেদন এই যে, ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিতে চাকরি করা কেন হারাম— তা বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।
বি. দ্র. আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্র। পিতার অর্থের উপর নির্ভর করে আমার চলতে হয়। যেহেতু আমার বাবা ব্যাংকে চাকরি করেন এবং সেই উপার্জন থেকেই আমার প্রয়োজনীয় খরচ দেয়া হয়, তাই এখন আমি এই টাকা গ্রহণ করতে পারব কি না— এব্যাপারে মুহতারাম মুফতী সাহেবের মূল্যবান দিকনির্দেশনা কামনা করছি। জাযাকুমুল্লাহ।
Answer
ক) প্রচলিত ধারার ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো সুদী অর্থব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। আর প্রচলিত বীমাব্যবস্থায় ‘কিমার’ তথা জুয়াও বিদ্যমান। এসব ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা হারাম হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যার কয়েকটি নিম্নরূপ :
১. কুরআন ও হাদীসে সুদের ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে; যা কারো অজানা নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَ ذَرُوْا مَا بَقِیَ مِنَ الرِّبٰۤوا اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ. فَاِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا فَاْذَنُوْا بِحَرْبٍ مِّنَ اللهِ وَ رَسُوْلِهٖ.
অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং যা কিছু সুদ কারো কাছে বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও— যদি তোমরা মুমিন হও। যদি তা না কর তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা জেনে নাও। —সূরা বাকারা (২) : ২৭৮-২৭৯
হাদীস শরীফে সুদগ্রহীতা ও সুদদাতার পাশাপাশি সুদী চুক্তির লেখক ও সাক্ষীকেও অভিস¤পাত করা হয়েছে এবং এদের সবাইকে সমান অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছে। জাবের রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—
أنَّ النبيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لعَنَ آكِلَ الرِّبَا، وَمُؤْكِلَهُ، وَكَاتِبَهُ، وَشَاهِدَيْهِ، وَقَالَ: هُمْ سَوَاءٌ.
অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদগ্রহীতা, সুদদাতা, সুদী চুক্তির লেখক এবং সুদী লেনদেনের সাক্ষী— সবাইকে অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, তারা সকলেই সমান। —সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৮
বলা বাহুল্য, যারা প্রচলিত ধারার ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তারা সকলেই কোনো না কোনোভাবে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুদী চুক্তিগুলো সম্পাদনে ভূমিকা রাখেন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীগণের কাজটাই নাজায়েয।
২. প্রচলিত বীমাব্যবস্থায় সুদ ছাড়া ‘কিমার’ তথা জুয়াও বিদ্যমান। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা জুয়াকে হারাম সাব্যস্ত করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন—
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِنَّمَا الْخَمْرُ وَ الْمَیْسِرُ وَ الْاَنْصَابُ وَ الْاَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّیْطٰنِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ.
অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, পূজার বস্তু এবং জুয়ার তীর— এসবই অপবিত্র, শয়তানের কাজ। অতএব এসব থেকে দূরে থাক, যাতে তোমরা সফলকাম হও। —সূরা মায়েদা (৫) : ৯০
৩. গুনাহের কাজে সহায়তা করা স্বতন্ত্র গুনাহ। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা গুনাহের কাজে সহায়তা করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন—
وَ لَا تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَانِ.
অর্থাৎ তোমরা গুনাহের কাজে ও জুলুমে একে-অপরের সাহায্য করো না। —সূরা মায়েদা (৫) : ২
৪. শরীয়তের দৃষ্টিতে যে কোনো শ্রমের পারিশ্রমিকই জায়েয হয় না; বরং পারিশ্রমিক জায়েয হওয়ার জন্য শ্রম ও পারিশ্রমিক দুটিই হালাল হতে হয়। নাজায়েয শ্রম বাবদ পারিশ্রমিকের অর্থ ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম বলে গণ্য। আবু মাসঊদ আনসারী রা. থেকে বর্ণিত—
أنَّ رسولَ الله صلى الله عليه وسلم نَهَى عن ثَمَنِ الكَلْب، ومَهْر البغيِّ، وحُلْوانِ الكاهِنِ.
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন— কুকুরের মূল্য থেকে, পতিতার উপার্জন থেকে এবং জ্যোতিষীর পারিশ্রমিক থেকে। —সহীহ বুখারী, হাদীস ২২৩৭
যেহেতু প্রচলিত ধারার ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলোতে শ্রম দেওয়া নাজায়েয, তাই এর পারিশ্রমিকের অর্থও হারাম।
৫. প্রচলিত ধারার ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির কর্মচারীদের যে বেতন দেওয়া হয় তা স্বাভাবিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের আয় বা মুনাফা থেকেই দেওয়া হয়। আর জানা কথা যে, যাদের কারবার হারাম তাদের আয়ের মুখ্যঅংশই হারাম। হারাম অর্থ থেকে কোনো জায়েয শ্রমেরও পারিশ্রমিক নেওয়া বৈধ নয়। সুতরাং প্রচলিত ধারার ব্যাংক ও বীমার কাজে শ্রম দেওয়াই প্রথমত নাজায়েয, উপরন্তু এর পারিশ্রমিকও দেওয়া হয়ে থাকে প্রধানত হারাম অর্থ থেকে, তাই এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এবং এর আয় ভোগ করা সবই নাজায়েয।
হাদীস শরীফে হারাম অর্থ ভোগ করার ব্যাপারে কঠোর সতর্কবাণী এসেছে। আবু বকর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
لَا يَدْخُلُ الجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بِحَرَامٍ.
অর্থাৎ যে শরীরকে হারাম খাওয়ানো হয়েছে তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। —মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৭৮
কা‘ব ইবনে উজরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ لَحْمٌ وَدَمٌ نَبَتَا عَلَى سُحْتٍ، النَّارُ أَوْلَى بِهِ.
অর্থাৎ হারাম অর্থ থেকে উৎপন্ন রক্ত-মাংস জান্নাতে প্রবেশ করবে না। জাহান্নামই তার জন্য উপযুক্ত। —সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৫৭৬
খ) যদি আপনার উপার্জনের সুযোগ না থাকে এবং আপনি আপনার পিতার উপর নির্ভরশীল হন তাহলে উপার্জনে সক্ষম হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রয়োজন পরিমাণ খরচ আপনার পিতা থেকে নিতে পারবেন। —ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৪০২; রদ্দুল মুহতার ৬/১৯১