Shaban-Ramadan 1433   ||   July- August 2012

আল্লাহর বিধানে সংশোধন!!

মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া

 

উত্তরাধিকার সম্পদে নারীর অধিকারনিশ্চিতকরতে সরকার ১৯৬১ সালে প্রণিত মুসলিম আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। ১৯৬১ সালের আইনের অনেক ধারা কুরআন-সুন্নাহ শরীয়তের সর্বসম্মত বিধানের পরিপন্থী ছিল। ওলামা-মাশায়েখের তত্ত্বাবধানে তা সংশোধন করে নেওয়া জরুরি ছিল, কিন্তু তা না করে সংশোধনীর নামে তাতে এমন বিষয় যুক্ত করা হচ্ছে, যা আরো বেশি বাতিল মুনকার। যেমন-এই সংশোধনী প্রস্তাবনায় রয়েছে, ছেলে সন্তানের অবর্তমানে মেয়ে সন্তান বাবার পূর্ণ সম্পদ পেয়ে যাবে। মেয়ের চাচা, ফুফুরা কিছুই পাবে না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে মৃতের ভাইবোন কোন সম্পদ পাবে না। অথচ ইসলামের মীরাস আইনে মৃতের ছেলে সন্তান না থাকলে এবং মেয়ে একজন থাকলে সে পুরো সম্পদের অর্ধেক পাবে। আর মেয়ে দুই বা ততোধিক থাকলে দুই তৃতীয়াংশ পাবে। বাকীটা পাবে মৃতের ভাই-বোন। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনীতে তারা বঞ্চিত হবে।

এই সংশোধনীর সূত্র সম্পর্কে সংশোধনীর প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে : 

Increase of Daughter's Share in the absence of Son by Ijtihad.

Now the simple and rational question is, if the daughter of the predeceassed father can inherit the full share of her grandfather, why she will not fully inherit her father's property ofter latter's death.

‘‘পুত্র না থাকা অবস্থায় ইজতিহাদের ভিত্তিতে কন্যার অংশ বৃদ্ধি-প্রসঙ্গ 

একটি অতি সাধারণ যৌক্তিক প্রশ্ন হল, আগে মৃত্যুবরণকারী পিতা থেকে কন্যা তার দাদার পূর্ণ অংশের উত্তারাধিকারিনী হলে পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করলে সে কেন তার পিতার পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারিনী হবে না?’’ 

একথা জেনে রাখা প্রয়োজন যে, ইসলামী ফারায়েযে প্রত্যেক ওয়ারিছের অংশ সরাসরি কুরআন  মজীদ এবং হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। ইসলামী ফরায়েযের কারো অংশ ইজতিহাদ বা কেয়াস দ্বারা সাব্যস্ত হয়নি। আর ফিকহে ইসলামীর সাথে পরিচিত যে কোন ব্যক্তিই একথা জানেন যে, যে বিধান সরাসরি কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত সেখানে ইজতিহাদ কিয়াসের কোনো স্থান নেই।  

পুত্রহীন পিতার সম্পত্তিতে মেয়ের অংশ কুরআনে কারীমের সুস্পষ্ট আয়াত দ্বারাই প্রমাণিত। সুতরাং ইজতিহাদ দ্বারা তার অংশ বৃদ্ধি করার সুযোগ নেই। তদ্রূপ মেয়ের সাথে পিতার ভাই-বোন থাকলে তারাও যে মৃত ভাইয়ের সম্পদ পাবে তা বহু হাদীস, সাহাবা কেরামের ইজমা, কাযা ফায়সালা দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং এক্ষেত্রে ইজতিহাদের দ্বারা তাদের অংশ না দেওয়ার সুযোগ নেই।

এছাড়া সংশোধনী প্রস্তাবটি পেশ করা হয়েছে ১৯৬১ সনের নাতীর মীরাস সংক্রান্ত নং ধারার উপর কেয়াস করে। অথচ সেই ধারাটি সম্পূর্ণ শরীয়ত কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী। সুতরাং সেটার উপর কেয়াস করে কোন প্রস্তাব সংশোধনী পেশ করলে সেটাও যে শরীয়ত বিরোধী হবে তা সহজেই অনুমেয়। ১৯৬১ সনের ধারাটি নিম্নে উল্লেখ করছি। এরপর এটা যে শরীয়ত বিরোধী তার কিছু দলীল উল্লেখ করা হবে।

নং ধারা :

‘‘যাহার সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে বণ্টিত হবে, তার পূর্বে তার কোনো পুত্র বা কন্যা মারা গেলে এবং উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি বণ্টনের সময় উক্ত পুত্র বা কন্যার কোনো সন্তানাদি থাকলে, তারা প্রতিনিধিত্বের হারে সম্পত্তির অংশ পাবে, যা তাদের পিতা অথবা মাতা জীবিত থাকালে পেত।’’

১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইনের এই ধারাটি সম্পূর্ণ শরীয়ত বিরোধী আইন। কুরআন-হাদীস ইজমায়ে সাহাবার সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে আইয়ূব খানের শাসন আমলে তা প্রস্ত্তত করা হয়। কুরআন-হাদীস বিরোধী আইন হওয়ার কারণে তখন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান কোনো অঞ্চলের ওলামা-মাশায়েখ ঈমানদার শ্রেণী তা মেনে নেননি।

আর ইন্ডিয়ায় তো মুসলিম পার্সনাল বোর্ড নামে সম্পূর্ণ শরীয়তসম্মত পারিবারিক আইন রয়েছে। বৃটিশ বেনিয়াদের ভারতবর্ষে দু বছর শাসন আমলেও পারিবারিক আইন অক্ষত ছিল। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো স্বাধীন বাংলাদেশে আইউব খানের ওই পরিত্যক্ত আইন স্বসম্মানে স্থান করে নিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান নাগরিকের উপর মুসলিম আইনের নামে সম্পূর্ণ কুরআন-হাদীস বিরোধী আইন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হল বটে কিন্তু পাকিস্তানের ওই পরিত্যক্ত অংশটি রয়েই গেছে। এর চেয়েও আরো আশ্চর্য হল, বর্তমান সংশোধনী প্রস্তাব, ১৯৬১ সনের অযৌক্তিক শরীয়ত বিরোধী আইনের উপর কেয়াস করে পেশ করা হয়েছে।

১৯৬১ সনের নং ধারা কুরআন-সুন্নাহ শরীয়ত বিরোধী হওয়ার সংক্ষিপ্ত দলীল

নাতীর মীরাস সংক্রান্ত ধারার সংক্ষেপ হল :

() মৃতের এক ছেলে জীবিত আছে। আর এক ছেলের ছেলে অর্থাৎ নাতী জীবিত আছে। তাহলে ছেলে এবং নাতী সমান সম্পত্তি পাবে। ছেলে থাকাবস্থায় নাতী মীরাসের অংশীদার হচ্ছে।

() মৃতের মেয়ে আছে। আর মৃত ছেলের ছেলে অর্থাৎ নাতী আছে, কিংবা ছেলের মেয়ে ‘‘নাতনী’’ আছে। তাহলে মেয়ে পাবে এক তৃতীয়াংশ, নাতী বা নাতনী পাবে দুই তৃতীয়াংশ!!

() মৃতের ছেলে থাক বা মেয়ে থাক, তার মৃত মেয়ের ছেলে বা মেয়ে থাকলে তারাও মার অংশ পাবে। অর্থাৎ মেয়ের ঘরের সন্তানাদি যবীল আরহাম হওয়া সত্ত্বেও যবীল ফুরুয আসাবার উপস্থিতিতে অংশ পাচ্ছে।

এই তিনটি সিদ্ধান্তই ইসলামী ফরায়েযের সম্পূর্ণ বিরোধী। কুরআন-হাদীসের অসংখ্য দলীলের পরিপন্থী। বিষয়ে কিছু কথা পেশ করা হল।

সহীহ বুখারীতে হযরত যায়েদ বিন সাবেত রা. এর ফাতওয়া উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি বলেন-

ولا يرث ولد الابن مع الابن

অর্থ : ছেলে থাকাবস্থায় (মৃত) ছেলের সন্তানাদি কোন মীরাস পাবে না। (সহীহ বুখারী /৯৯৭)

* উত্তরাধিকার বন্টনের ক্ষেত্রে নিকটবর্তী দূরবর্তীর উপর প্রাধান্য পাবে। হাদীস শরীফে আছে :

عن ابن عباس رضي الله عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : الحقوا الفرائض بأهلها، فما بقي فهو لأولى رجل ذكر.

 ‘‘যাবিল ফুরুযের (কুরআনে যাদের অংশ নির্ধারিত তাদের) অংশ তাদেরকে দিয়ে দাও। এরপর যা অবশিষ্ট থাকবে তা সবচেয়ে নিকটবর্তী পুরুষ আত্মীয় পাবে।’’-সহীহ বুখারী ৬৭৩৫

এই বিধান অনুযায়ী মৃতের সম্পত্তি থেকে সর্বপ্রথম যাবিল ফুরুয অংশ পাবে। এর পর আসাবা। যাবিল ফুরুয এবং আসাবা না থাকলে যাবিল আরহাম অংশ পাবে। কিন্তু ১৯৬১ সনের আইনে ইসলামী ফরায়েযের এই মূলনীতিকে ভঙ্গ করা হয়েছে।

* ‘‘ইজমা’’ শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ অকাট্য দলীল।

ছেলের বর্তমানে নাতী, নাতনীর মীরাস না পাওয়া সাহাবায়ে কেরামের ইজমা এবং এর পরবর্তী সকল আহলে ইলমের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। 

أجمع أهل العلم على أن بني الابن وبنات الابن لا يرثون مع بني الصلب شيئًا.

সকল আহলে ইলম এর ইজমা যে, ছেলের ছেলে-মেয়ে মৃতের ছেলে থাকাবস্থায় কোন উত্তরাধিকার পাবে না।-আলআওসাত /৩৮৩

* মুআত্তা মালেকেও ইজমার কথা উল্লেখ হয়েছে।

قال مالك : الأمر المجتمع عليه عندنا والذي أدركت عليه أهل العلم ببلدنا في فرائض الميراث ... فإن اجتمع الولد للصلب وولد الابن فكان في الولد للصلب ذكر فإنه لا ميراث معه لأحد من ولد الابن.

ইমাম মালেক রহ. বলেন, আমাদের নিকট এবং আমাদের শহর মদীনাতে সকল আহলে ইলমকে যে সব বিষয়ে একমত পেয়েছি তা হল, যদি (মৃতের) ছেলে এবং ছেলের সন্তান নাতী থাকলে ছেলের বর্তমানে নাতীরা কেউ মীরাস পাবে না।-মুআত্তা মালেক পৃষ্ঠা : ৩২৩

* এক মেয়ে, ছেলের মেয়ে (নাতনী) এবং এক বোন থাকলে ১৯৬১ সনের আইন অনুযায়ী মেয়ে এক তৃতীয়াংশ আর নাতনী দুই তৃতীয়াংশ সম্পদ পাবে। আর বোন বঞ্চিত। কিন্তু ঠিক এসব আত্মীয়দের অংশ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিদ্ধান্ত এবং ফায়সালা অন্যরকম।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফায়সালা দিয়েছেন যে, মেয়ে পাবে অর্ধেক, নাতী এক ষষ্ঠাংশ। আর অবশিষ্টাংশ পাবে বোন। (সহীহ বুখারী-৬৭৪২)

উপরোল্লিখিত দলীলসমূহ থেকে প্রমাণিত হল যে, ১৯৬১ সনে নাতীর মীরাস সংক্রান্ত নং ধারাটি কুরআন-হাদীস ও শরীয়ত বিরোধী আইন।

বর্তমান সময়ে এই অবৈধ আইনের উপর কেয়াস করে ইজতিহাদের (!) ভিত্তিতে বোন/ভাইকে বঞ্চিত করে পুরো সম্পত্তি মেয়েকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ পর্যায়ে প্রশ্ন হয় যে, তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? একে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার নাম দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু ইসলাম যেখানে বোনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করেছে সেখানে বোন বঞ্চিত হচ্ছে কেন। এক নারীকে বঞ্চিত করে আর এক নারীকে সব দিয়ে দেওয়াই কি ইনসাফ? অধিকার প্রতিষ্ঠা?

ছেলেহীন পিতামাতার মেয়ের অংশ সরাসরি কুরআনের আয়াতেই উল্লেখ আছে। আর এক্ষেত্রে ভাই-বোনের অংশ পাওয়াটাও বহু হাদীস ও সাহাবা-তাবেঈদের কাযা ও ফাতওয়া দ্বারা সুপ্রমাণিত।

কিন্তু তারা কী সুপারিশ পেশ করছেন তা লক্ষ্য করুন।

    মিরাস সংক্রান্ত সংশোধনী প্রস্তাবে রয়েছে :

‘‘পুত্রের অনুপস্থিতিতে পিতামাতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হওয়ার ক্ষেত্রে কন্যার অংশ যথাসম্ভব বৃদ্ধিকরণের জন্য আইন কমিশনের সুপারিশমালা।’’

Recommendation of law commission for possible increase of Daughter's share in the succession of parent's property in absence of son.

‘‘উপরের আলোচনার আলোকে আইন কমিশন জোরালো সুপারিশ করে যে, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১-এর চতুর্থ ধারার পর আরেকটি নতুন ধারা যোগ করা হোক। আর তা হল, কন্যা/কন্যাদের অংশবৃদ্ধির বন্দোবস্ত করা। সম্পত্তির কোনো অংশ আসাবা (নিকটবর্তী আত্মীয়)দের নিকট যাওয়া নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে, যেমন-উত্তরাধিকারের সাধারণ অবস্থায় পুত্রের অনুপস্থিতে চাচার বিষয়টি।’’

 In the light of the above discussions the law commission strongly recommends a new section be added after section 4 of the Muslim Family Laws Ordinance 1961 with the provision of increasing share of daughter's by prohibiting any part of the property going to the collaterals i.e. uncles in the absence of son in usual course of inheritance.

