Rajab 1433   ||   June 2012

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে নারীর জিজ্ঞাসা ও নারীর বিষয়ে জিজ্ঞাসা

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

রমযান ও রোযা

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন, আমি ও হাফসা নফল রোযা রেখেছিলাম। আমাদের কাছে কিছু খাবার  হাদিয়া এল। আমরা তখন খাবার খেয়ে রোযা ভেঙ্গে ফেলি। যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে এলেন আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের কাছে কিছু খাবার হাদিয়া এসেছিল। খাবারের চাহিদা থাকায় আমরা নফল রোযা ভেঙ্গে ফেলি। এখন আমাদের কী করতে হবে? তিনি বললেন, অসুবিধা নেই, তোমরা এই রোযার জায়গায় আরেকদিন রোযা রাখ।-সুনানে আবু দাউদ ১/৩৩৩

ফায়েদা : যদিও নিয়ম হল ঘটনার আগে বিধান জেনে নেওয়া, কিন্তু সব সময় তা হয়ে ওঠে না। এ ধরনের ক্ষেত্রে পরে বিধান জেনে নেওয়া জরুরি। অজ্ঞতার মধ্যে থাকা উচিত নয়। তেমনি নিজে নিজে কোনো একটি ব্যাখা্যা করে সন্তুষ্ট থাকাও উচিত নয়।

রমযানে দিনের বেলায় স্ত্রী মিলন

হযরত আবু হুরাইরা রা. বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর নিকট এসে বলল, আল্লাহর রাসূল! এই হতভাগা রমযানে দিনের বেলায় স্ত্রীর সাথে সহবাসে লিপ্ত হয়েছে! (এখন তার কী উপায়?) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার কি একটি কৃতদাস আযাদ করার সামর্থ আছে? সে বলল, জী না। তিনি বললেন, তাহলে ধারাবাহিক দুই মাস রোযা রাখতে পারবে?  সে বলল, জী না। তিনি বললেন, তাহলে তোমার কি ষাটজন মিসকীনকে খাওয়ানোর সামর্থ আছে? লোকটি বলল, তা-ও নেই। এসময় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একপাত্র খেজুর হাদিয়া এল। তিনি লোকটিকে বললেন, এগুলো তোমার পক্ষ থেকে গরিবদের মাঝে দিয়ে দাও। সে বলল, আমাদের চেয়েও গরিবকে দিব? মদীনার দুই সীমান্তের মাঝে তো আমাদের চেয়ে গরিব আর কেউ নেই। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এগুলো তোমার পরিবারকেই খাইয়ে দাও।-সহীহ বুখারী ১/২৬০

ফায়েদা : রমযান মাসে ইচ্ছাকৃতভাবে রোযা ভাঙ্গা অনেক বড় গুনাহ। ঈমানদার এই গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। কখনো শয়তানের ধোকায় পড়ে গুনাহ হয়ে গেলে সাথে সাথে অনুতপ্ত হয় এবং গুনাহমাফির পথ অন্বেষণ করে। এই হাদীসে কাফফারার বিবরণ আছে। তবে প্রশ্নকারী হতদরিদ্র হওয়ায় প্রথমে নিজের পরিবারের প্রয়োজন পূরণের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

স্বামীর অনুমতি ছাড়া নফল রোযা রাখবে না

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, জনৈক মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর নিকট এসে আরজ করলেন, আল্লাহর নবী! স্ত্রীর উপর স্বামীর কী কী হক আছে? তিনি বললেন, স্বামীর অনুমতি ছাড়া রোযা রাখবে না, তবে ফরয রোযা এর ব্যতিক্রম। স্বামীর অনুমতি ছাড়া রোযা রাখলে গুনাহগার হবে এবং তার রোযা কবুল হবে না।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৩১৭

ফায়েদা : অন্যের হক সম্পর্কে ইলম অর্জন করা ছিল সাহাবায়ে কেরামের একটি বৈশিষ্ট্য। এটিই হচ্ছে সামষ্টিক জীবনের সুখ-শান্তির চাবিকাঠি। পক্ষান্তরে অন্যের হক সম্পর্কে উদাসীন হয়ে নিজের হকের চুলচেরা হিসাবের প্রবণতা সকল আপত্তির মূল। আর অখিরাতেও তারই জিত হবে যিনি সর্বদা অন্যের হক আদায়ে সচেষ্ট থাকবেন। চিন্তাশীলগণ এই ইসলামী দর্শনের সাথে বর্তমান সময়ের অধিকার আদায়ের দর্শনকে তুলনা করে দেখতে পারেন।

মহিলাদের উত্তম জিহাদ হল হজ্ব

উম্মুল মুমেনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তো জিহাদকে সর্বোত্তম আমল বলে জানি। তাহলে আমরা কি জিহাদ করবো না? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না; তোমাদের জন্য উত্তম জিহাদ, হজ্বে মাবরুর।-সহীহ বুখারী ১/২০৬

ফায়েদা : সঠিকভাবে আমলের জন্য যেমন চাই আমলের জযবা তেমনি চাই ইলমের রাহনুমায়ী। তাই যে কাজ করতে চাই আগে সে সম্পর্কে ইলম হাসিল করি তারপর আমল করি। আর ইলম হাসিল করার অন্যতম মাসনুন তরীকা হল আলিমকে জিজ্ঞাসা করা।

