Rajab 1433   ||   June 2012

তবে কী তারা জাহেলী আইন পছন্দ করছে?

মাওলানা মুহাম্মদ আনসারুল্লাহ হাসান

 

 

মানব রচিত আইন বিধানে পরিবর্তন তথা পরিবর্ধন-পরিমার্জন সংস্কার সাধন হতে পারে এবং হয়েও আসছে। কারণ সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী মানুষের স্বাভাবিকভাবেই ভুল হয়। তারা বিভিন্ন চিন্তা-চেতনা মন-মানসিকতায় আক্রান্ত হয়। নানা পথ মতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। স্বার্থ আবেগের কারণে বিভ্রান্ত হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ রাববুল আলামীন সকল মাখলুকের স্রষ্টা বিশ্বজগতের পালনকর্তা। তাঁকে কখনো ভুল-ভ্রান্তি স্পর্শ করে না। তাঁর কোনো ভুলভ্রান্তি ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে না। তিনি সকল দোষ দুর্বলতা এবং সকল সীমা সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে মহান পূত-পবিত্র সত্ত্বা। সুতরাং তার নাযিলকৃত আইন বিধানে কোনো ধরনের পরিবর্তন সংস্কার হতে পারে না। আল্লাহর বিধানে কোনো ধরনের পরিবর্তন সাধন বা কোনো ধরনের বিরুদ্ধাচরণ চরম অন্যায় জঘন্যতম অপরাধ। যারা আল্লাহর বিধানে হাত দেওয়ার দুঃসাহস করে, আল্লাহর আইনে পরিবর্তন সংস্কারের চিন্তা-ভাবনা করে তারা চরম দুষ্কৃতিকারী, বড় জালিম এবং আল্লাহর জমিনে ফাসাদ সৃষ্টিকারী। তারা ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত।

আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে বিবাহ তালাকের বিধান বর্ণনা করার পর ইরশাদ করেছেন-

تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَعْتَدُوهَا وَمَنْ يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ

(তরজমা) সবই আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা। সুতরাং তোমরা তা লঙ্ঘন করো না। যারা আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করে তারা বড়ই জালিম।-সূরা বাকারা () : ২২৯

অনুরূপভাবে উত্তরাধিকার সম্পত্তির বণ্টনে আল্লাহ তাআলা কুরআনে নির্ধারিত অংশগুলোকেআল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হিস্যা’  আখ্যায়িত  করে

ঘোষণা করেছেন-

تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ * وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ

এসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা। যে ব্যক্তি আল্লাহ তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে তিনি তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন। যার তলদেশে নহর প্রবাহিত হবে। সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। আর এটাই মহাসাফল্য।

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহ তাঁর রাসূলের অবাধ্য হবে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবে তিনি তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন। যাতে সে চিরস্থায়ী থাকবে এবং তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।-সূরা নিসা () : ১৩-১৪

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-

إِنَّ الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي آَيَاتِنَا لَا يَخْفَوْنَ عَلَيْنَا أَفَمَنْ يُلْقَى فِي النَّارِ خَيْرٌ أَمْ مَنْ يَأْتِي آَمِنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ

(তরজমা) যারা আমার আয়াতসমূহে বিকৃত করে তারা অগোচরে নয়। কে শ্রেষ্ঠ-যে ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে সে, নাকি যে কিয়ামতের দিন নিরাপদ থাকবে? তোমাদের যা ইচ্ছা কর। তোমরা যা কর তা তিনি দেখেন।-সূরা ফুসসিলাত (৪১) : ৪০

এছাড়াও কুরআনের অনেক জায়গায় যেমন, সূরা মায়েদায় (আয়াত : ৪৮) সাবধান করা হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সুস্পষ্ট বিধানাবলির কোনো একটি বিধানের বিরোধিতা করাও হারাম কুফরি।

হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু সালাবা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা কিছু সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তোমরা সেগুলো লঙ্ঘন করো না এবং কিছু বিধান অবধারিত (ফরয) করে দিয়েছেন তোমরা সেগুলোকে পরিত্যাগ করে বিনষ্ট করো না। আর কিছু বিষয়কে হারাম বা নিষিদ্ধ করেছেন তোমরা সেগুলোকে ভঙ্গ করো না। আর কিছু বিষয় তোমাদের প্রভুর ভুলক্রমে নয়; বরং তোমাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে (মুবাহ হিসেবে) ছেড়ে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তা গ্রহণ করো এবং সেগুলোর সন্ধানের পিছে পড়ো না।-মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ৭১৯৬; তবারানী ২২/২২১; সুনানে দারা কুতনী /১৮৩

আন্তঃধর্মীয় বিবাহ আইন কুরআনের বিধান

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বর্তমান সরকারের আমলে পারিবারিক আইন সংস্কারের নামে ইসলামবিরোধী আন্তঃধর্মীয় বিবাহকে বৈধতা দানের উদ্দেশ্যেবিশেষ বিবাহ আইন ২০০৭শীর্ষক একটি নতুন আইন ইতিমধ্যে সংসদে পাশ হয়ে আইনে রূপান্তরিত হয়েছে।

বিবাহ হল ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আল্লাহ তাআলা অশ্লীলতা ব্যভিচার রোধ করার লক্ষ্যে যেমন বিভিন্ন বিধি-বিধান দিয়েছেন তেমনি মানুষকে উৎসাহিত করেছেন বিবাহের প্রতি। সে যেন তার স্বভাবগত চাহিদা বৈধ পন্থায় পূরণ করে। তাই বিবাহ-শাদি হল নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক বৈধ জীবন যাপনের খোদায়ী বন্ধন। মানবজাতির অস্তিত্বরক্ষা বংশ বিস্তারের শুদ্ধ-সুন্দর মাধ্যমরূপে নর-নারীর মাঝে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য আল্লাহ তাআলা মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন হতে বিবাহের এই বিধান দান করেছেন। আল্লাহ রাববুল আলামীনের দেওয়া বিধান অনুসারেই এই বন্ধন স্থাপিত হবে। কুরআন-সুন্নাহর হুকুম-আহকাম নিয়ম-কানুন অনুসারে এবং শরীয়তসম্মত উপায়ে বন্ধন সম্পর্ক বৈধতা লাভ করবে। কুরআন-সুন্নাহর হুকুম-আহকাম তথা ইসলামের বিধি-বিধানই সম্পর্কের মূল ভিত্তি প্রধান উপাদান। আল্লাহর বিধান মানুষের বিবেক-বুদ্ধির অনুগামী হয় না। মানুষের যুক্তি-বুদ্ধিতে বোধগম্য হোক বা না হোক আল্লাহর বিধান অনুসরণের মধ্যেই প্রতিটি মানুষের দুনিয়া আখিরাতের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যে মহান সৃষ্টিকর্তা নারী-পুরুষ উভয় সত্ত্বার মালিক, তিনিই তাদের পারস্পরিক বৈধতার জন্য বিধান দিয়েছেন। সুতরাং সে বিধান অনুসরণ করলেই পরস্পরের জন্য হারাম নিষিদ্ধ দুজন নর-নারীর মধ্যে সম্পর্ক বৈধতা লাভ করবে। তাদের পারস্পরিক জীবন যাপন হালাল বলে গণ্য হবে। অন্যথায় নয়। মোটকথা, আল্লাহর বিধানেই নারী-পুরুষ একে অপরের জন্য বৈধ হয় এবং আল্লাহর বিধানেই হারাম হয়।

আন্তঃধর্মীয় বিবাহ আইনটি সম্পূর্ণ কুরআন-সুন্নাহবিরোধী একটি আইন। কারণ আল্লাহ তাআলা শিরক কুফরি করে এমন নারী-পুরুষের সাথে মুসলমান নারী-পুরুষের বিবাহ হারাম করে দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

وَلَا تَنْكِحُوا الْمُشْرِكَاتِ حَتَّى يُؤْمِنَّ وَلَأَمَةٌ مُؤْمِنَةٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكَةٍ وَلَوْ أَعْجَبَتْكُمْ وَلَا تُنْكِحُوا الْمُشْرِكِينَ حَتَّى يُؤْمِنُوا وَلَعَبْدٌ مُؤْمِنٌ خَيْرٌ مِنْ مُشْرِكٍ وَلَوْ أَعْجَبَكُمْ أُولَئِكَ يَدْعُونَ إِلَى النَّارِ وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَى الْجَنَّةِ وَالْمَغْفِرَةِ بِإِذْنِهِ وَيُبَيِّنُ آَيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ

(তরজমা) তেমারা মুশরিক নারীদের বিয়ে করো না যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। নিঃসন্দেহে একজন মুমিন দাসী যে কোনো মুশরিক নারীর চেয়ে অনেক উত্তম। যদিও এই মুশরিক নারীকে তোমাদের বেশি ভালো লাগে। আর তোমরা (তোমাদের নারীদের) মুশরিক পুরুষদের কাছে বিয়ে দিয়ো না। যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। নিঃসন্দেহে একজন মুমিন দাস যে কোনো মুশরিক পুরুষের চেয়ে অনেক উত্তম। যদিও সেই মুশরিক পুরুষকে তোমাদের বেশি ভালো লাগে। কারণ তারা (মুশরিকরা) সকলে তো জাহান্নামের দিকে ডাকে আর আল্লাহ তার বিধানের মাধ্যমে জান্নাত মাগফিরাতের দিকে আহবান করেন। তিনি তার আয়াতসমূহ মানুষের উপকারার্থে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তারা তা অনুসরণ করতে পারে।-সূরা বাকারা () : ২২১

অন্য আয়াতে ইরশাদ করেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا جَاءَكُمُ الْمُؤْمِنَاتُ مُهَاجِرَاتٍ فَامْتَحِنُوهُنَّ اللَّهُ أَعْلَمُ بِإِيمَانِهِنَّ فَإِنْ عَلِمْتُمُوهُنَّ مُؤْمِنَاتٍ فَلَا تَرْجِعُوهُنَّ إِلَى الْكُفَّارِ لَا هُنَّ حِلٌّ لَهُمْ وَلَا هُمْ يَحِلُّونَ لَهُنَّ.. وَلَا تُمْسِكُوا بِعِصَمِ الْكَوَافِرِ

    (তরজমা) হে ঈমানদারগণ! যখন তোমাদের নিকট ঈমানদার নারীগণ হিজরত করে আসে তখন তোমরা তাদের পরীক্ষা কর। আল্লাহ অধিক জ্ঞাত তাদের ঈমানের ব্যাপারে। এরপর তোমরা যদি জানতে পার, তারা (হিজরত করে আসা নারীগণ) মুমিন তাহলে তাদেরকে কাফেরদের কাছে ফিরিয়ে দিও না। তারা (মুমিন নারীগণ) কাফেরদের জন্য বৈধ নয় এবং কাফেরগণও তাদের (মুমিন নারীদের) জন্য বৈধ নয় ... আর তোমরা কাফের নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না।-সূরা মুমতাহিনা (৬০)  : ১০

উক্ত আয়াতদ্বয় দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, কোনো মুসলিম নারী কোনো অমুসলিম পুরুষের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। অনুরূপভাবে কোনো মুসলিম ব্যক্তি কোনো কাফের, মুশরিক নারীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতে পারে না। অর্থাৎ মুসলিম-অমুসলিমের কোনো বিবাহ বৈধ হতে পারে না।

শুধু বিবাহ-শাদি নয়, কাফির-মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব, প্রেম-প্রীতি ভালবাসায় জড়িয়ে পড়া এবং যে কোনো ধরনের সম্পর্ক স্থাপনকেও আল্লাহ তাআলা কঠোরভাবে নিন্দা করেছেন এবং তা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন-

لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آَبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ   أُولَئِكَ  كَتَبَ فِي قُلُوبِهِمُ الْإِيمَانَ وَأَيَّدَهُمْ بِرُوحٍ مِنْهُ

 (তরজমা) যে জাতি আল্লাহ শেষ দিবসের উপর ঈমান রাখে তাদের আপনি কখনো দেখবেন না ওই সব লোকদের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে, যারা আল্লাহ তাঁর রাসূলের সাথে মোকাবেলারত। হোক তারা তাদের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বেরাদর কিংবা আত্মীয়-স্বজন, ওদের অন্তরে আল্লাহ ঈমানকে বদ্ধমূল করেছেন এবং তাদেরকে তার রূহ দ্বারা শক্তিশালী করেছেন।-সূরা মুজাদালা (৫৮) : ২২

তাই প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর কর্তব্য, বিবাহ-শাদি আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টিসহ সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুম মান্য করা, তার বিধানের অনুসরণ করা। এটাই মুসলমানিত্বের প্রকৃত অর্থ, যথার্থ দাবি।

বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা নারীর বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। কারণ তাদেরকে তোমরা গ্রহণ করেছ আল্লাহর নিরাপত্তায়। আর তাদের লজ্জাস্থানকে হালাল করেছ আল্লাহর বিধান দ্বারা।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১২১৮

মনে রাখা উচিত, শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম বিয়ে কোনো বিয়েই নয়। এজন্য বিষয়টি এমন নয় যে, সে শুধু একবারই হারাম কাজ করল; বরং এটা তার গোটা জীবনের অপরাধ। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের এই সম্পর্ক থাকবে ততক্ষণ হারাম সম্পর্কের গুনাহ হতে থাকবে। আর তাদের সন্তানের হুকুমের বিষয়টি তো সহজেই অনুমেয়। বিয়ের শুধু একটি বিষয়ে আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করা হলে সামাজিকতা, দাম্পত্য সম্পর্ক, নসব মীরাস ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়ে অজান্তেই আল্লাহ তাআলার অকাট্য স্পষ্ট বিধানের বিরোধিতা করা হয় তা আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। 

