Jumadal Ula 1434   ||   March 2013

আমাদের রাজ্যশাসন-৬

মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী

৬ষ্ঠ হিজরী : রাজা-বাদশাহ্দের প্রতি ইসলামের দাওয়াত জানিয়ে পত্র প্রেরণ

হুদাইবিয়া সন্ধির পর মক্কার কাফেরদের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। এই সুযোগে তিনি পার্শ্ববর্তী রাজা-বাদশাহদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর ইচ্ছা করলেন এবং তাদের নিকট পত্র প্রেরণ করলেন। হযরত দিহয়া কালবী রা.কে রোম-সম্রাট কায়সারের নিকট, আবদুল্লাহ ইবনে হুযাফা রা.কে ইরানের বাদশাহ খসরূ পারভেজের নিকট, হাতিব ইবনে আবী বালতাআ রা.কে মিসরের গভর্ণরের (আযীযে মিসর) নিকট, আমর ইবনে উমাইয়্যা রা.কে হাবশার বাদশাহ নাজাশীর নিকট, সালীত ইবনে আমর রা.কে ইয়ামামার সর্দারদের নিকট ও শুজা’ ইবনে ওয়াহাব রা.কে হারিস গাসসানীর নিকট পত্র পৌঁছানোর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

৭ম হিজরী : খায়বর যুদ্ধ

খায়বর মদীনা ও শামের মধ্যবর্তী একটি অঞ্চল। এটি ছিল ইহুদীদের একটি যুদ্ধকেন্দ্র। এখানে তাদের অনেকগুলো দূর্গ ছিল। কোনো অঞ্চলে মুসলমানের আগমন ঘটলে সেখানকার ইহুদীরা খায়বর চলে আসত এবং এখানে বসতি স্থাপন করত। আর তাদের সর্দাররা আরব নেতাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য উদ্ধুদ্ধ করতে থাকত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে সন্ধির ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু তারা সম্মত হল না। ফলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আবশ্যক হয়ে গেল। অবশেষে ৬ষ্ঠ হিজরীর শেষ কিংবা ৭ম হিজরীর শুরুর  দিকে মুসলিমগণ খায়বর আক্রমণ করেন। ইহুদীরা দূর্গের ভেতর সুরক্ষিত হয়ে যুদ্ধ করতে লাগল। এভাবে মুসলমানদেরকে এক একটি করে দূর্গ জয় করতে হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ লড়াই করে মুসলিমগণ সব কটি দূর্গ দখল করে নেন। এই যুদ্ধে ৯৩ ইহুদী নিহত হয়।

যুদ্ধ শেষে ইহুদীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে খায়বরের ভূমি চাষাবাদের জন্য তাদেরকে দেওয়া হয়। আর মুসলমানগণ শুধু মালিকানা লাভেই সন্তুষ্ট থাকেন।

৮ম হিজরী : মক্কা বিজয়

আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে তাওহীদের শিক্ষার বিস্তার, মূর্তিপূজা নির্মূল ও প্রিয় ঘর কাবাকে মূর্তিপূজার পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত কুরাইশ পৌত্তলিকরা তা পূর্ণ হতে দেয়নি। কাবা গৃহে ছিল ৩৬০টি মূর্তি। তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশ বছর মেয়াদী হুদাইবিয়া সন্ধির কারণে এ নিয়ে ত্বরা করেননি। কিন্তু কুরাইশরাই সন্ধি ভঙ্গ করে তাঁকে মক্কা আক্রমণে বাধ্য করে।

বনু খুযাআহ ছিল মুসলমানের মিত্র। ফলে সন্ধির কারণে বনু খুযাআহর উপর আক্রমণের অধিকার কুরাইশের ছিল না। অন্যদিকে বনু বকর ছিল বনী খুযাআহর শত্রু। কিন্তু বনু বকরের সাথে মিত্রতার কারণে কুরাইশও বনু খুযাআহর উপর আক্রমণ করে বসে। হেরেমের সীমানার ভিতর কাবায় তাদের রক্ত ঝরায়। এই ধৃষ্টতার পরও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিশোধ নেন না। তিনি কুরাইশের নিকট লোক পাঠালেন, তারা যেন নিরপরাধ নিহতদের রক্তপণ পরিশোধ করে অথবা বনু বকরের মিত্রতা ত্যাগ করে। অন্যথায় যেন চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয়। কুরাইশরা তৃতীয় প্রস্তাবটি গ্রহণ করল এবং জানিয়ে দিল যে, চুক্তি রহিত।

এই স্পষ্ট জবাবের পর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ৮ম হিজরীর রমযান মাসে ১০ হাজার সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা হলেন। মুসলিমদের সেই দুর্বল অবস্থা আর নেই। সংখ্যায় তাঁরা অনেক। যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জামও যথেষ্ট। ফলে তাদেরকে প্রতিহত করার ক্ষমতা কুরাইশের ছিল না। তাই সামান্য কিছু আক্রমণ-চেষ্টা প্রতিহত করেই তারা মক্কায় প্রবেশ করলেন। তাদের প্রতাপ ও জৌলুস দেখে কুরাইশের বড় বড় নেতারাও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল।

এই বিজয়ের মুহূর্তে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী করলেন? তাদেরকে অভয় দিলেন। বললেন, ভয়ের কিছু নেই, তোমরা নিশ্চিন্ত থাক। এরপর  তিনি কাবা শরীফ তাওয়াফ করলেন এবং সবকটি মূর্তি বের করলেন। এরপর মক্কার সব মানুষকে একত্র করলেন এবং তাদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন।

কী আশ্চর্য পরিবর্তন! একটা সময় ছিল তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। কুরাইশের প্রতিটি লোক ছিল তাঁর রক্ত পিপাসু। কিন্তু আজ? হাতের এক ইশারায় জীবন উৎসর্গকারী দশ হাজার সাহাবী তাঁর সাথে। শত্রু আজ তাঁর হাতের মুঠোয়। তাঁর এক আদেশে তাদের মস্তক ধর থেকে হয়ে যাবে। কিন্তু তিনি তো ছিলেন আল্লাহর নবী। সমগ্র দুনিয়ার জন্য শান্তি ও করুণা হয়েই তাঁর আগমন। তাঁর পক্ষে প্রতিশোধ গ্রহণ কীভাবে সম্ভব?

তিনি সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন এবং ঘোষণা করলেন, যাও! তোমরা সবাই স্বাধীন। আবু সুফিয়ান-যে ছিল ইসলামের ঘোরতর শত্রু, সব সময় যে ইসলামের ক্ষতি করেছে, সকল যুদ্ধেই যে ছিল সর্বাগ্রে-তাকেও আল্লাহর রাসূল ক্ষমা করে দিলেন। শুধু ক্ষমাই নয়; বরং তাকে সম্মান দিয়ে ঘোষণা করলেন, আবু সুফিয়ানের ঘরে যে আশ্রয় নিবে সে-ও ক্ষমাপ্রাপ্ত।

কুরাইশের প্রতি এই দয়া ও অনুগ্রহের সুফল এই হল যে, তাদের এক বিরাট অংশ মুসলমান হয়ে গেল।   

    (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

অনুবাদ : আবদুল্লাহ ফাহাদ

 

advertisement