Zilhajj 1430   ||   December 2009

পর্দানশীন : মৃত্যুর স্মরণ

Mawlana Mufti Taqi Usmani

[হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উছমানী কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফর করেছেন। সে সফরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ’০৯ ঈ. সুন্নত চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে মহিলাদের উদ্দেশে এই বয়ানটি করেছিলেন। তা রেকর্ড করা হয়েছিল। পরে তা কাগজে লেখা হয় ও অনুবাদ করা হয়। লিখেছেন মাওলানা সায়ীদ আহমদ, অনুবাদ করেছেন মাওলানা আবদুল্লাহ ফাহাদ। আলকাউসারের পাঠকদের জন্য তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।] (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সেদিন তোমাদেরকে ওই নেয়ামতসমূহের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে যা আমি তোমাদেরকে দুনিয়ায় দান করেছি। সেসবের কী হক তোমরা আদায় করেছ?

হাদীস শরীফে আছে, একবারের ঘটনা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপবাসী ছিলেন। ঘরে কোনো খাবার ছিল না। চিন্তা করুন, আজ আমরা কত সুখে দিন কাটাচ্ছি। কত উত্তম খাবার গ্রহণ করছি। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে জীবন যাপন করেছেন যে, তাঁকে ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে উপবাসও করতে হয়েছে। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন, কখনো কখনো এমনও হয়েছে যে পরপর তিন মাসের চাঁদ দেখা হয়ে যেত অথচ আমাদের ঘরে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্তা হত না। জিজ্ঞাসা করা হল, কীভাবে জীবন ধারণ করতেন? উত্তরে বললেন, খেজুর ও পানি দ্বারা।’ তিন মাস যাবৎ শুধু খেজুর আর পানি দ্বারা জীবন ধারণ!

এক সাহাবী বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরো জীবনে কখনো পেট ভরে যবের রুটি খাননি।’ একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ষুধার্ত ছিলেন আর ঘরেও খাওয়ার মতো কিছু ছিল না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো কাজে বাইরে বের হয়েছেন। দেখলেন যে, একজন সাহাবী আসছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, কেন এসেছ? উত্তরে তিনি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! খুব ক্ষুধার্ত আর খাওয়ারও কিছু নেই। তখন দো জাহানের বাদশাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ভাই! আমারও তো একই অবস্থা। চল, আমার এক বন্ধুর (একজন আনসারী সাহাবী) বাগান আছে। আমরা বাগানে প্রবেশ করলাম। সাহাবী আমাদের দেখে অত্যন্ত খুশি হলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করেছেন। তখন ছিল গরম কাল। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটি গাছের নিচে বসিয়ে নিজে খেজুর ইত্যাদি আনতে গেলেন। কিছুক্ষণ পর খেজুর ও ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর খেলেন এবং পানি পান করলেন। এরপর সাহাবীদের লক্ষ করে বললেন, যা কুরআন মজীদে বলা হয়েছে, (তরজমা) ‘কেয়ামতের দিন তোমাদেরকে নেয়ামতসমূহের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ এই খেজুর ও ঠাণ্ডা পানি সম্পর্কেও কেয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তোমাদেরকে যে নেয়ামত দান করেছিলাম তার কী হক আদায় করেছ?

একটু ভাবুন, ক্ষুধার সময় যখন ঘরে খাওয়ার কিছুই ছিল না সে অবস্থায়ও যে খেজুর ও পানি পাওয়া গেল সে সম্পর্কেও কেয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তোমরা তার কী হক আদায় করেছ?

অথচ আজ আমরা বিলাসী জীবন যাপন করছি। যা ইচ্ছা খাচ্ছি, পান করছি। সাহাবায়ে কেরামের সামনে কোনো উত্তম খাবার আসলে তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন, খাবার খেতে পারতেন না। তারা বলতেন, আমাদের মনে পড়ে যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে জীবন যাপন করেছেন। আজ আমরা এত উন্নত জীবন যাপন করছি!

আমি বলছিলাম, আমাদেরকে কুরআন মজীদ সতর্ক করে দিচ্ছে যে, তোমরা তো দিনরাত নিজেদের শরীর পূজায় লিপ্ত রয়েছ এবং এই চিন্তায় নিমগ্ন রয়েছ যে, কীভাবে বিলাসী থেকে বিলাসী জীবন-যাপন করা যায়, অধিক থেকে অধিক সম্পদ উপার্জন করা যায় আর এ চিন্তাই তোমাদেরকে আখিরাত সম্পর্কে উদাসীন করে রেখেছে। যার ফলে তোমরা এ অবস্থায়ই কবরস্থানে চলে যাবে এবং সেখানে গিয়ে তোমরা বুঝতে পারবে, তোমরা কেমন নির্বুদ্ধিতার শিকার ছিলে। সেদিন তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে, যেসব নেয়ামত তোমাদেরকে দান করা হয়েছিল তার কী হক তোমরা আদায় করেছ? তোমরা কি আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করেছ? আল্লাহ তাআলার ইবাদত করেছ? আল্লাহর বিধান মেনে চলেছ? আমার ভাই ও বোনেরা!

আমরা এ সূরা সবসময়ই পড়ে থাকি প্রত্যেক মুসলমানেরই এ সূরা মুখস্ত আছে। কিন্তু যেহেতু অর্থ জানা নেই তাই এতে যে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে আমরা উদাসীন থাকি। প্রত্যেকেই নিজের অবস্থা যাচাই করে দেখি যে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন চিন্তায় মগ্ন ছিলাম আর কতটুকু সময় মূল লক্ষ্যের প্রতি মনোযোগী ছিলাম। কতটুকু সময় আল্লাহ তাআলার স্মরণে কেটেছে? কখনো কি এ চিন্তা এসেছে যে, আমাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে, আল্লাহ তাআলার সামনে দাঁড়াতে হবে এবং কৃতকর্মের জবাবদিহী করতে হবে? এ চিন্তাটা কতটুকু সময় হয়েছে? তাহলে বাস্তব তো তা-ই, যা কুরআন মজীদ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে (তরজমা) অর্থ-প্রাচুর্য তোমাদেরকে উদাসীন করে দিয়েছে।

এই উদাসীনতা থেকে মুক্তির উপায় খোঁজা প্রয়োজন

এ বিষয়ে সর্বপ্রথম কথা হল মাথা থেকে এ ভ্রান্ত ধারণা ঝেড়ে ফেলা যে, এই দুনিয়া শুধু উপার্জনের জন্য। কাফেররা যেমন বলে, (তরজমা) আমাদের পার্থিব জীবন ছাড়া আর তো কোনো জীবন নেই। এতেই আমাদের জীবন ও মৃত্যু। আর সময়ই আমাদেরকে বিলুপ্ত করে। আল্লাহর ওয়াস্তে এই বাস্তবতাটুকু বুঝতে চেষ্টা করুন যে, দুনিয়ার জীবন হল একটি সফর এবং তা যে কোনো সময় সমাপ্ত হয়ে যাবে। এরপর আখেরাতের জীবন শুরু হবে। আল্লাহ তাআলার সামনে জবাবদিহী করতে হবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘সকল স্বাদ বিনষ্টকারী মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ কর।’ অথচ আমাদের তো তা স্মরণই হয় না।

নিজের হাতে প্রিয়জনদের কাফন পরাই, নিজের হাতে কবরে দাফন করি, নিজের কাঁধে জানাযা উঠিয়ে নিয়ে যাই, নিজের হাতে মাটি দেই। এরপর হাত পরিষ্কার করে ফিরে আসি। তখনো এ চিন্তা আসে না যে, এমন সময় আমারও একদিন আসবে। আমিও একদিন কবরে যাব। একটি কথা তো হল মৃত্যুকে স্মরণ করা। হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. বলেছেন, দিনের কোনো একটি সময় এই ধ্যান করা চাই যে, আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত এসে গেছে, আমি দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছি। আত্মীয়-স্বজন আমাকে কবরে রেখে চলে গেছে। ফেরেশতাগণ এসেছেন। সুওয়াল-জওয়াব শুরু হয়েছে। আমার সারা জীবনের আমলনামা সামনে রাখা হয়েছে। বলুন, এ সময় কী অবস্থা হবে? এ বিষয়টি ধ্যান করা জরুরি। এর জন্য অল্প সময় বের করতে হবে। আল্লাহ তাআলা নিজ রহমতে এই ফিকির আমাদের অন্তরে মজবুত করে দিন যে, এই দুনিয়াই সবকিছু নয়। দুনিয়ার পরে আরো একটি জীবন আছে। (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement