যিকির : আল্লাহ পাকের স্মরণ
মরুভূমিতে এক মেষপালকের নিকট এসে এক নিঃসঙ্গ-পথিক আবেদন করলেন, ‘আমি ক্ষুধার্ত, খাবার বলতে আমার কাছে কিছু নেই; আমি-কি তোমার একটি মেষ থেকে কিছু দুগ্ধ দোহন করে নিতে পারি’? মেষপালক বললো, ‘আমি-তো এই মেষের মালিক নই; সুতরাং মালিকের অনুমতি ছাড়া কাউকে দুধ দোহন করতে দিতে পারি না। মালিক নিশ্চয়ই জানতে পারবে এবং সে এটা পছন্দ করবে না’। আসলে পথিকের মনে ছিল অন্য খেয়াল। তিনি বললেন, ‘তুমি বরং আমার কাছে একটি মেষ বিক্রয় করে দাও। মালিক যখন জানতে চাইবে, তুমি বলবে যে, একটি নেকড়ে বাঘ এসে মেষটিকে ধরে নিয়ে গেছে। নেকড়েরা-তো পশুপালগুলোতে প্রায়-সময়ই হানা দেয়। আমিও আমার ক্ষুধা নিবারণ করতে পারবো, আর তুমিও টাকা পাবে, আমাদের দু’জনেরই লাভ হবে’। মেষপালক অত্যন্ত জোরালোভাবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলল, ‘কিন্তু আল্লাহর ব্যাপারে কী-হবে’? অসাধারণ! এই কথা শুনে পথিক-ব্যক্তিটি আনন্দিত হয়ে বলল, ‘যতদিন পর্যন্ত উম্মাহর মধ্যে তোমার মতো মানুষ থাকবে, নেকড়েরা কখনও কোনো মেষকে আক্রমণ করবে না’।
মেষপালকের এটা আদৌ জানা ছিল-না যে, সে যার সঙ্গে কথা বলছে, তিনি আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর রা., যিনি মানুষের হৃৎস্পন্দন অনুভব করার জন্য সর্বদা সক্রিয় থাকতেন। আসলে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর স্মরণ হল একজন মুমিনের স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া এবং একজন মুমিনের নিকট থেকে এই রকম মন্তব্যই স্বাভাবিক; কারণ সে-জানে, আল্লাহকে স্মরণ করার কী মূল্য! আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, সর্বত্রই নেকড়েরা কেমন অবাধে মেষগুলোকে হত্যা করে চলেছে। কারো অজানা নয়, মুসলিম-বিশ্বের অধিকাংশ স্থানেই দুর্নীতি আজ একটি সাধারণ বিষয়। কিন্তু কেন? কারণ হল, আল্লাহকে স্মরণ রাখার মধ্যেই-যে পাপ ও দুর্নীতির প্রতিরোধ নিহিত, এই সহজ কথাটি আমরা অধিকাংশ মানুষ আজ বিস্মৃত হয়েছি।
আমাদের ইহজীবনের এই সফর সম্পর্কে কুরআন বলছে, এটা একটা ক্রমাগত পরিশ্রমের সফর, যার শেষে আমরা আমাদের মহান স্রষ্টার সাক্ষাতলাভে ধন্য হব।
হে মানুষ, কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তুমি তোমার সৃষ্টিকর্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছো; অতঃপর তুমি তাঁর সাক্ষাত লাভ করবে’। (সূরা ইনফিতার : ৬)
যে-ব্যক্তি আল্লাহকে স্মরণ করে, সে-তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে গন্তব্যের প্রতি। এই সফর খুবই শ্রমসাধ্য এবং এখানে চিত্তবিক্ষেপের সম্ভাবনাও বড় বেশি। শয়তান এবং আমাদের প্রবৃত্তি অব্যাহতভাবে চেষ্টা করছে আমাদেরকে বিপথগামী করতে। কিন্তু যারা সতর্ক ও জ্ঞানী, তাদের দৃষ্টি কখনোই গন্তব্য ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয় না; এবং এরাই তারা, যাদের অন্তরে সর্বদা আল্লাহর কথা জাগরুক।
‘‘নিঃসন্দেহে, আসমানসমূহ ও যমীনের এই নিখুঁত সৃষ্টি এবং দিবারাত্রির আবর্তনের মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য পর্যাপ্ত নিদর্শন রয়েছে। (আর এই জ্ঞানবান লোক হচ্ছে তারা) যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শায়িত অবস্থায় সর্বদা আল্লাহ পাক-কে স্মরণ করে’’। (সূরা আল ইমরান : ১৯০-১৯১)
