আবু আব্দুল্লাহ - আমীন বাজার, ঢাকা
৫৬৭৯. Question
গত বছর ২০২১ ঈ.-এ ঈদুল ফিতর শুক্রবারে হয়েছে। আমাদের মসজিদের খতীব সাহেব ঈদের নামাযের আলোচনার সময় বলেন, জুমার দিন ঈদ হলে ঈদের নামায পড়লে জুমার নামায না পড়লে কোনো অসুবিধা নেই। সঠিক মাসআলা দলীলসহ জানতে চাই।
Answer
জুমার দিনে ঈদ হলে ঈদ ও জুমা উভয়টিই পড়তে হবে। ঈদের নামায পড়লে জুমা পড়া লাগবে না- এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কেননা, ঈদের নামায ও জুমার নামায দুটি পৃথক পৃথক আমল। অন্যদিকে ঈদের নামায ওয়াজিব আর জুমার নামায ফরয। সুতরাং একটি আদায় করে আরেকটি বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর সপক্ষে হাদীসের অনেক সুস্পষ্ট প্রমাণও রয়েছে। জুমার দিন ঈদ হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয় নামাযই পড়তেন। সহীহ হাদীস দ্বারা এটিই প্রমাণিত। এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে জুমার নামায না পড়ার কোনো প্রমাণ নেই।
হযরত নুমান ইবনে বাশীর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَقْرَأُ فِي الْعِيدَيْنِ، وَفِي الْجُمُعَةِ بِسَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى، وَهَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ الْغَاشِيَةِ، قَالَ: وَإِذَا اجْتَمَعَ الْعِيدُ وَالْجُمُعَةُ، فِي يَوْمٍ وَاحِدٍ، يَقْرَأُ بِهِمَا أَيْضًا فِي الصّلَاتَيْنِ.
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই ঈদের নামাযে এবং জুমার নামাযে সূরা আ‘লা ও সূরা গাশিয়া পড়তেন। যখন একই দিনে জুমা ও ঈদ হত, তিনি উভয় নামাযেই এই সূরাদ্বয় পড়তেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৭৮)
সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, তাবেয়ী আবু উবাইদ রাহ. বলেন-
ثُمّ شَهِدْتُ العِيدَ مَعَ عُثْمَانَ بْنِ عَفّانَ، فَكَانَ ذَلِكَ يَوْمَ الجُمُعَةِ، فَصَلّى قَبْلَ الخُطْبَةِ، ثُمّ خَطَبَ فَقَالَ: يَا أَيّهَا النّاسُ، إِنّ هَذَا يَوْمٌ قَدِ اجْتَمَعَ لَكُمْ فِيهِ عِيدَانِ، فَمَنْ أَحَبّ أَنْ يَنْتَظِرَ الجُمُعَةَ مِنْ أَهْلِ العَوَالِي فَلْيَنْتَظِرْ، وَمَنْ أَحَبّ أَنْ يَرْجِعَ فَقَدْ أَذِنْتُ لَهُ.
অর্থাৎ হযরত উসমান রা.-এর খেলাফতকালে একবার জুমার দিনে ঈদ হল। তিনি ঈদের নামায পড়ালেন। তারপর খুতবায় বললেন, হে লোকসকল, এটি এমন একটি দিন, যেই দিনে দুই ঈদ একত্রিত হয়েছে। তাই মদীনার বাইরের এমন প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে জুমার বিধান নেই, সেখান থেকে আগত লোকদের কেউ চাইলে জুমার জন্য অপেক্ষা করতে পারে। আর কেউ (নিজ এলাকায়) ফিরে যেতে চাইলে আমি তাকে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলাম। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৭২)
উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন-
اجْتَمَعَ عِيدَانِ عَلَى عَهْدِ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فَقَالَ: مَنْ أَحَبّ أَنْ يَجْلِسَ مِنْ أَهْلِ الْعَالِيَةِ فَلْيَجْلِسْ فِي غَيْرِ حَرَجٍ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় একবার একই দিনে জুমা ও ঈদ হয়। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মদীনার বাইরের এমন প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে জুমার বিধান নেই, সেখান থেকে আগত লোকদের কেউ চাইলে জুমার জন্য অপেক্ষা করতে পারে। যদি তার কোনো কষ্ট না হয়। (মুসনাদুশ শাফিয়ী, হাদীস ৫০০)
এই বর্ণনাগুলোতে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ হয়েছে, জুমার নামাযে হাজির না হওয়ার সুযোগ কেবলই মদীনার বাহির থেকে আগত লোকদের জন্য। যাদের উপর জুমা ফরযই নয়।
লক্ষণীয় যে, যারা বলেন, ‘জুমার দিন ঈদ হলে ঈদের নামায পড়লে জুমার নামায না পড়লে কোনো অসুবিধা নাই’ তারা কিছু হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করে থাকেন, কিন্তু সেগুলোর সনদ যয়ীফ। এ ধরনের যয়ীফ হাদীস দ্বারা কোনো ফরয বিধান (যেমন জুমার নামায) বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, জুমার নামায ফরয হওয়ার বিষয়টি কুরআন মাজীদের আয়াতসহ শরীয়তের অনেক অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। আর কোনো দুর্বল হাদীস দ্বারা তা বাদ দেওয়া যায় না।
যেমন তারা তাদের দাবির পক্ষে হযরত যায়েদ ইবন আরকাম রা.-এর সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীস পেশ করেন। হাদীসটি নিম্নরূপ-
عَنْ إِيَاسِ بْنِ أَبِي رَمْلَةَ الشّامِيِّ، قَالَ: شَهِدْتُ مُعَاوِيَةَ بْنَ أَبِي سُفْيَانَ، وَهُوَ يَسْأَلُ زَيْدَ بْنَ أَرْقَمَ، قَالَ: أَشَهِدْتَ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ عِيدَيْنِ اجْتَمَعَا فِي يَوْمٍ؟ قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: فَكَيْفَ صَنَعَ؟ قَالَ: صَلّى الْعِيدَ، ثُمّ رَخّصَ فِي الْجُمُعَةِ، فَقَالَ: مَنْ شَاءَ أَنْ يُصَلِّيَ، فَلْيُصَلِّ.
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে একবার জুমার দিন ঈদ হয়। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের নামায পড়েন এবং জুমার নামায পড়ার ব্যাপারে ছাড় দেন। তিনি বলেন, যে জুমার নামায পড়তে চায় সে পড়তে পারে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৭০)
কিন্তু এ সম্পর্কে প্রথম কথা হল, এই হাদীসের সনদে ইয়াস ইবনে আবী রামলা নামে একজন রাবী আছেন। তাকে ইবনুল মুনযির (৩১৮ হি.) রাহ. এবং হাফেয ইবনে হাজার (৮৫২ হি.) রাহ. ‘মাজহূল’ (অর্থাৎ যার পরিচয় অজানা। তাই তার বিশ^স্ততাও প্রমাণিত নয়) বলেছেন। [বায়ানুল ওয়াহমি ওয়াল ঈহাম ৪/২০৩ (১৬৯৭), মীযানুল ইতিদাল ১/২৬৮ (৯৯৬), তাকরীবুত তাহযীব (৫৮৭) পৃ. ১৫৫]
তার সম্পর্কে ইমাম ইবনে খুযাইমা রাহ. বলেন-
إني لا أعرف إياس بن أبي رملة بعدالة ولا جرح.
অর্থাৎ আমি ইয়াস ইবনে আবী রামলার ব্যাপারে ভালো-মন্দ কিছুই জানি না। (সহীহ ইবনে খুযাইমা ১/৭০৯)
যাইহোক, সনদে মাজহূল রাবী থাকায় একে সহীহ বলার সুযোগ নেই। ইমাম ইবনুল মুনযির (৩১৮ হি.) রাহ. বলেন-
هذا الحديث لا يثبت، وإياس بن أبي رملة راويه عن زيد مجهول.
অর্থাৎ হাদীসটি প্রমাণিত নয়। এর বর্ণনাকারী ইয়াস ইবনে আবী রামলা মাজহূল। (আততালখীসুল হাবীর ২/২১০)
ইমাম ইবনুল কাত্তান (৬১৮ হি.) রাহ. ইবনুল মুনযিরের বক্তব্য সমর্থন করেছেন। এছাড়াও ইমাম ইবনে খুযাইমা (৩১১ হি.) রাহ. إن صح الخبر বলে হাদীসটি সহীহ হওয়ার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
এ বিষয়ে দুর্বল সনদে আরো দুটি বর্ণনা থাকায় কেউ কেউ হাদীসটিকে সামষ্টিক বিচারে গ্রহণযোগ্য বলতে চেয়েছেন। কিন্তু হাদীসটি গ্রহণযোগ্য ধরে নেওয়া হলেও তা দ্বারা সাধারণভাবে সকল মানুষের জন্য জুমা না পড়ার এখতিয়ার প্রমাণিত হয় না; বরং এ ধরনের হাদীস ও আসারের আলোকে ঐসব মানুষের জন্য জুমার ছাড় দেওয়া হয়েছে, যারা ঈদের নামায পড়ার জন্য এমন এলাকা থেকে এসেছে যেখানের লোকদের উপর জুমা পূর্ব থেকেই ফরয নয়। সহীহ বুখারীর পূর্বোক্ত বর্ণনাটিসহ বিভিন্ন হাদীসই যার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
ইমাম তাহাবী (৩২১) রাহ. বলেন-
إن المرادين بالرخصة في ترك الجمعة في هذين الحديثين هم أهل العوالي الذين منازلهم خارجة عن المدينة ممن ليست الجمعة عليهم واجبة؛ لأنهم في غير مصر من الأمصار، والجمعة فإنما تجب على أهل الأمصار، وفي الأمصار دون ما سوى ذلك.
অর্থাৎ হাদীসে যাদেরকে জুমার নামায না পড়ার ব্যাপারে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তারা হল মদীনার বাহির থেকে আগত লোকেরা। তাদের উপর জুমা ফরয ছিল না। কেননা জুমার নামায ফরয হয় শহরবাসীদের উপর। (শরহু মুশকিলিল আছার ৩/১৮৭)
ইমাম ইবনে আবদুল বার (৪৬৩ হি.) রাহ. একই ব্যাখ্যা করেছেন এবং বলেছেন-
وهذا تأويل تعضده الأصول وتقوم عليه الدلائل ومن خالفه فلا دليل معه.
অর্থাৎ শরীয়তের উসূল ও মূলনীতি এই ব্যাখ্যার সমর্থন করে এবং এর সপক্ষে অনেক দলীল রয়েছে। এর বিপরীত ব্যাখ্যার সমর্থনে কোনো দলীল নেই। (আততামহীদ ১০/২৭৪)
তিনি আরো বলেন-
وأحسن ما يتأول في ذلك أن الأذان رخص به من لم تجب الجمعة عليه ممن شهد ذلك العيد، والله أعلم، وإذا احتملت هذه الآثار من التأويل ما ذكرنا لم يجز لمسلم أن يذهب إلى سقوط فرض الجمعة عمن وجبت عليه؛ لأن الله عز وجل يقول :>یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِذَا نُوْدِیَ لِلصَّلٰوةِ مِنْ یَّوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا اِلٰی ذِكْرِ اللّٰهِ<، ولم يخص الله ورسوله يوم عيد من غيره من وجه تجب حجته، فكيف بمن ذهب إلى سقوط الجمعة والظهر المجتمع عليهما في الكتاب والسنة والإجماع بأحاديث ليس منها حديث إلا وفيه مطعن لأهل العلم بالحديث.
অর্থাৎ এ বিষয়ক হাদীসসমূহের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা হল, জুমার নামায পড়ার ব্যাপারে ঐ লোকদের ছাড় দেওয়া হয়েছে, যাদের উপর জুমার নামায ফরয ছিল না। তবে তারা সেসময় ঈদের নামাযে হাজির হয়েছিল। উক্ত হাদীসসমূহের এই ব্যাখ্যা পাওয়ার পর কোনো মুসলিমের জন্য একথা বলা জায়েয হবে না যে, ঈদের দিন জুমার ফরয রহিত হয়ে যায়। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِذَا نُوْدِیَ لِلصَّلٰوةِ مِنْ یَّوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا اِلٰی ذِكْرِ اللّٰهِ.
(হে ঈমানদারগণ! জুমার দিন যখন নামাযের জন্য ডাকা হয় তখন আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হও) আর আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল ঈদের দিনের ব্যাপারে কোনো আলাদা বিধান দেননি (তাই এই বিধান সারা বছরের সকল জুমাবারের জন্য প্রযোজ্য)। জুমা ও যোহরের নামাযের বিধান কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং ঐ ব্যক্তির কাজ কীভাবে সঠিক হতে পারে, যে এমন অকাট্য বিধান রহিত করতে চায় এমন সব হাদীস দ্বারা, যার প্রতিটিতেই শাস্ত্রজ্ঞদের মতে কোনো না কোনো দুর্বলতা আছে। (আততামহীদ ১০/২৭৭)
সুতরাং জুমার দিনে ঈদ হলেও জুমার নামায বাদ দেওয়া জায়েয হবে না; বরং ঈদ ও জুমার নামায উভয়টিই আদায় করবে।
উল্লেখ্য যে, যাদের উপর জুমা ফরয না থাকায় ঈদের নামাযের পর নিজ অঞ্চলে চলে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল তাদের থেকে ওই দিনের যোহরের নামায যে মাফ হয়ে যায়নি তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, যাদের উপর জুমা ফরয নয় তাদের যোহরের নামায আদায় করা ফরয।