Shawal 1434   ||   August 2013

কৌ শ ল : ব্যবহারের উল্টোসুর

Khasru Khan

মুখের ভাষায় উদারতার চিকন চিকন শব্দ। শিরোনামটাও বেশ দরদমাখা। কিন্তু ভেতরে কদর্য কৌশল ও চাতুর্যের পাহাড় লুকিয়ে আছে। এভাবেই একচক্ষু উপস্থাপনার একেকটি মহড়া এখন দেশে অনুষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এতে উদ্দিষ্ট মতলব খুব একটা হাসিল করতে পারছে না মতলবী সাধু-সন্তুর দল। পুরো বিষয়টি সাদা চিন্তার নাগরিকরা ঠিকই ধরে ফেলছেন। এতে মতলবীদের সব উদ্যোগ-আয়োজন একদম মাঠে মারা যাচ্ছে।

ঢাকার একটি সংবাদপত্র গত ২৯ জুন একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। সেখানে ওই সংবাদপত্রের পক্ষ থেকে একজন সঞ্চালকসহ মোট ১৫ জন আলোচক বক্তব্য রাখেন। তাদের গোলটেবিল বৈঠকের শিরোনাম ছিল : ধর্মীয় সম্প্রীতি ও বর্তমান বাস্তবতা। সাইনবোর্ডের মতো এ শিরোনামটি রেখে ভেতরে যা আলোচনা হয়েছে তার বেশির ভাগই ছিল মতলবী এজেন্ডাভিত্তিক। আলোচনা শেষে যে বার্তা ও মূল বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে তাতে পরিস্কার বোঝা গেছে, এদেশে মুসলমানদের কষ্ট-দুঃখ ও দুর্দশার কোনো মূল্যায়ণ তাদের কাছে ছিল না। তারা কেবলই এখানকার সংখ্যালঘুদের বিপন্নতা নিয়ে শংকিত হতে চেয়েছেন। পাশাপাশি সাম্প্রতিককালে প্রকৃতই নিপীড়িত, নিহত ও মার খাওয়া মুসলমানরা যেন এদেশে কিছুতেই কোনো ধরনের প্রতিকার ও সহানুভূতি পেতে না পারেন-তার একটি জোরদার বন্দোবস্ত করতে চেয়েছেন। পুরোপুরি একতরফা, একপাক্ষিক ও মুসলমানদের প্রতি নির্মমতাবাদী ওই গোলটেবিলটির খবর ওই সংবাদপত্রেই পরের দিন প্রকাশিত হয়। প্রথম পাতায় গুরুত্বসহ মুদ্রিত ওই খবরের শিরোনাম ছিল-ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করার আহবান। ওই খবরটি নিয়েই প্রায় ১৮ দিন পর আবার পুরো পাতা ব্যাপি একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। সংক্ষিপ্ত খবর ও বিস্তারিত আয়োজনের সব দেখে শুনে বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে, গোলটেবিল আয়োজকরা বড় রকম একটি হতাশা থেকেই এটি আয়োজন করেছেন। পাশাপাশি ভবিষ্যতে জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্রিক বড় রকম একটি টার্গেটও তারা পূরণ করার অভিলাষ পোষণ করছেন।

বৈঠকের প্রধান আলোচক (যে কোনো ইসলামী ইস্যুতে অত্যন্ত নেতিবাচক বিবৃতিজীবী বাংলার এক অধ্যাপক) বললেন, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রেখে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন করা যাবে না। রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভোটের প্রলোভনে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপসের যে ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, তা বন্ধ করতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মনে আস্থার ও নিরাপত্তাবোধের অভাব কীভাবে দূর করা যায়, তা দেখতে হবে। আলোচিত এক নারী নেত্রী সেখানে বড় ক্ষোভ ও জ্বালা নিয়ে বললেন,  রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এ কারণে সহিংসতা  হচ্ছে। মাদরাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষার পেছনে আমরা কত ব্যয় করেছি? সেখানে কী শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে? আজকে তার ফলাফল কী পাচ্ছি? এর একটা মূল্যায়ণ হওয়া দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার শিক্ষক এক সংখ্যালঘু নারী যথেষ্ট খোলামেলা ভাষায় বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সবাই জানি কীভাবে ধর্মের ব্যবহার করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ধর্মীয় খেলার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। যে কোনো মূল্যে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কিছুদিন আগে গণধাওয়া খেয়ে নাপিতের দোকানে আশ্রয় নেওয়া এক আলোচক জেদ ও অন্তর্জ্বালা লুকাতে না পেরে ডাহা মিথ্যা ও চরম আজগুবি কিছু কথাই বলে ফেললেন। তিনি বললেন, সরকারি দল, বিরোধী দল সবাই আল্লামা আহমদ শফীকে হুজুর বলছে। সবাই জানেন, একাত্তরে তিনি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী ছিলেন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত একশর অধিক জঙ্গি সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে। হেফাজতের বেশিরভাগ নেতা জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কিত। জঙ্গি মৌলবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত। ... আমি মিসর থেকে ফিরেছি, তারা বলেছে, ব্রাদারহুড নামক মৌলবাদীদের ছাড় দিয়ে আমরা যে ভুল করেছি, তোমরা এ ভুল করো না।

এভাবে উদ্ধৃতি দিতে থাকলে প্রসঙ্গ অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। ওই বৈঠকে মূলত এ দেশে হিন্দু- বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নির্যাতনের কয়েক হাজার (!) ঘটনার কথা বার বার উচ্চারণ করে সংখ্যালঘু সমাজের নিরাপত্তার স্বার্থে (?) সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা ও ধর্মীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের টুটি সর্বাত্মকভাবে চেপে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। গোছগাছ করে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তারা রাখঢাকের ধার আর ধারেননি। শাহবাগের নাস্তিক জাগরণ মঞ্চ থেকে গত ফেব্রুয়ারিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধের দাবি জোরেশোরে উঠানো হয়েছিল। সে গোলটেবিল আলোচনায় ওই দাবিরই প্রতিধ্বনি লক্ষ্য করা  গেছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তারা হয়তো আগামী নির্বাচনে প্রতিবাদী হেফাজতকর্মী-সমর্থক ও নিরাপত্তাবোধশূন্য কোটি ধার্মিক মুসলমানের সরব অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করার একটা চোরা পথ তৈরি করতে চাচ্ছে। নিরীহ আলোচনার ভঙ্গিতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ ইস্যুটিকে সামনে এনে পরবর্তী সময়ে সুশীলঝড়, কূটনৈতিক চাপ ও মিডিয়ার ফরমালিন দিয়ে জাতীয় নির্বাচনে ক্ষুব্ধ ও সক্রিয় মুসলমানদের নিষ্ক্রিয় করার একটা চুড়ান্ত ড্রাইভ দেওয়ার চেষ্টা করবে। এভাবে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে নতুন কোনো সংশোধিত বিধি চাপিয়ে দেওয়ার কায়দা খুঁজবে। কিন্তু এসব চেষ্টায় কি কোনো সুফল আদৌ তারা পাবে? কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের ক্ষুদ্র মনস্তত্ত্বের ছবি বলে দিচ্ছে- এসব করে কোনো সুফল তারা পাবে না। বরং অন্য অনেক নোংরা খেলার মতো এটাও শেষ পর্যন্ত তাদের বিপক্ষেই যাবে।

কারণ হচ্ছে, তারা নিজেরাই তো বিভিন্ন আলোচনায়-বক্তব্যে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মন্দির-উপাসনালয় ভাংচুরের অবাস্তব কাহিনী বলে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের কুৎসিত উদাহরণ বার বার সৃষ্টি করেছে। কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনায় গত পাঁচ বছরে কোনো একজন সংখ্যালঘুরই মৃত্যু হয়নি এ দেশে। তার পরও তারা অনবরত সংখ্যালঘু কার্ড খেলে যাচ্ছে। এভাবে রাজনীতি, নির্বাচন ও দেশের ইমেজের বারোটা বাজিয়েও তারা নিগৃহিত নির্যাতিত ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মুখ চেপে ধরতে চাইছে। তারা দেশজুড়ে হিন্দু নিগ্রহের কথা বলছে, মন্দির ধ্বংসের কথা বলছে, অথচ মসজিদে তালা লাগানোর কথা, হাজারো ইমামকে নাজেহাল করার কথা, আলেমদের গ্রেফতারের কথা, শাপলার কথা, মতিঝিলের কথা, রক্তের কথা, লাশের কথা, রঙের কথা, লাশ গায়েবের এবং মধ্যরাতে বাতি নেভানো রাষ্ট্রীয় বর্বরতার কথা বলতে দিতে চাইছে না। সংখ্যালঘুদের ধর্ম কি ধর্ম নয়? তাদের ইস্যুগুলো নিয়ে কথামালা ও উসকানি দিয়ে রাজনীতি ও নির্বাচন করলে কি ধর্মের ব্যবহার হয় না? ধর্মের ব্যবহার হয়ে যায় শুধু আস্তিক মুসলমানদেরকে হত্যার কথা উচ্চারণ করলে?

এই দ্বিচারিতা ও এই নির্মম কৌশলী প্রপাগান্ডায় সাধারণ মানুষ আর বিভ্রান্ত হবে বলে মনে হয় না। এজেন্ডাবাজ মিডিয়া ও সুশীলদের কদর্য কৌশল দেখতে দেখতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন ওই মহলের পক্ষ থেকে বললেই মানুষ কলকাতা বুঝে ফেলে। রাজনীতিতে ধর্মকে ন্যাক্কারজনকভাবে কারা বার বার ব্যবহার করে, কারা ধর্মবিদ্বেষী শক্তিকে আস্কারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে, কারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে বিষ ও খুনের চোখে দেখে এবং কারা দেশের সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয় সাধক-আলেমকে পশুর গর্ভজাত বলে গাল দিয়ে আরাম পায়- দেশের সব মানুষ এটা জানে।

 

চোখেমুখে ফিটফাট ভাব নিয়ে গোলটেবিল উপদেশ দিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার সুযোগটা এখন নেই। সময়টা তাদের জন্য বড় খারাপ যাচ্ছে। ষ

 

advertisement