এই প্রস্তাবটি কার্যকর করা হলে ইসলামী মীরাস অনুযায়ী যাদের সম্পত্তি পাওয়া নিশ্চিত ছিল এমন সাত শ্রেণীর ওয়ারিশ সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত হয়ে যায়।

(১) সহোদর ভাই এক বা একাধিক

(২) সহোদর বোন এক বা একাধিক

(৩) বৈমাত্রেয় ভাই এক বা একাধিক

(৪) বৈমাত্রেয় বোন এক বা একাধিক

(৫) সহোদর ভাইয়ের ছেলে

(৬) বৈমাত্রেয় ভাইয়ের ছেলে

(৭) মৃতের চাচা।

কেননা মৃতের ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে চাচা আসাবা হয়। এখন যেই আইনে মৃতের ভাই সম্পত্তি পাবে না, সেই আইনের কারণে চাচাও পাবে না।

নিম্নে প্রত্যেক ওয়ারিশের অংশ শতকরা হারে দেখানো হল :

* কন্যা এবং এক সহোদর বা বৈমাত্রেয় ভাই/বোন থাকলে মেয়ে সমুদয় সম্পত্তির ৫০% আর ভাই বা বোন ৫০% পাবে।

* একাধিক কন্যা এবং সহোদর বা বৈমাত্রেয় ভাই/বোন থাকলে কন্যারা পাবে দুই তৃতীয়ংশ। অর্থাৎ ৬৬.৬৬% আর ভাই বা বোন একজন হোক বা একাধিক তারা পাবে অবশিষ্টাংশ। অর্থাৎ ৩৩.৩৩%।

* এক কন্যা একজন এবং সহোদর বা বৈমাত্রেয় এক ভাই ও এক বোন থাকলে কন্যা পাবে সমুদয় সম্পত্তির অর্ধেক ৫০%। আর বোন একষষ্ঠাংশ অর্থাৎ ১৬.৬৬% এবং ভাই পাবে এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৩৩.৩৩%।

* একাধিক কন্যা এবং সহোদর বা বৈমাত্রেয় এক ভাই ও এক বোন থাকলে কন্যারা পাবে দুই-তৃতীয়াংশ ৬৬.৬৬% আর বোন পাবে ১১.১১%, ভাই পাবে ২২.২২%। অর্থাৎ ভাই বোন মিলে এক-তৃতীয়াংশ পাবে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে পরিষ্কার বুঝা গেল যে, যেখানে ইসলামী মিরাসে ভাই-বোনদের অংশ নিশ্চিত করেছে, সেখানে সংশোধনী প্রস্তাবে তারা চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রস্তাবিত সংশোধনী আইনে শরীয়তের মোট ৪টি অকাট্য মাসআলার বিরোধিতা করা হয়েছে।

সেই চারটি অকাট্য মাসআলা হল :

(১) ছেলের অবর্তমানে কন্যার অংশ নির্ধারিত। অর্থাৎ একজন হলে সমুদয় সম্পত্তির অর্ধেক, একাধিক হলে দুই-তৃতীয়াংশ। এটি সরাসরি কুরআন মাজীদের বিধান। এছাড়া অনেক হাদীস, সাহাবা তাবেঈনের ফাতওয়া ও আছার এবং উম্মতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।

অথচ বক্ষমান সংশোধনী প্রস্তাবে কন্যা একজন হোক বা বেশি তাদেরকে পুরো সম্পত্তি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

(২) মৃতের কন্যা এবং ভাই বা ভ্রাতুষ্পুত্র থাকলে কন্যা নির্ধারিত অংশ নেওয়ার পর (আসাবা বিনাফসিহী হিসেবে) অবশিষ্ট সম্পত্তি ভাই বা ভ্রাতুষ্পুত্র পাবে। এটিও কুরআন-সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরাম থেকে সবযুগের গোটা উম্মতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। এ পর্যন্ত এই মাসআলায় কোনো ফকীহ বা আলেম দ্বিমত করেননি। ঠিক এইসব দলীল দ্বারা মৃতের কন্যা এবং ভাই-বোন থাকলে কন্যার নির্ধারিত অংশ নেওয়ার পর অবশিষ্ট সম্পদ ভাই-বোন পাবে এটিও প্রমাণিত।

কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র এবং ভাই-বোন সকল আসাবা ওয়ারিশকে ঐসকল দলীল উপেক্ষা করে একেবারে বঞ্চিত করা হয়েছে।

(৩) মৃতের কন্যা এবং এক বা একাধিক বোন থাকলে কন্যা তার নির্ধারিত অংশ নেওয়ার পর অবশিষ্ট অংশ বোনেরা পাবে। তারা عصبة مع غيره -এর অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে বোনদের প্রাপ্যতা হাদীস আসার এবং পরবর্তীদের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বোনদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

(৪) মৃতের কন্যা এবং মৃতের চাচা থাকলে কন্যা তার নির্ধারিত অংশ নেওয়ার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি চাচা পাবে। কিন্তু উপরোক্ত প্রস্তাবনায় তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

উল্লেখিত সুপারিশমালায় কুরআন-সুন্নাহর স্পষ্ট নুসূস ও শরীয়তের অকাট্য বিধানের কত বিরোধিতা করা হয়েছে-এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আলোচনার জন্য আমরা নিম্নোক্ত শিরোনামের অধীনে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই :

(১) কুরআনে কারীমের দলীল

(২) হাদীসের দলীল

(৩) আসারে সাহাবার দলীল

(৪) ইজমায়ে উম্মতের দলীল

(৫) ১ম হিজরী থেকে ১০০ হিজরী পর্যন্ত প্রত্যেক শতাব্দীর মুজতাহিদ/ফকীহগণের ঐকমত্য অবস্থান এবং প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ফকীহগণের উদ্ধৃতিসমূহ।

(১) কুরআনে কারীমের দলীল :

মৃতের ছেলে না থাকলে কন্যার হিস্যা নির্ধারিত :

মৃতের ছেলে না থাকলে এবং কন্যা একজন থাকলে পুরো সম্পত্তির অর্ধেক পাবে, আর একাধিক কন্যা থাকলে দুই-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি পাবে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : 

يُوصِيكُمُ اللَّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ

অর্থ : আল্লাহ তোমাদের সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে আদেশ দিচ্ছেন যে, এক ছেলের অংশ দুই মেয়ের অংশের সমান। কিন্তু যদি কেবল (দুই) বা দুই-এর অধিক মেয়েই থাকে তবে মৃত ব্যক্তি যা কিছু রেখে গেছে, তারা এর দুই-তৃতীয়াংশ পাবে। আর যদি শুধু একজন মেয়ে থাকে তবে সে অর্ধেক পাবে। (সূরা নিসা ৪ : ১১)

হাদীসের দলীল

আসাবার অংশ নিশ্চিত

প্রস্তাবিত সংশোধনী আইনের মূল কথাই হল, মেয়ের চাচা অর্থাৎ মৃতের ভাই সম্পত্তি পাবে না। অথচ সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাব এবং অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যাতে তাদের অংশিদারিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। এক হাদীসে আছে

عن ابن عباس رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : الحقوا الفرائض بأهلها، فما بقي فهو لأولى رجل ذكر.

অর্থ : ‘‘আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কুরআনে কারীমের নির্ধারিত অংশ তার হকদারকে দিয়ে দাও। অতপর যা অবশিষ্ট থাকবে তা অধিক নিকটবর্তী পুরুষকে দিবে।’’

সহীহ বুখারী হাদীস নং : ৬৭৩২

সহীহ মুসলিম- ১৬১৫

জামে তিরমিযী- ২০৮৯

সুনানে ইবনে মাজাহ- ২৭৪০

সুনানে কুবরা নাসায়ী- ৬৩৩১

মুসনাদে আহমদ- ২৬৫৭, ২৯৯৩

আল আওসাত- ৬৮৩৬

সুনানে দারকুতনী- ৪/৭১-৭২

মুসনাদে আবু ইয়ালা- ২৩৬৭

মৃতের ভাই আসাবা। কন্যা নিজের অংশ নেওয়ার পর অবশিষ্টাংশ ভাই পাবে। উক্ত হাদীস দ্বারা এটাই বুঝা গেল।

মৃতের কন্যা থাকা সত্ত্বেও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃতের ভাইকে আসাবা হিসেবে সম্পত্তি দিয়েছেন। বঞ্চিত করেননি।

عن جابر رضي الله عنه، قال : جاءت امرأة سعد بن الربيع إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم بابنتيها من سعد، فقالت : يا رسول الله! هاتان ابنتا سعد بن الربيع قتل أبوهما معك في أحد شهيدا، وإن عمها أخذ مالهما. فلم يدع لهما مالا. ولا ينكحان إلا ولهما مال. قال : فقال : يقضي الله في ذلك، قال : فنزلت آية الميراث. فأرسل رسول الله صلى الله عليه وسلم إلى عمهما، فقال : أعط ابنتي سعد الثلثين وأمهما الثمن، وما بقي فهو لك.

অর্থ : জাবির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাআদ ইবনে রবী রা. এর দুই মেয়েকে নিয়ে তার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হন এবং বলেন, আল্লাহর রাসূল! এ দুজন সাআদ ইবনে রবীয়ের মেয়ে। তাদের পিতা আপনার সাথে উহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছেন। তাদের চাচা তাদের সকল সম্পদ নিয়ে গেছে। তাদেরকে কিছুই দেয়নি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তাআলা এব্যাপারে কোনো সমাধান অবতীর্ণ করবেন। অতপর মীরাসের আয়াত অবতীর্ণ হয়। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের চাচাকে ডেকে পাঠান এবং তাকে বলেন, সাআদের দুই মেয়েকে (সম্পদের) দুই-তৃতীয়াংশ, এবং তার স্ত্রীকে এক অষ্টমাংশ দিয়ে দাও। এরপর যা থাকবে তা তোমার।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৪৭৯৮; সুনানে আবু দাউদ ২৮৮৩; জামে তিরমিযী ২০৯২; মুসতাদরাকে হাকিম ৮০২৪; শরহু মাআনিল আছার ২/২৯৫; সুনানে ইবনে মাজা ২৭২০; মুসনাদে আবু ইয়ালা ২০৩৫; আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকী ৬/২১৬; সুনানে দারাকুতনী ৪/৮

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেয়েদেরকে তাদের নির্ধারিত অংশ দিলেন আর ভাইকেও বঞ্চিত করলেন না। তাকেও আসাবা হিসাবে অবশিষ্ট সম্পত্তি দিলেন।

মৃতের ছেলে এবং পিতা না থাকলে মেয়ের সাথে বোনও আসাবা হিসেবে অংশ পাবে

এধরনের পরিস্থিতিতে মৃতের সম্পত্তিতে বোনের প্রাপ্তি সুনিশ্চিত। স্বয়ং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেয়ের সাথে বোনকেও অংশ দিয়েছেন। আর সাহাবায়ে কেরামও অনুরূপ ফয়সালা দিয়েছেন। নিম্মে এ সংক্রান্ত কিছু ঘটনার ফয়সালা তুলে ধরা হচ্ছে।

عن عبد الله قال : قضى رسول الله صلى الله عليه وسلم في ابنة وابنة الابن وأخت، أعطى البنت النصف، وابنة الابن السدس تكملة الثلثين وللأخت ما بقي.

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক কন্যা, এক নাতনী ও এক বোনের উত্তরাধিকার বিষয়ে ফয়সালা দিয়েছেন যে, মেয়ে অর্ধেক, নাতনী এক ষষ্ঠাংশ যেন এই দুই অংশ নিয়ে দৃই তৃতীয়াংশ পূর্ণ হয়ে যায়। আর বোন অবশিষ্টাংশ (এক-তৃতীয়াংশ) পাবে।- সহীহ বুখারী ৬৭৪২, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৩১৭২৫, সহীহ ইবনে হিববান ৫/৪৫৩ (৬০৪৩), আলমুজামুল কাবীর তাবারানী ৯৮৬৯, আলআওসাত, হাদীস : ৬৮৪৮, মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ১৯০৩২

সাহাবায়ে কেরামের কাযা ও ফায়সালা

আমীরুল মুমিনীন উমর রা., হযরত আলী রা., আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. মুআয বিন জাবাল রা., আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা., আবু মুসা আশআরী রা. থেকে সুস্পষ্ট ফয়সালা বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া মৃতের ভাই যে আসাবা হিসাবে অংশ পাবে এতে সাহাবাদের ইজমা আছে। ইজমার অংশে এর বরাত উদ্ধৃত করা হবে ইনশাআল্লাহ। এ সকল সাহাবীদের কাযা ও ফায়সালা অন্যান্য সাহাবীদের সম্মুখেই ছিল।

* আমীরুল মুমিনীন উমর রা. এর ফায়সালা

عن أبي سلمة بن عبد الرحمن أن عمر بن الخطاب قسم المال بين الأخت والابنة شطرين.

অর্থ : আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান বলেন, উমর রা. বোন ও মেয়ের মাঝে সমান দুই ভাগে উত্তরাধিকার ভাগ করেছেন। -মুসতাদরাকে হাকেম ৮০৪৬, আস্সুনানুল কুবরা, বাইহাকী ৬/২৩৩, শরহু মাআনিল আসার ২/৩৯৪, আলআওসাত, হাদীস : ৬৮৪৬

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় ইয়েমেনে হযরত মুআয বিন জাবাল রা. এর কাযা ও ফায়সালা :

عن الأسود، قال : قضى فينا معاذ بن جبل على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم النصف للابنة والنصف للأخت.

আসওয়াদ রাহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মুআয বিন জাবাল রা. আমাদের মাঝে (অর্থাৎ ইয়ামানে, এক মেয়ে এবং একবোনের ক্ষেত্রে) এভাবে ফায়সালা করেন যে, মেয়েকে দেন সম্পদের অর্ধেক আর বোনকে দেন বাকী অর্ধেক।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৭৪১; সুনানে আবু দাউদ ২৮৮৫, শরহু মাআনিল আসার ২/৩৯৫; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ৩১৭২৫, মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ১৯০২৫; মুসতাদরাকে হকেম ৮০৪২, আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকী ৬/২৩৩

কন্যার সাথে মৃতের বোনকে উত্তরাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. ফায়সালা প্রদান করেন এবং বলেন, এটি স্বয়ং রাসূলের ফায়সালা। আবু মুসা আশআরী রা.ও  এই ফায়সালা মেনে নেন। পূর্ণ বর্ণনাটি হল, ‘‘আবু মুসা আশআরী রা.কে মেয়ে, নাতনী ও বোনের মীরাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, মেয়ে পাবে অর্ধেক আর বোন পাবে অর্ধেক। তিনি নাতনীকে কোনো অংশ দেননি। এবং তিনি-(আবু মুসা আশআরী রা.) বলেন : তোমরা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কে জিজ্ঞাসা কর। তিনিও আমার সাথে একমত হবেন। অতপর তারা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে জিজ্ঞেস করেন এবং আবু মুসা আশআরী রা.-এর কথা সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন। তিনি (ইবনে মাসউদ রা.) বলেন : (যদি আমি তার অনুরূপ ফায়সালা করি) তবে তো আমি সঠিক পথ থেকে সরে যাব; সঠিক পথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত থাকব না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফয়সালা অনুযায়ী তোমাদের মাঝে ফায়সালা করছি। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মেয়ে পাবে অর্ধেক, নাতনী পাবে এক ষষ্ঠাংশ ও বোন পাবে এক-তৃতীয়াংশ। অতপর আবু মুসা আশআরীর রা. নিকট এ সংবাদ পৌঁছলে তিনি বললেন : যতদিন তোমাদের মাঝে এ মহাজ্ঞানী জীবিত আছেন তোমরা আমার কাছে কোনো কিছু সম্পর্কে জানতে চেয়ো না।-আল মুজামুল কাবীর, তবারানী ১০/৩৬, হাদীস নং : ৯৮৭১

হাদীসটির আরবী পাঠ নিম্নরূপ-

أخرج الإمام الطبراني في المعجم الكبير : 10/36، برقم : 9871، عن هزيل بن شرحبيل أن أبا موسى سئل عن بنت وبنت ابن وأخت، فقال : للابنة النصف، وللأخت النصف، ولم يجعل لابنة الابن شيئًا، وقال : سلوا ابن مسعود، فإنه يتابعني، فسألوا ابن مسعود وأخبره بقول الأشعري، فقال : قد ضللت إذًا وما أنا من المهتدين، أقضي بينكم بقضاء رسول الله صلى الله عليه وسلم، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : للابنة النصف، ولابنة الابن السدس، وللأخت الثلث، فبلغ الأشعري فقال : لا تسألواني عن شيء ما دام هذا الحبر بين أظهركم.

আরো দেখুন : মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৩৬৯১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৮৮২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২০৯৩; শরহু মাআনিল আসার ২/৩৯৪, আসসুনানুল কুবরা, নাসায়ী ৬৩২৮, মুসতাদরাকে হাকেম ৮০২৮, আস সুনানুল কুবরা, বাইহাকী ৬/২৩৩, মুসনাদে আবু ইয়ালা ৫২১৩, সুনানে দারাকুতনী ৪/৭৯

অন্যান্য সাহাবাদের ফায়সালা

এছাড়া আরো অনেক সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে এ ফায়সালা হাদীসের কিতাবাদিতে উদ্ধৃত হযেছে। যেমন : হযরত আলী রা., যায়েদ বিন ছাবিত রা., আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা., আয়েশা রা., আবু মুসা আশআরী রা. ও সালমান ইবনে রবীআহ আলবাহিলী রাহ. প্রমুখ সাহাবা-তাবেয়ীগণ।-আলইসতিযকার ৪/৩৩৬; আলআওসাত ৭/৪৫৩; শরহু মাআনিল আছার ২/৩৯৫; সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৬/২৩৩; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩১৭২০

ইজমার দলিল

(১) ইমাম ইবনুল কাইয়িম বলেন,

أما الأنثى فقد دل القرآن على أنها إنما تأخذ النصف، ولا تمنع الأخ عن النصف الباقي إذا كانت بنت وأخ، بل دل القرآن مع السنة والإجماع أن الأخ يفوز بالنصف الباقي.

অর্থ : যদি মৃতের মেয়ে ও ভাই থাকে তাহলে কুরআনে কারীম দ্বারা প্রমাণিত যে, কন্যা অর্ধেক পাবে। আর সে ভাইকে বাকী অর্ধেক নেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারবে না। বরং কুরআনে কারীম সুন্নাতুর রাসূল এবং ইজমা দ্বারা প্রমাণিত যে, ভাই অবশিষ্ট অর্ধেক সম্পত্তি পেয়ে যাবে।-ইলামুল মুয়াককিয়ীন ১/২৭৫

(৩) ইমাম তহাবী রাহ. বলেন-

وقد أجمعوا جميعًا على أنها لو تركت بنتها وأخاها لأبيها كان للابنة النصف، وما بقي فللأخ.

অর্থ : সকলে একমত যে, মৃতের যদি মেয়ে এবং ভাই থাকে তাহলে মেয়ে পাবে অর্ধেক। আর ভাই পাবে অবশিষ্টাংশ। (শরহু মাআনিল আসার ২/৩৯৪)

(৪) ইমাম মালেক রাহ. বলেন-

الأمر المجتمع عليه عندنا أنهم لا يرثون مع الولد الذكر، ولا مع ولده الذكر شيئًا، ولا مع الأب، ويرثون مع البنات وبنات الأبناء مالم يترك المتوفى جدا أبا أب ما فضل المال يكونون فيه عصبة بعد من له فريضة مسماة، يقتسمون ذلك الفضل على كتاب الله للذكر مثل حظ الأنثيين.

অর্থ : আমাদের মাঝে সকলের ঐকমত্য বিষয় হল, মৃতের ছেলে, নাতি ও পিতার সাথে ভাই-বোন মীরাসের কোনো অংশ পাবে না। তবে তারা মৃতের মেয়ে ও নাতনীর সাথে মীরাস পাবে যদি মৃতের দাদা বা তার উপরস্থ কোন পুরুষ না থাকে। আর এক্ষেত্রে মেয়ে ও নাতনীর নির্ধারিত অংশ দেয়ার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি ভাই-বোনের মাঝে কুরআনের বিধান অনুযায়ী বণ্টিত হবে; অর্থাৎ ভাই পাবে বোনের দ্বিগুণ। (আলইকনা ফী মাসাইলিল ইজমা ২/১৫৩) মুয়াত্ত্বা মালেক পৃ : ৩২৫)

(৬) ইবনে আবদুল বার রাহ. বলেন :

إن جمهور العلماء الذين هم الحجة على من شذ عنهم قد أجمعوا على توريث الإخوة مع البنات.

অর্থ : ভাইয়েরা মেয়েদের সাথে মীরাস পাওয়ার ব্যাপারে জমহুর উলামায়ে কেরাম ঐকমত্য পোষণ করেছেন। যারা ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছেন এই ইজমা তাদের বিরুদ্ধে দলীল। (আলইসতিযকার ৪/৩৩৬)

আরো দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হাদীস : ৩১৭২২, আলমুগনী ইবনে কুদামা ৯/১০, মারাতিবুল ইজমা ইবনে হাযম, পৃ : ১৭৫, নাইলুল আওতার-শাওকানী ৬/৫৮ ও ফিকহুল মাওয়ারীস কাযী আবদুল লতীফ ২/৯৩৭

তাবেঈনের যুগ থেকে অদ্যাবধি ফকীহগণ, মুজতাহিদগণের ঐকমত্যের দলীল

চার মাযহাবের সকল ফকীহ মুজতাহিদও কন্যার সাথে ভাই-বোন ও শুধু বোনকে আসাবা হিসাবে সম্পত্তি দেওয়ার মত ব্যক্ত করেছেন। সাহাবাগণের পর থেকে প্রত্যেক শতাব্দীর ফকীহ/মুজতাহিদদের কর্মধারা ও তাওয়াতুর দ্বারা প্রমাণিত। নিম্নে প্রত্যেক শতাব্দীর ফকীহগণের উদ্ধৃতি পেশ করা হচ্ছে।

১ম শতাব্দী হিজরী

তাবেঈর মধ্যে থেকে : আবদুল্লাহ বিন উতবা রহ (মৃত ৭০)

সালমান বিন রবিয়াহ রহ. (মৃত ৩১)

 (ইস্তিযকার ৪/৩৩৪)

২য় শতাব্দী হিজরী

ইমাম মালেক রহ. (মৃত ১৭৯ হিজরী) বলেন :

الأمر المجمع عليه عندنا أن الاخوة للأب والأم ... هم يرثون مع البنات وبنات الابن.

অর্থ : আমাদের নিকট ঐকমত্য বিষয় যে, সহোদর ভাইগণ মৃতের কন্যাগণ এবং নাতনীদের সাথে উত্তরাধিকার অংশ পাবে। (মুআত্তা মালেক ৩২৫)

আবু বকর মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম ইবনুল মুনযির নাইসাপুরী বলেন :

وبهذا قال مالك بن أنس وأهل المدينة وسفيان الثوري، وأهل العراق، وهو قول أحمد بن حنبل، وإسحاق بن راهوية.

 (সহোদর ভাইগণ কন্যা এবং নাতনীর সাথে উত্তরাধিকার অংশ পাবে যদি মৃতের দাদা না থাকে।)

এটি মালেক বিন আনাস, মদীনাবাসী, সুফিয়ান সাওরী (মৃত ১৬১ হিজরী) ইরাকবাসীর মত। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (মৃত ২৪১), ইসহাক বিন রাহুয়াহ (মৃত ২৩৭) এরও মত এমনই।-আলআওসাত ৭/৪৫৪; সুনানে কুবরা বাইহাকী ৬/২৩১

ইমাম আবু হানীফা রহ. মৃত ১৫০ হিজরী, ইমাম আবু ইউসুফ রহ. (মৃত ১৮২) ও ইমাম মুহাম্মদ রহ. (মৃত ১৮৯) থেকেও অনুরূপ বক্তব্য রয়েছে। শরহু মাআনিল আসার ২/৩৯৪

৩য় শতাব্দী হিজরী

‘‘মাসাইলুল ইমাম আহমদ’’ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. (মৃত ২৪১), ইসহাক বিন রাহুয়া রহ. (মৃত ২৩৭), ইমাম আবু ইব্রাহীম ইসমাইল বিন ইসমাইল বিন ইয়াহইয়া আল মুযানী মৃত ২৬৪ হি. ‘‘মুখতাসারুল মুযানী’’ ৮/২৩৯-এ বলেন,

وللأخوات مع البنات ما بقي، إن بقي وإلا فلا شيء لهن.

 ‘‘কন্যার সাথে বোন অবশিষ্টাংশ পাবে, যদি থাকে। অন্যথায় তারা কিছুই পাবে না।

৪র্থ শতাব্দী হিজরী

* ‘‘মুখতাসারুত তহাভী’’ ইমাম তহাভী রহ. (মৃত ৩২১ হি.) পৃ. ১৪৬,

* ‘‘শরহু মাআনিল আসার’’ ইমাম তহাভীকৃত ২/৩৯৩-৩৯৫,

* ‘‘শরহু মুখতাসারিত তহাভী’’ ইমাম আবু বকর জাসসাস (মৃত ৩৭০হি.)

والأخوات مع البنات عصبة

কন্যাদের সাথে বোনরা আসাবা হবে।

* ‘‘মুখতাসারুল খিরাকী আবুল কাসেম উমর বিন হুসাইন (মৃত ৩৩৪)

তিনি বলেন :

والأخوات مع البنات عصبة لهن ما فضل

অর্থ : বোনরা কন্যাদের সাথে আসাবা হবে। তারা কন্যাদের নেওয়ার পর অবশিষ্ট পূর্ণ সম্পত্তির হকদার।’’

মুখতাসার খিরাকী ৯/৯-মুগনী

৫ম শতাব্দী হিজরী

* ‘‘মাবসূতে সারাখসী’’ শামসুদ্দীন সারাখসী রহ. (মৃত ৪৯০) ২৯/১৫৬-১৫৭

* ‘‘আননুতাফ ফিল ফাতাওয়া’’ সে সময়ের প্রধান কাযী আবুল হাসান আসসুগদী রহ. পৃ ৫১৪

* ‘‘আলমুহাযযাব’’ আবু ইসহাক ইব্রাহীম বিন আলী সিরাজী রহ. (৪৭৬ হি.) ১৭/১১০-মাজমু

* ‘‘নেহায়াতুল মাতলাব ফী দিরায়াতিল মাযহাব’’ ইমামুল হারামাইন আবদুল মালিক বিন ইউসুফ আল জুয়াইনী (মৃত ৪৭৮) ৯/৬২

والأخوات من الأب والأم، والأخوات من الأب مع البنات وبنات الابن عصبة عند الجمهور

 ‘‘সহোদর এবং বৈমাত্রেয় বোনরা কন্যাদের ও নাতনীদের সাথে আসাবা হবে। এটা জুমহুরের মত।’’-নেহায়াতুল মাতলাব ৯/৬২

* ‘‘আলমাউনাহ আলা মাযহাবি আলিমিল মাদীনা ২/৫৪২

কাযী আবু মুহাম্মাদ আবদুল ওয়াহহাব আলী বিন নসর মালেকী (মৃত ৪২২ হি.)

৬ষ্ঠ শতাব্দী হিজরী

* ‘‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/২১৪, তাহের বিন আবদুর রশীদ আলবুখারী হানাফী (মৃত ৫৪২ হি.)

* ফাতাওয়া ওয়াল ওয়ালিজিয়া ৫/৪১৬, আবুল ফাতাহ যহীরুদ্দীন ওয়াল ওয়ালিজি (মৃত ৫৪০ হি)

* ফাতাওয়া সিরাজিয়া পৃ ১৫১, ইমাম আলী বিন উসমান আল আউশী হানাফী, (মৃত ৫৭৫ হিজরী)

* ‘‘আলবায়ান ফী মাযহাবিল ইমাম শাফী’’ ৯/৫৩-৫৪, আবুল হাসান ইয়াহইয়া বিন আবুল খাইর রহ. (মৃত ৫৫৮ হিজরী) আলবায়ান ৯/৫৩-৫৪

* ‘‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ’’ ২/৪২১ মুহাম্মদ বিন আহমাদ বিন রুশদ (মৃত ৫৯৫)

তিনি বলেন :

لما أجمعوا على توريث الإخوة مع البنات فكذلك الأخوات

অর্থ : কন্যার সাথে ভাইদের যেহেতু উত্তরাধিকার হকদার হওয়ার ব্যাপারে ইজমা আছে সেহেতু বোনের বিষয়টিও তেমনি।-বিদয়াতুল মুজতাহিদ ২/৪২১

* আহকামুল কুরআন ইবনুল আরাবী (মৃত ৫৪৩) ১/৩৪৯

৭ম শতাব্দী হিজরী

* আলমুহীতুল বুরহানী ২৩/২৯৫, বুরহানুদ্দীন মাহমুদ বিন সদরুশ শরীআহ (মৃত ৬১৬ হি)

* আলইখতিয়ার লি তালীলিল মুখতার ৪/৪৪৮ আবদুল্লাহ আলমুসিলী রহ. (মৃত ৬৮৩ হি.)

* ‘‘রওযাতুত্তালেবীন ওয়া উমদাতুল মুফতীন’’ ৬/১৭, ইমাম আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া বিন শরফ নববী রহ. (মৃত ৬৭৬ হি.)

* আযযখীরা ১৩/৩৮, শিহাবুদ্দীন আলকারাফী (মৃত ৬৮৪ হি.)

* আলমুগনী ৯/৯-১০, মুওফফাকুদ্দীন ইবনে কুদামা (মৃত ৬২০ হি.)

* আলমুহাররার ফিল ফিকহ ১/২২৪ মাজদুদ্দীন ইবনে তাইমিয়া আলহাররানী (মৃত ৬৫২.)

৮ম শতাব্দী হিজরী

* কানযুদ দাকায়েক ৭/৪৮৩; আবুল বারাকাত আবদুল্লাহ বিন আহমদ আননাসাফি (মৃত ৭১০ হি.)

তাবয়ীনুল হাকায়েক ৭/৪৮৩; ফখরুদ্দীন যাইলাঈ (মৃত ৭৪৩ হি.)

* ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ২০/২৩৭, ফরীদুদ্দীন আলিম বিন আলা (মৃত ৭৮৬)

* আততানকীহ (২/৭৫৩), শামসুদ্দীন যাহাবী (মৃত ৭৪৮ হি.)

* মাজমুউ ফাতাওয়া, শায়খুল ইসলাম, ইবনে তাইমিয়া রাহ. ৩১/৩৪৬, ইমাম ইবনে তাইমিয়া (মৃত ৭২৮ হি.)

* কিতাবুল ফুরূ ৩/৯, শামসুদ্দীন আবু আবদিল্লাহ আলমাকদিসি (মৃত ৭৬৩ হি.)

* ইলামুল মুআককিঈন ১/২৭৪, আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. (মৃত ৭৫১)

* আননুকাত ওয়াল ফাতওয়ায়িদুস সানিয়্যাহ ১/৬২৪ শামছুদ্দীন আবু আবদিল্লাহ আলমাকদিসী (মৃত ৭৬৩ হি.)

৯ম শতাব্দী হিজরী

* ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ৬/৪৫৬, মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ কারদারী (মৃত ৮২৮ হি.)

* রমযুল হাকায়েক ২/২৮৮, বদরুদ্দীন আইনী রাহ. (মৃত ৮৫৫ হি.)

* আততাজ ওয়াল ইকলীল ৮/৫৮৬, আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ (মৃত ৮৯৭ হি.)

* আলইনসাফ ৭/৩১২, আবুল হাসান বিন সুলাইমান আলমারদাবী (মৃত ৮৮৫ হি.)

১০ম শতাব্দী হিজরী

* মুলতাকাল আবহুর ৪/৫০৬, ইব্রাহীম বিন মুহাম্মদ আল হালাবী মৃত ৯৫৬ হি.

* তুহফাতুল মুহতাজ শরহুল মিনহাজ ৮/৩৭৪, শিহাবুদ্দীন ইবনে হাজার আলহাইতামী (মৃত ৯৭৩ হি.)

* মাওয়াহিবুল জালীল শরহু মুখতাসারিল খলীল ৮/৫৮৫, ইমাম হাত্তাব (মৃত ৯৫৪ হি.)

* যাদুল মুসতাকনি ৪/২৮, শরফুদ্দীন মাকদিসী (মৃত ৯৬০ হি.)।

১১তম শতাব্দী হিজরী

* মাজমাউল আনহুর ৪/৫০৬, আবদুর রহমান বিন মুহাম্মাদ কালয়ূবী মৃত ১০৭৮

* তানভীরুল আবছার ৬/৭৭৬, শামছুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ আততুমুরতাশী, (মৃত ১০০৪ হি.)

* আদ্দুররুল মুনতাকা ৪/৫০৬, মুহাম্মাদ বিন আলী আলহাসকাফী মৃত ১০৮৮ হি.

* আখসারুল মুখতাসারাত ৩/১৩০, শামছুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বদরুদ্দীন (মৃত ১০৮৩ হি.)

১২তম শতাব্দী হিজরী

* ফাতাওয়া আলমগীরী ৬/৪৫০

* তাকমিলাতুল বাহর আররায়েক ৮/৪৯৬, মুহাম্মাদ বিন হুসাইন বিন আলী আততুরী (মৃত ১১৩৮ হি.)

* সুবুলুস সালাম ৩/১৯১; মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আসসানআনী (মৃত ১১৮২ হি.)

১৩তম শতাব্দী হিজরী

* হাশিয়াতুত তহতাবী আলাদ্দুর ৪/৩৮৫, সাইয়িদ আহমাদ আততহতাবী (মৃত ১২৩১ হি.)

* রদ্দুল মুহতার ৬/৭৭৬, আল্লামা ইবনে আবিদীন শামী (মৃত ১২৫২ হি.)

* আললুবাব ফী শরহিল কিতাব, পৃ. ৩*২৩৯; আল্লামা আবদুল গনী আলগুনাইমী, (মৃত ১২৯৮ হি.)

* আশশরহুস সগীর আলা আকরাবিল মাসালিক ৪/৬২১, আল্লামা আবুল বারাকাত আহমাদ আদদারদীর, (মৃত ১২০১ হি.)

* বুলগাতুস সালিক লিআকরাবিল মাসালিক ৪/৬২১, আল্লামা আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ আসসাবী, (মৃত ১২৪১ হি.)

* আল ফাওয়াইদুল মুনতাখাবাত ৩/১৩২, আল্লামা উসমান ইবনে আবদুল্লাহ, (মৃত ১২৪০ হি.)

* নাইলুল আওতার ৬/৫৮, আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে আলী আশশাওকানী, (মৃত ১২৫৫ হি.)

১৪তম শতাব্দী হিজরী

* কাশফুল হাকাইক ২/৩৪১, শায়েখ আবদুল হাকীম আফগানী (মৃত  ১৩২৬ হি.)

* ইলাউস সুনান ১৩/৩৮১, আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী (মৃত ১৩৯৪ হি.)

* আলজাওয়াহিরুন নাকিয়্যা, পৃ : ৩৩৪, শায়েখ আহমাদ ইবরাহীম আলবানহাবী, (মৃত ১৩৩৬ হি.)

* নাইলুল মারাম, পৃ. : ২০১, আল্লামা ছিদ্দীক হাসান খান ভুপালী, (মৃত ১৩০৭ হি.)।

১৫তম শতাব্দী হিজরী

* মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাতুন মুতানাওয়ীআ ২০/২০৮, শায়েখ আবদুল্লাহ বিন বায, (মৃত  ১৪২০ হি.)

* ফাতাওয়া উলামাইল বালাদিল হারাম, পৃ : ৫১১, শায়েখ মুহাম্মাদ বিন ছালিহ আলউসাইমীন, (মৃত ১৪২১ হি.)

এ দীর্ঘ আলোচনা ও উদ্ধৃতিসমূহ থেকে পুত্রহীন পিতার সম্পত্তিতে
ভাই-বোনের প্রাপ্যতা যে কত সুদৃঢ় তা সহজেই বুঝা গেল। এভাবেই মৃতের উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে জীবিত আত্মীয়দের কার অংশ কতটুকু তা শরীয়তের অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। শরীয়তের অনেক বিধান কুরআনে কারীমে বিস্তারিতভাবে নেই। কিন্তু মীরাসের বিধান একেবারে ভিন্ন। যাবিল ফুরূযের অংশ এক এক করে কুরআন মজীদে সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া হাদীস শরীফের একটি বিশাল অধ্যায়ে প্রত্যেকের অংশ ও প্রাপ্যতা খুলে খুলে বর্ণিত হয়েছে। সঙ্গত কারণেই এগুলো সাহাবাদের সময় থেকে নিয়ে চূড়ান্ত ও স্বীকৃত। ফলে কারো অংশের ব্যাপারে ১৪ শত বছর পর এসে কেয়াসের প্রয়োজনীয়তাও নেই এবং এর কোন সুযোগও নেই।

আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতা ও সন্তানদের অংশ উল্লেখ করার পর বলেন-

اباءكم وابناءكم لا تدرون ايهم اقرب لكم نفعا، فريضة من الله، ان الله كان عليما حكيما


তোমাদের পিতা ও সন্তানদের মধ্যে কে তোমাদের জন্য অধিক উপকারী তোমরা তা জাননা। নিশ্চয় এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা নিসা-১১)


ভাই-বোনদের অংশ উল্লেখ করার পর আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন :

يبين الله لكم ان تضلوا، والله بكل شيء عليم.

অর্থ : আল্লাহ তোমাদেরকে (ভাই-বোন ও ওয়ারিশদের) অংশ সুস্পষ্টভাবে বর্ননা করলেন যেন তোমরা এ ব্যাপারে ভ্রষ্টতার স্বীকার না হও। আল্লাহ সব বিষয়ে অবগত। (সূরা নিসা : ১৭৬)

মীরাছের বিধান উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন :

تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ * وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ

অর্থ : এইসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরন করবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত। তারা সেখানে স্থায়ী হবে এবং এটা মহা সাফল্য। আর যে আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হবে এবং নির্ধারিত সীমাকে লঙ্ঘন করবে তাকে দোযখে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং সেখানে তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি। সূরা নিসা-১৩-১৪

আল্লাহ তাআলা ওয়ারিশদের প্রত্যেকের অংশ নির্ধারন করে দিয়েছেন অতপর সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এই বন্টন না মেনে নিজ থেকে করলে আল্লাহর দেওয়া সীমা লঙ্ঘনের ফলে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।

মনে রাখা দরকার যে, ইসলাম কোন মানবরচিত আইন নয় এবং তা মানবীয় আবেগ দ্বারা প্রভাবিতও নয়। বরং এটি হল আল্লাহ প্রদত্ত ভারসাম্যপূর্ণ একটি দ্বীন ও শরীয়ত। তাই সাম্য ও ইনসাফের আইন একমাত্র ইসলামই দিতে পারে। এ কথা যেমন মাখলুকের অন্য সকল হকের ক্ষেত্রে সত্য তেমনি মিরাছের হকের ক্ষেত্রেও সত্য।

আর একজন মুমিনের কাজ হল, আল্লাহর হুকুম জানা। যখন কুরআন ও সুন্নাহের মাধ্যমে আল্লাহর হুকুম জানা হয়ে গেল তখন বিশ্বাস ও কর্মের জন্য অন্য কোন কিছুর অপেক্ষা নেই। যদি বিধানটির রহস্য ও তাৎপর্য নিশ্চিত ও পূর্ণর্াঙ্গভাবে জানা না যায়, কিংবা একেবারেই জানা না যায় তবুও তার বিশ্বাস ও কর্মে কোন পার্থক্য সূচিত হবে না। সে তো আল্লাহর হুকুমের গোলাম, বুদ্ধি বা তাৎপর্যের গোলাম নয়।

দ্বীন ও শরীয়ত বিদ্বেষীদের একটি শ্রেণী আছে, যারা তাদের বক্তব্য অকপটভাবে বলে থাকে। এরা যদিও দ্বীনের কঠিন দুশমন, কিন্তু এদের পক্ষ থেকে ক্ষতির আশংকা কম থাকে। ক্ষতির আশংকা ঐ শ্রেণীর দ্বীন-বিদ্বেষীদের থেকে বেশি, যারা নিফাক ও কপটতার আশ্রয় নিয়ে থাকে। এদের আল্লাহর প্রতি আস্থা নেই এবং তাঁর বিধানের উপর বিশ্বাস নেই। কিন্তু পরিষ্কার ভাষায় তা প্রকাশ করারও তাদের সাহস নেই। তাই কখনো কুরআনের দ্ব্যর্থহীন বিধানকে আলেমদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষন বলে অস্বীকার করে, কখনো নিজের পক্ষ থেকে কুরআনী বিধানের বিকৃতি সাধান করে, যেন কুরআন মানবরচিত কোন আইন, যা পরিবর্তন-পরিবর্ধনযোগ্য। নাউযুবিল্লাহ। তেমনি কখনো কুরআনের মোকাবেলায় তাদের যুক্তি ও বুদ্ধিকে পেশ করে থাকে। তারা যেন বলতে চায়, কুরআনের চেয়ে তাদের যুক্তি অগ্রগামী। তাদেরকে আমরা আল্লাহ তাআলার এই সতর্কবাণী স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

إِنَّ الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي آَيَاتِنَا لَا يَخْفَوْنَ عَلَيْنَا أَفَمَنْ يُلْقَى فِي النَّارِ خَيْرٌ أَمْ مَنْ يَأْتِي آَمِنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ

অর্থ : যারা আমার আয়াতসমূহকে বিকৃত করে তারা আমার অগোচর নয়। শ্রেষ্ঠ কে?- যে ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে সে, নাকি যে কিয়ামতের দিন নিরাপদ থাকবে? তোমাদের যা ইচ্ছা কর। তোমরা যা কর তিনি তা দেখেন। (সূরা ফুসসিলাত (৪১) : ৪০)

এ কথাটিও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, মীরাছের কুরআনী হিস্যাসমূহকে আল্লাহ তাআলা نصيبا مفروضافريضة من الله অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত হিস্যা বলেছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে, এগুলো আল্লাহর এঁকে দেওয়া সীমারেখা, যা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ তাআলা জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (সূরা নিসা (৪) : ৭, ১১, ১৩ ও ১৪)

আমরা তাদের জন্য হেদায়েতের দুআ করি। আল্লাহ সবাইকে সঠিক ইলম ও সঠিক ঈমান নসীব করুন। আমীন।

 

advertisement