আল্লাহর স্মরণ অথবা ‘যিকির’ মুসলমানদের জন্য শক্তির একটি উৎস। ‘হাদীসে কুদ্সী’-তে আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি আমার বান্দার সঙ্গে ততক্ষণ থাকি যতক্ষণ সে আমাকে স্মরণ করে’। (সহীহ বুখারী হাদীস : ৬৮৫৬)
এটা এইজন্য যে, অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগী এবং যিকির-এর মধ্যে একটা পার্থক্য বিদ্যমান। অতিমাত্রায় আনুষ্ঠানিক ইবাদতের তেমন আবশ্যকতা নেই; এক্ষেত্রে কারো ইবাদত মাত্রাতিরিক্ত হয়ে না-ওঠে সে-বিষয়ে বরং সতর্কই করা হয়েছে। কিন্তু যিকির যেন বেশি-বেশি করা হয়, এই বিষয়টির প্রতি এমনভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে, যাতে আমাদের অন্তর ও জিহবা সততই আল্লাহর স্মরণে নিয়োজিত থাকে। আমরা যেন কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল ও উদাসীন হয়ে না-পড়ি। আর এই কাজে আমরা ক্লান্ত হতে পারি না, হওয়া উচিতও নয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জান্নাতবাসীদের মনে কোনো-কারণেই কোনো দুঃখ থাকবে না; দুঃখ শুধু একটা কারণেই হবে,তা হল পার্থিব জীবনের যে-মুহূর্তগুলো তারা মহামহিমান্বিত আল্লাহ পাকের স্মরণ থেকে উদাসীন ছিল।’ (তবারানী-২০/৯৪)
এখন প্রশ্ন, আমরা কী-ভাবে আল্লাহকে স্মরণ করতে পারি, যখন আমরা তাঁকে দেখতে সক্ষম নই; এবং তাঁর সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে আমরা দৃশ্যায়িত করতে পারি না?
এ-বিষয়ে দুটি উত্তর। প্রথম, আমরা তাঁর সৃষ্টির দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারি, কারণ সৃষ্টিসমূহই স্মরণ করিয়ে দেবে স্রষ্টাকে। সূরা আল ইমরান থেকে গৃহীত পূর্বোক্ত আয়াতে এ-কথার উল্লেখ আছে; এবং আলকুরআনের বহু আয়াত এই একই-কথার সাক্ষ্য দিচ্ছে। মহাবিশ্বের যে-অকল্পনীয় বিশালতা, সেদিকে আমরা যত-বেশি লক্ষ্য করব, তার নির্মাণকর্তা মহান আল্লাহর কথা তত-বেশি মনে পড়বে। শুধু এইটুকু ভাবলেই শিহরিত হতে হয়, একটি বীজ অঙ্কুরিত হতেও কত বিবিধ শক্তির একত্রীভূত কী নিখুঁত সমন্বয়ই-না প্রয়োজন! কী-ভাবে এই বিশাল মহাবিশ্ব জটিল কিন্তু পূর্ণ-ভারসাম্য নিয়ে ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে, আর কী নিখুঁত এই ব্যবস্থাপনা! এই মহাবিশ্বের প্রতি ইঞ্চিতে-ইঞ্চিতে ক্ষুদ্র-বৃহৎ সরল ও জটিল যেখানে যা-কিছু আছে, সবাই সর্বত্র স্রষ্টার অস্তিত্ব ও উপস্থিতির কথা ঘোষণা করছে। বস্ত্তত, মহাবিশ্ব বাঁহরাবৎংব কথাটির আরবি-প্রতিশব্দ ‘আলম’, যা মূল ‘ইলম’ বা জ্ঞান থেকে গৃহীত; এবং এ-থেকে স্রষ্টাকে জানার বিষয়টি অনেকখানি অর্থময় হয়ে ওঠে। অনেকটা ‘খাতাম’ শব্দটির মতোই যার অর্থ মোহরাঙ্কিত করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পশ্চিমা-সভ্যতা যখন বিজ্ঞানের উপর প্রাধান্য বিস্তার করল, তখন স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের যে-সম্পর্ক ও সংযোগ,তা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। আলকুরআন উল্লেখ করছে, ‘আকাশ ও যমীনে (আল্লাহর কুদরতের) কত (অসংখ্য) নিদর্শন রয়েছে, যার উপর দিয়ে মানুষের গমনাগমন, কিন্তু এতদসত্ত্বেও তারা কোনোরূপ মনোযোগ দেয় না’ (সূরা ইউসুফ : ১০৫)।
অতএব অদ্যকার মুসলিম বৈজ্ঞানিকদের প্রধান কাজ হল, স্রষ্টার সঙ্গে মানুষের এই নির্বোধ-সংযোগহীনতাকে দূর করা। আর এটাই-তো প্রজ্ঞার প্রকৃত নিদর্শন যে, একজন ব্যক্তি মহাবিশ্বের দিকে দৃষ্টিপাত করে এবং বলে সুবহানাল্লাহ, সকল মহিমা ও গৌরব একমাত্র আল্লাহর।