দেশের সর্বমহলেই আলোচিত হচ্ছে, পারিবারিক আইনে পরিবর্তন সংস্কার হঠাৎ করে এত আবশ্যক হয়ে উঠল কেন? বাংলাদেশের জাতীয় সামাজিক জীবনে কী এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হল, যার ফলে ধরনের পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়লো? যে দেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সর্বোপরি মানবিক হাজার হাজার সমস্যায় জর্জরিত, যেখানে আমাদের সমাজ অন্যায়-অপরাধের অভয়ারণ্য হয়ে পড়েছে, নীতি-নৈতিকতা চারিত্রিকতার ভিত ধ্বসে পড়েছে। দুর্নীতি সমাজ প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে, চুক্তি লেনদেনে ধোঁকাবাজি প্রকট হয়েছে, সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, ব্যাভিচারের মতো জঘন্য অপরাধগুলো বৈধ বিষয়ের মতো ভয়ঙ্কর পর্যায়ে রূপ নিয়েছে। যে দেশে গুম-হত্যাসহ অদ্ভুত অদৃষ্টপূর্ব নানা সমস্যা নিত্য উপস্থিত হচ্ছে, এমন অসংখ্য অগণিত সমস্যা যে দেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে সেখানে আন্তঃধর্মীয় বিাবহ আইনটি কেন পাশ করতে হয়েছে?

তাহলে মুসলিম নর-নারীদের জন্য আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে তারা কি জাহেলী যুগের কুফরি আইন পছন্দ করছে? এটা তো মুমিনের কাজ নয়। এটি হল ইহুদী-খৃস্টান মুনাফিকদের কাজ। আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-

أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ

(তরজমা) তাহলে তারা কি জাহেলী যুগের বিধান কামনা করে? যারা ঈমান রাখে তাদের জন্য আল্লাহ অপেক্ষা উত্তম বিধানদাতা কে হতে পারে?-সূরা মায়েদা () : ৫০

সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা বিশ্বাস মুছে দিয়ে সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে ভিত্তি গড়া হয়েছে এগুলো কি তারই সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ? সরকারের শুরু থেকেই মন্ত্রী, এমপি, নাস্তিক-মুরতাদ বুদ্ধিজীবী, তথাকথিত নারী নেত্রী এবং নাস্তিক্যবাদী মিডিয়ার অসুরিক শক্তি যে একদম খোলামেলাভাবেই ইসলাম বিরোধী অবস্থান পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে এটি তার আরেকটি ঝলকমাত্র।

তাদের কর্মকান্ড থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমান প্রজন্মকে ইসলামী বিশ্বাস মূল্যবোধের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলার একটি পরিকল্পিত কর্মপন্থা তাদের রয়েছে। কারণ আইন পাশ করার পর বিভিন্ন মিডিয়াতে ধরনের বিবাহকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বর্তমান সরকারের অবশ্য কর্তব্য হবে সংসদে বিল এনে এই শরিয়া নৈতিকতা বিরোধীবিশেষ বিবাহ আইনবাতিল করা এবং ভবিষ্যতে ধর্মীয় বিষয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে চাইলে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ অভিজ্ঞ মুফতীগণের সাথে আলোচনা পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। অন্যথায় শুধু সরকার নয়, পুরো দেশ জাতির জন্য তা এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। ধরনের আত্মঘাতী আইনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এটাই প্রত্যাশা। আল্লাহ তাআলা মুসলিম জাতিকে ধরনের ষড়যন্ত্র থেকে হেফাযত করুন। আমীন।

ইহুদী-খৃস্টান নারীদের বিবাহ করা

বাকি থাকল ইহুদী-খৃস্টানদের প্রসঙ্গ। এক্ষেত্রে কোনো মুসলিম মেয়েকে তাদের ছেলের কাছে বিয়ে দেওয়া তো এমনই হারাম যেমন মুশরিক মেয়েকে বিয়ে করা হারাম। তবে আহলে কিতাবের কোনো মেয়েকে কোনো মুসলিম পুরুষের জন্য বিয়ে করার বিষয়ে সূরা মায়েদা (আয়াত : ) শর্তসাপেক্ষে ছাড়ের বিধান রয়েছে। কিন্তু বিধানটি অনেকে ভুল বুঝে কিংবা ভুল প্রয়োগ করে। তাই বিষয়ে আলকাউসার রবীউস সানী২৮ হি., মে০৭ . সংখ্যায় (পৃষ্ঠা : ০৯) বিস্তারিত একটি ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছে। তা এখানে উদ্ধৃত হল :

‘‘মুসলিম ছেলেদের জন্য আহলে কিতাব মেয়েদেরকে বিবাহ করার বিষয়ে ইসলামী শরীয়তের হুকুম কয়েক ভাগে বিভক্ত এবং বিভিন্ন শর্ত প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যার দাবীদার। তাই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে একটি ভূমিকাসহ কিছুটা বিস্তারিতভাবে জবাব পেশ করা হল।

ভূমিকা

অনেক মানুষকে বলতে শোনা যায়মুসলমান ছেলেদের জন্য আহলে কিতাব মহিলাদের বিবাহ করা বৈধ।এটি একটি ব্যাখ্যাবিহীন অসম্পূর্ণ কথা। কেউ কেউ একথা শুনে মনে করেন যে, যে কোনো ইহুদী-খৃস্টান মহিলাকে বিবাহ করা বৈধ। অথচ ধারণা নিতান্তই ভুল।

প্রকাশ থাকে যে, উত্তরপত্রে তিনটি শব্দ ব্যবহৃত হবে। () বিবাহসংগঠিতহওয়া () বিবাহনা জায়েযহওয়া () বিবাহঅনুত্তমহওয়া। তিনটি শব্দের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা নিম্নরূপ :

বিবাহসংগঠিতহওয়ার অর্থ হচ্ছে, কাজ সম্পাদনের পর ওই দম্পতির স্বামী-স্ত্রী সুলভ সম্পর্ক ব্যভিচার বলে গণ্য হবে না এবং তাদের সন্তান বৈধ বলে গণ্য হবে।

আর বিবাহনা জায়েযহওয়ার অর্থ হচ্ছে, কাজটি করা শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ গোনাহের কাজ এবং তা থেকে বিরত থাকা কর্তব্য।

আর বিবাহঅনুত্তমবলে বুঝানো হয়েছে কাজটি সম্পূর্ণ অবৈধ না হলেও তা পরিত্যাজ্য এবং তা থেকে বেঁচে থাকা উচিত।

জেনে রাখা আবশ্যক যে, কোনো ইহুদী-খৃস্টান মহিলার সাথে বিবাহ শরীয়তের দৃষ্টিতে বিবাহ বলে গণ্য হওয়ার জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে। এদুটি শর্তের কোনো একটি না পাওয়া গেলে সেটি বিবাহ বলেই গণ্য হবে না; বরং যিনা ব্যভিচার সাব্যস্ত হবে। তবে উভয় শর্ত পাওয়া গেলেই যে তাদেরকে বিবাহ করা বিনা দ্বিধায় নিঃশর্ত জায়েয বৈধ হয়ে যাবে বিষয়টি এমনও নয়; বরং বিবাহের পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বেই আরও কয়েকটি শর্তের উপস্থিতির ব্যাপারে আশ্বস্ত হওয়া আবশ্যক। যদি ওই শর্তগুলো না পাওয়া যায় তবে সে ক্ষেত্রেও বিবাহ জায়েয হবে না। এর পরের কথা হল, এই শর্তগুলোও যথাযথ বিদ্যমান থাকলে বিবাহ তো জায়েয হয়ে যাবে, কিন্তু কাজ যে অবশ্যই মাকরূহ হবে তা তো বলাই বাহুল্য। ইসলামী শরীয়তে যেখানে মুসলিম নারীকে বিবাহ করার ক্ষেত্রেও নামাযী শরীয়তের অনুসারী নারীকে পছন্দ অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে সেখানে যে মহিলা ইসলামের কালিমাকেই মানে না (যদিও সে আহলে কিতাব হয়ে থাকুক এবং বিবাহ সহীহ হওয়ার নির্ধারিত শর্তসমূহও বিদ্যমান থাকুক) তাকে বিবাহ করা কি আদৌ পছন্দনীয় হতে পারে? এখানে ভুল বোঝাবুঝির মূল কারণ এই যে, প্রধান দুই শর্ত সাপেক্ষে আহলে কিতাব মহিলার সঙ্গে বিবাহ শুদ্ধ হওয়াকেই জায়েয হওয়া বলে মনে করা হয়। অথচ বিবাহ শুদ্ধ হলেই জায়েয হয় না; বরং জায়েয হওয়ার জন্য ভিন্ন শর্ত রয়েছে। সেদিকে লক্ষ করা হয় না। এরপর বিবাহ জায়েয হওয়ার শর্তাবলি বিদ্যমান থাকা অবস্থায় যে বিবাহ সম্পন্ন হয়, তাকে মাকরূহ বিহীন বিবাহ ধারণা করা হয়ে থাকে; অথচ ধারণা সহীহ নয়। এজন্য নিম্নে আহলে কিতাব মহিলাদের বিবাহ করা সম্পর্কিত ইসলামের নির্দেশনাসমূহ তিনটি স্তরে কিছুটা বিশ্লেষণের সাথে তুলে ধরা হল। বিষয়টি যথাযথভাবে বুঝে নেওয়া আবশ্যক।

এক. বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি

প্রথমেই জানা দরকার যে, যুগের অধিকাংশ ইহুদী খৃস্টান আহলে কিতাব নামধারীরা আদমশুমারীতে ওই দুই ধর্মের লোক বলে সরকারিভাবে রেজিষ্ট্রিকৃত হলেও মূলত তারা কোনো আসমানী কিতাব বা ধর্মে বিশ্বাসী নয়; বরং ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে জড়বাদী বস্ত্তবাদী নাস্তিকই বটে। তাই কোনো নারীর শুধু সরকারী খাতায় ধর্মাবলম্বী বলে নিবন্ধিত হওয়া কিংবা ইহুদী বা খৃস্টান নামধারী হওয়াই তার সাথে মুসলমান পুরুষের বিবাহ সহীহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত শর্তসমূহ পূর্বে যাচাই করে নিতে হবে।

() মেয়েটি বস্ত্তবাদী নাস্তিক না হতে হবে; বরং প্রকৃত অর্থে ইহুদী বা নাসারা তথা আহলে কিতাব হতে হবে। জন্য তার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উপস্থিতি জরুরি। () আল্লাহ তাআলার সত্তা অস্তিত্ব স্বীকার করা। () ইহুদী হলে মুসা . তাওরাতের উপর আর খৃস্টান হলে ঈসা . ইঞ্জিলের উপর ঈমান থাকা।

() মেয়েটি পূর্ব থেকেই ইহুদী বা খৃস্টান ধর্মে বিশ্বাসী হতে হবে। মুরতাদ, অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে ইহুদী বা খৃস্টান হয়েছে এমন না হতে হবে। তাই  কোনো মুরতাদের ইহুদী-খৃস্টান মেয়ের সাথেও মুসলমান পূরুষের বিবাহ সংগঠিত হওয়ার সুযোগ নেই।

এসব শর্ত কোনো ইহুদী বা খৃস্টান মেয়ের মধ্যে পাওয়া গেলে শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী তাকে বিয়ে করলে বিবাহ শুদ্ধ বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ সকল শর্ত সাপেক্ষে বিবাহের আকদ করলে তাদের একত্রে থাকা ব্যভিচার হবে না; বরং তাদের মেলামেশা বৈধ ধরা হবে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, কেবল শর্তগুলো পাওয়া গেলেই তাদেরকে বিবাহ করা জায়েয তথা নিস্পাপ কাজ বলে গণ্য হবে; বরং সে জন্য দরকার আরও কয়েকটি শর্তের উপস্থিতি। যা পরবর্তী ধাপে বর্ণনা করা হচ্ছে। -আহকামুল কুরআন, জাস্সাস /৩২৩-৩২৬; তাফসীরে রূহুল মাআনী /৬৪; ফাতহুল কাদীর /১৩৫; আদ্দুররুল মুখতার /৪৫, /২৫৫-২৫৬; বাদায়েউস্ সানায়ে /১২৫-১২৬; বুহুস /৪১৫; তাফসীরে মাজহারী /৪২

দুই.

বিবাহ জায়েয হওয়ার শর্তাবলি

() ইহুদী-খৃস্টান মেয়েকে বিবাহের আগে এই বিষয়ে প্রবল আস্থা থাকতে হবে যে, এই বিবাহে স্বামীর দ্বীন-ধর্মের কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই; বরং এই বিবাহের পরও সে ঈমান দ্বীনের উপর অটল থাকতে পারবে ইনশাআল্লাহ।

() এই ব্যাপারেও নিশ্চিত ধারণা আস্থা থাকতে হবে যে, এই দম্পিতির যে সন্তানাদি জন্মগ্রহণ করবে (মা আহলে কিতাব হওয়ার কারণে) তাদের দ্বীন-ঈমান রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো বাধা শিক্ষা-দীক্ষা অনুযায়ী জীবন কাটাতে পারবে। পুরুষ অথবা তার ভবিষ্যত সন্তানদের ক্ষেত্রে উক্ত বিষয়ে কোনো আশঙ্কা থাকলে বিবাহ জায়েয হবে না।

() বিবাহের আগে ভালোভাবে জেনে নিতে হবে, যে রাষ্ট্রের মহিলাকে বিবাহ করার ইচ্ছা করছে সে রাষ্ট্রে
সন্তানদেরকে মায়ের ধর্মের অনুসারী গণ্য করার আইন রয়েছে কি না। অর্থাৎমা অমুসলিম হলে সন্তানও অমুসলিম ধর্তব্য হবেএরকম আইন থাকলে সেখানে থেকে ওই মহিলাকে বিবাহ করা জায়েয হবে না।

() তালাক বা স্বামীর ইন্তেকালের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলে সন্তানরা ধর্মের দিক থেকে মায়ের অনুসারী গণ্য হবে এবং স্বামী বা স্বামীর ওয়ারিশরা তাদের নিতে পারবে না-এই ধরনের কোনো আইন যে দেশে রয়েছে সে দেশে অবস্থিত কোনো আহলে কিতাব মহিলাকেও বিবাহ করা জায়েয হবে না।

() যদি আলামত-প্রমাণের মাধ্যমে স্পষ্টত বোঝা যায় যে, এই বিবাহের কারণে ইসলামী রাষ্ট্র বা মুসলমানদের কোনো ক্ষতি হবে তাহলে বিবাহ থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। উপরোক্ত শর্তগুলোর দিকে সূরা মায়েদার নং আয়াতের শেষাংশে ইঙ্গিত রয়েছে। বিধর্মী রাষ্ট্রের ইহুদী-খৃস্টানদের মধ্যে যেহেতু সাধারণত উপরোক্ত শর্তগুলো পাওয়া যায় না তাই ফুকাহায়ে কেরাম ঐক্যবদ্ধভাবে এই ফতোয়া দিয়েছেন যে, বিধর্মী রাষ্ট্রের কোনো আহলে কিতাব মহিলাকে বিবাহ করা মাকরূহে তাহরীমী; তথা না জায়েয গোনাহের কাজ। কোনো আহলে কিতাব মহিলা যদি ইসলামী রাষ্ট্রের অধিবাসী হয়ে থাকে এবং উপরোক্ত শর্তগুলো পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যায় তাহলে বিবাহ যদিও সংঘটিত হয়ে যাবে কিন্তু তা হবে খুবই অনুত্তম কাজ। যার আলোচনা তৃতীয় ধাপে আসছে। উপরোক্ত আলোচনার স্বপক্ষে কিছু নির্ভরযোগ্য দলীল প্রামাণ নিম্নে পেশ করা হল,

قال ابن عباس : لا يحل نساء أهل الكتاب إذا كانوا حربا.

 প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, ‘আহলে কিতাব মহিলাগণহারবীতথা কাফের রাষ্ট্রের অধিবাসিনী  হলে তাদের সাথে বিবাহ বন্ধন হালাল নয়।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ১৬৪৩১

وتكره كتابية الحربية إجماعا، لانتفاح باب الفتنة من إمكان التعلق المستدعي للمقام معها في دار الحرب، و تعريض الولد على التخلق بأخلاف أهل الكفر.

সুপ্রসিদ্ধ ফক্বীহ আল্লামা ইবনে হুমাম রহ. (মৃত : ৮৬১ হি.) বলেন, কাফের রাষ্ট্রের আহলে কিতাব মহিলাকে বিয়ে করা ফিকাহবিদদের সর্বসম্মতিক্রমে মাকরূহে (তাহরীমী বা না জায়েয) কারণ স্বামীকে কাফের রাষ্ট্রে তার সাথে বসবাস করতে হবে। ফলে সকল প্রকার ফিতনার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে এবং এতে সন্তানদেরকে কাফেরদের  সমাজে তাদের মতো করে বেড়ে উঠতে বাধ্য করা হবে।-ফাতহুল কাদীর /১৩৫

সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ আল্লামা দারদীর রহ. বলেন, কাফের রাষ্ট্রের আহলে কিতাব মেয়েকে বিয়ে করা আরও কঠিনভাবে নিন্দনীয়। কারণ মুসলিম রাষ্ট্রের আহলে কিতাব মহিলার চেয়ে এদের ক্ষমতা অনেক বেশি থাকে। ফলে মহিলাটি সন্তানদেরকে স্বীয় ধর্মের উপর লালিত পালিত করতে থাকবে এবং সন্তানের পিতাকে ব্যাপারে সে কোনো পরওয়াই করবে না।-আশশারহুস সাগীর /৪০৬

বিখ্যাত ফকীহ আল্লামা শারবীনী রহ. বলেন, কিন্তু যে সকল আহলে কিতাব মহিলা কাফের রাষ্ট্রে থাকে তাদেরকে বিবাহ করা মাকরূহ (তাহরীমী) তদ্রূপ বিশুদ্ধ মতানুযায়ী মুসলমান দেশে বসবাসকারিনী আহলে কিতাব মহিলাকে বিয়ে করা দোষনীয়; ফিতনার আশঙ্কার কারণে। কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্রের চেয়ে কাফের রাষ্ট্রের অধিবাসিনীকে বিয়ে করা অধিক গর্হিত কাজ।-মুগনীল মুহতাজ /১৮৭

জামেয়া আজহারের প্রখ্যাত শায়খ আব্দুল্লাহ আল গুমারী রহ. বলেন, কাফের রাষ্ট্রের আহলে কিতাব মহিলাদেরকে বিয়ে করার বড় একটি খারাবী হল, সন্তানাদি মার মতোই খৃস্টান হয়ে যায়। কারণ পিতার মৃত্যু ঘটলে মা নিজের ধর্মের অনুসারী করে সন্তানদেরকে লালন করতে থাকে। আর যদি স্বামী তালাক দিয়ে দেয় তাহলে রাষ্ট্রীয় আইনে স্বামী সন্তান নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পায় না। ফলে সন্তানরা মার সাথে থেকে তার ধর্মেই দিক্ষিত হয়।-দফউশ্ শক ১৯

এরপর তিনি (শায়খ আব্দুল্লাহ) বেশ কিছু বাস্তব ঘটনার উদাহরণ নিয়ে এসেছেন, যেগুলোতে দেখা গেছে যে, সন্তানরাও তাদের মায়ের ধর্মাবলম্বী হয়েই বড় হয়ে উঠেছে আহলে কিতাব হয়ে গেছে।

আরও দ্রষ্টব্য : আহকামুল কুরআন, জাস্সাস /৩২৬; আহকামুল কুরআন, থানভী /৪০৪; তাফসীরে মাজহারী /৪১; তাতার খানিয়া /

তিন.

মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারিনী ইহুদী-খৃস্টানকে বিবাহের হুকুম

আহলে কিতাব নারী যদি মুসলমান রাষ্ট্রে বসবাসকারিনী হয় এবং তাদেরকে বিয়ে করলে স্বামী বা সন্তান বিধর্মী হওয়ার আশঙ্কা নাও থাকে তবুও সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন চার মাযহাবের ফেকাহবিদগণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাদেরকে বিয়ে করা মাকরূহ বলেছেন।

সাহাবী হুযায়ফা রা. এক ইহুদী মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। হযরত উমর রা. পত্র মারফত ওই মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার পারমর্শ দিলেন। তখন তিনি লিখে পাঠালেন, যদি তাকে বিয়ে করা হারাম হয়ে থাকে তাহলে আমি ছেড়ে দিব। উত্তরে হযরত জানালেন, আমি হারাম হওয়ার কথা বলি না, তবে আমার আশঙ্কা হয় এভাবে তাদের ব্যভিচারিনীদেরকেও বিবাহ করা শুরু হবে।-ইবনে আবি শাইবা, হা : ১৬৪১৭

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘হুযায়ফা রা. হযরত উমর রা.-এর শাসন আমলে এক ইহুদী মহিলাকে বিয়ে করেন। তখন উমর রা. তাকে বললেন, ‘তুমি ওই মেয়েকে তালাক দিয়ে দাও। কারণ সে হল অগ্নিকুন্ড।’-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস : ১০০৫৭

ঘটনার কিছু দিন পর হযরত হুযায়ফা রা. ওই মেয়েকে তালাক দিয়ে দেন।

হযরত ত্বলহা রা. জনৈক ইহুদী মহিলাকে বিয়ে করলে খলিফা হযরত উমর রা. তাকে তালাক দিতে বাধ্য করেন।-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস : ১০০৫৯

হযরত উমর রা.-এর যুগ স্বর্ণযুগের অন্তুর্ভুক্ত। তার প্রশাসনের অধীনে বসবাসকারিনী আহলে কিতাব মহিলার বিয়ের ব্যাপারে যদি তার অভিমত হয়ে থাকে তবে বর্তমান যুগে ইহুদী-খৃস্টান নারীদের অবস্থা দেখলে তিনি কি হুকুম দিতেন তা সহজেই অনুমেয়। হযরত হাসান রা.কে একদা আহলে কিতাব মহিলাকে বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি এর জবাবে বলেছিলেন, আহলে কিতাব মহিলাকে কেন বিবাহ করতে হবে? অথচ আল্লাহ তাআলা প্রচুর মুসলমান রমণী রেখেছেন।-রুহুল মাআনী /৬৬

আল্লামা জাস্সাস রহ. তাদের নারীকে বিয়ে করা মাকরূহ হওয়ার আরেকটি কারণও বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ তাআলার ইরশাদ (তরজমা) যারা আল্লাহ পরকালে বিশ্বাস করে তাদেরকে আপনি আল্লাহ তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না।-সূরা আলমুজাদালাহ ২২

আর বিবাহ যে ভালোবাসা সৃষ্টি করে এটা তো বলাই বাহুল্য।-আহকামুল কুরআন, জাস্সাস /৩২৬

এছাড়াও চার মাযহাবের ফকীহগণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে মুসলিম দেশে বসবাসকারিনী আহলে কিতাব মহিলাদেরকেও বিয়ে করা মাকরূহ তথা অনুত্তম বলেছেন।-আদদুররুল মুখতার /৪৫; ফাতহুল কাদীর /১৩২-১৩৬; আলমুগনী /৫৯০; আলমুফাস্সাল /১৮-১৯; আহকামুল কুরআন, জাস্সাস /৩২৪; আহকামুল কুরআন থানভী /৪০৫

পুরো বিষয়টির জন্য আরও দেখা যেতে পারে : তাফসীরে ইবনে কাসীর /৩০; তাফসীরে কুরতুবী /৫১; মাআরিফুল কুরআন /৬০-৬৪; আলমাবসুত /২১০; আলমুহীতুল বুরহানী /১১০; আলবাহরুর রায়েক /১০৩; আননাহরুল ফায়েক /১৯৪; ফাতহুল কাদীর /১৩৫-১৩৬; আলমুফাস্সাল /১২-২৪; দাফউশ্শাক্কি ওয়াল ইরতিয়াব, আব্দুল্লাহ আলগুমারী রহ.’’      


 

 

 

advertisement