কাশ্মীরের গণবিদ্রোহ ও ভারত
কাশ্মীর সম্পর্কে গভীর জ্ঞান না থাকলে কাশ্মীরের এবারের নির্বাচনের তাৎপর্য বোঝা কঠিন। গত আগস্টে, তখন আমি সেখানে ছিলাম, কাশ্মীরে এক অভূতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। গোটা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমে তা প্রচারিত হয়। সে সময় হাজার হাজার মানুষ ‘আজাদি, আজাদি, আজাদি’ ধ্বনি তুলে রাজপথ প্রকম্পিত করে। আর এখন সব সুনসান। এখনো আমি সেখানে। এখনো যেন আমার কানে বাজছে ফল বিক্রেতাদের চিৎকার। হাতে ফল নিয়ে চিৎকার করে বিক্রির কথা না বলে তারা বলছে, ‘আজাদি, আজাদি, আজাদি’। তাদের কাছে আজাদির মানে মুক্তি তো অবশ্যই, আরও অনেক কিছু। বাসযাত্রীরা, রাস্তার শিশুরা এমনকি আকাশও যেন সেই একই স্লোগান দিচ্ছিল।
সেটা ছিল অহিংস গণঅভ্যুত্থান। আসলে সেটা ছিল নেতাদের উদ্দেশে। নেতারা কিন্তু আন্দোলনটা তৈরি করেননি; বরং জনগণই গুটিয়ে থাকা নেতাদের টেনে নিয়ে এসেছিল রাজপথে, তাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল বিপ্লবের সম্মুখে।
জবাবে ভারতীয় সরকার নজিরবিহীন কারফিউ জারি করে। দিনের পর দিন, তারও পরের দিনগুলো কাঁটাতার, ইস্পাতের দেয়াল দিয়ে মানুষজনকে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায়, এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লায় যেতে বাধা দেওয়া হয়। হত্যা করা হয় অনেক কাশ্মীরিকে। সবাই জানে তারপরও বলি, কাশ্মীরে এখন পাঁচ থেকে সাত লাখের মতো ভারতীয় সেনা রয়েছে। অথচ ইরাকে রয়েছে এক লাখ ৬৫ হাজার মার্কিন সেনা। আমার মনে হয়, কাশ্মীরের যেকোনো জায়গা ছেয়ে ফেলতে এই সেনাদের মাত্র আধা ঘন্টা সময় লাগবে। কারণ তারা ছড়িয়ে রয়েছে এবং সর্বদাই টহল চলছে। তাই গণ-অভ্যুত্থান দমন করা তাদের জন্য কঠিন ছিল না।
তারপরই শুরু হল বিতর্ক-নির্বাচন হবে কি হবে না। নির্বাচন বর্জনের ভয় ছিল। আগেও তাই হয়েছে। কিন্তু এবারে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভোট দিতে গিয়েছে। ঘটনা দেখে অনেকেই চমকে গেছে। কোথায় গেল আজাদির জোশ? কোথায় গেল রাজপথের বিক্ষুব্ধ মানুষেরা?
জম্মুর কয়েকটি জেলা হিন্দু অধ্যুষিত। বাদবাকি জেলাগুলো বুটের তলায় পিষ্ট। কাশ্মীরে গেলেই দেখা যাবে, সেখানকার শ্বাস-প্রশ্বাসও সেনা-নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং ভারতের পক্ষে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কিছু না। তারপরও গ্রামের চেয়ে শহরে ভোট পড়েছে কম। নির্বাচনের আগে হাজার হাজার লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। কেবল স্বাধীনতাকামী হুররিয়াতের নেতা-কর্মীই নয়, সব নেতা-কর্মী এবং বিক্ষোভে অংশ নেওয়া তরুণদের আটক করা হয়। এখন প্রথম প্রশ্ন হল, এত ঘন সেনা উপস্থিতির মধ্যে কি মুক্ত নির্বাচন হতে পারে? সেটা কি সম্ভব? যাঁরা সেখানে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে এসেছেন, তাঁরা দেখেছেন, বেয়নেটের খোঁচা ছাড়াই মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁরা দেখেননি যে, কাশ্মীরের মানুষ গুটিয়ে গেছে। মনের মধ্যে তারা গভীরভাবে আহত। এর মানে হচ্ছে, কাশ্মীরিরা ভালো করেই জানে যে, তারা দখলদারির অধীন। সুতরাং এর মধ্যে একটু ভালোভাবে বাস করার কৌশল তারা রপ্ত করেছে। এবং তাদের রয়েছে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি। তারা জানে, কালকেই তারা স্বাধীন হচ্ছে না এবং তাদের আরো অনেকদিন টিকে থাকতে হবে। তাই কাশ্মীরের প্রধান রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স জানিয়ে দিয়েছে, নির্বাচনের সঙ্গে স্বাধীনতার কোনো সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক রয়েছে রুটি-রুজির। তাই নির্বাচনের স্লোগান ছিল সড়ক, পানি, বিজলি।
শহরাঞ্চলে এগুলো কিছুটা থাকলেও গ্রামাঞ্চল এসবের অভাবে ধুঁকছে। তাই শহরের চেয়ে গ্রামের লোক বেশি ভোট দিয়েছে। এগুলো হয়তো দখলদারির কাঁটা বিছানো শয্যার ওপর চিকন এক পরত নিরাপত্তা। তারপরও বিষয়টা কেবল এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। যেমন, সেখানে রয়েছে এসওজি-স্পেশাল অপারেশনস গ্রুপ। এরা যে কাউকেই তুলে নিয়ে যেতে পারে। সে রকম হলে মানুষের তো তদবিরের জন্য কাউকে লাগবে। এবং সেই একজন হবেন কোনো রাজনীতিবিদ। যেমন একজনের কথা বলা যায়, তিনি নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনীকে দিয়ে পাঁচ-ছয় জন লোককে ধরার ব্যবস্থা করেন। তারপর মানুষ তাঁর কাছে আসে। তখন তিনি তাদের ছাড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। আর এলাকাবাসী তাঁর প্রতি চির কৃতজ্ঞ হয়ে গেল। এ রকম অনেক অদৃশ্য কারবার সেখানে চলে।
আরও কারণও রয়েছে। এবার ভারত খুব ব্যাকুলভাবে দেখাতে চেয়েছে, কাশ্মীরে গণতন্ত্র চলছে। তার জন্য ভোটের সংখ্যা যাতে বাড়ে সেটা দেখানো দরকার। সেজন্য মাঠে অনেক প্রার্থী নামানো হয়েছিল টাকা দিয়ে। আর গ্রামের সামন্ত সংস্কৃতিতে প্রত্যেকেরই জ্ঞাতিগুষ্টি একেবারে কম নয়। তারা আত্মীয়কে ভোট দিতে এসেছে। বাস্তবে এসব পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েও দেয়, গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা তাদের টাকা দিয়ে প্রার্থী করেছিল। কেউ কেউ সেই টাকা না পাওয়ায় এখন ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় খারাপ লোককে পরাজিত করার জন্যও ভোটাররা অন্য প্রার্থীকে দলে দলে ভোট দিয়েছে।
এভাবেই ভারত যুগের পর যুগ ধরে সমস্যাগুলোকে মাদুরের তলায় লুকিয়ে রেখে কাশ্মীরে ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট’ চালাচ্ছে। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা হল, কাশ্মীরিদের যাদের সঙ্গেই কথা বলেছি তারাই বলেছে, তারা শিয়াদের মহররমের মিছিলের মতো করে নিজেদেরই কষ্ট দিচ্ছে। তারা বলে, ‘আর যখন আমাদের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে, তখন ভারতীয় মিডিয়া এসে সেখানে লবণ লাগিয়ে দেয়।’
ভারতের পক্ষে এই ছোট্ট উপত্যকাকে ধরে রাখা হয়তো খুবই সহজ। কিন্তু চিরকাল নয়। কারণ, একে দখল করে রাখার মূল্য অনেক বেশি। আর সেই মূল্যটা দিতে হয় সাধারণ ভারতীয় সেনাদের। তাদের বেশির ভাগ গরিব। কিন্তু যখন দিল্লি বা মুম্বাইয়ের পাঁচতারা হোটেলে ধনীদেরও মূল্য দিতে হবে, তখন কী হবে? মনে রাখতে হবে, কাশ্মীরকে ভারতের হাতে তুলে দেয় এখানকার হিন্দু রাজা।
কাশ্মীর সম্পর্কে সাধারণ ভারতীয়রা সত্য জানতে পারে না। তাদের জানানো হয়, কাশ্মীর সন্ত্রাসীদের আস্তানা। তারা জানে না, যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৬০ থেকে ৭০ হাজার কাশ্মীরি জীবন দিয়েছে। আরও ১০ হাজারের মতো মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। তারপরও বলা হয়, কাশ্মীর নাকি ভারতের অটুট অঙ্গ।
কাশ্মীরিরা অন্তর থেকে পাকিস্তানকেও চায় না, তারা কেবল চায় আজাদি। পাকিস্তান এখানে জনপ্রিয় হলেও তাদের যদি ভারত, পাকিস্তান আর আজাদির মধ্যে কোনো একটি বেছে নিতে বলা হয়, তারা আজাদিকেই নেবে। পাকিস্তান তার স্বার্থের কারণেই কাশ্মীরকে সমর্থন দেয়, সেটা কাশ্মীরিরা বোঝে। তারপরও সেটা তো আজাদিরই সমর্থন!
কাশ্মীর ভারত রাষ্ট্রের নৃশংসতার শিকার। তারা নিজেদের ভারতীয় মনে করে না। আমাদের দেখলে তারা বলে, তোমরা কি ভারত থেকে এসেছ? কাশ্মীর আর ভারতীয় মুসলিমদের সমস্যাও কিন্তু এক নয়। ভারতীয় মুসলিমদের ভারতেই থাকতে হবে। ভারতে মুসলমানদের জন্য এখন কঠিন সময় যাচ্ছে। কীভাবে ১৫ কোটি মানুষকে সংখ্যালঘু বলা যায়? তারপরও ভারতে তারা প্রান্তিক। আজ যদি আমরা তাদের তলায় ঠেলে রাখি, তাদের হতাশার চরমে তারা আমাদেরও তলার দিকে টেনে নিয়ে যাবে। আর সে কাজের জন্য ৯৯ শতাংশ মুসলমানের দরকার নেই, ১ শতাংশ মানুষই যথেষ্ট।
[দৈনিক প্রথম আলো বৃহস্পতিবার, ১৯ মার্চ ২০০৯]