দ্বিতীয়ত, আমরা আমাদের জীবনে আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহের আশায় পুনঃপুনঃ প্রার্থনা জানাই। এই প্রার্থনা, এই আকুতি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত মূল্যবান; কিন্তু এতদসঙ্গে সত্য ও বাস্তবতা হল, আল্লাহর রহমত দ্বারা পূর্ণরূপে পরিবেষ্টিত এই জীবন তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া একটি মুহূর্তও চলতে পারে না। ঠিক এই মুহূর্তে কেউ হয়তো এই কথাগুলি পাঠ করছে। কিন্তু একটু বিরতি নিয়ে এ-বিষয়ে আমরা একটু ভেবে দেখতে পারি। মুদ্রিত অক্ষরগুলো শনাক্ত করতে চোখ সক্রিয় আছে, চোখে প্রতিফলিত কাগজের এই ছবিকে অর্থপূর্ণ বাক্যে রূপান্তরিত করার কাজে মস্তিষ্কও সক্রিয়; এবং এই কর্ম-সম্পাদনের জন্য আমাদের মনের শান্তি ও একাগ্রতার সঙ্গে সময়-ও প্রয়োজন, অথচ এর কোনোটাই আমাদের নিজস্ব নয়। তাহলে এগুলো আমরা কোথা থেকে পেলাম?
আমরা অধিকাংশই যথেষ্ট ভাগ্যবান যে, আমরা প্রতিদিনই আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য পাচ্ছি। এ-বিয়টিকেও আমরা আমাদের বিবেচনায় আনতে পারি। কারণ খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, আহারযোগ্য খাবার প্রস্ত্ততিকরণ, খাদ্যগ্রহণ, পরিপাকক্রিয়া ইত্যাদি মিলিয়ে আমাদের একগ্রাস খাবার মুখে তোলার মধ্যেও আল্লাহ পাকের কী-বিরাট রহমত-যে বিদ্যমান, আমরা-তো উপলব্ধি করতে পারি। এটাও প্রজ্ঞার পরিচায়ক যে, একজন ব্যক্তি এটা অনুভব করে এবং সকৃতজ্ঞচিত্তে বলে ওঠে ‘আলহামদুলিল্লাহ’, সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর।
‘সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার’ এগুলি আল্লাহর যিকির-এর কিছু প্রচলিত ধরন। এগুলি উচ্চারণ করা মৌখিক যিকির; আর এগুলি অনুধাবন করা ও হৃদয়ে প্রতিফলন ঘটানো হল অন্তরের যিকির। এই দুটি ধরনই বিশেষভাবে মূল্যবান ও বাঞ্ছনীয়; এবং তারা একটি অপরটির মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে। মৌখিকভাবে পুনঃপুনঃ উচ্চারণের কারণে শব্দগুলি হৃদয়পটে গভীরভাবে খোদিত হয়, অপরদিকে আন্তরিক উপলব্ধি ও অনুভূতির প্রতিফলন মৌখিক উচ্চারণকে জীবন্ত ও প্রাণময় করে তোলে এবং উভয়ে একসঙ্গে একীভূত হয়ে এই ইহজীবনের সফরকে এমনভাবে তাৎপর্যমন্ডিত করে তোলে, যা আমাদের দৃষ্টিকে প্রকৃত গন্তব্যের প্রতি তন্ময় ও সজাগ রাখতে সাহায্য করে। এই যিকির আল্লাহ পাকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে গভীর ও শক্তিশালী ও অবিচ্ছেদ্য করে তোলে; এবং ফলত, প্রবৃত্তির সকল অসৎ-অনুচিত আকর্ষণ থেকে মুক্ত ও নিরাপদ হয়ে আমরা আমাদের হৃদয়ে নিবিড় প্রশান্তি অর্জন করতে পারি; এবং আমরা আশা করতে পারি, যে-ব্যক্তি সর্বদা আল্লাহ পাকের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে, সময় যখন আসবে, সে বঞ্চিত হবে না।
একজন নিরক্ষর মেষপালক সঠিক উপলব্ধির মানদন্ডে একজন বিরাট-মাপের মানুষ; এবং পার্থিব-দৃষ্টিতে অনেক ‘বড়-বড়’ মানুষ যারা আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল, আলোচ্য শিক্ষাদীক্ষাহীন এই মেষপালকের তুলনায় তারা কতই-না ক্ষুদ্র! অবশ্য বিষয়টি আমরা যদি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারি। #
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আবু জাফর