নিম্নের কয়েকটি পদ্ধতির ব্যবসা সম্পর্কে শরীয়তের ফয়সালা জানিয়ে বাধিত করবেন।
১ম প্রদ্ধতি : কোনো ব্যক্তি কারো থেকে ঋণ চাইলে তাকে নগদ অর্থ না দিয়ে ঋণ গ্রহীতার প্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয় করে তা ঋণদাতার জিম্মায় আনা হয়। যেমন- ধান, চাল, সেলাই মেশিন ইত্যাদি। তারপর ঋণ গ্রহীতার কাছে এক বছর অথবা দুই বছর মেয়াদী মাসিক কিস্তির মাধ্যমে বাকিতে কিছু বেশি মূল্যে বিক্রি করা হয়। যেমন- শফিক সাহেব করীম সাহেবের কাছে পাঁচ হাজার টাকা ঋণের আবেদন করায় তাকে নগদ অর্থ না দিয়ে তার ইচ্ছানুযায়ী ৫০০০/- টাকার চাল ক্রয় করে করীমের জিম্মায় এনে শফিক সাহেবের কাছে উক্ত পাঁচ হাজার টাকার চাল এক বছর মেয়াদী ১২ কিস্তিতে আদায়ের শর্তে ছয় হাজার টাকায় বিক্রি করা হল।
২য় পদ্ধতি : কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে জমি ক্রয় করে উক্ত জমি মাটি ভরাট করে অধিক মূল্যে বিক্রি করা অথবা মার্কেট নির্মাণ করে দোকান ভাড়া দেওয়া।
৩য় পদ্ধতি : একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জমি ক্রয় করে উক্ত জমি মাটি ভরাট করে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে এক বছর বা দুই বছর মেয়াদে মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করার শর্তে বাকি টাকায় বিক্রি করা। যেমন- আব্দুর রহিম সাহেবের কাছ থেকে ২০ শতাংশ জমি ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ১০হাজার টাকা শতাংশ হিসাবে দুই লক্ষ টাকায় ক্রয় করে মাটি ভরাট করে এক বছর মেয়াদী ১২ কিস্তিতে আদায়ের শর্তে প্রতি শতাংশ ২০ হাজার টাকা দরে গ্রাহকদের কাছে বাকি তো বিক্রি করল।
৪র্থ পদ্ধতি : একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কৃষিপণ্য বা শিল্পজাত দ্রব্য অগ্রিম মূল্য পরিশোধে ক্রয় করা হয়। চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠান কতৃর্পক্ষ দাম পরিশোধ করে, কিন্তু পণ্য গ্রহণ করে নির্ধারিত মেয়াদের পর। যেমন- আব্দুল মালেকের কাছ থেকে কোনো প্রতিষ্ঠান ২০০/- টাকা মণ দরে ২০ মণ ধান নগদ ৪০০০/- টাকায় ক্রয় করে এই শর্তে যে, আব্দুল মালেক সাহেব তিন মাস পর ১৫ তারিখে ভালো মানের ২০ মণ বোরো ধান ওই প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করবে।
৫ম পদ্ধতি : একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন শিল্প ও বানিজ্য অংশীদারির ভিত্তিতে মূলধন যোগায়। চুক্তিতে লিখিত হার অনুযায়ী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান লাভ পায়। যেমন- কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আব্দুল করীমের শিল্প প্রতিষ্ঠানে দুই লক্ষ টাকা মূলধন বিনিয়োগ করল। এই শর্তে যে, লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে লভ্যাংশ থেকে শতকরা ২৫% বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান পাবে কিন্তু বর্তমানে আব্দুল করীম সাহেব প্রতি মাসে ৩০০০/- টাকা প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করবে। বছর শেষে লাভ-ক্ষতি হিসাব করে বাকী টাকা প্রদান করবেন।
১ম পদ্ধতি, হিসাব করে বাকী প্রদান করবেন। প্রশ্নপত্রে প্রথম পদ্ধতিতে যে কারবারের কথা বলা হয়েছে তা ফিকহের পরিভাষায় “বাইয়ে মুআজ্জাল” কিংবা “বাইয়ে মুরাবাহা মুআজ্জাল” হিসাবে পরিচিত। এ দু’টি কারবারে সামান্য কিছু পার্থক্য থাকলেও মূল শর্ত ও উদ্দেশ্যের বিবেচনায় দু’টিতে তেমন ফারাক নেই। জানা প্রয়োজন যে, এ চুক্তিটি সুদমুক্ত শরীয়তসম্মত হওয়ার জন্য বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। প্রশ্নপত্রে মাত্র দু’একটি শর্তের প্রতি ইঙ্গিত করা রয়েছে। বাকী শর্তের উল্লেখ নেই। যেগুলোর কোনো একটি ব্যতিক্রম ঘটলেই কারবারটি নাজায়েয হয়ে যাবে। নিম্নে এই কারবার বৈধ হওয়ার জন্য উল্লেখযোগ্য শর্তসমূহ পেশ করা হল :
১) বিনিয়োগকারী বা বিক্রেতা যে মাল বিক্রি করতে চাচ্ছে, বিক্রির সময় সেটি তার মালিকানাধীন ও হস্তগত হতে হবে। সুতরাং গ্রাহক যে মাল খরিদ করতে আগ্রহী তা বিক্রেতার মালিকানায় না থাকলে মালটি আগে খরিদ করে নিজের হস্তগত করতে হবে।
২) মাল ক্রয় ও হস্তগত হওয়ার পর পূর্বের অঙ্গীকার অনুযায়ী গ্রাহকের নিকট ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে। অর্থাৎ বিক্রেতা বা তার প্রতিনিধি বলবে যে, এই মাল এত মূল্যে এই মেয়াদের জন্য আপনার নিট বিক্রি করলাম। তখন গ্রাহক খরিদ করলাম বলে তা গ্রহণ করবে।
৩) বিক্রেতা মাল ক্রয় ও হস্তগত হওয়ার আগে কোনো চুক্তি সম্পাদন করতে চাইলে সেখানে বিক্রির “অঙ্গীকার” হিসাবে তা সম্পাদিত হবে। এ ক্ষেত্রে কোনোক্রমেই ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি চুড়ান্ত ও সম্পাদন করা যাবে না।
৪) ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে যে পণ্য আদান-প্রদান হবে কারবার শেষে পণ্যটি যার কাছে ছিল তার নিকটেই ফিরে না আসতে হবে। যেমন, কোনো কারবার এভাবে ঘটে যে, এক ব্যক্তির নিকট পণ্য রয়েছে। সে পণ্যটি গ্রাহকের নিকট বেশি মূল্যে বাকিতে বিক্রি করল। অতঃপর গ্রাহক আবার তা প্রথম ব্যক্তির নিকট কম মূল্যে নগদে বিক্রি করেদিল। অথবা প্রথম ব্যক্তি একজন থেকে পণ্য ক্রয় করল এ বলে যে, এ পণ্য আপনার নিকট আবার বিক্রি করে দেওয়া হবে। এভাবে ক্রয় করে তা গ্রাহকের নিকট বিক্রি করে দিল। অতপর গ্রাহক ওই পণ্য যার কাছ থেকে প্রথম ব্যক্তি নিয়েছিল তার কাছেই পুনরায় বিক্রি করে দিল, যেহেতু আগের থেকেই কথা রয়েছে এ মাল তার নিকট ফিরে আসবে।
এধরনের কারবার জায়েয নয়। কারণ এতে কোনো পক্ষেরই ক্রয়-বিক্রয় উদ্দেশ্য থাকে না; বরং ক্রয়-বিক্রয়কে সুদ গ্রহণের ছুতা হিসাবে অবলম্বন করা হয়ে থাকে মাত্র।
৫) পণ্যের মূল্য, মূল্য আদায়ের দিন তারিখ এবং ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সুনির্ধারিত হতে হবে। মূল্য কিস্তিতে আদায়যোগ্য হলে প্রতিটি কিস্তি আদায়ের তারিখও তখনই চুড়ান্ত হতে হবে।
৬) নির্ধারিত মেয়াদে কিংবা কিস্তি আদায়ে বিলম্ব হলে পূর্ব নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত নেওয়া যাবে না। তদ্রূপ চুক্তিকালীন এ শর্তও করা যাবে না যে, নির্ধারিত মেয়াদের আগেই কিস্তি পরিশোধ করে দিলে মূল্য কম নেওয়া হবে। যেমন, পণ্যের নগদ মূল্য বিশ হাজার টাকা। এক বছর মেয়াদে বিক্রির জন্য এমূল্য ধরা হয়েছে একুশ হাজার টাকা। এখন এ শর্ত করা বৈধ হবে না যে, ছয় মাসের মধ্যে মূল্য পরিশোধ করে দিলে বিশ হাজার পাঁচশত টাকা নেওয়া হবে। অবশ্য চুক্তিকালীন কোনো প্রকার শর্ত ও পূর্বনির্ধারিত কোনো নিয়ম না থাকলে এ ক্ষেত্রে বিক্রেতার নৈতিক দায়িত্ব হল মেয়াদের কারণে বর্ধিত মূল্যের অর্ধেক ফেরত দেওয়া। তবে এটি কোনোভাবেই পূর্ব শর্তকৃত না হতে হবে।
৭) এই কারবারের সাথে শরীয়ত বিরোধী অন্য কোনো শর্ত জড়িত না হতে হবে।
উল্লেখ্য শরীয়ত কতৃর্ক নির্দেশিত এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় লেনদেন ওই গ্রাহকের জন্যই প্রযোজ্য, যে গ্রহাক মূলত পণ্যই গ্রহণ করতে চায়;নগদ অর্থ নেওয়া যার উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি আসলে পণ্য গ্রহণ করতে চায় না; বরং নগদ অর্থ নিতে চায় তার নিকট কোনো পণ্য এ জন্য বিক্রি করা যে, সে তা বাজারে বিক্রি করে হলেও নগদ অর্থ হাসিল করবে -এটি শরীয়তের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয় কাজ। এতে প্রকারান্তরে ইসলামী বিনিয়োগের নামে পূঁজিবাদী পদ্ধতিকেই জিইয়ে রাখা হয়। শরীয়ত এ ধরনের কারবারকে নিরুৎসাহিত করে। যে সকল লোক মাল না নিয়ে নগদ অর্থই নিতে চায় উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে তারা দুই প্রকার।
(ক) নগদ টাকা নিয়ে মিল ফ্যাক্টরি বা নিজের কোনো ব্যবসায় লাগাবে।
(খ) নগদ টাকা নিয়ে কোনো প্রয়োজন যেমন, চিকিৎসা, খানাপিনা ইত্যাদি কাজে খরচ করবে।
প্রথম প্রকার লোকের নিকট শরীয়তস্বীকৃত ব্যবসায়ি পন্থাসমূহ যথা মুদারাবা, মুসারাকা, ইসতিসনা এবং ইজারা ইত্যাদি পন্থায় কোনো প্রতিষ্ঠান অর্থলগ্নি করতে পারে। এধরনের লোকের কাছেও ওই সকল পন্থা অবলম্বন না করে তার চাহিদা বহির্ভূত কোনো পণ্য এ নিয়তে ক্রয়-বিক্রয় করা অনুত্তম যে, সে তা নিয়ে অন্যত্র বিক্রি করে টাকা ক্যাশ করবে, অতঃপর নিজে ব্যবসায় লাগাবে।
আর দ্বিতীয় প্রকারের লোকদের নিকট কোনো পণ্য উক্ত নিয়তে বিক্রি করা আরো খারাপ। এধরনের লোকের নিকট ব্যবসার নিয়তে টাকা লগ্নি করা শরয়ী মাসআলার খেলাপ। শরীয়ত বলে, এ লোক যদি যাকাত গ্রহণের যোগ্য হয় তাহলে সম্ভব অনুযায়ী যাকাত-ফিতরা, দান ও সদকা দিয়ে সহয়তা কর। আর যদি যাকাত গ্রহণের যোগ্য না হয় তাহলে সাধ্যানুযায়ী নফল সদকা দেওয়া কিংবা সম্ভব হলে কর্জে হাসানার ব্যবস্থা করা। কিন্তু আজকাল এধরনের লোকের নিকটও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অর্থলগ্নি করতে দেখা যায়।
২য় ও ৩য় পদ্ধতি
এ দু‘টি পদ্ধতিতে জমি বিক্রি যে জায়েয তা কারো অজানা নয়, কিন্তু এ জানা কারবারেও শরয়ী নীতিমালা পালন না করলে কিংবা শরীয়ত পরিপন্থী কোনো শর্ত জুড়ে দিলে এ কারবারও অবৈধ হয়ে যাবে। তাই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত এ বর্ণনা কারবারটি বৈধ উপায়ে হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং কী কী প্রক্রিয়া এ কারবার সংঘটিত হয়েছে তা বিস্তারিত জানালেই উক্ত কারবারের হুকুম বলা যাবে।
৪র্থ ও ৫ম পদ্ধতি
৪নং কারবারটি হল “বাইয়ে সালাম” (আগাম খরিদ) আর ৫নং কারবারটি “শিরকত” (যৌথমূলধনী কারবার)। এ দু‘টি কারবারের বৈধতার জন্য রয়েছে অনেকগুলো শর্ত। শর্তগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও বিস্তর, যার কিছুই প্রশ্নে উল্লেখ নেই। আর এভাবে পত্রিকার বিভাগের স্বল্প পরিসরে এত লম্বা আলোচনাও অনেকটা দুষ্কর। তাই এ সকল কারবার বৈধ উপায়ে করতে চাইলে কোনো বিজ্ঞ আলেম কিংবা মুফতীর নিকট গিয়ে তার নিয়মাবলি জেনে নিয়ে সে অনুযায়ী করতে হবে।