Jumadal Ula 1434   ||   March 2013

নবী নামের প্রতি সম্মান ঈমানের অংশ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

এ লেখাটি আলকাউসার ডিসেম্বর ০৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে তা পুনর্মুদ্রণ করা হল। আশা করি, পাঠকবৃন্দ এখানে প্রয়োজনীয় অনেক প্রশ্নের জবাব পাবেন।-সম্পাদক

 

আল্লাহর বান্দাদের উপর আল্লাহর নবী খাতামুন্নাবিয়ীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক হক রয়েছে। সবচেয়ে বড় হক হল তাঁর প্রতি অন্তর থেকে ঈমান আনা এবং পিতামাতা, সন্তান-সন্ততি এমনকি নিজ প্রাণের চেয়েও অধিক তাঁর প্রতি মহববত রাখা। তাঁর যথাযথ সম্মান করা এবং অনুসরণ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল দ্বীনী আকীদাকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি সত্যিকারের মহববত আর যথাযথ তা‘জীম ও সম্মান হচ্ছে ঈমানের জন্য অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু শিক্ষার নিছক অনুসরণ ঈমানদারীর জন্য যথেষ্ট নয়। পশ্চিমা দুনিয়াও তাদের পার্থিব স্বার্থে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক শিক্ষা অনুসরণ করে থাকে। এমন অনুসরণ কখনো যথেষ্ট নয়। বরং তাঁর শর্তহীন আনুগত্য মেনে নেওয়া, তাঁর আদব-ইহতিরাম এবং মহববত ও ভালোবাসা হচ্ছে ফরয এবং ঈমানের অপরিহার্য অংশ। এটা ছাড়া ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়। এ প্রসঙ্গে মনে রাখার মতো একটি সংক্ষিপ্ত কথা এই যে, আল্লাহকে ভালোবাসার মানদন্ড আল্লাহ নিজেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বানিয়েছেন। কেউ যদি আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে চায় তবে এর একমাত্র পথ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মহববত রাখা এবং তাঁর আনুগত্য অবলম্বন করা। এ মানদন্ডে উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া আল্লাহকে ভালোবাসার দাবি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ

মুমিনের হৃদয়ে নবী-মহববত কী পরিমাণ থাকা উচিত-এ প্রশ্নের উত্তর খোদ কুরআন মজীদে এসেছে-

النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ

অর্থাৎ নবীর সঙ্গে ঈমানদারের প্রাণেরও অধিক সম্পর্ক। তিনি তাদের সত্তা থেকেও তাদের কাছে অগ্রগণ্য। (সূরা আহযাব : ৬)

মুমিনের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মুমিনের যে সম্পর্ক তার প্রকৃতিই ভিন্ন, মাহাত্ম্যই আলাদা। এই সম্পর্কের সঙ্গে পার্থিব কোনো সম্পর্কের কোনো তুলনাই হতে পারে না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানদারের জন্য তার পিতামাতার চেয়েও অধিক মেহেরবান আর তার নিজের চেয়েও অধিক কল্যাণকামী। উম্মতের ঈমানী ও রূহানী অস্তিত্ব নবীর রূহানিয়াতেরই অবদান। যে মমতা ও প্রতিপালন নবীর পক্ষ থেকে উম্মত লাভ করেছে এর কোনো নমুনা গোটা সৃষ্টি-জগতের মধ্যেও পাওয়া যাবে না। পিতামাতা এর দৃষ্টান্ত হতে পারেন না। পিতার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে দান করেছেন দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন আর নবীর মাধ্যমে হাসিল হয় চিরস্থায়ী ‘হায়াত’। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের এরূপ সহানুভূতি ও কল্যাণকামিতার সঙ্গে প্রতিপালন করে থাকেন যে সহানুভূতি ও কল্যাণকামিতা আমাদের নিজ সত্তার পক্ষেও সম্ভব নয়। স্ত্রী-সন্তান এমনকি পিতামাতাও অজ্ঞতা বা অসচেতনতার কারণে কখনো আমাদের ক্ষতির কারণ হতে পারে, ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে, কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে সর্বদা ওই পথই দেখিয়ে থাকেন, যে পথে রয়েছে তাদের প্রকৃত সফলতা। মানুষ নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করে, নির্বুদ্ধিতার কারণে নিজের ক্ষতি সাধন করে, কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে ওই নির্দেশই দান করেন যাতে বাস্তবিকই তার কল্যাণ রয়েছে। এজন্য উম্মতের উপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হক্ব প্রতিষ্ঠিত যে, তাঁকে নিজের পিতামাতা, স্ত্রীসন্তান এবং প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবাসবে। নিজের মতামতের উপর তাঁর মতামতকে এবং নিজের সিদ্ধান্তের উপর তাঁর সিদ্ধান্তকে অগ্রগণ্যতা দেবে। আর তাঁর আদেশকে শিরোধার্য করবে।

আমাদের জান-মাল সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এরূপ অধিকার রয়েছে, যা পৃথিবীতে আর কারো নেই। শাহ আব্দুল কাদের দেহলভী রহ.-এর ভাষায়- ‘নবী আল্লাহর নায়েব। ব্যক্তির জান-মালের উপর তার নিজেরও অতখানি কর্তৃত্ব নেই যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রয়েছে। নিজেকে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা বৈধ নয়, কিন্তু নবী যদি আদেশ দেন তবে তা ফরয হয়ে যায়।’

উল্লেখিত আয়াতে কারীমার মর্মবাণী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে এভাবে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা ও সন্তানের চেয়ে, সকল মানুষের চেয়ে, এমনকি তাঁর প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয় না হই। -সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৬৩২; সহীহ মুসলিম ১/৪৯

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তা‘জীম

বড়কে সম্মান করা একটি স্বতঃসিদ্ধ এবং সর্বজনস্বীকৃত বিষয়। ইসলামও বড়দের সম্মান করার এবং আলিমদের শ্রদ্ধা করতে গুরুত্বের সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছে। তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যাঁকে আল্লাহ সৃষ্টিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মাকাম দান করেছেন দুনিয়াতে এবং আখিরাতে, আর যাঁকে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামসহ সকল বনী আদমের সাইয়েদ ও সরতাজ বানিয়েছেন, রাববুল আলামীনের পর জগৎবাসীর উপর যাঁর অনুগ্রহই সর্বাধিক, স্বয়ং রাববুল আলামীন যাঁকে রাহমাতুল্লিল আলামীন ও খাতামুন নাবিয়ীন উপাধীতে ভূষিত করেছেন তাঁর তা‘জীম ও সম্মান যে গোটা মানবজাতির জন্য ফরয ও অপরিহার্য হবে তা তো বলাই বাহুল্য।

এখানে যে কথা বলতে চাই তা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সম্মান ও তা‘জীমের বিষয়কে আল্লাহ তাআলা শুধু বড়দের সম্মান করার সাধারণ আদেশের মধ্যেই ছেড়ে দেননি; বরং তাঁর তা‘জীম-সম্মানের বিষয়ে বিশেষ বিশেষ বিধান নাযিল করেছেন। তাঁর আদব-ইহতেরাম আল্লাহ এমন অপরিহার্য করেছেন যে, এটা ছাড়া কারো ঈমান তাঁর দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। এমন সকল কথা-কাজ, আচার-আচরণ আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন এবং লা‘নত ও অভিশাপের কারণ সাব্যস্ত করেছেন যা নবীকে কষ্ট দেয়। আদব-ইহতিরামের যে বিষয়গুলোতে মানুষ কখনো অসচেতন হতে পারে সেগুলো সম্পর্কে কুরআনী আয়াতে স্পষ্ট নির্দেশ দান করেছেন আর তা পালনে যত্নবান হতে আদেশ করেছেন। আর সাবধান করে দিয়েছেন, এর অন্যথা হলে আশঙ্কা রয়েছে যে, সকল আমল বিনষ্ট হবে।’ -সূরা আ‘রাফ ১৫৭; সূরা ফাত্হ ৯; সূরা হুজুরাত ১-৫; সূরা নূর ৬৩; সূরা আহযাব ৫৩, ৫৬-৫৮; সূরা তাওবা ৬১; সূরা বাক্বারা ১০৪; সূরা নিসা ৪৭

মহববত এবং তা‘জীমের বিষয়টি শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহববত ও তা‘জীমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাঁর সঙ্গে যাদের বিশেষ সম্পর্ক আর যে জিনিসগুলো তাঁর সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত তাদের সঙ্গেও মুমিনের ভালোবাসার সম্পর্ক হওয়া জরুরি। প্রেম-ভালোবাসার ধর্ম হচ্ছে প্রিয়জনের যা কিছু প্রিয় তার সঙ্গেও ভালোবাসা হবে। তাহলে নবীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সকল কিছুর সঙ্গে মহববতের সম্পর্ক কায়েম হওয়া নবী-

মহববতের স্বাভাবিক দাবি, আর শরীয়তও এর তাকীদ করেছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামের তা‘জীম

যে কোনো মানুষের নামই তার স্বত্তার পরিচয় বহন করে থাকে। সে নাম ধরেই তাকে স্মরণ করা হয় আবার সে নামেই সে পরিচিতি লাভ করে। এ জন্য কারো নাম তার সত্তা থেকে ভিন্ন কিছু নয়। নামের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন মূলত ব্যক্তির প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন। অনুরূপভাবে কারো নামের প্রতি বিরূপভাব ও অবজ্ঞা প্রকাশ মূলত ব্যক্তিরই প্রতি বিরূপ ও অবজ্ঞার শামিল।

শরীয়ত যে কোনো বস্ত্ত বা ব্যক্তির নাম সম্পর্কে বহু আহকাম প্রদান করেছে। এ সম্পর্কে কুরআনে হাকীমের একাধিক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। আর হাদীসের কিতাবসমূহে তো এ সম্পর্কে এক বড় ও স্বতন্ত্র অধ্যায়ই বিদ্যমান রয়েছে। নাম সম্পর্কিত শরয়ী আহকামসমূহের মধ্যে একটি হলো এই যে, কোনো নামেরই বিকৃতি ঘটানো যাবে না এবং তা নিয়ে বিদ্রূপও করা যাবে না। তবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামের ব্যাপারটি সাধারণ এ হুকুম থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও বহু ঊর্ধ্বে। কেননা, তাঁর নামের বিষয়টি হলো সরাসরি দ্বীন ও ঈমানের বিষয় এবং ইসলামের শিআর ও নিদর্শন। এ নামের তা‘জীম করেছেন স্বয়ং আল্লাহ রাববুল আলামীন, তাঁর ফেরেশতাগণ এবং তিনি নিজেই এ নামের তা‘জীমের নির্দেশ প্রদান করেছেন।

আর এর চেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে যে, আল্লাহ তাআলা কালেমায়ে তাওহীদ, কালেমায়ে শাহাদাত, যা ঈমানের কালেমা ও শিআরে ইসলাম, তাতে নিজের নামের সঙ্গে রাসূলের নাম যুক্ত করেছেন। আযানে ও নামাযের তাশাহহুদে প্রিয়তমের নামও শামিল করেছেন। সূরা ‘আলাম নাশরাহ’-এর আয়াতের

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

‘আর আমি আপনার আলোচনা সমুচ্চ করেছি’ এই ইলাহী ইকরামের কথা বলা হয়েছে। আমরা কি কখনো ভেবেছি, প্রতিদিন পাঁচবার কত লক্ষ মসজিদের মিনারে মিনারে ধ্বনিত হয় ‘আল্লাহু আকবার’। আর তারই সঙ্গে ধ্বনিত হয় ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’র সুমধুর ধ্বনি। কিংবা এভাবেও কি ভেবেছি যে, যে নামের কালেমা পাঠ করে মানুষ ঈমানদার হয় আর যে নামের কালেমা অস্বীকার করে ঈমান হারায় তার মাহাত্ম্য কতখানি। এ নামের সঙ্গে সামান্যতম বেআদবী কত বড় অপরাধ। বলাবাহুল্য, এটা এমন কোনো অস্পষ্ট বিষয় নয় যা বোঝানোর প্রয়োজন হতে পারে।

আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম মোবারকের তা‘জীমের আরেকটি দৃষ্টান্ত এই যে, তাঁর নাম উচ্চারিত হলে দরূদ পাঠের আদেশ করেছেন এবং জিব্রীলের আ. যবানীতে এই বদদুআ করিয়েছেন যে, ‘যার সামনে হাবীবে পাকের আলোচনা হয়, অথচ সে দরূদ পড়ে না তার বিনাশ হোক।’

এরপর বদদুআর উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানে আমীন বলিয়েছেন। -সহীহ ইবনে খুযাইমা, সহীহ ইবনে হিববান, দেখুন আলকাওলুল বাদী পৃ. ২৯২-২৯৮

আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের কোথাও তাঁর হাবীবকে নাম ধরে সম্বোধন করেননি। অন্য বান্দাদের আদেশ করেছেন, তারা যেভাবে নিজেদের মধ্যে একে অপরকে নাম ধরে কিংবা পারিবারিক, বংশীয় বিভিন্ন সম্পর্কের ভিত্তিতে সম্বোধন করে থাকে।’ সেভাবে যেন রাসূলকে সম্বোধন না করে।-সূরা নূর : ৬৩

আর এটা বাস্তব যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা সম্পর্কে তিনিই সবচেয়ে বেশি অবগত, যিনি তাঁর স্রষ্টা এবং যিনি তাঁকে এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছেন। রাসূলের উম্মতী যতই তাঁর মাহাত্ম্য বয়ান করুক শেষে অক্ষমতা স্বীকার করে বলতে হয়- 

دامن نگہ تنگ وگل حسن تو بسيار

گلچيں تو از تنگئى دامن گلہ دارد

ভাবনার আস্তীন খাটো কিন্তু সৌন্দর্যের ফুল অনেক, কিংবা বলতে হবে-

بعد از خدا بزرگ توئى قصہ مختصر

খোদার পরেই তোমার মকাম।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’টি নাম

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেকগুলো গুণবাচক নাম রয়েছে। তবে তাঁর ব্যক্তি নাম দু’টি। ‘মুহাম্মাদ’ ও ‘আহমদ’। উভয় নামের মূল ধাতু এক, ‘হামদ’। এটি প্রশংসা, সম্মান, শোকর ইত্যাদি অর্থ প্রকাশ করে।

এ বিষয়গুলোর প্রকৃত হক্বদার হলেন আল্লাহ তাআলা। সকল প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য। যে সব গুণ  বা বৈশিষ্ট্যের উপর কারো প্রশংসা করা হয় তা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই প্রশংসা। কেননা, আল্লাহই তাঁকে নিজ অনুগ্রহে সে কাজের তাওফীক দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলার ‘আসমায়ে হুসনা’র মধ্যে একটি হচ্ছে ‘হামীদ’। এরও মূল ধাতু  ‘হামদ’। অর্থাৎ যে সত্তা চির প্রশংসিত, যিনি সকল প্রশংসার প্রকৃত অধিকারী, যেখানে যারই প্রশংসা করা হোক তা তাঁরই প্রশংসা।

আল্লাহ তাআলা তাঁর পাক নাম ‘হামীদ’ থেকে নির্গত দুই নাম ‘মুহাম্মাদ’ ও ‘আহমদ’কে তার হাবীবের নাম বানিয়েছেন। ‘মুহাম্মাদ’ অর্থ ‘অতি প্রশংসিত’। আর ‘আহমদ’ শব্দের অর্থ দু’টি-এক অর্থ অনুযায়ী তা ‘মুহাম্মাদ’-এর সমার্থক অর্থাৎ অতি প্রশংসিত। আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে ‘সর্বাধিক প্রশংসাকারী’।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম ‘মুহাম্মাদ’ কেন? এজন্য যে, তিনি আল্লাহর কাছে প্রশংসিত, ফেরেশতাদের মাঝে প্রশংসিত, পৃথিবীবাসীর নিকটে প্রশংসিত, যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে তাদের কাছে প্রশংসিত, এমনকি যারা ঈমান আনেনি তাদের কাছেও তিনি তাঁর গুণ ও মাহাত্ম্যের, চরিত্র ও মহানুভবতার কারণে প্রশংসিত। সৃষ্টির মধ্যে যাঁর প্রশংসা সবচেয়ে বেশি করা হয়েছে আর জগৎ-সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে আজ পর্যন্ত যাঁর প্রশংসা অব্যাহত রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে তিনি হলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর নাম ‘মুহাম্মাদ’ তিনি প্রশংসিত। আর প্রশংসা, হামদের সঙ্গেই তাঁর চিরন্তন সম্পর্ক। ময়দানে হাশরে যে স্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি শাফায়াত করবেন সে স্থানের নাম ‘মাকামে মাহমূদ’। সেদিন ‘লিওয়ায়ে হামদ’- প্রশংসার ঝান্ডা তাঁর মুবারক হস্তেই উড্ডীন থাকবে।

তিনি মুহাম্মাদ, কুল মাখলুক তাঁর প্রশংসাকারী। তিনি আহমদ, স্রষ্টার প্রশংসায় সবার চেয়ে অগ্রগামী। মরুভূমির বালুকারাশি আর আসমানের মেঘমালা যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত তার চেয়েও অধিক বিস্তৃত করেছেন তিনি রাববুল আলামীনের হামদ ও ছানা। (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মানিত নামসমূহের ব্যাখ্যা ও মর্ম জানার জন্য দেখুন ‘রহমাতুল লিল আলামীন’ মাওলানা মুহাম্মাদ সুলায়মান মানসুরপুরী, খ. ৩ পৃ. ১৪-১৫, ১৭৮-১৯৮)

এ নামের সঙ্গে উম্মতের প্রীতি ও ভালোবাসা

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগে আরব ভূখন্ডে কিংবা পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে কারো নাম ‘আহমদ’ রাখা হয়নি। মুহাম্মাদ নামটিও তাঁর আগমনের আগে প্রসিদ্ধ ছিল না। তাঁর আবির্ভাবের নিকটবর্তী সময়ে তাঁর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণীর ভিত্তিতে কেউ কেউ তাদের সন্তানের নাম ‘মুহাম্মাদ’ রেখেছিল। এদের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে পাঁচ-সাত জন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর লোকেরা আদরের সন্তানের নাম মুহাম্মাদ বা আহমদ রাখা সৌভাগ্যের বিষয় মনে করেছে। মুহাম্মাদ নামের অনেক মানুষের নাম-ধাম, কীর্তি ও অবদান ইতিহাসের পাতায় এখনো সংরক্ষিত রয়েছে। উম্মতের যে শ্রেণী ইলমে দ্বীনকে ধারণ করেছেন ও বর্ণনা করেছেন তাদের জীবন ও কর্মের ইতিহাস সংরক্ষণ করার জন্য মুসলিমগণ এমন এক ‘শাস্ত্র’ উদ্ভাবন করেছেন, যা কমবেশি চল্লিশটি শাখায় বিস্তৃত। এ শাস্ত্রের নাম ‘ইলমু আসমাইর রিজাল’। এ শাস্ত্রের অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ হচ্ছে, ‘তাকরীবুত তাহযীব’। এতে সাহাবী যুগ থেকে হিজরী তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালের হাজারো মনীষীদের মধ্য থেকে একটি সংক্ষিপ্ত জামাতের আলোচনা স্থান পেয়েছে। এতে ‘মুহাম্মাদ’ নামের সাতশ’রও অধিক আর ‘আহমদ’ নামের শতাধিক ব্যক্তির আলোচনা এসেছে। এরা সবাই ছিলেন কুরআন-সুন্নাহর আলিম। তাঁদের অনেকেই হলেন সাহাবী, তাবেয়ী এবং উম্মাহর বিশিষ্ট ইমাম।

ইমাম বুখারী রহ. (১৯৪-২৫৬ হিজরী)-এর ‘আততারীখুল কাবীর’ হচ্ছে ইলমু আসমাইর রিজালের মাঝারি মাপের গ্রন্থ, তাতে ‘মুহাম্মাদ’ নামের আটশত একাত্তর জন ব্যক্তির আলোচনা রয়েছে। ইমাম বুখারী রহ. এ কিতাবের ভূমিকায় লেখেন, ‘এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের নাম আমি বিন্যস্ত করেছি বর্ণানুক্রমিকভাবে। তবে নিয়মের ব্যতিক্রম করে ‘মুহাম্মাদ’ নামের ব্যক্তিদের আমি সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছি। কেননা, এ নাম আমাদের নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম।’

وإنما بدئ بمحمد من حروف ا، ب، ت ، ث، لحال النبي صلى الله عليه وسلم، لأن اسمه محمد صلى الله عليه وسلم، فإذا فرغ من المحمدين ابتدئ في الألف ثم الباء.

এটা শুধু ইমাম বুখারী রহ.-এরই নীতি নয়, আরো অনেক গ্রন্থকার তাঁদের গ্রন্থ বর্ণানুক্রমিক বিন্যস্ত করার পরও ‘মুহাম্মাদ’ ও ‘আহমদ’ এই দুই নামের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করেছেন এবং এ দুই নামকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন।

হিজরী অষ্টম শতাব্দীর প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুয়াররিখ (জীবনীকার) আব্দুল কাদের কুরাশী (৭৭৫ হি.) ‘আলজাওয়াহিরুল মুযীআ’তে লেখেন, ‘সমরকন্দের শহর ‘জাকরদীযাহ’তে একটি কবরস্থান আছে যার নাম ‘তুরবাতুল মুহাম্মাদীন’। অর্থাৎ ‘মুহাম্মাদ নামীয় উলামা-ফুকাহার কবরস্থান’। এখানে এমন চারশ উলামা-ফুকাহা সমাহিত আছেন যাঁদের প্রত্যেকের নাম মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ।’ অর্থাৎ তাঁর নামও মুহাম্মাদ, পিতার নামও মুহাম্মাদ।

হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ইমাম আবুল হাসান আলমারগিনানী (৫৯৩ হি.) যাঁর রচিত গ্রন্থ ‘আলহিদায়া’ সুবিখ্যাত ও সর্বজনসমাদৃত, ইন্তেকালের পর তাঁকে সমাহিত করার জন্য ওই কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু কবরস্থানের দায়িত্বশীলরা বিনয়ের সঙ্গে বলে দেন যে, ‘হযরতের নাম তো মুহাম্মাদ নয়।’ পরে নিকটবর্তী একস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

মোটকথা, এ নামের সঙ্গে মুসলমানের হৃদয়ের সম্পর্ক সাহাবী-যুগ থেকে আর তা কিয়ামত পর্যন্ত অটুট থাকবে ইনশাআল্লাহ। অনেক ভাগ্যবান পিতা রয়েছেন যারা তাদের সকল

সন্তানের নাম ‘মুহাম্মাদ’ রেখেছেন। এরপর পার্থক্যের জন্য নামের সঙ্গে আওয়াল (প্রথম) ছানী (দ্বিতীয়) যোগ করেছেন।

পাক-ভারত-বাংলা অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম থেকে বরকত হাসিলের দু’টি পন্থা প্রচলিত আছে। সন্তানের নাম মুহাম্মাদ রাখা কিংবা অন্য নাম রাখা হলেও নামের শুরুতে ‘মুহাম্মাদ’ শিরোধার্য করা। আমাদের এ অঞ্চলে দ্বিতীয় পদ্ধতিই অধিক প্রচলিত।

ইসলামের দুশমনদের এ নামের প্রতি দুশমনী

মুসলিম সমাজে ক্রমবর্দ্ধমান ঈমানী দুর্বলতার কারণে যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহববতের হক আদায় হয় না। তবুও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তারা নবী মুহাম্মাদ-এর মুহাববত অন্তরে ধারণ করেন। এই মহববতেরই বহিঃপ্রকাশ যে, তারা বরকতের জন্য নবীয়ে পাকের পবিত্র নাম তাদের নামের সঙ্গে শিরোধার্য করেন। যদিও সামান্য তবুও তা রাসূলের সঙ্গে সম্পর্ক। এ সম্পর্কটুকুও একশ্রেণীর ইসলামবিদ্বেষীর গাত্রদাহের কারণ হয়ে যায়। এই পাক নামের চর্চা ও প্রচলন তাদের মর্মপীড়া উৎপাদন করে। কিন্তু ইলাহী ঘোষণা যখন এই-

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

তখন তাদের সকল বিদ্বেষ যে শুধু তাদেরকেই দগ্ধ করে যাবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

দু’মাস আগে একটি দৈনিক  পত্রিকার সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে যে কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল তা ওই বিদ্বেষ ও অন্তর্জবালারই একটি দৃষ্টান্ত। সে সময় ওই কাজের উপর চতুর্দিক থেকে সমালোচনা হয়েছে এবং সকল শ্রেণীর মানুষ এর প্রতিবাদ করেছেন। ওই পত্রিকার কর্তৃপক্ষ ক্ষমাপ্রার্থনা করতে বাধ্য হয়েছে। সে সময় জুমার বয়ানে এবং বিভিন্ন প্রশ্নকারীর প্রশ্নের উত্তরে যা বলা হয়েছিল তার মধ্যে থেকে কিছু কথা আলকাউসারের পাঠকদের সামনে পেশ করছি।

১. শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘শাআয়েরে ইসলামে’র বিষয় অত্যন্ত সংবেদনশীল। এ বিষয়গুলোর সম্মান ঈমানের প্রধান দাবিগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর মধ্যে কোনো একটি সম্পর্কেও সামান্য তাচ্ছিল্য ও অসম্মান ঈমান নষ্ট করে দেয়। কেননা, এ বিষয়টি সর্বসম্মত যে, ‘শাআইর’-এর সম্মান ঈমানের পরিচায়ক আর তার কোনো একটির সামান্য অসম্মান, তাচ্ছিল্য মুনাফিকী ও ইসলামবিদ্বেষের দলীল। শাআয়েরের মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ক. কুরআনে কারীম

খ. রাসূলে কারীম

গ. কালেমায়ে ইসলাম

ঘ. ইসলামের ইবাদতসমূহ। যথা : নামায, হজ্ব, রোযা, যাকাত, দুআ, দরূদ ইত্যাদি।

ঙ. বিশেষ ফযীলতপূর্ণ স্থানসমূহ। যথা : বায়তুল্লাহ, মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, মসজিদে আকসা অতঃপর অন্যান্য মসজিদসমূহ।

