মি ডি য়া : প্রতিবেশীর আদরে তৃপ্তি!
তথ্যবিকৃতি ও অপপ্রচারের একটি বাজে মহড়া দিল এ দেশের গণমাধ্যম। গত কয়েক মাস ধরেই এ মহড়ার নানা ধরনের রূপ পাঠক-দর্শকদের নজর কেড়েছে। প্রধান ও প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো প্রায় একযোগে এ মহড়ায় শরিক হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে এক শ্রেণীর ব্লগারের মঞ্চ নির্মাণের পর থেকেই এটি অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে।
এর মানে এই নয় যে, এসব গণমাধ্যম এর আগে এমন বিচ্যুতির ধারায় আর যায়নি। বরং আগেও বিকৃতি ও বিচ্যুতির পথে তাদের পদচারণা যথেষ্টই ছিল। বারবরই ছিল বললেও অত্যুক্তি হবে না। ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার বিকাশের সঙ্গে হাত ধরাধরি করেই তথ্য বিকৃতি ও অপপ্রচারের বিস্তার ঘটেছে। তবে আগে এরও একটা সীমা ও মাত্রা তারা ঠিক করে রাখতো। কিছু রাখঢাক, কিছু লাজলজ্জার পরোয়া করতো। কিন্তু এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এই বিকৃতি ও বিচ্যুতির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ গণমাধ্যম কোনো সীমা-সরহদ মানার প্রয়োজন মনে করেনি। লাজলজ্জা ধুয়ে মুছে তথ্য বিকৃতিতে ও উগ্রপ্রচারে নেমে পড়েছে। অনেকটা কোরাস গাওয়ার মতো। একসঙ্গে একজোট হয়েই নেমেছে। সেক্যুলারিজমের পক্ষে এবং ধর্ম ও ইসলামবিদ্বেষের ক্ষেত্রে নিজেদের এজেন্ডার পক্ষে গেলে ৫০ জনের বন্ধনকে ছবি ও বর্ণনায় কোটি মানুষের সমাবেশে রূপ দিয়েছে। আর বিপক্ষে গেলে ১০ লাখ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত জনস্রোতকে ১০০ জনের চিত্রে পরিণত করেছে। ১০ জনের মতামতকে মাথার উপর উঠিয়ে আকাশে তুলে ধরেছে আর হাজার জনের বক্তব্যকে পদদলিত করে ‘নিখোঁজ’ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এজেন্ডা ও ধারার বাইরের দু-তিনটি গণমাধ্যমের কারণে পুরোপুরি সফল না হলেও নির্লজ্জ বিকৃতির কসরত তারা বাদ দেয়নি।
এরই একটি চূড়ান্ত নজির কায়েম হয়েছে ৫ ও ৬ মের ট্র্যাজেডির পর থেকে। দাপ্তরিক প্রচারযন্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে মিথ্যাচারের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়ে দিনকে রাত ও রাতকে দিন বানানোর কাজটি খুব ‘কাঁচা হাতে’ করতেও দ্বিধা করেনি প্রভাবশালী গণমাধ্যম। দিনব্যাপি চাপিয়ে দেওয়া হানাহানি, শেষ রাতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর নারকীয় আক্রমণ আর হত্যা-গুম-খুনের সব ঘটনাকে চাপা দিয়ে উল্টো আক্রমণাত্মক অপপ্রচারে যেতে তাদের বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাও হয়নি। দেশের ‘উপরমহল’ যা চেয়েছে অতি উৎসাহে তার চেয়ে অনেক বেশি ‘তথ্যসেবা’ তারা দিয়েছে। এখনও এ ধারা ‘বীরবিক্রমে’ চালিয়ে যেতে কোনো কার্পণ্যই তারা করছে না। দেশীয় গণমাধ্যমের গণচরিত্রের এ মহা অবক্ষয় দেখে বিলেতের দ্য ইকনমিস্ট পর্যন্ত দুঃখে-বেদনায় হাহাকার করে উঠেছে। ৬ মের ট্র্যাজেডির সপ্তাহখানেকের মধ্যে পত্রিকাটি বলেছে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম ‘নতজানু’ ভূমিকা পালন করছে। তারা সাহস করে সত্য প্রকাশ করছে না।
ইকনমিস্টের এই হাহাকারে অবশ্য আমাদের গণমাধ্যম-কর্তাদের কানে কোনো পানিই যায়নি। তারা তাদের ‘সুকর্মে’ অনড় ও অবিচল হয়েই আছেন। বাইরের সুবচন নিয়ে তারা মোটেই চিন্তিত নন। কারণ তারা যে শুধু তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে ‘বিমূর্ত’ একটা সুখ পাচ্ছেন তা তো নয়, একই সঙ্গে তারা সেক্যুলার ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকেও পাচ্ছেন বিপুল পিঠ-চাপড়ানি। আর পাচ্ছেন বিশাল ক্ষমতাধর পাশের দেশের আদর-আপ্যায়ন। কীভাবে পাচ্ছেন-শুনুন। ট্র্যাজেডির ঠিক এক সপ্তাহ পর ঢাকার বাইরে এক সীমান্তজেলায় সফরে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পংকজ শরণ বলেছেন, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বিরাট ইতিবাচক বিকাশ ঘটেছে। এতে তিনি খুবই উৎফুল্ল। তিনি জানান, এদেশের গণমাধ্যমকর্মীদের উন্নয়নে তিনি কিছু কর্মসূচি হাতে নেবেন।
আর দরকার নেই। আমাদের নাক-কান কাটা গণমাধ্যম জায়ান্টরা আগ্রাসী ও উগ্রপ্রতিবেশী ভারতকে যে কতোটা সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন-এ বক্তব্য থেকেই তার অনুমান করে নেওয়া যায়। সীমান্ত হত্যা, পানি আগ্রাসন, বাণিজ্য বৈষম্য, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনসহ বিভিন্ন বিষয়ে এ দেশীয় গণমাধ্যমের ভূমিকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের কালোঘাম ছুটে যাওয়ার কথা। সে-ই লোকই যখন গণমাধ্যমের ভূমিকায় তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন, তখন বোঝা যায় এদেশের গণমাধ্যম স্বজাতির স্বকীয়তার বিরুদ্ধে সেবা দিতে কতোটা পারঙ্গম। আমাদের গণমাধ্যম এখন কি নিষ্ঠার সঙ্গে সে কাজই করে চলেছে? ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমিক মুসলমানদের ঈমান, জীবন ও অস্তিত্বের বিরোধিতার পথেই কি তারা হাঁটবে? অনন্তকাল হাঁটতে থাকবে? তালাবদ্ধ বিবেকের এই গণমাধ্যমকে যদি অনতিকাল পরেই কোনো এক বা একাধিক মহল ‘গণশত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু করে-আমরা তখন তাদের বিরুদ্ধে কী বলতে পারব? আমরা কিছু বললেই কি তারা সেটা শুনবেন?