মাওলানা গিয়াস উদ্দীন শায়খে বালিয়া রাহ.
কয়েক মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন শীর্ষ আলেম চলে গেলেন। এই মিছিলে সর্বশেষ যোগ দিলেন হযরত মাওলানা গিয়াস উদ্দীন শায়খে বালিয়া (রহ.)। ৭৫ বছর বয়সে তিনি পরপারে চলে যান। এদেশের সমকালীন শীর্ষস্থানীয় আলেমগণের মধ্যে তাঁর নাম সর্বজনবিদিত। ১৯৩৮ ঈ. সনে মোমেনশাহী জেলার ফুলপুর থানাধীন বালিয়া গ্রামের পাঠানপাড়ায় এক ধার্মিক ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম তৈয়ব উদ্দীন পাঠান ও মাতার নাম হাসনা বানু বেগম। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তৎকালীন সময়ে আদর্শ, সততা ও ধর্মপরায়ণতায় এ পরিবারটি ছিল বিশেষ ঐতিহ্যের অধিকারী।
পিতার একান্ত ইচ্ছা ছিল ছেলেকে একজন আদর্শ, চরিত্রবান সত্যিকারের দ্বীনের খাদেম হিসেবে গড়ে তোলার। তাই নিজের আকাঙ্খা পূর্ণ করার পদক্ষেপ হিসেবে তিনি ছেলেকে প্রাথমিক পড়াশোনার জন্য গ্রামের দ্বীনদার বড় আলেম মাওলানা আকবর আলী (রহ.)-এর হাতে তুলে দিলেন। বালক গিয়াস উদ্দীন তার কাছেই কায়দা, আমপারা, উর্দু ও আরবী ভাষার প্রাথমিক কিতাবাদি পাঠ করেন। এরপর তাকে ভর্তি করে দেয়া হলো একই গ্রামে অবস্থিত দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী আশরাফুল উলূম বালিয়া মাদরাসায়। বালিয়া মাদরাসায় পড়াশোনাকালে যে সকল ইলমী ও আমলী উস্তাদের সংস্পর্শে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন, তারা সকলেই ছিলেন একেকটি প্রতিষ্ঠান। এদেশের আলেম উলামাগণের মধ্যে তারা ছিলেন একেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। মাওলানা দৌলত আলী (রহ.), মাওলানা লোকমান আলী (রহ.), মাওলানা মুফতী আব্দুল ওয়াহিদ (রহ.), মাওলানা নূরুদ্দীন গহরপুরী (রহ.) প্রমুখ খ্যাতনামা বুযুর্গের সান্নিধ্যে থেকেই তিনি হেদায়া জামাত পর্যন্ত অব্যাহতভাবে বালিয়া মাদরাসায় পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হয়ে কিছুদিন পড়াশোনার পর সেখানকার আবহাওয়া তাঁর স্বাস্থ্যের অনুকূল না হওয়ায় চলে আসেন তাঁর দীর্ঘদিনের উস্তাদ হযরত মাওলানা নূর উদ্দীন আহমাদ গহরপুরী (রহ.)-এর নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত সিলেটের গহরপুর মাদরাসায়। উল্লেখ্য, হযরত গহরপুরী (রহ.) বালিয়া মাদরাসায় থাকাকালীন তার জন্য বালিয়ার হযরত (রহ.)-এর বাড়ি থেকে নিয়মিত খাবার-দাবার আসতো এবং তিনি তাঁদের বাড়িতে থাকাকালে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। গহরপুরী হযরতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা তখন থেকেই ছিলো অত্যন্ত গভীর। গহরপুর মাদরাসায় তিনি ভর্তি হয়ে তাঁর তত্ত্বাবধানেই দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। গহরপুরে থাকাকালে তিনি গহরপুরী হযরতের পরিবারভুক্ত সদস্যের মতই লালিত-পালিত হয়েছেন।
তাঁর মেধা ও স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। কঠিন বিষয়গুলো তিনি সামান্য অধ্যয়নেই আয়ত্ত করে ফেলতে পারতেন। কুরআন এবং হাদীসের ইলমে তাঁর অগাধ দখল ছিলো। গহরপুর মাদরাসা থেকে ১৩৮১ হিজরী সনে সিলেট কওমী মাদরাসা বোর্ডে ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি উত্তীর্ণ হন। গহরপুরী হযরতের নির্দেশে তিনি গহরপুর মাদরাসায়ই মুহাদ্দিস হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দীর্ঘ ৭/৮ বছর তিনি সেখানেই কৃতিত্বের সঙ্গে মুহাদ্দিসের দায়িত্ব পালন করেন। এরই মধ্যে বালিয়া মাদরাসায় নতুন একজন মুহাদ্দিস প্রয়োজন হওয়ায় হযরত মাওলানা দৌলত আলী (রহ.) ১৯৬৭ ঈ. সনে সশরীরে গহরপুর গিয়ে গহরপুরী হযরতের অনুমতি সাপেক্ষে তাঁকে বালিয়া মাদরাসার মুহাদ্দিস হিসেবে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে হযরত মাওলানা দৌলত আলী (রহ.) শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ায় ১৯৮০ ঈ. সনে তিনি নিজ হাতে প্রিয় ছাত্র শায়খে বালিয়াকে মাদরাসার মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করেন। সময়ের সাথে সাথে তাঁর কর্মব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় তিনি নিজে ২০০০ ইং সনে মাদরাসার দায়িত্বপূর্ণ মুহতামিম পদ ছেড়ে দিয়ে ছদরুল মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস হিসেবে সেখানেই আজীবন অধিষ্ঠিত ছিলেন।
তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে তিনি গোটা দেশের বিশেষ করে বৃহত্তর মোমেনশাহী ও সিলেটের বিভিন্ন কওমী মাদরাসার শায়খুল হাদীস ও মজলিসে শূরার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সহ-সভাপতি ও মজলিসে শূরার অন্যতম সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ ধরে বৃহত্তর মোমেনশাহীর আলেম উলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষের অন্যতম প্রধান মুরুবিব ছিলেন তিনি।
রাজনৈতিক ময়দানে স্বীয় পীর ও মুর্শিদ অল্লামা গহরপুরীর অনুসরণে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। জমিয়তের কেন্দ্রীয় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তাঁর নাম ছিলো। মোমেনশাহী জেলা জমিয়তের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন কিছুদিন। এছাড়াও ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হিসেবে রাজনৈতিক ময়দানে তাঁর সরব অংশগ্রহণ ছিলো।
বৃহত্তর মোমেনশাহীর আলেম-উলামাদের বৃহত্তর অরাজনৈতিক সংগঠন ইত্তেফাকুল উলামার মজলিসে শূরার সভাপতি ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় জাতীয় ও আঞ্চলিক ইস্যুতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলন, কুখ্যাত তসলিমা নাসরিন বিরোধী গণআন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন অন্যতম প্রধান অগ্রসেনানী।
আধ্যত্মিক জীবনে সর্বজনস্বীকৃত ওলী হযরত মাওলানা নূরুদ্দীন আহমাদ গহরপুরী (রহ.) ছিলেন তাঁর একান্ত উস্তাদ এবং আধ্যাত্মিক রাহবার। তিনি তাঁর জীবন গড়ার মূল কারিগর ছিলেন। তিনি তাঁর উস্তাদ ও পীর সম্পর্কে নিজের অনুভূতির কথা লিখেছেন এভাবে, ‘‘আমার জীবনে হযরত নূরুদ্দীন গহরপুরী (রহ.)-এর অবদান ও অনুগ্রহের কথা আমি বলে শেষ করতে পারব না। আমার জীবন গঠন ও ইলমে দ্বীন হাসিলের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা তাঁর। তিন বছর তাঁর কাছে পড়েছি। এরপর সাত বছর তাঁর অধীনে শিক্ষকতা করেছি। সারা জীবন তাঁর অনুগ্রহ বয়ে চলেছি।’’ আল্লামা গহরপুরীর (রহ.) ইন্তেকালের পর মাওলানা গিয়াস উদ্দীন (রহ.) ছিলেন তাঁর প্রধান মুখপাত্র। এছাড়াও উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ বুযুর্গ আওলাদে রাসূল হযরত মাওলানা হোসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.)-এর অন্যতম খলীফা মাওলানা হাবীবুর রহমান রায়পুরী (রহ.)-এর আধ্যাত্মিক শিষ্যও ছিলেন তিনি। পীরে কামেল আল্লামা নূরুদ্দীন গহরপুরী (রহ.) ও আল্লামা হাবীবুর রহমান রায়পুরী (রহ.)-এর যৌথ খেলাফতে ধন্য হন মাওলানা গিয়াস উদ্দীন (রহ.)।
বছরের বেশিরভাগ সময় তিনি দেশের নানা জায়গায় সফরে থাকতেন। এসব সফরের বেশির ভাগই ছিলো ধর্মীয় এবং ইসলাহী মাহফিলে অংশগ্রণের জন্য। তিনি এসব মাহফিলে দ্বীনী এবং ইসলাহী বয়ান করতেন। বহু মানুষ তাঁর হাতে বায়আত হতেন। ইসলাহী তা’লীম গ্রহণ করতেন। এজন্য পাকিস্তান, লন্ডনসহ বহু দেশ তিনি সফরও করেছেন। হজ্বের সফর করেছেন দু’বার। মাওলানা গিয়াস উদ্দীন (রহ.) জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্যয় করেছেন নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের তদবীর প্রদানে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত রোগী ছুটে যেতো তাঁর দরবারে চিকিৎসার জন্য। তিনি দরদ দিয়ে তাদের সেবা দিতেন। ঝাঁড়ফুক করতেন। আল্লাহর পবিত্র কালামের ওসিলায় অসংখ্য অভিনব প্রকৃতির রোগী তাঁর মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করতো। একবারের ঘটনা, ঢাকার রমনা থেকে জনৈক রোগীকে তার আত্মীয়রা নিয়ে গেলো তাঁর দরবারে। সমস্যা ছিলো, হঠাৎ করে একদিন ঐ রোগীর মুখের যবান বন্ধ হয়ে গেলো। তিনি কোন কথা বলতে পারছিলেন না। দেশে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা দিয়েও কোন সুফল না পেয়ে শায়খে বালিয়ার দরবারে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি আল্লাহর কালাম পড়ে ঐ রোগীর গায়ে দম দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের যবান চালু হয়ে গেলো। আল্লাহু আকবার! এ ধরনের বহু ঘটনা তাঁর জীবনে। তিনি এই চিকিৎসার অনুমতি পেয়েছিলেন তাঁর পীর আল্লামা হাবীবুর রহমান রায়পুরী (রহ.)-এর নিকট থেকে।
প্রায় ৪ বছর আগে লন্ডন সফরকালে তিনি প্রথম ব্রেইনস্ট্রোকে আক্রান্ত হন। চিকিৎসায় দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন। কিছুটা দুর্বলতা সত্ত্বেও স্বাভাবিক কাজকর্ম করে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে গত ১ ফেব্রুয়ারি রাতে বালিয়া মাদরাসার বার্ষিক সভা চলাকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ শরীর নিয়েই প্রথা অনুযায়ী সভার লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে খতমে বুখারীর দরস দিয়ে রাত ১২টায় তিনি মোনাজাত পরিচালনা করেন। অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় তাৎক্ষণিক তাঁকে
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলে সেখানেই ভোর ৫ টা ২০ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ৮ ছেলে, ১২ মেয়েসহ অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী রেখে গেছেন। তাঁর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রমাণ পাওয়া গেছে ওই দিন বাদ আসর নামাজে জানাযায় লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে। বালিয়ার ঐতিহাসিক মাঠে প্রিয় শায়েখের লাশ কাঁধে নিয়ে ভক্ত-মুরিদান ব্যাকুল হয়ে কেঁদেছেন। বালিয়া মাদরাসাসংলগ্ন মসজিদের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়েছে। আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁর সারা জীবনের খেদমত কবুল করুন এবং তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের আ’লা মাকাম দান করুন। আমীন।