২.         আমলে শিথীলতা অবশ্যই অপরাধ কিন্তু যদি ঈমান-আকীদা বিশুদ্ধ হয়, ‘শাআয়েরে ইসলামে’র সম্মান করে, গুনাহ হয়ে গেলে নিজেকে অপরাধী মনে করে তবে এই অপরাধ আল্লাহ তওবা ছাড়াও মাফ করতে পারেন। গাফলতী ও অলসতার কারণে যদি কোনো ফরয ছুটে যায় তবুও মানুষ ঈমানের গন্ডি থেকে খারিজ হয় না, কিন্তু অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের বিষয়টি অতি মারাত্মক। ফরয আমলের কথা তো বলাই বাহুল্য, কেউ যদি দ্বীনের কোনো মুস্তাহাব আমল, কোনো ছোট খাট বিষয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো ছোট সুন্নতের দিকেও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকায়, সে সম্পর্কে কোনো অবজ্ঞাসূচক বাক্য ব্যবহার করে কিংবা এমন কোনো আচরণ করে, যা অবজ্ঞা প্রকাশক তাহলে এটা সুস্পষ্ট কুফরী। এ থেকে প্রমাণ হয়, ওই লোকের অন্তরে ঈমান নেই, তার অন্তর দ্বীনের মাহাত্ম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহববত থেকে একেবারে শূন্য।

আর শাআয়েরে ইসলামের মধ্যে সামান্য কোনো বিষয়ের সঙ্গেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য যে ইরতেদাদ বা ইসলাম থেকে খারিজ হওয়ার কারণ তা সর্বজনবিদিত। ‘শাআয়েরে ইসলামে’র মর্যাদাহানী, ইসলামের নবীর সঙ্গে মশকরা, তার নামের সঙ্গে ঠাট্টা-বিদ্রূপ, ইসলামের কেন্দ্র বায়তুল্লাহর সঙ্গে বিদ্রূপ এরপর আবার ইসলামের দাবি!

৩.         সে সময় যখন চারদিক থেকে প্রতিবাদ হচ্ছিল তখন একজন সাদাসিধা ভাল মানুষ বললেন যে, কাফের, মুশরিক, ইয়াহুদী, নাসারা এবং বেদ্বীন লোকেরা তো এমন করবেই, তাদের তো আর আমাদের নবীর প্রতি ঈমান নেই!

তাকে বলেছিলাম, বিষয়টি এমন নয় যেকোনো জাতি বা ধর্মে যে ব্যক্তিত্বগণ সম্মানিত তাদের সম্পর্কে অবজ্ঞাসূচক বাক্য ব্যবহার না করা, সাধারণ মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। সকল জাতি, ধর্ম ও মতবাদ- সে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী হোক কি নাস্তিক্যবাদী, সবার কাছেই বিষয়টি স্বীকৃত। যেকোনো ধর্মের বা গোষ্ঠীর সম্মানিত ব্যক্তিত্বের মানহানী, অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য আন্তর্জাতিক আইনেও অপরাধ। এজন্য এই কথা ঠিক নয় যে, বদদীন ও বেদ্বীন লোকেরা তো এমন করবেই! প্রশ্ন হল, কেন করবে? আল্লাহ তাআলার কাছে ‘শাআয়েরে ইসলাম’ বিশেষত ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদার বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলার বিধানে ‘মুয়াহিদ’ ও ‘আহলে যিম্মা’র সঙ্গে (অর্থাৎ মুসলিম রাষ্ট্রে অবস্থানকারী অমুসলিম জনগণ, যারা বিশেষ অঙ্গীকারসূত্রে ইসলামী রাষ্ট্রে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করে) চুক্তি ও অঙ্গীকার ততক্ষণ পর্যন্তই বহাল থাকে যে পর্যন্ত তারা ‘শাআয়েরে ইসলাম’ ও নবীয়ে ইসলামের প্রতি কোনোরূপ তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা প্রদর্শন থেকে বিরত থাকে।

(আহকামু আহলিয যিম্মা, ইবনুল কাইয়েম, আসসারিমুল মাসলূল আলা শাতিমির রাসূল, ইবনে তাইমিয়া)

৪. ওই দৈনিকে যে ক্ষমাপ্রার্থনা সে সময় প্রকাশিত হয়েছিল তার মধ্যে সর্বশেষ বক্তব্য এখানে সংরক্ষণের  জন্য উল্লেখ করে দিচ্ছি-                    

আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী

মতিউর রহমান

গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘আলপিন’-এ প্রকাশিত একটা অনাকাঙ্ক্ষিত, অগ্রহণযোগ্য কার্টুন-কাহিনী প্রকাশের জন্য আমরা আবারও দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি। পাশাপাশি বিষয়টিকে ভুল হিসেবে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য সবার প্রতি আবেদন জানাচ্ছি।

ওই কার্টুন-কাহিনী সংবলিত আলপিনসহ ১৭ সেপ্টেম্বরের পত্রিকা ছাপা হয়ে বাজারে চলে যাওয়ার পর ধরা পড়ে যে, একটা বড় অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল হয়ে গেছে। এ এমন একটা ভুল, যার পক্ষে কোনো যুক্তিই যথেষ্ট নয়। প্রথম আলো সব সময়ই ইসলাম ধর্ম ও ধর্মীয় আবেগের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পাঠক ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের আবেগ ও অনুভূতিতে যাতে আঘাত না লাগে, সে ব্যাপারে আমরা সব সময় সচেতন এবং তা রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, এত সতর্কতা, এত চেষ্টার ভেতরও কী করে এ রকম একটা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য কার্টুন ছাপা হয়ে গেল? বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম আলো ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। সিদ্ধান্ত নেয়, নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাওয়া হবে এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত যে সহসম্পাদকের বিবেচনায় এই ভুল ধরা পড়েনি, তাঁকেও অপসারণ করা হবে। প্রথম আলোর পাঠকদের অনেকেই ফোন করে জানিয়েছেন, এই কার্টুনটি তাঁদের আহত করেছে। আমরা তাঁদের সমব্যথী। প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতির একটি হলো- ভুল যাতে না হয় সেজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা, তারপরও ভুল হয়ে গেলে তা বোঝার বা জানার সঙ্গে সঙ্গে সংশোধনী ছাপানো ও দুঃখ প্রকাশ করা। কারণ যে পত্রিকাটি প্রায় ২৫ লাখ পাঠকের কাছে প্রতিদিন যায়, তাতে একটা ভুল হলে তার নেতিবাচক প্রভাবও হয় ব্যাপক। অনেকে এ জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন, অনেকে মানসিকভাবে আহত হতে পারেন।

এই নীতি অনুসরণ করে গত ১৮ সেপ্টেম্বর পত্রিকার মাধ্যমে প্রথম আলো ওই কার্টুন-কাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯ সেপ্টেম্বর ওই প্রদায়ক কার্টুনিস্টের আর কোনো লেখা বা কার্টুন পত্রিকায় না ছাপার সিদ্ধান্ত নেয়। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহসম্পাদককে অপসারণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয় পাঠকদের। প্রথম আলো পর পর দুই দিন সবার কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ ও নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে। প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় এই আবেদন প্রকাশিত হয়। গতকাল ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। অনিচ্ছাকৃত ভুলটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন।’

সরকারও গত বুধবার আলপিনের ১৭ সেপ্টেম্বরের সব কপি বাজেয়াপ্ত করে এবং প্রদায়ক কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। এ রকম একটা অনাকাঙ্ক্ষিত কার্টুন প্রকাশিত হওয়ার জন্য আজও প্রথম আলো দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করছে

আন্তরিকভাবে। কারণ এই ভুলটি একেবারেই অনিচ্ছাকৃত ও অসাবধানতাবশত। ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুলের পুনারাবৃত্তি না করার ব্যাপারে সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে এই পত্রিকা। একই সঙ্গে ১৩ জন সম্পাদকের গতকালকের বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত।

প্রথম আলো আশা করছে, সবাই বিষয়টা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। -প্রথম আলো ২১ সেপ্টেম্বর ২০০৭

৫. কোনো কোনো দৈনিকে উপরোক্ত ক্ষমাপ্রার্থনাকে ‘তাওবা’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত এটা তাওবা নয়, এটা তো দুঃখ প্রকাশ মাত্র। একে যদি ‘তাওবা’  বলা হয় তবে তা হবে একটি রাজনৈতিক তাওবা, দ্বীনী ও ঈমানী তাওবা এটা নয়। তাওবার জন্য অপরিহার্য হল, আবার নতুন করে ঈমান আনয়ন করা, কালেমা পড়া, যে কুফরী কাজ করা হয়েছে তা কুফরী কাজ বলে জেনে তা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর নামের সঙ্গে মুহাববত, হৃদ্যতা ও সম্মান প্রদর্শনের ঘোষণা প্রদান করা। এশর্তগুলো পূরণ হলে দুনিয়ার ইসলামী আদালত বলবে, সে ‘তাওবা’ করেছে। এর কারণে রিসালাতের মানহানী ও শাআয়েরে ইসলামের অবজ্ঞার শাস্তি মওকুফ হবে কি না সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আর আল্লাহর কাছে তওবা কবুল হওয়ার জন্য একাজগুলো অন্তর থেকে হতে হবে। শুধু মৌখিক স্বীকারোক্তি যথেষ্ট নয়। আল্লাহর কাছে বাহ্য-অবাহ্য সব কিছু সমান। কোনো কিছুই তার কাছে

গোপন নয়।

৬. সে সময় কিছু বেদ্বীন ভাবাদর্শ সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, ‘এই কার্টুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে অবমাননাকর কিছু বলা হয়নি।’

একেই বলে চুরি আবার সীনাজুরি। যারা এই ঘৃণ্য কাজ করেছে তারা একে মানহানীকর বিষয় বলে স্বীকার করে বার বার দুঃখ প্রকাশ করছে এবং ক্ষমা চাচ্ছে। তাদের পক্ষ থেকে অন্যান্য ক্ষমাপ্রার্থনাকারীরাও একে মানহানীকর বলে স্বীকার করছে আর এরা বলছে যে, এটা মানহানীকর নয়। কারো নামকে পশুর জন্য ব্যবহার করা মানহানীকর নয় তো সম্মান প্রদর্শন? স্পষ্ট ভাষায় অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা প্রকাশের চেয়ে ইশারা-ঈঙ্গিতে প্রকাশ আরো মারাত্মক। কেননা, এখানে কুফরের সঙ্গে মুনাফিকীও রয়েছে। ‘আল কিনায়াতু আবলাগু মিনাস সারীহ’ সব ভাষাতেই স্বীকৃত।

মনে রাখা উচিত যে, অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সাধারণত নিয়ম এটাই যে, এতে ইশারা-ইঙ্গিত এবং স্পষ্ট বক্তব্য সবগুলোর বিধান এক। এরপর শাআয়েরে ইসলাম ও নবীয়ে ইসলামের বিষয়তো আরো সংবেদনশীল।

ইসলাম অবশ্যই উদারতার ধর্ম, কিন্তু তারও আগে ইসলাম স্পষ্টবাদিতা, সত্যবাদিতা ও আমানতদারীর ধর্ম। শিথিলতা ও মুনাফিকী কোনোক্রমে ইসলামে সহনীয় নয়।

দুনিয়াবী বিষয়ে কার্টুন বানিয়ে কৌতুক করার বিধান কী এ বিষয়ে আলিমদের কাছে জেনে নেবেন, কিন্তু দ্বীন ও ঈমান, শরীয়ত ও সুন্নাহ এবং শাআয়েরে ইসলামের মতো সংবেদনশীল বিষয়কে কৌতুকের বিষয় বানানো যে একে তুচ্ছতায় নামিয়ে আনা তা খুব সামান্য চিন্তাতেই বোঝা যায়।

‘কৌতুক’ বিষয়টির মূল কথাই হল হাস্যরস আর ঈমান ও ঈমানিয়াত, ইসলাম ও ইসলামিয়াত বিশেষত শাআয়েরে ইসলামের বিষয়গুলো ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয় যা অত্যন্ত সংবেদনশীল। এসব বিষয়কে যারা হাস্যরসের বিষয় বস্ত্ততে পরিণত করে আল্লাহর কাছে তারা অবিশ্বাসী হিসেবে পরিগণিত। ঈমান থেকে খারিজ হওয়ার জন্য সংকল্প করে কুফরী কাজ করা জরুরি নয়; বরং কথা বা আচার-আচরণের কুফরও অনেক সময় অধিক মারাত্মক হিসেবে পরিগণিত হয়। 

৭. এ প্রসঙ্গে মুসলমানের করণীয় কী- এ প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,

১. সরকারের কর্তব্য হল, তারা আলোচিত পত্রিকা এবং এ ধরনের যেসব পত্র-পত্রিকা ইসলাম-বিদ্বেষ ও মুসলিম-বিদ্বেষের মানসিকতা নিয়ে কাজ করে সবগুলোর প্রকাশনা বন্ধ করা এবং ডিক্লারেশন বাতিল করা। দেশ ও জাতির দুশমনদেরকে দুশমনী চরিতার্থ করার কোনো সুযোগই না দেওয়া।  

২. সরকারের আরো কর্তব্য হচ্ছে, ‘শাআয়েরে ইসলাম’ সম্পর্কে পরিষ্কার আইন সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা। আর তা ওই আইনই হতে হবে যা ইসলামের আইন। যে বিষয়গুলো ‘ইরতেদাদে’র কারণ সেগুলোর শাস্তিবিধানের আইন এবং শক্ত হাতে তা

বাস্তবায়িত হওয়া মুসলিম জনপদে বসবাসকারী মুসলিমদের একটি সামান্য অধিকার। এই অধিকার পূরণ করা সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

৩. মুসলিম জনগণের করণীয় হল তারা যৌক্তিক ও শান্তিপূর্ণ  উপায়ে সরকারকে করণীয় সম্পর্কে সচেতন করবেন এবং এই দ্বীনী অধিকার তাদের কাছ থেকে আদায় করবেন।

৪. মুসলমানদের জন্য সবসময়ের, বিশেষত এ সময়ের করণীয় হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য, গুণ ও মাহাত্ম্য অধিক পরিমাণে চর্চা করা, তার পূর্ণাঙ্গ ও অতুলনীয় শিক্ষা প্রচার-প্রসার করা, তাঁর সুন্নত ও আদর্শকে নিজের মধ্যে ও পরিবারের সবার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা। আর এহইয়ায়ে সুন্নত ও মহববতে রাসূলের পরিবেশ সৃষ্টি করা। যেখানে জীবনের সকল ক্ষেত্রে নবী-আদর্শ প্রতিষ্ঠিত থাকবে সেখানে কোনো বেদ্বীন প্রকাশ্যে ‘শাআয়েরে ইসলাম’ ও নবীয়ে ইসলামের অবজ্ঞা করতে অবশ্যই কুণ্ঠাবোধ করবে।

৫. প্রত্যেক ইসলাম-বিদ্বেষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, তা দেশি হোক  বা বিদেশি, সম্পর্ক ছিন্ন করা আর তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সবধরনের সহযোগিতা পরিত্যাগ করা।

৬. আকাইদে ইসলামের সঠিক ইলম হাসিল করে সে অনুযায়ী নিজের আক্বীদা-বিশ্বাস দুরস্ত করা এবং তার উপর অবিচল থাকা।

৭. ‘শাআয়েরে ইসলাম সম্পর্কিত শরয়ী বিধানের ইলম হাসিল করা এবং সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শাআয়েরে ইসলাম ও নবীয়ে ইসলামের মাহাত্ম্য অনুধাবন করার তাওফীক দিন এবং নবী আদর্শকে জীবনের সকল অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করার তাওফীক দিন। আমীন।

টীকা-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুবারক নামসমূহের মর্ম ও ব্যাখ্যার জন্য দেখুন ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ মাওলানা মুহাম্মাদ সুলায়মান মনসুরপুরী খ. ৩ পৃ. ১৪-১৫, ১৭৮-১৯৮

শনিবার, ১২/১১/১৪২৮ হিজরী, ২৪/১১/২০০৭ ইংরেজি

 

advertisement