এরপর থেকে ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারের বিষয়টি মনে জায়গা করে নিলো। আর শুধু ভাবতে থাকলাম মানুষকে ইসলামী জ্ঞানে আলোকিত করতে তালিবুল ইলমদের তলবুল ইলমে উদ্বুদ্ধ করতে এমন একটি ভ্রাম্যমাণ মাকতাবা যদি করতে পারতাম। যাতে ইসলামী বইয়ের সাথে সাথে তুরাছি মাছাদের, মারাজে ও তথ্যগ্রন্থগুলো থাকবে। আর আমরা তালিবুল ইলমরা এ সমস্ত সোনার হরিণতুল্য কিংবা ‘আনকা’ পাখির মত শুনতে থাকা মাছাদের মারাজে ও তথ্যসূত্রগুলো একবার দেখে স্পর্শ করে পুলকিত হবো। হবো সত্যিকারের আলোকিত মানুষ। এভাবেই ভাবতে থাকলাম। ভাবনার জগতে আরো কত নতুন ভাবনার উদয় হতে থাকে। বই আর কিতাবের সাথেও সম্পর্ক বাড়তে থাকে। আমি যে সকল মাদরাসায় পড়েছি সেগুলোর মাকতাবাগুলো তালাবদ্ধ থাকায় বাইরের সাধারণ পাঠাগার এবং বিশেষ করে পাবলিক লাইব্রেরী আর নিজের সংগৃহিত কিতাবের মাঝেই চলতে থাকে আমার অধ্যয়ন অভিসার।

এরই মাঝে হঠাৎ একটি সুভাবনার অঙ্কুরোদ্গম হয়। যেই ভাবনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। শোকর আল-হামদুলিল্লাহ!! আচ্ছা আমরাতো ইলমের জাতি। আমাদের উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে সর্ব প্রথম যে নির্দেশ আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন তা হচ্ছে اقرأ পড়। পড় তোমার প্রভুর নামে। পড়, তোমার পালনকর্তা মহা দয়ালু। শুধুই পড়ার কথা। সেই থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনে  ইসলাম মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও জ্ঞান অর্জন ফরয ঘোষণা করে বলেছেন, ‘ইলম অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ’ সুতরাং জ্ঞান-বিজ্ঞানের শুরু ইসলাম এবং ইসলামী ব্যক্তিরা করবে এটাই স্বাভাবিক। এবং হয়েছেও তাই। আধুনিক ইউরোপ আমেরিকা যে সমস্ত বিষয় নিয়ে আত্ম-অহমিকা করছে, জাতীয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাগরণী ভূমিকা রাখছে, এসবের সূচনা ইসলামী ব্যক্তি ও বৈজ্ঞানিকরাই করেছেন। তাদের বিভিন্ন সূত্র ও মূল গবেষণা নিয়েই আজ ইউরোপ আমেরিকা সব ক্ষেত্রে আবিষ্কারের ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। সব কিছু বাদ দিয়ে এই পঠন পাঠনে তো মুসলিমদের চেয়ে আগে কেউ বাড়তে পারেনি। বাইতুল হিকমা, নিজামিয়া, বাগদাদ, মিশর এর সাক্ষী। তাহলে এই ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারের ক্ষেত্রে কি কোন মুসলিম মনীষীর ভূমিকা ছিল? নাকি অন্যরা যেভাবে বলছে, এর আবিষ্কার বা শুরুটা হয়েছে বৃটেন আমেরিকায় ১৯১২ সালে, ঘোড়ার গাড়ির আকৃতিতে ছোট আকারের সেলফে কিছু বই সাজিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে এবং এর উন্নতি সাধিত হয় ফ্রান্সে ১৯১৯ সালে?      

