Zilhajj 1434   ||   October 2013

ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব

Mawlana Abul Bashar Md Saiful Islam

 

বিদআতের উৎপত্তি যেভাবে হয় : এই মাত্রাজ্ঞানের অভাব থেকেই উম্মতের মধ্যে নানারকম রসম-রেওয়াজ ও বিদআতের সৃষ্টি হয়েছে। কুফর ও শিরকের পর বিদআতই ইসলামে সর্বাপেক্ষা নিন্দনীয় জিনিস। এর উদ্ভাবক ও অনুসারী নিজের জন্য ছওয়াবের পরিবর্তে লানত ও অভিশাপই কুড়িয়ে থাকে। হাদীস মতে জাহান্নামই বিদআতের শেষ ঠিকানা। সব বিদআত গোমরাহী আর সব গোমরাহীর ঠাঁই জাহান্নামে।

এহেন নিকৃষ্ট জিনিসের জন্ম হয়

বাড়াবাড়ি থেকেই। কেবল মুবাহ ও বৈধ স্তরের জিনিসকে এক শ্রেণীর মানুষ খেয়াল-খুশী ও ভাবাবেগের বশবর্তীতে সুন্নত-ওয়াজিবের মত গুরুত্ব দিয়ে বসে। তারা সেই গুরুত্বের সাথে নিজেরাও তা পালন করে এবং অন্যদেরকেও পালন করতে উৎসাহিত ও ক্ষেত্র-বিশেষে বাধ্য পর্যন্ত করে। ফলে যা মূলত দীনের অংশ নয় তা দীনের একটি অংশরূপে পরিচিতি পায় কিংবা যা দীনের যেই স্তরের নয় সেই স্তরের একটি কাজরূপে ধরে নেওয়া হয়। এভাবে পূর্ণাঙ্গ দীনের ভেতর নবসংযোজনরূপে বিদআতের অনুপ্রবেশ ঘটে। সুতরাং প্রচলিত মীলাদ, ১২ই রবীউল আউওয়ালে ঈদে মীলাদুন নবী উৎযাপন, মৃত ব্যক্তির জন্য চল্লিশা, হযরত আব্দুল কাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মৃত্যু দিবস (ফাতেহায়ে ইয়াযদহম) পালন, বুযুর্গানে দীনের কবরে ওরশ ইত্যাদি মৌলিক বৈধ বিষয়সমূহে এক শ্রেণীর মানুষ মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে এগুলোকে দীনের অংশ বানিয়ে ফেলেছে। তাদের দৃষ্টিতে এসব কাজ ফরয-ওয়াজিব অপেক্ষা কম কিছু নয়। এহেন বাড়াবাড়ির কারণে এসব কাজ তার মূল বৈধতা হারিয়ে বিদআত ও নিষিদ্ধ কাজে পর্যবসিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্পষ্ট ঘোষণা কেউ আমাদের দীনে যদি এমন কোন নতুন বিষয়ের উদ্ভাবন করে, যা এ দীনের অংশ নয়, তবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ২৬৯৭) বলাবাহুল্য এ জাতীয় বাড়াবাড়ি দ্বারা প্রকারান্তরে দীনের ভেতর নতুন উদ্ভাবনই ঘটানো হয়। যা কেবলই বৈধ, তাকে ওয়াজিব ও জরুরি সাব্যস্ত করার দ্বারা দীনে নতুন এক ওয়াজিবেরই কি জন্মদান করা হয় না?

প্রচলিত মীলাদের প্রতি লক্ষ করুন না, এতে যে দরূদ শরীফ পড়া হয়, মৌলিকভাবে তা একটি বৈধ কাজই তো; বরং তা অতি বড় পুণ্য ও বরকতের কাজ। কিন্তু শরীআত এর জন্য নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি দান করেনি এবং সাধারণ অবস্থায় তা পড়াও ওয়াজিব করেনি। বিষয়টা কেবলই ঐচ্ছিক। যে পড়বে সে প্রভূত ছওয়াবের অধিকারী হবে, না পড়লে কোন গুনাহ হবে না। কিন্তু প্রচলিত মীলাদে দরূদ শরীফ পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-নীতি তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। সে নিয়মে না পড়লে যেন দরূদ শরীফই পড়া হয় না এবং তা যেন মহাঅপরাধ।

প্রচলিত নিয়মের সেই মীলাদ এখন এমনই এক বাধ্যতামূলক কাজ হয়ে গেছে যে, কেউ তা না করলে সে এর প্রবক্তাদের দৃষ্টিতে দীন থেকে খারিজ হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুশমন হয়ে যায়। যে কারণে তাকে কেবল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপই নয় আরও

নানাভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

এমনিভাবে মৃত ব্যক্তির জন্য যে চল্লিশা করা হয়, তাতে মূলত যে কাজটি করা হয়, অর্থাৎ মানুষজনকে খাওয়ানো, মৌলিকভাবে তাও একটি বৈধ ও ছওয়াবের কাজ। কিন্তু মৃত ব্যক্তির কল্যাণার্থে এভাবে খানা খাওয়ানো বা কাঙালীভোজ দেওয়া কোন ফরয-ওয়াজিব কাজ নয় কিছুতেই। এটা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক বিষয়। কিন্তু বিষয়টাকে এ স্তরে রাখা হয়নি; বরং এটাকে সামাজিকভাবে এমন আবশ্যকীয়  কাজে পরিণত করা হয়েছে যে, কেউ পালন না করলে সে নিন্দা-সমালোচনার পাত্র হয়ে যায়। যেন সে শরীআতের মস্ত বড় এক হুকুম অমান্য করেছে। এহেন বাড়াবাড়িই মৌলিক এ বৈধ কাজটিকে নিষিদ্ধ বিদআতের অন্তর্ভুক্ত করেছে।

মোটকথা এ রকম আরও যেসব কাজ মৌলিকভাবে বৈধ হওয়া সত্ত্বেও এখন তা বিদআত ও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে এবং কুরআন-সুন্নাহর মূলনীতি অনুযায়ী তা গুনাহের কাজে পরিণত হয়েছে, তার এ অবস্থান্তরের জন্য মানুষের বাড়াবাড়িই দায়ী। বৈধ কাজকে তার আপন স্থান থেকে সরিযে কার্যত আবশ্যিকতার স্তরে পৌঁছানোর বাড়াবাড়িতেই তা অবৈধতায় পর্যবসিত হয়েছে। আজ মুসলিম সমাজে যত বিদআত প্রচলিত মূলত এ জাতীয় বাড়াবাড়ি থেকেই তার উৎপত্তি।

মধ্যপন্থা ধরে রাখার উপায় : শরীআতের বিধানাবলীতে মধ্যপন্থী থাকার উপায় হচ্ছে বিধানাবলীর যথাযথ অনুসরণ। যে ব্যক্তি শরীআতের যতটা বিশুদ্ধ অনুসরণ করবে, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সে ততটাই ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হবে। কেননা শরীআতের বিধানই ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে থাকে। মানবস্বভাব যা দাবী করে, যা মানব স্বভাবের অনুকূল এবং যা দ্বারা মানব জীবন উপকৃত হয়, সেইমত বিধানই মধ্যপন্থাসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে থাকে। মানুষকে সেইমত বিধানই দেওয়া হয়েছে আর তারই নাম দীন ইসলাম। ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে দীনে প্রতিষ্ঠিত কর। অনুসরণ কর আল্লাহর (সৃষ্ট) স্বভাব-প্রকৃতির, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল দীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। (রূম : ৩০)

বস্ত্তত স্বভাব প্রকৃতি যা চায় প্রতিটি বিধানের মান ও পরিমাণ সে হিসেবেই স্থিরীকৃত। ফরয, ওয়াজিব, মুস্তাহাব, হালাল-হারাম ইত্যাদি সে অনুসারেই সাব্যস্ত। প্রকতৃপক্ষে এ রকমই হওয়া স্বাভাবিক। কেননা মানুষের স্রষ্টা ভালোভাবেই জানেন মানুষের কল্যাণার্থে কি কি বিধান কী মান ও পরিমাণে দেওয়া চাই এবং কোন্ কোন্ বিধান তার স্বভাবের উপযোগী ও কী মাত্রায় উপযোগী। সুতরাং প্রতিটি বিধান তিনি সে হিসেবেই দিয়েছেন। নামায পাঁচ সংখ্যায় ফরয করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি সময়ে। তাতে রাকআত সংখ্যাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে এবং কত রাকআত ফরয ও কত রাকআত সুন্নত তাও স্থির করে দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে রুকূ-সিজদার সংখ্যা ও পদ্ধতি এবং কার্যাবলীর ধারাবাহিকতা সবকিছুই সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে এর প্রতিটি বিষয়ই ভারসাম্যমান। না হেলা করার মত লঘু পর্যায়ের, না চাপবোধ করার মত গুরুভার। যাকাতের দিকে লক্ষ করুন-তা নির্দিষ্ট সম্পদে, সুনির্দিষ্ট মেয়াদে ও সুনির্দিষ্ট হারে ফরয করা হয়েছে এবং ক্ষেত্র বিশেষ ছাড়া অতিরিক্ত দান-খয়রাতকে ঐচ্ছিক পর্যায়ে রাখা হয়েছে। এমনিভাবে রোযা ও হজ্জের মান, পরিমাণ ও প্রাসঙ্গিক সবকিছুও স্থিরীকৃত। কোনওটিই কোনও রকম

প্রান্তিকতা দোষে দুষ্ট নয়। বরং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে যে মান ও পরিমাণ স্থির করা হয়েছে তা পরিপূর্ণভাবে স্বভাবসম্মত। তার বেশি হলে অতিরিক্ত চাপ পড়ত আর কম হলে প্রয়োজনীয় মাত্রানুরূপ না হওয়ায় বিধান দ্বারা কাঙ্খিত সুফল পাওয়া অসম্ভব হত। সুতরাং ইসলাম যে বিধান যে মান ও যে পরিমাণে দিয়েছে তা সম্পূর্ণ স্বভাবসম্মত ও যথাযথ মাত্রাযুক্ত। সে মান ও পরিমাণ রক্ষা করে বিধানাবলী পালন করা হলে তাই হবে ইসলামের যথার্থ অনুসরণ। তখন বাড়াবাড়িজনিত প্রান্তিকতার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বিদআতে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। এর জন্য কোন্ বিধান কী পর্যায়ের সে সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। আলহামদুলিল্লাহ উম্মতের ফুকাহায়ে কিরাম ফিকহ চর্চার মাধ্যমে সে বিষয়টাও আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রচুর বই-পুস্তক লেখা হয়েছে। ফিকহের যে-কোনও একটি বিশুদ্ধ রচনা আগাগোড়া পড়লে সহজেই সে ধারণা লাভ হয়ে যাবে।

আয়-ব্যয়ে পরিমিতিবোধ : ইসলাম অর্থোপার্জন ও খরচের ব্যাপারেও মধ্যপন্থা অবলম্বনের শিক্ষা দিয়েছে। অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে একদিকে আদেশ করা হয়েছে, (তরজমা) যখন নামায আদায় হয়ে যাবে, তখন জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) সন্ধান কর। (জুমুআ : ১০) কেননা

لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى

মানুষ যা চেষ্টা করে কেবল তাই পায় (নাজম : ৩৯)

তাই বিনা চেষ্টায় হাত-পা ছেড়ে বসে থাকা ইসলামের শিক্ষা নয়। দুনিয়ায় আল্লাহ তাআলার রীতিই হল চেষ্টা ও উপায় অবলম্বনের ভিত্তিতে জীবিকা দান করা। তাই হালাল পন্থায় জীবিকার্জনের চেষ্টাকে ফরয করা হয়েছে। হাদীসে ইরশাদ : হালাল উপার্জনের সন্ধান অন্যান্য ফরযের পর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয।-সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৬/১২৮

তো একদিকে উপার্জনের নির্দেশ অন্যদিকে সাবধান করা হয়েছে কেউ যেন উপার্জনের মোহে পড়ে আখিরাতকে ভুলে না যায় এবং শরীআতের হুকুম পালনে উদাসীন না হয়ে পড়ে। সুতরাং উপরের ওই আয়াতেই নামায আদায়ের হুকুমকে প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) হে মুমিনগণ তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন করে না রাখে। (মুনাফিকূন : ৯) যারা সে উদাসীনতার শিকার না হয়, তাদের প্রশংসা করে বলা হয়েছে (তরজমা) সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে সেই লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে এবং সালাত কায়েম ও যাকাত দেওয়া হতে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে যেদিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। (নূর : ৩৭)

মোটকথা উপার্জনের ক্ষেত্রে এমন অবহেলা ও শিথিলতা করা যাবে না যদ্দরুণ নিজের ও সংশ্লিষ্টজনদের হক আদায় বিঘ্নিত হয় এবং ইসলামবিরোধী বৈরাগ্যবাদের প্রশ্ন দেখা দেয়। আবার এমন বাড়াবাড়ি ও লোভ-লালসার শিকার হওয়াও বাঞ্ছনীয় নয়, যদ্দরুণ হালাল-হারামের সীমারেখা লংঘন হয়ে যায় এবং নামায-রোযা ও আল্লাহর যিকির-স্মরণে অবহেলা প্রদর্শন করা হয়। বরং আল্লাহ তাআলার হুকুম-আহকাম পালনের পর বৈধতার সীমারেখার মধ্যে থেকে যতটুকু চেষ্টা সম্ভব ততটুকুতেই ক্ষান্ত থাকবে এবং তাতে যে উপার্জন হয় তাতে পরিতুষ্ট থাকবে।

এটিই উপার্জন-চেষ্টার মধ্যপন্থা। হাদীসে এরই শিক্ষাদান করা হয়েছে,

أجملوا في طلب الدنيا فإن كلا ميسر لما كتب له منها

তোমরা দুনিয়া সন্ধানে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর। মনে রেখ প্রত্যেকের জন্য তা থেকে যা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, সে কেবল তাই পাবে।-মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ২১৩৩; মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ১৬০২

এবং ইরশাদ হয়েছে, ঐশ্বর্য

অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্যে হয় না। মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৪৪৬, সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১০৫১)

আয়ের মত ব্যয়ের ক্ষেত্রে রয়েছে মধ্যপন্থার নির্দেশ। ইরশাদ হয়েছে,

وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا

 (দয়াময় আল্লাহর বান্দা তারা ...) এবং যারা ব্যয় করার সময় অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না; বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়। (ফুরকান : ৬৭)

আরও ইরশাদ হয়েছে,

وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا

(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং (অপব্যয়ী হয়ে) তা সম্পূর্ণ খুলেও রেখ না। যদ্দরুণ তোমাকে নিন্দাযোগ্য ও নিঃস্ব হয়ে বসে পড়তে হবে। (বনী ইসরাঈল : ২৯) মোটকথা কার্পণ্যও নয় ও অপব্যয়ও নয়। বরং সুচিন্তিতভাবে যেখানে যা প্রয়োজন তা ব্যয় করাই ইসলামের নির্দেশ। এটাই মধ্যপন্থা। এভাবে চললে উপার্জনে বরকত হয় ও অর্থকষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি পরিমিত ব্যয় করে সে নিঃস্ব হয় না। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৪২৬৯ তবারানী কাবীর, হাদীস ১০১১৮; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস : ৬১৪৯)

ঔদার্য ও কৃপণতার প্রচলিত ধারণা ও যথার্থ মিতব্যয়

উপরিউক্ত হাদীসটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থব্যয়ের মূলনীতি শিক্ষা দিয়েছেন। সেই সাথে যে ব্যক্তি মূলনীতিটির অনুসরণ করে তাকে অভাবমুক্ত একটি স্বস্তিকর জীবনের সুসংবাদ শুনিয়েছেন। তিনি আল্লাহ তাআলার মহান নবী। নবুওয়তের সমুজ্জ্বল আলো থেকেই উৎসারিত হয় তাঁর প্রতিটি কথা। তাঁর কথার কোন ব্যত্যয় নেই। কাজেই যে ব্যক্তি অর্থব্যয়ে পরিমিতিবোধের পরিচয় দেবে অভাব অনটন তার নাগাল পেতেই পারে না। অধিকাংশ লোকই ইসলামের এ মহান শিক্ষাটির যথাযথ অনুসরণ করছে না। ফলে অর্থোপার্জনের কাঙ্খিত সুফল থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে এবং প্রচুর উপার্জনের পরও অনেককে কষ্ট-ক্লেশের জীবন যাপন করতে হচ্ছে।

শিক্ষাটি অনুসরণ না করার বহুবিধ কারণের অন্যতম প্রধান কারণ হল ঔদার্য ও কৃপণতা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা। মনে করা হয়ে থাকে প্রয়োজন-অপ্রয়োজন নির্বিচারে দু হাতে টাকা ওড়ানোই হচ্ছে উদারতা। আড্ডা দিয়ে, ফূর্তি করে, অখাতে-কুখাতে খরচ করতে পারলে বেশ বাহবা পাওয়া যায়। বলা হয় সে বড় দিলদরিয়া । পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অর্থব্যয়ে বিচার-বুদ্ধিকে কাজে লাগায়, পাপ-পুণ্যের পার্থক্য করে এবং অপব্যয় হতে বেঁচে থাকে তাকে কৃপণ নামে আখ্যায়িত করা হয়। বর্তমানে অর্থব্যয়ের অবৈধ খাত বিস্তর। কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির ঔরস-উদর প্রসূত নানা রকম আচার-অনুষ্ঠানে গোটা সমাজ আচ্ছন্ন। এর তালিকা উত্তরোত্তর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। জন্মদিন, মৃত্যুদিবস, বিবাহবার্ষিকী, ভালোবাসা দিবস, মাতৃদিবস, পিতৃদিবস, কারামুক্তিদিবস, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসসহ গুচ্ছের দিবস-বার্ষিকীর এক অন্তহীন চক্রপাকে গোটা সমাজ ঘুরছে। আছে নানা রকম ধর্মীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎসব অনুষ্ঠান, বিভিন্ন রকম পাল-পার্বণ। তা ছাড়া পাড়া-মহল্লার ক্রীড়ানুষ্ঠান, নাট্যানুষ্ঠান, রঙ-তামাশা। এর সবকটিতে সক্রিয় থাক, টাকা উড়াও, মজা দাও, মজা লোট তো তুমি দরাজদিল-এর তকমা পাবে। আর কী পরিমাণ সেটা কোন কথা নয়। আর সকলে থাকছে তুমি কেন থাকবে না। টাকা না থাকে তো ধার কর। কিন্তু এইসব বেহুদা বলনাচে তোমাকে নাচতেই হবে। অন্যথায় হে সাধু-সিদ্ধ পুরুষ তোমার মত পবিত্রের আমাদের সমাজে ঠাঁই নেই। বউ-বাচ্চা গোঁজ হয়ে থাকবে। পাড়া-পড়শী ধিক্কার দেবে, বলবে ব্যাটা মহাকৃপণ। তা কৃপণ আখ্যা কে-ই বা পেতে চায়। প্রিয়জনের মলিন মুখই বা কে দেখতে চায়। তারচে সকলের সাথে তাল মিলাও। হিসাব-কিতাব বাদ দাও। তা বাদ দেওয়াই হচ্ছে। আর এরই থেকে জন্ম নিচ্ছে যতসব অনাসৃষ্টি। হয় বেতাল ব্যয়ের সাথে তাল মেলানোর ব্যর্থ প্রয়াসে আমদানির চোরাপথ খোঁজ, দৌঁড়াও কালা টাকার পেছনে। নয়ত যা আছে সব খরচ করে ফেল, তারপর ধার-দেনা কর, তা শোধের জণ্য ভিটামাটি যা আছে সব বিক্রি করে দাও এবং সবশেষে সর্বশান্ত হয়ে রাস্তায়- রাস্তায় ঘোর বা গলায় ফাঁস দাও। এসবই অপরিমিত ব্যয়ের পরিণতি, বেহিসাব খরচের খেসারত। এর থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইলে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা অনুসরণ করতে হবে। অর্থব্যয়ে পরিমিতিবোধের পরিচয় দিতে হবে। বের হয়ে আসতে হবে সমাজের সব আন্ধা পাকচক্র থেকে।

মনে রাখতে হবে ঔদার্য ও কৃপণতার যে ধারণা সমাজ তৈরি করে নিয়েছে, তা নিতান্তই ভুল, সুস্থ ও সুষ্ঠু বোধ-বুদ্ধিরহিত এবং বিলকুল অজ্ঞতাপ্রসূত। প্রচলিত ঔদার্য মূলত এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা, ইন্দ্রিয়-পরবশতা এবং অপচয়প্রবণতা। এমনিভাবে কৃপণতার প্রচলিত ধারণাও আদৌ বস্ত্তনিষ্ঠ নয়। বরং সাধারণত যাকে কৃপণতা বলা হচ্ছে সেটাই মিতব্যয়-যদি শরীআত-নির্ধারিত হুকুক (অর্থাৎ আল্লাহর হক ও বান্দার হক) আদায় করা হয়ে থাকে। সুতরাং অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম নিজ ধারণাকে সংস্কার করতে হবে। স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে কোনটা ঔদার্য আর কোনটা কৃপণতা।

মূলত শরীআতসম্মত অর্থব্যয়ের দুটি স্তর আছে। প্রথম স্তর বাধ্যতামূলক এবং দ্বিতীয় স্তর ঐচ্ছিক। বাধ্যতামূলক স্তর হল হুকুক আদায়ের স্তর। অর্থাৎ যারা উপার্জনকারীর উপর নির্ভরশীল, যাদের ভরনপোষণের দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত, যেমন স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, অভাবগ্রস্ত পিতামাতা ও অন্যান্য পোষ্যবর্গ। এদের থাকা-খাওয়া, পোশাক, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা তার অবশ্যকর্তব্য। এগুলো তাদের হক।

উপার্জনকারী ব্যক্তি তার উপার্জন দ্বারা সর্বপ্রথম এ হক আদায় করবে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

إبدأ بمن تعول

যারা তোমার প্রতিপাল্য সর্বপ্রথম খরচটা তাদের উপরই করবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৪২৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১০৩৪)।

পোষ্যবর্গের ব্যয় নির্বাহের পর কিছু উদ্বৃত্ত থাকলে তা যে কোনও সৎকাজে ব্যয় করা যেতে পারে এবং চাইলে সঞ্চয়ও করা যেতে পারে। উদ্বৃত্তের পরিমাণ নেসাব পরিমান অর্থাৎ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্য পরিমাণ হলে তাতে আল্লাহ তাআলার হক সংশ্লিষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং এক বছরের মাথায় সে অর্থের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ গরীব-দুঃখীর মধ্যে বিতরণ করা ফরয। পরিভাষায় একে যাকাত বলে। যাকাত ইসলামের অন্যতম প্রধান রুকন (স্তম্ভ), যা আদায় ছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজেকে মুসলিমরূপে পরিচয় দেওয়ার অধিকার থাকে না। সদকাতুল ফিতর ও কুরবানীও এরূপ ব্যক্তির উপর ওয়াজিব। এসবই আল্লাহর হক।

আল্লাহ তাআলার হকের কিছু সাময়িক ও উপস্থিত ক্ষেত্রও আছে, যাতে বিশেষ-বিশেষ পরিস্থিতিতে অর্থব্যয় করা অবশ্যকর্তব্য, যেমন মহল্লায় মসজিদ নির্মাণ করা, জরুরি দ্বীনী শিক্ষার ব্যবস্থা করা, ক্ষুধার্তকে অন্নদান করা, বিপন্ন ও আর্তের সাহায্য করা ইত্যাদি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

إن في المال لحقا سوى الزكاة

অর্থ-সম্পদে যাকাত ছাড়াও হক (অবশ্য প্রদেয়) আছে। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ৬৬০)

আল্লাহ তাআলার ও বান্দার হক আদায় করা হল অর্থব্যয়ের প্রথম স্তর। এ ব্যয় অবশ্যকর্তব্য এবং সংগতি থাকা সত্ত্বেও এটা না করা কঠিন গুনাহ এবং সেটাই প্রকৃত বখীলী বা কার্পণ্য। কুরআন-হাদীসে যে কার্পণ্যের নিন্দা করা হয়েছে এবং যার জন্য কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী শোনানো হয়েছে, তার সম্পর্ক মূলত এই স্তরের অর্থব্যয়ে অবহেলার সাথে।

সুতরাং আমরা বখীল বা কৃপণ বলতে সেই ব্যক্তিকেই বুঝব, যে এই পর্যায়ের খরচেও কুণ্ঠিত থাকে। অর্থাৎ সংগতি থাকা সত্ত্বেও পরিবার-পরিজনের দরকারি খরচটাও করতে চায় না, যাকাত ফরয হওয়া সত্ত্বেও তা আদায় করে না, প্রকৃত ভিখারীদের ভিক্ষা দিতে চায় না, অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের ধারকর্জ দিতে রাজি হয় না, দ্বীনী জরুরি ক্ষেত্রে অর্থসাহায্য নিয়ে এগিয়ে যায় না ইত্যাদি। কিন্তু এসব খরচে যারা অকুণ্ঠ তাদেরকে কৃপণ বলা অন্যায় এবং এটা তাদের প্রতি অপবাদ। কারও প্রতি অপবাদ আরোপ করা গুরুতর পাপ।

শরীআতসম্মত অর্থব্যয়ের দ্বিতীয় স্তর হল এমনসব মহৎ কাজে দান-খয়রাত করা, যা করা ফরয-ওয়াজিব নয় বটে, কিন্তু তা করতে শরীআতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে এবং করলে প্রভূত ছওয়াব পাওয়া যায়, যেমন পরস্পরে হাদিয়া বিনিময় করা, সুলাহা ও পুণ্যবানদের খেদমত করা, রোযাদারকে ইফতার করানো, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও জনকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করা ইত্যাদি। হকূক আদায়ের পর টাকা-পয়সা উদ্বৃত্ত থাকলে তা সঞ্চয় করে রাখা জায়েয বটে, কিন্তু কেউ যদি তার সবটা বা আংশিক এসব কাজে ব্যয় করে তবে তা হবে তার মহানুভবতা ও ঔদার্যের পরিচায়ক। অবশ্য এক্ষেত্রে বিশিষ্ট ও সাধারণের মধ্যে পার্থক্য আছে। বিশিষ্টজনেরা অর্থাৎ যাদের পরিপূর্ণ আল্লাহ-নির্ভরতা আছে, অভাব-অনটনে যাদের মন বিন্দুমাত্র টলে না, তারা উদ্বৃত্ত অর্থের সবটাও আল্লাহর পথে ব্যয় করতে পারে, কিন্তু সেই স্তরের তাওয়াক্কুল যাদের নেই, এ রকম আম-সাধারণের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা হল-

خير الصدقة ما كان عن ظهر غنى

শ্রেষ্ঠ দান তাই, যা নিজ অভাবমুক্ততা রক্ষার সাথে  হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৪২৬) অর্থাৎ উদ্বৃত্ত সবটা দান না করে তার অংশবিশেষ দান করাই উত্তম, যাতে দান করার পরও কিছু টাকা-পয়সা হাতে থাকে এবং প্রয়োজন ক্ষেত্রে তা কাজে লাগাতে পারে। অন্যথায় এমন পরিস্থিতিও দেখা দিতে পারে যে, অর্থের সবটা দান-খয়রাত করে দেওয়া হল আর তারপর এমন কোন জরুরি প্রয়োজন দেখা দিল, যা মেটানোর জন্য যে অর্থ দরকার তার ব্যবস্থা করা গেল না। এরূপ ক্ষেত্রে দাতা নিজ দান-খয়রাতের জন্য আক্ষেপ করবে এবং উল্টো এখন সে নিজেই অন্যের কাছে হাত পেতে বেড়াবে। এরই জন্য হাদীস শিক্ষা দিচ্ছে যে, দান-খয়রাত যদিও ভালো কাজ কিন্তু তাতেও তুমি পরিমিতিবোধের পরিচয় দাও। দু হাত উজাড় করে সবটা দিয়ে দিও না। হাতে কিছু না কিছু রেখে দিও। পূর্বোক্ত আয়াতও সে কথাই বলছে, হাত সম্পূর্ণ খুলে দিও না, পাছে তোমাকে নিন্দিত ও দুঃখিত হয়ে বসে পড়তে হয়। (বনী ইসরাঈল : ২৯)

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা অর্থব্যয়ে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিরক্ষা সম্পর্কে যে সার-নির্যাস পাই তা নিম্নরূপ, কোনও অবস্থায়ই শরীআতবিরোধী কোনো খাতে অর্থব্যয় করা যাবে না। সমাজে যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও পাল-পার্বণ প্রচলিত আছে, তার অধিকাংশই শরীআতসম্মত না হওয়ায় তাতে টাকা-পয়সা খরচ পরিহার করতে হবে। শরীআতসম্মত অনুষ্ঠানাদিতেও প্রতিযোগিতার মানসিকতা পরিহার করে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনকেই লক্ষ্যবস্ত্ত বানাতে হবে অতপর আয়ের সাথে সংগতি রেখে তার ব্যয় নির্বাহ করতে হবে। বিবাহ, ওলিমা, আকীকা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এ নীতি প্রযোজ্য।

পরিবার-পরিজনের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা, পোশাক ইত্যাদির ব্যাপারে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। তবে এর মান ও পরিমাণ অবশ্যই আয়ের সাথে সংগতিপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে গরীব ও মধ্য আয়ের লোকদের যেমন ধনীর সাথে পাল্লা দেওয়া ঠিক নয়, তেমনি ধনীরও উচিত নয় উঞ্ছবৃত্তিতে লিপ্ত হওয়া। কেননা আল্লাহ তাআলা বান্দাকে যে নিআমত দান করেন, বান্দাতে তার ছাপ দেখতে তিনি পসন্দ করেন। (হাদীস)

তবে এক্ষেত্রেও সীমালঙ্ঘন ও অপব্যয় নিন্দনীয়। সুতরাং স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের চাহিদাকে যথেচ্ছভাবে পূরণ না করে তাকে শরীআতের মানদন্ডে বিচার করে নিতে হবে। চিন্তা করতে হবে তারা যে জিনিসের আবদার করছে দ্বীন বা দুনিয়ার বিবেচনায় তা ঠিক প্রয়োজনীয় কিনা এবং প্রয়োজনীয় হলে তা ঠিক কতখানি প্রয়োজন। সেই সঙ্গে তা পূরণ না করার ক্ষতিও মাথায় রাখা চাই। অনেক ক্ষেত্রে চাহিদা পূরণও সমূহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই এসব কিছু সতর্কতার সাথে বিবেচনা করে অর্থব্যয় করা বা না করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বন্ধু-বান্ধবদের পেছনে অর্থব্যয়ও এ নিয়মের মধ্যে পড়ে ।

