বি প রী ত : বামপন্থীদের উগ্র শ্রেণীচেতনা
শ্রেণীহীন সমাজ কায়েমের কথা। শুনতে ও বলতে বড় মজা লাগে। সমাজতন্ত্রী কিংবা বামপন্থীরা সে মজাটা বেশি উপভোগ করে থাকেন। মুখের মজা পর্যন্তই। ভেতরে কিছু নেই। শব্দ বড়, কিন্তু আত্মাটা ছোট। পুঁটি মাছের মতো। পেশাদার ফকিরের মন নিয়ে বহু বামপন্থী শ্রেণীবৈষম্য দূর করতে চায়। এদেশের বেলায় এটাই সত্য। আগে কথাটা শুনতাম, বুঝতাম না। এখন এদের আচার-আচরণে হাবভাবে সব পরিষ্কার। কেন বলছি-একটু শুনুন।
গত ৬ মের মতিঝিল ট্র্যাজেডি সম্পর্কে সবাই সবিস্তারে জানেন। জানেন এর পক্ষ-বিপক্ষের নানা প্রচারণার কথাও। এসবের একটি হচ্ছে, ‘কওমী মাদরাসা-পড়ুয়ারা হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। খাওয়া-পরার ফ্রি সুবিধা পাওয়ার জন্য ওরা মাদরাসায় ভর্তি হয়ে থাকে। অনেকেই এতীম। মা-বাবার সঙ্গেও তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। কেউ কেউ শহরের বস্তিবাসীর সন্তান। ওরা সমাজের নিচের তলার বাসিন্দা। দুনিয়ার কিছুই বোঝে না। আন্দোলন-সংগ্রামে ঢাকার রাজপথে এসে ওরা ঝামেলা বাঁধাবে কেন?’ তীব্র তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মাদরাসা-ছাত্রদের এসব পরিচিতি নির্ধারণের কাজটি বেশি করছেন বামপন্থী সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা। পত্রিকার লেখাজোখা ও চ্যানেলের টকশোগুলোতে বামপন্থীদের এসব নাক উঁচু মূল্যায়ন এখন প্রায়ই ভেসে আসছে। সম্পাদক ও পরিচালক বামপন্থী-এমন পত্রিকা ও চ্যানেলগুলোতে মাদরাসা-ছাত্রদের হতদরিদ্র বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার প্রবণতাটা একটু বেশি মাত্রায় চোখে পড়ছে।
এজন্যই বলছি, শ্রেণীবৈষম্য দূর করার মুখরোচক স্লোগান দিলেও ছোট্ট মেজাজ এরা ছেড়ে আসতে পারেননি। এসব বামপন্থীর প্রায় সব ক’জনই নিম্নবিত্ত-দরিদ্র পরিবার থেকে এলেও এখন কলার উঁচিয়ে ‘এলিট’ সাজার চেষ্টা করেন। এরা অর্ধেক জীবন পার করেন দুপুরে টোস্ট আর চা খেয়ে। বিরানি-তেহারির প্রতি থাকে খুব বিষোদগার। কিন্তু শেষ জীবনে সুযোগ পেলেই বাশি পোলাউয়ের পাতিলে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। মুখে পুঁজিবাদ বিদ্বেষ। মুখে শ্রেণীসংগ্রাম। মুখে মেহনতী মানুষের গান। আর সুযোগ পেলেই পুঁজিপতি দস্যুর পা-চাটা দালাল। হা-ভাতে বুভুক্ষ ফকীর। সব কটি মিডিয়া হাউজ দেুখন। সেখানে কর্মরত বামপন্থীদের দেখুন। ওই সব মিডিয়া হাউজের মালিকদের সামাজিক ও পেশাগত পরিচিতি দেখুন। বিভিন্ন বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর পারিবারিক পরিচয় জানার চেষ্টা করুন! এখন তারা কোথায় কীভাবে উপার্জন করে চলেন-খোঁজ নিন। দেখবেন উচ্চবিত্ত শ্রেণীর তল্পিবহন ছাড়া এরা আর কিছুতেই নেই। এরা করবেন শ্রেণীসংগ্রাম? এরা দূর করবেন শ্রেণীবৈষম্য? এদের মনে সমাজতন্ত্র? আসলে এদের মুখে কওমী মাদরাসার ‘হতদরিদ্র’ ছাত্রদের প্রতি তাচ্ছিল্যের ভাষা শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এইসব বামপন্থীর প্রতি সহানুভূতিশীল শ্রেণীরও অভাব নেই এদেশে। তারাও মাদরাসা-ছাত্রদের ‘গরিব-মিসকীন’ আখ্যা দিয়ে বিকৃত সুখ বোধ করেন। মনে করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদেরকে বলতে পারি, বর্তমানেও এদেশের প্রথম শ্রেণীর বহু আমলা, অধ্যাপক, জজ-ব্যারিস্টার, প্রশাসক, তাত্ত্বিক, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক আছেন, যারা এসেছেন হতদরিদ্র পরিবার থেকে। তাদের মা-বাবা অন্য পরিবারে দিনমজুরের কাজ করতেন। তাদের পরীক্ষার ফিসের টাকা হাট-বাজারে চাঁদা করে তুলতে হয়েছে। তারা এখনও বড় চেয়ারে বসে দায়িত্ব পালন করছেন। তাছাড়া এই ঢাকা শহরের ক’জন বাড়িওয়ালা-গাড়িওয়ালা দু’পুরুষ আগে থেকেই বিত্তবান? বর্তমান বিত্তবানদের ৯০ জনেরই তো এক পুরুষ আগের ইতিহাস হচ্ছে ফসলের কাদামাটিতে লাঙলের ফলা ঠেলা। এটা কি তাদের গ্লানি? এতে কি লজ্জার কিছু আছে? তাহলে মাদরাসা-ছাত্রদের ‘হতদরিদ্র’ বলে তাচ্ছিল্য করায় বিকৃত সুখবোধটা কেন? দারিদ্র কি অপরাধ? কে বলেছে তাদের-এসব ছেলে মাদরাসায় এসেছে ফ্রি খাওয়া-পরার সুবিধা পাওয়ার জন্য? আর একথা কতটুকু সত্য যে, এখন মাদরাসায় হতদরিদ্র পরিবারের ছেলেরা বেশি আসছে? তথ্য হিসেবে তো এটা সঠিক নয়। বর্তমানে কওমী মাদরাসায় যারা পড়েন তাদের শতকরা ৬০ ভাগ আসছেন স্বচ্ছল পরিবার থেকে। কেউ কেউ মধ্যবিত্ত, অবশ্যই কেউ কেউ উচ্চবিত্ত পরিবার থেকেও। আর যারা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছেন তারা এসেছেন সৎ, দ্বীনদার ও সামাজিকভাবে প্রশংসিত বিভিন্ন পরিবার থেকে। তাদের প্রতি ছোটলোকী তাচ্ছিল্য দেখানোর মতো ছোট তারা নন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া সব ছাত্র কি স্বচ্ছল পরিবার থেকে আসছেন? তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক বাজেটে বিরাট অংকের ভর্তুকি রাখতে হয় কেন? ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা এবং শিক্ষার সঙ্গে খাদ্যকর্মসূচির পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের কারণ কী?
হ্যাঁ, একটা জায়গায় এদের মনোভাব সঠিক। কওমী মাদরাসার ছাত্র, ছাত্রদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের পক্ষে ডিজিটাল বড়লোকী অবলম্বনের কোনো পথ খোলা নেই। ডেসটিনির কোটিপতি আর রানাপ্লাজার শিল্পপতি হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। একইভাবে শেয়ার বাজারের আলাদিনের চেরাগ হাতে নেওয়া আর পদ্মাসেতুর ‘দেশপ্রেমিক’ সাজা তাদের আরাধ্য হতে পারে না। বন্দুক-চাপাতি দিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ কিংবা ভিওআইপির ‘বাতাসী’ ব্যবসায় কোটি টাকা কামানোর রুচি তাদের হয় না। জমি, জলাশয়, গ্যাস-বিদ্যুৎ, কমিশনসহ শত ধান্দার অন্ধিসন্ধিতে মাস্টারি করার মতো ‘যোগ্যতা’ তাদের নেই। এই ডিজিটাল বড়লোকীতে তারা পিছিয়েই আছেন। এজন্য তাদের ‘হতদরিদ্র’ বলে সুখ পেতে চাইলে কিছু বামপন্থী ও বাম-সহানুভূতিশীল ভোগপন্থীদের প্রতি আমরা করুণাই করতে পারি। হায়রে বেচারা! মুখে তার শ্রেণীসংগ্রাম, অন্তরে উৎকট বৈষম্য! এদেশে এরাই করেন বাম রাজনীতি! মায়াই হয় এই রাজনীতির জন্য।