এ নিয়ে ভাবতে থাকলাম। কিন্তু এ ব্যপারে চিত্তে প্রশান্তিদায়ক কোন তথ্যসূত্র বা আলোচনা কোথাও পেলাম না। তাই সেই ভাবনা ভাবনাই থেকে গেল। হয়তো কখনো এর সঠিক ইতিহাস এবং এর মূল আবিষ্কারক বের করতে পারবো এমন আশার জাল বুনতে থাকলাম। এবং এক সময় ভুলে যাওয়ার উপক্রম হলাম।

১৪২৮হি. রমজান মাসের ২১তারিখে আল্লাহ তাআলা সবুজের ছায়ায় মদীনার পুণ্যভূমিতে তলবুল ইলমের উদ্দেশ্যে একজন তালিবুল ইলম হয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য নছীব করলেন। আল্লাহ তাআলা আমার মনের মকসূদ এবং আববু-আম্মুর দুআ কবুল করলেন। আল হামদুলিল্লাহ ওয়া জাযাহুমাল্লাহু খায়রান।

সবুজের ছায়ায় ও মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে দিনগুলো খুব ভালই কাটছিলো। দেশে থাকাকালীন পেপার কাটা, দোকানিদের বিভিন্ন ঠোঙা থেকে চমৎকার বাক্য, সাহিত্য বিষয়ক কোন লেখা কাটা আমার অভ্যাস ছিল। এখানে এসে রাস্তায় পড়ে থাকা যে কোন কাগজ দেখলেই তা কুড়িয়ে নিতাম আর মনে হতো এই বুঝি একটা নতুন আরবী বাক্য পেলাম। তবে কাগজ ফেলার জন্য যে বাক্স ছিল যার নামصندوق الأوراق المحترمة এতে মাসিক, দৈনিক পত্রিকা এবং ফেলে দেয়া অনেক কিতাব পাওয়া যেতো। তাই এর দিকে আমার ঝোঁকটা ছিলো বেশি। যদিও এর কপাট খুললে বিভিন্নদেশী এমনকি নিজ দেশীয় অনেক ছাত্ররাই অবাক হতো। কিন্তু আমিতো এর দ্বারা উপকৃত হচ্ছি। ভাষা-সাহিত্যসহ অনেক চমৎকার চমৎকার বিষয় খুঁজে পাচ্ছি। আর কবিতো বলেছেন ‘‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখিও তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন’’।

একদিন বিকেলের কথা। হারামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি। যাওয়ার পথে অফিসের সামনে থাকা বাক্সটিতে কি মনে করে হাত দিলাম। এবং ঠিকই একটি অমূল্য রতন পেলাম। যার মাঝে অপেক্ষা করছিলো আমার সেই ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারের মূল ইতিহাসের বীজ।

রতনটি হচ্ছে, ড.আতিয়্যাহ বিন আতিয়্যাহ আল-মুযাইনি লিখিত গ্রন্থাগার গবেষণা পদ্ধতি শীর্ষক প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার একটি মুযাককিরা বা নোট। এতে মূলত গবেষণার নীতি-পদ্ধতি, তথ্যসূত্র ও তথ্যগ্রন্থ ব্যবহারের কৌশল, গবেষণা- লেখন পদ্ধতি এবং গ্রন্থাগারের ভূমিকা, প্রয়োজনীয়তা এবং গ্রন্থাগারের প্রকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

যখনই গ্রন্থাগারের প্রকার দেখলাম সাথে সাথে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই পড়তে থাকলাম। এক পর্যায়ে দেখলাম লেখা المكتبة المتنقلة এবং এর অধীনে  লেখা-

حيث كان بعض العلماء , يتجول في أنحاء العالم الإسلامي , و يحمل معه ما استطاع من كتب، يفيد منها هو و يستفيد منها غيره ممن يمر عليه, كما فعل الصاحب بن عباد، حيث كان يصطحب معه أثناء سفره من الكتب ما حمولته عشرة جمال,وكذلك المكتبة المتنقلة للسلطان أبو عنان من ملوك المغرب الأقصى التي بلغت عدتها ثمانين مجلدا.

কিছু আলেম ছিলেন, যারা ইসলামী বিশ্বের দেশে দেশে ঘুরতেন। সাথে সাধ্যমত কিতাব বহন করতেন, যা থেকে তিনি নিজেও উপকৃত হতেন এবং অন্যরাও উপকৃত হত। তাদের অন্যতম হলেন ছাহিব ইবনে আববাদ (৩২৬ হি./৯৩৮ ঈ.-৩৮৫ হি./৯৯৫ ঈ.)। সফরের সময় তাঁর ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারে দশ উট পরিমাণ কিতাব থাকত। অনুরূপভাবে মরক্কোর সুলতান আবু আনানের গ্রন্থাগারটিও উল্লেখযোগ্য। তার এই গ্রন্থাগারের গ্রন্থ সংখ্যা ছিল ৮০ ভলিউম। এই তথ্যটি পেয়ে সাথে সাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করলাম। তথ্যটি পাওয়ার  নেয়ামতের এবং সত্যিকারেই যে এর উদ্যোক্তা বা আবিষ্কারক একজন মুসলিম মনীষী এবং আরবী ভাষাবিদ-এ নেয়ামতের শুকরিয়া। আর সব নেয়াতম তো আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকেই। আলহামদুলিল্লাহ। সেই থেকে ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার নিয়ে নতুন করে ভাবা শুরু। কিন্তু এই দুই লাইনের আলোচনায় কোন তথ্য সূত্র না থাকায় ভাবতে থাকলাম যে বীজ যেহেতু পেয়েছি সুতরাং আরো অনেক কিছুই পাবো ইনশাআল্লাহ। তবে দরসের প্রতিদিনের পড়া বা বিভিন্ন গবেষণাপত্র তৈরীতে ব্যস্ত থাকায় এ বিষয়ে আর কিছু দেখা হয়নি।

কিছুদিন পরেই ১৪২৮ হিজরীর হজ্ব। হজ্বের সফরে আসলেন উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা আব্দুল মালেক দামাত বারাকাতুহুম। উস্তাযে মুহতারামের সোহবতে মদীনায় দীর্ঘ আট দিনে বেলা হিসাব উপকৃত হয়েছি। হাঁটা চলা, কোথাও যাওয়ার সময় বিভিন্ন ইলমী আলোচনা চলতো, বিভিন্ন কিতাব নিয়ে আলোচনা হতো আর বিভিন্ন মাকতাবায় গিয়ে কিতাব কেনা হতো। সে অনেক কথা।

এই ইলমী আলোচনার মাঝেই একদিন বিষয়টি উস্তাযকে জানালাম। তিনি পুলকিত হলেন। বললেন মাশাআল্লাহ একেবারেই নতুন তথ্য। নতুন একটি বিষয়। সুতরাং এ বিষয়ে আরো বহছ অনুসন্ধান করতে থাকো। আশা করি এধরনের একটি নতুন তথ্য পেয়ে সকলেই আনন্দিত হবে। আর তোমার জন্য রয়েছে নতূন বিষয় আবিষ্কারের আনন্দ এবং আজরে আজীম।

তার উৎসাহ প্রদানে নতুন করে সাহস পেলাম। গ্রন্থাগার-বিজ্ঞান বিষয়ক মসজিদে নববীর কিতাবগুলো মুতালাআ শুরু করলাম। কিছু কিছু গ্রন্থে আধুনিক সময়ের আবিষ্কারের কথা থাকলেও অধিকাংশ গ্রন্থেই বিশিষ্ট আলেম, ভাষাবিজ্ঞানী ছাহিব ইবনে আববাদের নাম উল্লেখ রয়েছে। এই গ্রন্থাগার নিয়ে তিনি কোথায় কীভাবে সফর করতেন, ছাত্ররা কীভাবে এর থেকে উপকৃত ও ইস্তেফাদাহ করতো এবং এই গ্রন্থাগারের কিতাব সংখ্যা কত তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া রয়েছে। দীর্ঘ এই বহছ ও গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পেরেছি যে ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার আধুনিক সময়ের কিংবা কোন অমুসলিম বা কোন মুসলিম সাধারণ মানুষের আবিষ্কার নয়। বরং তা একজন মুসলমান আলেমের আবিষ্কার।

অতএব এই ছাহিব ইবনে আববাদই হলেন ‘মাকতাবা মুতানাক্কিলা’ বা ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারের আবিষ্কারক। এবং বলা যায় ছাহিব ইবনে আববাদ ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারের জনক।

ছাহিব ইবনে আববাদের পুরো নাম ইসমাইল ইবনে আববাদ ইবনে আল আববাস আবুল কাসেম আতত্বালকানী। ছাহিব ইবনে আববাদ নামেই তিনি অধিক পরিচিত। তিনি ৩২৬ হিজরী (৯৩৮ ঈ.) তে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩৮৫হিজরী (৯৯৫ ঈ.) তে মৃত্যু বরণ করেন।

তিনি একাধারে ছিলেন মন্ত্রী, লেখক, সাহিত্যিক এবং ইলম, আমল, ফজল ও চিন্তা চেতনায় সময়ের উজ্জ্বল নক্ষত্র।

মুআইয়িদুদ্দৌলা ইবনে বুইয়াহ আদদাইলামী তাকে ওজীর বা মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন। পরবর্তীতে তার ভাই ফখরুদ্দৌলাও তাকে মন্ত্রী পদে বহাল রাখেন। ছোট সময় থেকে মুআইয়িদুদ্দৌলার সঙ্গী ও সাথী থাকায় তিনি ‘আসছাহিব’ (সাথী) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। কাজওয়ীনের তালক্বান নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সে কারণেই তাকে ত্বালকানী বলা হয়। বর্ণাঢ্য জীবন শেষে তিনি রিহ নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন এবং ইসপাহান শহরে তাকে দাফন করা হয়। তাঁর রচিত অনেক গ্রন্থ রয়েছে। এর  অধিকাংশই ভাষা বিষয়ক। তবে তার রচিত ‘আলমুহীত’ অভিধানটি আরবী ভাষার একটি মূল্যবান ও প্রসিদ্ধ অভিধান। এছাড়াও তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে

الوزراء ,الكشف عن مساوئ المتنبي ,الاقناع في العروض والقوافي,عنوان المعارف وذكر الخلائف

প্রভৃতি। এই প্রবন্ধে তার পুরো জীবনী আলোচনা উদ্দেশ্য নয়। পাঠক এ ব্যাপারে আরো ব্যাপক ধারণার জন্য দেখতে পারেন-মুজামুল বুলদান, আল আলাম, যিরিকলী এবং ওফায়াতুল আয়ান।

ফিরে আসি আমাদের মূল আলোচনায়। এবং জানতে চেষ্টা করি কীভাবে তিনি মাকতাবা মুতানাক্কিলার জনক , কেমন ছিলো তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার এবং তিনি ছাড়া আর কাদের ছিলো এ ধরনের ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার?

ছাহিব ইবনে আববাদ স্বভাবগতভাবে ছিলেন জ্ঞান ও গ্রন্থপ্রিয় একজন মানুষ। অধ্যয়নের সাথে সাথে গ্রন্থ সংগ্রহে তার শিক্ষকের চেয়েও কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিলেন তিনি। ইয়াকুত হামাবী তার গ্রন্থে বলেন-ঈসমাইল ইবনে আববাদ (৩৮৫/৯৯৫ ঈ.) ছাহিব ইবনে আববাদ নামে প্রসিদ্ধ। কারণ তিনি ইবনুল আমিদের সাথী ছিলেন। কিতাবের প্রতি ভালোবাসা ও কিতাব সংগ্রহের ক্ষেত্রে তাঁর উস্তাজের চেয়েও অগ্রজ ছিলেন। (মুজামুল বুলদান ৪/৮৪,  আলমাকতাবাতু ফিল ইসলাম পৃ. ৮৯)

কিতাব মুতালাআ ও অধ্যয়ন ছাড়া তার যেন সময়ই কাটতো না। তাই সফরে  হযরে, ঘরে-বাইরে তার কাছে কিতাব থাকা চাই-ই চাই। ঘরে তো সব সময় প্রয়োজনীয় গ্রন্থ সরবরাহ সম্ভব কিন্তু ভ্রমণ-অবস্থায় কিতাব পাবেন কোথায়। সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে দরসে ছাত্রদের বিভিন্ন কিতাবের সাথে পরিচয় করাতেও কিতাবের প্রয়োজন। এই চিন্তা এবং কিতাবের প্রতি এ ধরনের ভালোবাসা থেকেই তাঁর ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারের সৃষ্টি। তিনি কোথাও সফরে বের হলে সাথে উট ও ঘোড়ায় কিতাব সাজিয়ে গ্রন্থাগার বানিয়ে তারপর বের হতেন। কখনো কখনো এর সংখ্যা দাড়াতো ৩০ উট কখনো ৪০ উট। নিজে ভ্রমণকালে মুতালাআ করতেন। তাদরীস ও আলোচনার জন্য প্রস্ত্ততি নিতেন। আর যখন ছাত্রদের সামনে কোন পুরাতন পান্ডুলিপি বা তথ্যসূত্রের নাম বলতেন তখন ছাত্ররা সাথে সাথে উটের পিঠে থাকা কিতাবগুলো থেকে বের করে তা দেখে নিতো। এ ছাড়া তালিবুল ইলম তার এই মাকতাবা থেকে আরো বিভিন্নভাবে উপকৃত হতো।

প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান আবুল ফরয ইস্পাহানির জীবনী আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন-

و حكي عن الصاحب بن عباد أنه كان في أسفاره و تنقلاته يستصحب معه حمل ثلاثين جملا من كتب الأدب ليطالعها.

ছাহিব ইবনে আববাদ তার সফর ও ভ্রমণের সময় অধ্যয়ন ও মুতালাআর জন্য ত্রিশ উট বোঝাই সাহিত্যের কিতাব সাথে নিতেন। (ওফায়াতুল আয়ান ৩/৩০৭-৩০৮; আলমাকতাবাতু ফিল ইসলাম পৃ. ৯০)

তাছাড়া তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের  কিতাবের সংখ্যাও ছিল অনেক। ভাষা সাহিত্য ও ইলমের প্রতি তার বিশেষ অনুরাগ ও ভালবাসার ফলেই তিলে তিলে গড়ে ওঠেছে এই বিশাল গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারের কিতাব সংখ্যা  নির্ধারণ করতে গিয়ে ইয়াকুত হামাবী বলেন -

كانت مكتبة الصاحب ابن عباد تشتمل على مأتين و ستة آلاف مجلد

ছাহিব ইবনে আববাদের মাকতাবায় প্রায় ছয় হাজার দুই শত ভলিউম কিতাব ছিল। (মুজামুল বুলদান ৫/১৫০)

ছাহিব ইবনে আববাদের এই পুরো ঐতিহাসিক মাকতাবাটি ঘুরতে গিয়েছিলেন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবুল হাসান বায়হাকী রহ. তিনি সেখানে সেই মাকতাবার সমস্ত কিতাবের শুধু ক্যাটালগই দেখেছেন ১০ ভলিউম।

ছাহিব ইবনে আববাদের এই ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার ছাড়াও পরবর্তীতে আলেম-ওলামাদের মাধ্যমে এ জাতীয় আরো অনেক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে মরক্কোর সুলতান আবু আনানের মাকতাবাটি ছিল প্রসিদ্ধ। সফরে বের হলে তিনি প্রয়োজন অনুসারে গ্রন্থ সঙ্গে নিয়ে বের হতেন। তার এই গ্রন্থাগারের গ্রন্থসংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ ভলিউম। (দ্রষ্টব্য : আলমাকতাবাত ফিল ইসলাম পৃষ্ঠা ১৪৬)

পরবর্তী কোন প্রবন্ধে এ জাতীয় গ্রন্থাগার ওলামাদের মাঝে আর কার ছিলো, বর্তমানে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে আর কোথায় এ জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং এ জাতীয় গ্রন্থাগারের লক্ষ্য উদ্দেশ্য, ধরন-প্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।

এ ছাড়া আমরাও কীভাবে একটি সমৃদ্ধ ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত করে আমাদের ওলামাদের ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে ইলম এর খেদমত করতে পারি, তালিবুল ইলমদেরকে তলবুল ইলমে উদ্বুদ্ধ করতে পারি, মারাজে মাছাদের ও তথ্যসূত্রের সাথে পরিচয় করাতে পারি, মানুষের দ্বারে দ্বারে ইসলামের আলো পৌঁছানোর মাধ্যমে মানুষকে সত্যিকারের ‘‘আলোকিত মানুষ’’ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি সেই আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।

সব শেষে বলা যায় যে , ছাহিব ইবনে আববাদের এই গ্রন্থাগারটি ইতিহাসের প্রথম সমৃদ্ধ ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার। এর পূর্বে কোথাও এ জাতীয় সমৃদ্ধ মাকতাবা ছিল বলে জানা যায়নি। তাই কোনভাবেই বলার সুযোগ নেই যে, ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারের সূচনা হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকায়। অন্যান্য জ্ঞান বিজ্ঞানের মতই এর আবিস্কার হয়েছে একজন আলেমে দ্বীন মুসলিম মনীষীর হাতে। তবে আমাদের দূর্ভাগ্য আমরা এ সমস্ত ক্ষেত্রে বরাবরের মতই পিছিয়ে পড়ি। অধঃপতন আমাদের পিছু ছাড়ে না। আমাদের আসলাফ ও পূর্বসুরীদের এ ধরনের যুগান্তকারী ভূমিকা থেকে বিধর্মিরা উপকৃত হয়, সামাজিক কার্যক্রমে অনন্য ভূমিকা পালন করে এবং এক সময় নিজেদেরকে এধরনের ভূমিকার আবিষ্কারক বলে দাবি করে। আর আমরা নিজেরাই কেন যেন নিজেদের বিচরণের ক্ষেত্রগুলোকে সংকুচিত করে সন্তুষ্ট থাকি। এধরনের কাজ আমাদের জন্য নয় বলে আত্মতৃপ্তি অনুভব করি।

কিন্তু আমরা কি পারি না অন্তত ছোট্ট একটি বাসের মাধ্যমে কিছু কিতাব সাজিয়ে এ ধরনের মাকতাবা শুরু করতে। যার মাধ্যমে আমরা তালিবুল ইলমকে বিভিন্ন তথ্যগ্রন্থগুলোর সাথে পরিচয় করাতে পারবো। অধিক পরিমাণে কিতাবের সাথে পরিচয় করিয়ে মুতালাআ ও অধ্যয়নে উদ্বুদ্ধ করণের মাধ্যমে আরো সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবো। অথবা জনসাধারণের উপযোগী দ্বীনী বই ও কিতাবের ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারের মাধ্যমে তাদেরকে দ্বীনী জ্ঞান অর্জনে উদ্ধুদ্ধ ও সহায়তা করব। কেউ কি এগিয়ে আসবে এই চমৎকার এবং প্রয়োজনীয় খেদমতটি আঞ্জাম দিতে? আল্লাহ তাওফীক দান করুন। আমীন।

অধ্যয়নরত, ভাষা বিজ্ঞান বিভাগ

মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়