অর্থসম্পদে বান্দার আরও যেসব হক আছে তা আদায়েও যত্নবান থাকা চাই। এক্ষেত্রে গুরুত্বের পর্যায়ক্রমকেও নজরে রাখতে হবে, যথা সর্বপ্রথম নিজের হক। তারপর পরিবার-পরিজন, তারপর আত্মীয়-স্বজন, তারপর নিকট প্রতিবেশী, তারপর দূর প্রতিবেশী, এভাবে

ক্রমবিস্তার ঘটতে থাকবে।

পূর্বে অর্থ-সম্পদে আল্লাহ তাআলার যে হকসমূহের কথা বলা হয়েছে তাও যথাযথভাবে আদায় করা চাই। এক্ষেপ্সড্ডত্রেও অবহেলার কোন সুযোগ নেই। যে ব্যক্তি অর্থব্যয়ে এ নীতি অনুসরণ করে চলবে এবং এর বাইরে একটি পয়সাও খরচ করবে না, সমাজ চোখে সে যাই হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে সে একজন মিতব্যয়ী লোক। তাকে কৃপণ বলে নিন্দা করার কোন অবকাশ নেই। হাদীসের ঘোষণা মোতাবেক এরূপ ব্যক্তি কখনও অভাব-অনটনে ভুগবে না। মূলত অপব্যয় ও অপচয়ই অর্থাভাবের জন্ম দেয়। মিতব্যয়ের দ্বারা সে পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে উপার্জনে প্রচুর বরকত হয়। খুব বেশি আয় না করা সত্ত্বেও হুকুক আদায় সম্ভব হয়।

বর্তমানকালে অধিকাংশ উপার্জনকারী আয়-রোজগারে বরকত না হওয়ার অভিযোগ করে। প্রকৃতপক্ষে বরকত না হওয়ার জন্য সে নিজেই দায়ী। সে তার খরচে পরিমিতিবোধের পরিচয় দেয় না বলেই তার কষ্টার্জিত উপার্জন বেহুদা খরচ হয়ে যায়। কাজের কাজ কিছুই হয় না। বিশেষত হুকুক আদায়ে সে পেছনে থেকে যায়। সংগত কারণেই তার সম্পর্কে তার সংশ্লিষ্টদের অভিযোগেরও শেষ নেই। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, পিতামাতা আর বিবি-বাচ্চা পর্যন্ত তাদের প্রাপ্য বুঝে না পাওয়ার দরুণ তার প্রতি নাখোশ থাকে। এর থেকে মুক্তির উপায় একটাই-খরচে পরিমিতিবোধের পরিচয় দেওয়া বা মিতব্যয়ী হওয়া। এ গুণ যে অর্জন করেছে তার উপার্জনে বড় বরকত। তার দ্বারা কারও অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় না। সকলের ক্ষেত্রেই সে নিজ দায়িত্ব অল্প-বিস্তর আদায়ে সক্ষম হয়। ফলে তার বিরুদ্ধে কারও অভিযোগ থাকে না। বরং জরুরি খরচ শেষে তার কিছু না কিছু উদ্বৃত্তও থাকে, যা সে বিভিন্ন সৎকাজে খরচ করতে সক্ষম হয়। তার পরিমাণ বিবেচ্য নয়, অংশিদারিত্বই বড় কথা। আমাদের অভিজ্ঞতায় এটা প্রমাণিত যে, যারা নিম্ন বা মধ্য আয়ের লোক এবং হালাল-হারাম বিবেচনা করে চলে, এই পরিমিতিবোধকে কাজে লাগিয়েই তারা যেমন সুখে সংসার যাত্রা নির্বাহ করছে, তেমনি অন্যান্য হুকুক আদায়ের সাথে সাথে মসজিদ, মাদারাসা এবং দ্বীন ও জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজেও নিজেদের জড়িত রাখতে সক্ষম হচ্ছে। সুতরাং সত্যের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ বাণী কতই না বাস্তবসম্মত যে, যে ব্যক্তি মিতব্যয়ী হয়ে চলে সে কখনও অভাবগ্রস্ত হয় না।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement