Jumadal Ula 1430   ||   May 2009

যে জীবন ও আদর্শের কোনো তুলনা নেই প্রসঙ্গ : প্রামাণিকতা - ৩

Mawlana Muhammad Zakaria Abdullah

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

হাদীস শরীফ লিপিবদ্ধ হওয়া

এটা প্রমাণিত সত্য যে, স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগেও হাদীস লিখনের প্রচলন ছিল। পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণে বহু তাবেয়ীন হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। তাই একশ বছর হাদীস শরীফ অলিখিত থাকার প্রচারণা ভিত্তিহীন। বস্ত্তত এই প্রচারণার পিছনে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্বিক বিভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। গবেষণার মোড়কে উপস্থাপন করা হলেও এগুলো হচ্ছে নির্জলা মিথ্যা, যার উদ্দেশ্যই হল হাদীস শরীফের বিশুদ্ধতা ও মৌলিকত্ব সম্পর্কে দ্বিধা-সংশয় সৃষ্টি করা।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস ও সুন্নাহ এমন প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়েছে যার কোনো তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। হাদীস ও সুন্নাহর উপরে কখনো বিস্মৃতির ছায়াপাতও ঘটেনি। বহু মুহাদ্দিস যেমন তা কণ্ঠস্থ রেখেছেন তেমনি মুসলিম উম্মাহ তাদের প্রতিদিনের আমলে তা জীবন্ত রেখেছে। শিক্ষা-দীক্ষা এবং সভ্যতা-সংস্কৃতির মৌলিক উপাদান ছিল হাদীস ও সুন্নাহ। তদ্রূপ আইন-বিচার, রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সকল কাজে সুন্নাহ ছিল বিধান ও নির্দেশনার দ্বিতীয় উৎস। এজন্য বাস্তবতা এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে একটি হাদীসও যদি লিপিবদ্ধ না হত তবুও তার গ্রহণযোগ্যতা তেমনি অক্ষুণ্ণ থাকত যেমন আজ রয়েছে। সাহাবা-তাবেয়ীন যুগে হাদীস ও সুন্নাহ সংরক্ষণের পদ্ধতি এবং সে যুগের বৈশিষ্ট্য ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করলে যে কোনো সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে, এরপর আর লিপিবদ্ধ আকারে সংকলনের প্রয়োজনই থাকে না। তবুও ইতিহাসের সত্য এই যে, এই সব কিছুর পাশাপাশি সাহাবায়ে কেরামের যুগেই হাদীস শরীফের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ লিপিবদ্ধ আকারেও সংকলিত হয়েছে।

স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরীয়তের বহু বিধিবিধান লিপিবদ্ধ করিয়েছেন। বলা বাহুল্য, এগুলো হাদীস ও সুন্নাহরই অন্তর্ভুক্ত। তদ্রূপ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুমতিক্রমে সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন বিষয়ের হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন ওই লিখিত দলীলগুলো কোনোটি হুবহু আবার কোনোটির বিষয়বস্ত্ত, হাদীসের কিতাবে সংকলিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠক হাদীসের কিতাব খুলে তা দেখে নিতে পারেন। এখানে কিছু উদাহরণ পেশ করছি।

১. রিসালায়ে আমর ইবনে হাযম

ইয়ামান বিজিত হওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই অঞ্চলের শিক্ষক ও প্রশাসক হিসেবে হযরত আমর ইবনে হাযম রা.কে প্রেরণ করেছিলেন। ইয়ামানের অধিবাসীদের দ্বীন ও ঈমান শিক্ষাদানের দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত ছিল। সে সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিধিবিধান সম্বলিত একটি লিখিত দলীল তাকে প্রদান করেন। এতে তাকওয়া-পরহেযগারীর নির্দেশ এবং দাওয়াত-তালীম বিষয়ে নির্দেশনা ছাড়াও তহারাত, সালাত, যাকাত, উশর, হজ্ব-উমরা, জিহাদ, গণীমত, দিয়াত, কুরআন মজীদ স্পর্শ করার জন্য পবিত্রতা প্রসঙ্গ এবং গোত্রীয় সংকীর্ণতার নিষিদ্ধতার প্রসঙ্গ ছিল।

আমর ইবনে হাযম রা.-এর ইন্তেকালের পর এই মূল্যবান দলীল তার পৌত্র আবু বকর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আমর ইবনে হাযম-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল।    সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীন এই দলীলটিকে সুন্নতে নববীর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র মনে করতেন। ইমাম ইবনে শিহাব যুহরী রাহ. এই পুস্তিকা নিজে পাঠ করেছেন এবং তাঁর নকল সংগ্রহ করেছেন। হাকীম আবু আবদুল্লাহ নিশাপুরী রাহ. বলেছেন, হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. এবং যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব যুহরী রাহ. এই দলীলটির বিশুদ্ধতার সাক্ষ্য দিয়েছেন।-আততালখীসুল হাবীর ২/৪/১৮

ইমাম ইয়াকূব ইবনে সুফিয়ান রাহ. বলেছেন, এই পত্রের চেয়ে বিশুদ্ধ কোনো পত্রের কথা আমার জানা নেই। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবী এবং তবেয়ীগণ এ পত্রের শরণাপন্ন  হতেন এবং তাদের কোনো মত এতে উল্লেখিত দলীলের বিপরীত থাকলে তা তারা পরিহার করতেন। কিতাবুল মারিফাহ ওয়াত তারীখ ২১৬; আততালখীসুল হাবীর ২/৪১৮; মীযানুল ইতিদাল ২/২০২; তাহযীবুত তাহযীব ৪/১৮১; ফাতহুল কাদীর ২/১৩০

পরবর্তীতে এর বিষয়বস্ত্ত বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

দলীলটিতে যেহেতু বিভিন্ন বিষয়ের বিধান ছিল তাই মুহাদ্দিসগণ তাদের সংকলিত হাদীসগ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে সংশ্লিষ্ট অংশ বর্ণনা করেছেন। (দেখুন : সুনানে নাসায়ী, কিতাবুত দিয়াত ২/১০৯, ১১৩,১১৪, ১১৫-১১৬; মারাসীলে আবু দাউদ ১১০-১১ দিয়াত বিষয়ক আলোচনা। কোনো কোনো মুহাদ্দিস পূর্ণ দলীলটিও উল্লেখ করেছেন। (দেখুন : সহীহ ইবনে হিববান ১৪/৫০১-৫১০)

২. সদকা বিষয়ক একটি দলীল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিতাবুস সাদাকা লিপিবদ্ধ করালেন, কিন্তু  বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশাসকদের কাছে পাঠানোর আগেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়। এটা তাঁর তরবারির সঙ্গে খাপবদ্ধ ছিল। তাঁর ইন্তেকালের পর আবু বকর সিদ্দীক রা. এই অনুযায়ী আমল করেছেন। তাঁর পর হযরত উমর রা.।

হযরত উমর রা.-এর ওফাতের পর এই মূল্যবান দলীলটি তাঁর সন্তানদের নিকট সংরক্ষিত ছিল।-সুনানে তিরমিযী ১/৭৯

বিখ্যাত ইমামুল হাদীস ইবনে শিহাব যুহরী রাহ. বলেন, এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওই গ্রন্থের নুসখা, যাতে তিনি সদাকার বিধান লিপিবদ্ধ করিয়েছিলেন। মূল নুসখা হযরত উমর রা.-এর সন্তানদের কাছে সংরক্ষিত আছে। এটা আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর পুত্র সালিম আমাকে পড়িয়েছেন এবং আমি তা আদ্যোপান্ত মুখস্ত করে ফেলি। তদ্রূপ উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. এই গ্রন্থের নকল হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর দুই পুত্র-আবদুল্লাহ ও সালিম এর নিকট থেকে গ্রহণ করেন। আমার কাছে ওই নকলই বিদ্যমান রয়েছে।-সুনানে আবু দাউদ ১/২২০

হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. তাঁর খিলাফত আমলে যখন হযরত আনাস রা.কে বাহরাইনের আমিল নিযুক্ত করেন তখন তাকে সদাকা বিষয়ক একটি লিখিত দলীল প্রদান করেছিলেন। সম্ভবত এটাও ওই কিতাবুস সাদাকারই নকল ছিল। হযরত আনাস রা.-এর পৌত্র ছুমামা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আনাস রা.-এর নিকট তা সংরক্ষিত ছিল। বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাম্মাদ ইবনে সালামা তার নিকট থেকে এটি সংগ্রহ করেছেন এবং বর্ণনা করেছেন। অন্যান্য মুহাদ্দিসগণও তা বর্ণনা করেছেন। পরবর্তীতে হাদীসের কিতাবসমূহে সহীহ সনদে তা সংকলিত হয়েছে। (দেখুন : সহীহ বুখারী হাদীস ১৪৫৪; সহীহ ইবনে হিববান ৮/৫৭ হাদীস ৩২৬৬; সুনানে আবু দাউদ ২/৩১৫ হাদীস ১৫৬১ (তাহকীক শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা); মুসনাদে আহমদ ১/১১-১২)

এছাড়া সহীহ বুখারীসহ অন্যান্য হাদীসগ্রন্থেও এর বিভিন্ন অংশ সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে সংকলিত হয়েছে। (দেখুন : টীকা, সহীহ ইবনে হিববান, প্রাগুক্ত)

৩. হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রা.ও ইয়ামানে প্রেরিত হয়েছিলেন। তাকেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি লিখিত দলীল প্রদান করেন, যাতে সাদাকা ও অন্যান্য বিষয়ের বিধান ছিল। পরে এই দলীল বা তার নকল বিখ্যাত তাবেয়ী মুসা ইবনে তলহা (মৃত্যু : ১০৩ হি.)-এর কাছে সংরক্ষিত ছিল।

(দেখুন : মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৭১৮৭; সুনানে কুবরা বায়হাকী ৪/১২৮)

(চলবে ইনশাআল্লাহ)   

 

advertisement