স্বামী বা মাহরাম পুরুষ ছাড়া নারীরা হজ্বে যাবে না

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘‘কোনো নারী মাহরাম ছাড়া সফর করবে না এবং কেউ কোনো নারীর কাছে যাবে না তার নিকটে মাহারামের উপস্থিতি ছাড়া।’’ জনৈক ব্যক্তি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি অমুক বাহিনীর সাথে জিহাদে যাওয়ার ইচ্ছা করেছি। আর আমার স্ত্রী হজ্বে যাওয়ার ইচ্ছা্ করেছে (এখন আমি কী করতে পারি?) রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমিও তার সাথে (হজ্বে) যাও।-সহীহ বুখারী ১/২৫০২; সহীহ মুসলিম ১/৪৩৪

ফায়েদা : জিহাদে যাওয়া অনেক বড় নেক আমল। তবে নফল জিহাদের চেয়েও বড় নেক আমল স্ত্রীর পর্দা-পুশিদা এবং ইজ্জত-আব্রু রক্ষা করা।

ঋতু চলাকালীন সময় তাওয়াফ করবে না

উম্মুল মুমেনীন আয়েশা ছিদ্দীকা রা. বলেন, আমি (হজ্বের ইহরাম বেঁধে) মক্কায় এলাম। তখন আমি ঋতুবতী ছিলাম। তাই আমি বাইতুল্লাহর তাওয়াফ এবং সাফা-মারওয়ায় সাঈ করিনি। আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে (এই সমস্যার কথা বলে) প্রশ্ন করলাম। তিনি বললেন, হাজ্বীরা যা যা করে তুমিও করতে থাক। তবে পবিত্র হওয়ার আগে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করো না।-সহীহ বুখারী ১/২২৩

ফায়েদা : নারী ও পুরুষের যে কোনো সমস্যার সুন্দর সমাধান ইসলামে আছে। তবে জিজ্ঞাসা করতে হবে বিজ্ঞ আলিমকে।

অসুস্থ হলে বাহনে চড়ে হলেও তাওয়াফ করতে হবে

উম্মুল মুমেনীন উম্মে সালামা রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আমার অসুস্থতার অনুযোগ করলাম। তিনি আমাকে বললেন তুমি সওয়ারীতে চড়ে সবার পিছন দিয়ে তাওয়াফ কর। আমি মানুষের পিছন দিয়ে তাওয়াফ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইতুল্লাহর পাশে নামায পড়ছিলেন। এবং সূরা তূর তিলাওয়াত করছিলেন।-সহীহ বুখারী ১/২১৯

তাওয়াফে বিদার আগে স্রাব

শুরু হলে

উম্মুল মুমেনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, হজ্বের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী ছাফিয়্যা বিনতে হুয়াই রা.-এর ঋতুস্রাব শুরু হল। বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানো হলে তিনি বললেন, সে তো আমাদেরকে আটকে দিল? লোকেরা বলল, তিনি তাওয়াফে যিয়ারত করেছেন। একথা শুনে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে আর অপেক্ষা নয়।-সীহহ বুখারী, হাদীস ১৭৫৭; মুসনাদে আহমদ ৬/২৫৪

ফায়েদা : তাওয়াফে যিয়ারত আদায়ের পর তাওয়াফে বিদার আগে কোনো নারীর ঋতুস্রাব হলে তার উপর তাওয়াফে বিদার হুকুম থাকে না। সুতরাং তাকে তাওয়াফে বিদার জন্য মক্কা শরীফে অপেক্ষা করতে হবে না; তাওয়াফে বিদা ছাড়াই স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে পারবে।

মাজুরের পক্ষ থেকে বদলী হজ্ব

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, বিদায় হজ্বে খাছআম গোত্রের একজন নারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাবার উপর হজ্ব ফরয হয়েছে, কিন্তু এত বৃদ্ধ যে, সওয়ারীর উপর থাকতে পারেন না। সুতরাং আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্ব করতে পারি? রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ।-সহীহ বুখারী ১/২৫০, সহীহ মুসলিম ১/৪৩১

মৃতের পক্ষ থেকে বদলি হজ্ব

হযরত বুরাইদাহ রা. বলেন, জনৈক মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার মা ইন্তিকাল করেছেন। তিনি হজ্ব করেননি। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্ব করতে পারি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, তার পক্ষ থেকে হজ্ব কর।-সহীহ মুসলিম ১/৩৬২

মান্নত হজ্বের বদলি

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, জুহাইনা গোত্রের এক নারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর নিকট এসে বললেন, আমার মা হজ্বের মান্নত করেছিলেন। কিন্তু তা আদায় করার আগেই তার ইন্তেকাল হয়ে যায়। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্ব করতে পারব? আল্লাহর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তার পক্ষ থেকে হজ্ব কর। তোমার মায়ের কোনো ঋণ থাকলে তুমি কি তা পরিশোধ করতে না? সুতরাং আল্লাহর ঋণও আদায় কর। আল্লাহর ঋণ আরো বেশি আদায়যোগ্য।-সহীহ বুখারী ১/২৫০

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement