Muharram 1431   ||   January 2010

তালিবে ইলমের আত্মমর্যাদা

Mawlana Abu Taher Mesbah

অনেক দূরের কথা চিন্তা করে আমি এ কথাগুলো বলছি যে, আমাদের সমাজে ইলমের, তালিবে ইলমের এবং মাদরাসার কোনো মর্যাদা নেই। এটা আমাদেরকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। আর তা শুধু মুখের কথায় হয়ে যাবে না। নিজের যোগ্যতা দ্বারা, ব্যক্তিত্ব ও আচার আচরণ দ্বারা তা উদ্ধার করতে হবে। তোমাকে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। তোমার এই যোগ্যতা থাকতে হবে যে, তোমার পরিবারের যারা স্কুল-কলেজে পড়ে তাদের বলতে পার, তুমি কী বাংলা পড়! তোমার স্কুলে কী বাংলা পড়ায় আসো দেখি তোমার সাথে বাংলায় কথা বলি, তুমি বাংলা কতটুকু জান, আমি কতটুকু জানি দেখি।

আল্লাহ যদি তাওফীক দেন আমাদের তো যথেষ্ট সুযোগ আছে, যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, আমরা ওদের প্রতিটা পড়ার বিষয়কে নিজেদের বিষয় বানিয়ে নিতে পারি। কিন্তু আগে তো গোড়া মজবুত করতে হবে। গোড়াই তো মযুবত হচ্ছে না। এখনো তো আমরা নিজেদেরকে চিনতেই শিখিনি। তাই ওঝা না হয়েই যদি সাপ ধরতে যাও তাহলে তো পদে পদে ছোবল খাবে। আমাদের তো ইচ্ছা আছে সব সাপ-অংকের সাপ, বিজ্ঞানের সাপ, ভূগোলের সাপ সব আমাদের ঝাঁপিতে ভরব। ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আগে তো ওঝা হতে হবে। এখনো তো মন্ত্র শিখিনি বাজান! ছোবল খাব কেন? যাই হোক এটা অন্য বিষয়।

তো গত রাতে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের বাবা ফোন করে বলছে যে, আমরা ছেলের বিয়ের তারিখ করে ফেলেছি। এখন ও ছোট ছেলে। ওকে আসতে হবে। আমি বললাম, ভাই! সংক্ষেপ কথা হল, আপনার এ ছেলে যে বর্ষে পড়ে কয়েকদিন আগে সে বর্ষের এক ছেলেকে আমরা এই কারণে বিদায় করে দিয়েছি। এখন তাকে কীভাবে ছুটি দেই? কিন্তু তার এক কথা-ছুটি দিতে হবে। নাহলে বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে। আমি বললাম, বিয়ে ভেঙ্গে যাবে কেন? আপনারা আপনাদের কাজ করে ফেলেন। ছেলে এখানে লেখাপড়া করতে থাকুক। আমরা আপনাদের জন্য দুআ করি। বিয়ে ভাঙ্গবে কেন? আর যদি আপনি মনে করেন যে, আপনার ছেলের অনুপস্থিতিতে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে এত গুরুত্বপূর্ণ আপনার ছেলে তাহলে তার সুবিধামতো তারিখ করেননি কেন? কোনো জওয়াব নেই। না হুযুর! একটু ছুটি দেন। আরে ছুটি দিলে তো আপনার ছেলের ক্ষতি হবে। না হুযুর, দয়া করে একটু ছুটি দেন। আরে দয়া করেই তো ছুটি দিচ্ছি না। নির্দয় হলে তো ছুটি দিয়ে দিতাম। যে ছাত্রের বিষয়ে আমি নির্দয় হয়েছিলাম তার ফলাফল আমার সামনে আছে। ওরা বলেছিল দয়া করেন আমি নির্দয় হয়ে ছুটি দিয়ে দিয়েছিলাম। ঐ ছেলে এখনো জীবিত আছে। এখন আমি যদি তোমাকে ছুটি দেই তাহলে তোমার প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা হবে। তোমার পরিবার হয়তো জানে না, না জেনে তো মানুষ কত অন্যায় করে। না জেনে তো মাও ছেলেকে বিষ খাইয়ে দেয়। ওষুধ মনে করে। কিন্তু আমি তো জানি তোমার কত বড় ক্ষতি হবে। এ তো চরম অমর্যাদা তোমার পরিবার তোমাকে করবে, তুমি তোমার মাদরাসাকে করবে, এটার তো ফল আছে। এরপর ঐ ছেলে নিজে এসে চোখের পানি ফেলছে। হুযুর, দয়া করে আমাকে দুই দিনের ছুটি দেন। আমি প্রথমে শান্তভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। আমি সব বোঝাচ্ছি সে আমার পায়ে ধরে বলে হুযুর, দুই দিনের ছূটি দেন। তখন আমার ...। আমি আসলে তার কাছে মাফ চাচ্ছি। আমার আরো সংযম রক্ষা করা দরকার ছিল। আমি তাকে ধমক দিয়েছি-তোমার সাহস হল কীভাবে আমার কাছে তুমি ছুটি চাইতে এসেছ। তুমি না তোমার পরিবারকে বলবে যে, আপনারা বিয়েটা করে ফেলেন। বিয়ে ভেঙ্গে যাবে এটা খামাখা কথা। এটা কেমন কথা যে, ঐ ছেলে না থাকলে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে? এটা হল অপ্রয়োজনীয় ...।

যাই হোক, বাবা, নিজের মর্যাদা নিজে বুঝতে চেষ্টা কর এবং নিজের মর্যাদা নিজে রক্ষা করতে চেষ্টা কর। অন্যকে বোঝাও আমাকে যদি কোনো অনুষ্ঠানে সঙ্গে রাখতে হয় তাহলে আমার ক্যালেন্ডার আছে। আমি কোনো ফালতু মানুষ নই। শুধু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই এ কথাটা বলতে পারে যে, আমার আলাদা ক্যালেন্ডার আছে, আলাদা সময়সুচি আছে। তুমি সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তোমার পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বাকি সমাজ যেহেতু তোমাকে মর্যাদা দিচ্ছে না তাই নমনীয়তার সাথে অনমনীয় হও। বিরোধে যেও না। সমাজকে অনুমতি দিয়ে দাও যে, আমার অনুপস্থিতিতে সবকিছু করে ফেলতে পারেন। কিন্তু আমাকে থাকতে হবে-এটা ঠিক না। হ্যাঁ, কখনো কখনো তোমার এতে ক্ষতি হতে পারে। কখনো সুনামের ক্ষতি হতে পারে। ঐ ক্ষতিগুলোকে তুমি তোমার ইলমের যাকাত মনে করে আদায় কর, আর দেখ, আল্লাহ তাআলা কেমন উন্নতি দান করেন। হতে পারে, এই বিয়েতে শরিক না হওয়ার কারণে তোমার ভাই নারায হয়ে গেল। ঐ নারাযিকে তুমি কবুল করে নাও। বাকি ভাইয়ের সাথে ভ্রাতৃত্ব রক্ষা কর। ঐ নারাযি একদিন দূর হয়ে যাবে। আর যদি দূর না হয় তাহলে তুমি তোমার আজর পেয়ে যাবে।

আমাকে একজন বলেছিল যে, আমার ভাই তো আমার খরচ দেয়। আমি না গেলে আমার খরচ বন্ধ করে দিবে। আমি বললাম, ছিঃ। তুমি তালিবে ইলম, তোমার খরচ কে বন্ধ করবে? তোমার খরচ তো আসমান থেকে আল্লাহ তাআলা দেবেন। তুমি করে দেখ। ঠিকই সে বিয়েতে গেল না। কোনো সমস্যা হয়নি। শয়তানের ওয়াসওয়াসা। আর সমস্যা হলে আল্লাহ তাআলা নতুন রাস্তা খুলে দিবেন। আমি বলতে চাই যে, কারোর মৃত্যুতেও আমার ছুটি না নেওয়া উচিত। ছুটি নেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। এটা আমার কথা নয় আমার বড়দের কথা। তোমার দাদার ইন্তেকাল হয়েছে। তুমি এখান থেকে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড় এবং তার জন্য দুআ কর। সবাইকে নিয়ে দুআ কর। আমাদের এখানে এ রকম ঘটনা ঘটেছে। ছেলে যায়নি। আমরা সবাই মিলে তার জন্য দুআ করেছি। ঐ মরহুমের এখনো তো দুআ দরকার। তোমার উপস্থিতি তার দরকার নেই। তোমার উপস্থিতি তার হায়াত ফিরিয়ে আনবে না। কিন্তু তোমার ইলম থেকে মাহরুম হওয়ার কারণ হয়ে যেতে পারে। এগুলো এখন কেউ বোঝে না। আমার কথাগুলি আমার কাছের মানুষও বোঝে না, দূরের মানুষও বোঝে না। আল্লাহর কাছে রাস্তার অভাব? যার জন্য সমুদ্রের তলদেশের মাছ দুআ করে তার রিযিক বন্ধ হবে কীভাবে? আর যদি এ রকমই হয় তাহলে মাদরাসা ছেড়ে দাও। ইলমওয়ালা যার দায়িত্ব নেবে না এমন ইলম পড়বে কেন?

মোটকথা, নিজের মর্যাদাকে কখনো ভূলুণ্ঠিত করবে না। ইলমকে, মাদরাসাকে মর্যাদা দাও। নমনীয়তার সঙ্গে অনমনীয়তা বজায় রাখ। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। এ কথাটা যেন আর বারবার আমাকে না বলতে হয় বাবা! কিন্তু কী করব? কেউ যেন আমার কথা বোঝে না বলে মনে হয়।

 

advertisement