Shaban-Ramadan 1434   ||   June-July 2013

মজলিস : শেকড়ের পাশে সহৃদয় অবস্থান

খসরূ খান

কেরানীগঞ্জের হযরতপুর-বৌনাকান্দি। মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া ঢাকা-র প্রধান প্রাঙ্গন। চারদিকের সবুজের স্রোতের মধ্যে একটি আলোর দ্বীপ। সেই দ্বীপে সুন্দর এক মজলিসের আয়োজন। ১ মে বুধবার। সকাল থেকে নবীন আলেমরা এসে জমায়েত হয়েছেন। এরা একই সঙ্গে কওমী মাদরাসা পড়ুয়া নবীন আলেম এবং এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। জমায়েতের উদ্দেশ্য দ্বীনী শিক্ষার মূলকেন্দ্র, মূল শেকড়-মাদরাসার সঙ্গে এ ছাত্রদের সম্পর্ক জোরালো করা, বিশ্ববিদ্যালয় পাঠকালীন জীবনে ইলম ও আমলের সন্তুষ্টিমূলক ধারা বজায় রাখা এবং পরস্পর পরিচিতি ও পরামর্শের মধ্য দিয়ে শিক্ষা ও কর্মজীবনে দ্বীনের মূল মিশন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় গ্রহণ করা। সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যেই প্রায় ৪০ জন ছাত্রভাই এসে জমায়েত হন। এ যেন শেকড়ের পাশে এসে সহৃদয় অবস্থান। হৃদয় খুলে হৃদয় দিয়ে গ্রহণের এক অনাবিল আয়োজন।

মারকাযের রঈস মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ছাহেবের সভাপতিত্বে যোহরের নামায ও খানার বিরতিসহ মজলিসটি চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। মজলিসে সারগর্ভ, উদ্দীপনামূলক আলোচনা, পরামর্শ ও অভিব্যক্তি প্রকাশের এক হৃদয়ছোঁয়া ও চোখভেজা পরিবেশ তৈরি হয়। সভাপতিসহ আলোচনা পেশ করেন মারকাযুদ দাওয়ার আমীনুত তালীম মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক ছাহেব, দারুর রাশাদ মাদরাসার নাযেমে তালীমাত ও সাংবাদিক মাওলানা মুহাম্মাদ লিয়াকত আলী ছাহেব, ঢাবি উর্দু বিভাগের চেয়ারম্যান মাওলানা গোলাম রববানী ছাহেব, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাফেয মাওলানা মুহাম্মাদ তারেক ছাহেব, মাসিক আলকাউসারের সহ-সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ ছাহেব ও নির্বাহী সম্পাদক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ ছাহেব। নবীন আলেম ও বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্র মাওলানা মেরাজুল ইসলাম ও মাওলানা আজীজুর রহমানের উপস্থাপনায় মজলিসের শুরুতেই সমবেত ছাত্র ভাইয়েরা নিজেদের পরিচিত ও বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিজ নিজ লক্ষ-উদ্দেশ্য সংক্ষেপে তুলে ধরেন। মাদরাসায় পাঠগ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পেছনে তারা দ্বীনের আওয়াজ সবক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়া, শিক্ষা নিয়ে কাজ করা, দুর্নীতি দূর করা, বৃহত্তর পরিসরে দ্বীনের কাজ করা, প্রশাসনিক অঙ্গনে দ্বীনের কাজ করা, আইন-কানুনের ইসলাম-উপযোগী সংস্কারের চেষ্টা করাসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করেন। এরপর শুরু হয় মূল আলোচনা ও অভিব্যক্তি প্রকাশের পর্ব।

সভাপতির বক্তব্যে মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব বলেন, মুমিন যে অঙ্গনেই কদম রাখেন তার অন্তর অন্য মুমিনদের সঙ্গেই লেগে থাকে। মুমিনের ঈমান যেমন এক, তাদের চিন্তা ও অভিব্যক্তির সুরও এক।  যারা মাদরাসায় পড়াশোনা করে অন্য অঙ্গনে পড়তে যাচ্ছেন তাদের প্রতি আমরা সুধারণাই পোষণ করি। জাতি, সময় ও উম্মাহর প্রয়োজনে তারা অনেক খেদমত আঞ্জাম দিতে পারেন। এ কথা সত্য, যারা মাদরাসায় সার্বক্ষণিকভাবে দ্বীনী খেদমতে আছেন এবং যারা বাইরে পা রাখছেন তাদের মাঝে দুদিক থেকেই কিছু অনুযোগের কথা শোনা যেত। এর বাস্তব কিছু কারণও হয়তো ছিল। এখন সময় বদলাচ্ছে। সবাইকে সচেতন ও সহযোগী হতে হবে। যারা মাদরাসা থেকে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন, তাদের প্রত্যেকের উচিত উপযোগী মুরববী নির্বাচন করে পরামর্শ করে চলা। আপনার সংকটে মুরববীর পরামর্শ খুবই কাজে লাগবে। তাছাড়া বাইরের অঙ্গনে বিচরণকালে কথায়-কাজে প্রত্যেকের স্বয়ংক্রিয় দাঈ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তিনি জটিলতা ও ক্লেশমুক্ত একটি পদ্ধতিতে মাদরাসা ফারেগ-বিশ্ববিদ্যালয় পাঠরতদের একটি সমবেত রূপ গড়ে তোলা ও ধরে রাখার চেষ্টা করতে আহবান জানান।

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব বলেন, আজকের এই মজলিসটি একটি প্রাথমিক পরিচিতি-মজলিস হলেও আলহামদুলিল্লাহ এতে দ্বীন, ঈমান, ইলম, তাকওয়া ও তাহারাতের উন্নতি নিয়ে মতবিনিময়ের সুযোগ হয়েছে। সামনের মজলিসগুলোতে ইনশাআল্লাহ ইলমী তারাক্কী ও ইস্তিদাদ বৃদ্ধি বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। তিনি সবাইকে মুরশিদে হায়াত বা জীবন চলার পথে একজন পথনির্দেশক গ্রহণের বিষয়ে জোর দিয়ে বলেন, যারা মাদরাসায় পড়াশোনা করে বাইরের বিভিন্ন অঙ্গনে পড়তে গেছেন, কাজ করতে গেছেন তাদেরকে আমি কখনো আজনবী বা ভিন্ন অঙ্গনের মানুষ বলে মনে করিনি। শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামদের কেউ-ই শুধু এ কারণে কাউকে সে রকম মনেও করেন না। বাইরের অঙ্গনে যাওয়ার বিষয়টি কবীহ লিআইনিহী নয়। অন্য কোনো মন্দত্ব যুক্ত না হলে এতে দোষণীয় কিছু নেই।

মাওলানা লিয়াকত আলী ছাহেব বলেন, যারা বাইরের অঙ্গনে পড়াশোনায় পা রেখেছেন তাদেরকে নিজের বিশ্বাস, শিক্ষা ও চেতনার ওপর অটল থাকতে হবে। যারা নিজ বিশ্বাসের ওপর অবিচল থাকে তাদেরকে সবাই সম্মান করে। তিনি প্রত্যেককে নিজ নিজ অঙ্গনে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখার আহবান জানিয়ে বলেন, যোগ্যকে দুনিয়া সালাম দেয়। যোগ্যতা ও আমানতদারি থাকলে তার কদর সব যায়গায় পাওয়া যায়। দ্বীনের ওপর আঘাত কোন কোন দিক থেকে কীভাবে আসছে, সে সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে এবং আধুনিক কালের পরিভাষা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তাছাড়া বাংলাভাষা ভালোভাবে শিখতে হবে এবং ইংরেজীর ওপরও মোটামুটি দখল কায়েম করতে হবে। তিনি সেক্যুলারিজম, মুক্তচিন্তা, উদারতা, মানবাধিকার ও সাম্যের স্লোগানের আড়ালে দ্বীনবিরোধী যেসব উপাদান রয়েছে তা উপলব্ধি করে নিজেদের যুক্তি ও পদক্ষেপ ঠিক করে কাজ করার পরামর্শ দেন।

ড. মাওলানা গোলাম রববানী ছাহেব বলেন, কওমী মাদরাসার ছাত্র-এটাই আমার প্রথম ও শেষ পরিচয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার বিষয়টি আমার মূল পরিচয় নয়। আলেম-উস্তাদদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চললে বাইরের অঙ্গনের স্খলনগুলো থেকে বেঁচে চলা সম্ভব হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে বিভিন্ন দিক থেকে অশোভন দাওয়াত এসে থাকে। সেসব দাওয়াত গ্রহণ না করে নিজের দিকে অন্যদের দাওয়াত দিতে হবে। সব আলেম-উলামার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চললেও বিশেষভাবে একজন মুরববীকে মেনে চলতে হবে। সব সময় মনে রাখতে হবে, আমি কওমী মাদরাসার আলেম।

মাওলানা মুহাম্মাদ তারেক ছাহেব বলেন, কওমী মাদরাসায় পড়ে যারা বাইরের অঙ্গনেও পড়তে যাচ্ছেন তাদের দ্বারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে পারে। তাদের দায়িত্ব মূল প্রতিষ্ঠান, উস্তাদ ও ছাত্র বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখা। যোগাযোগ না থাকলে কিছু ক্ষতি হয় দু দিকেরই, তবে মূল ক্ষতিটা হয় চলে যাওয়াদের-এটা আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ও নবীন আলেমদের প্রতি সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিয়ে তিনি আরও বলেন, ফিকহ, হাদীস ও তাফসীর বিষয়ে মুতালাআ চালু রাখা, হাফেজদের নিয়মিত তারাবীহ পড়ানো, দ্বীনী কাজের সাথে সম্পর্ক ধরে রাখা, ভালো পড়ালেখা করা, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বন্ধু নির্বাচনে সাবধানী হওয়া ও ভবিষ্যতে পেশা নির্বাচনের বিষয়ে আগেই মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ ছাহেব বলেন, সবকিছুর মাঝেই কিছু ভালো-কিছু মন্দ থাকতে পারে। কিন্তু যার ভালো বেশি তাকেই আমরা ভালো বলি। সেহিসেবে  বাইরের অঙ্গনে গিয়ে কওমী মাদরাসার ইতিবাচক ইমেজ তুলে ধরতে হবে। তিনি বলেন, চলতি অপপ্রচারে প্রভাবিত না হয়ে দৃঢ় থাকতে হবে। এখন এগিয়ে যাওয়া ও পিছিয়ে পড়ার যে মানদন্ড দাঁড় করানো হয়, তার প্রবঞ্চনা থেকে আমাদের মুক্ত থাকতে হবে।

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ ছাহেব বলেন, মূল প্রতিষ্ঠান বা মাদরাসা হচ্ছে আমাদের পরিবারের মতো। এ পরিবারের সঙ্গে যোগসূত্র যেন কেটে না যায়- সেজন্য এধরনের আয়োজন অবশ্যই প্রশংসনীয়। বাইরের অঙ্গনে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া এবং হীনম্মন্যতায় ভোগার মতো মানসিক পরিস্থিতি থেকে বেঁচে থেকে শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকলেই আমরা নিরাপদ থাকব ও সফল হতে পারব ইনশাআল্লাহ।

আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যয়নরত নবীন আলেমরা তাদের অভিব্যক্তি তুলে ধরেন। অভিব্যক্তি ব্যক্ত করে বিভিন্ন সমস্যা, প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ের কথা তুলে ধরেন মাওলানা আব্দুল কাদির, মাওলানা মামুনুর রশীদ, মাওলানা আলাউদ্দীন, মাওলানা যোবায়ের রশীদ, মাওলানা কেফায়েতুল্লাহ, মাওলানা মুহাম্মদ মুহসিন প্রমুখ। অভিব্যক্তি প্রকাশ করে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন বলেন,  তারা যেন হারিয়ে না যায়, তারা যেন শেকড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে-সেজন্য আমাদের মুরববীদেরও সস্নেহ ভূমিকা ও পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত থাকা দরকার।  তারা যেন কওমী হালকার ওলামায়ে কেরামের অধীনে ও নির্দেশনায় চলতে পারেন- সেরকম পরিবেশ তৈরি করতে পারলে বহুমুখি কল্যাণ সাধিত হবে ইনশাআল্লাহ।

দুআর মধ্য দিয়ে বিকাল চারটার পর মজলিস সমাপ্ত হয়। যতদূর জানা গেছে,  কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত কওমী মাদরাসার নবীন আলেমদের পারস্পরিক পরিচিতি গড়ে তোলার আয়োজনটি  চালু রাখার চেষ্টা চালু থাকবে ইনশাআল্লাহ। এক্ষেত্রে মাওলানা মেরাজুল ইসলাম, মাওলানা আজীজুর রহমান ও মাওলানা আলাউদ্দীন(০১৭৩৫-৮৯৫৯৮৯) বর্তমানে উদ্যোগী ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। ষ

 

 

advertisement