Jumadal Akhirah 1433   ||   May 2012

সাহসের নজির চাই সব দেশে

খসরূ খান

ভালো নজির স্থাপন করল পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালত। আদালতের নির্দেশ অমান্য করায় এবং এভাবে আদালত অবমাননা হওয়ায় পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করে ২৬ এপ্রিল শাস্তি দিয়েছে ওই আদালত। প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রেজা গিলানী আদালতে হাজির হওয়ার পর তাকে ৩০ সেকেন্ডের প্রতীকী শাস্তি দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ আদালতের সাত সদস্যের নির্দিষ্ট ওই বেঞ্চের প্রধান বিচারপতি নাসির উল মুলক বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করায় পাকিস্তানের সংবিধানের ৬৩ (১) (জি) ধারায় প্রধানমন্ত্রী দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তাকে প্রতীকী শাস্তিও দেওয়া হয়েছে। এজন্য তাকে আর জেলে যেতে হবে না। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এ রায় ও সাজার কারণে তাকে সংসদ সদস্যপদ খোয়াতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়তে হতে পারে। পাকিস্তানসহ দেশ-বিদেশের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো বলেছে, এ রায়ের কারণে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবারও অস্থিতিশালী হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের প্রতি বিচারবিভাগের দুর্বলতা ও দৃষ্টিকটু নমনীয়তা দেখে দেখে অভ্যস্ত উন্নয়নশীল বহু দেশের নাগরিকরা দারুণ স্বস্তি ও আনন্দ প্রকাশ করেছেন। শাসকদের বিষয়ে বিচারবিভাগের এই দৃঢ়তা বহু দেশের বিচারবিভাগের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।

নিকটঅতীতে পাকিস্তানের বিচারবিভাগের এই দৃঢ়তার প্রথম ইস্যুটি সৃষ্টি হয় সে দেশের প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মাদ চৌধুরীর অনমনীয় অবস্থানের কারণে। সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের আমলে সরকারকে জব্দ করা ও বেকায়দায় ফেলার মতো বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর তাকে বে-আইনিভাবে বরখাস্ত করেন প্রেসিডেন্ট মোশাররফ। ওই বিচারপতি প্রতিবাদে নেমে পড়েন এবং দেশজুড়ে বিভিন্ন আদালতের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেন। তার আন্দোলনে ব্যাপক সাড়া দেন সে দেশের আইনজীবীরা। রাজনৈতিক দলগুলোর শর্ত ও সমর্থনে নির্বাচনের পর নতুন সরকার (পিপলস পার্টি) তাকে পুনর্বহাল করে। আগের সামরিক সরকার ও বর্তমান পিপিপি সরকারের আমলে এই বিচারপতি বিভিন্ন পর্যায়ে গুম হওয়া নাগরিকদের ফিরিয়ে দিতে রাষ্ট্রীয় এজেন্সির প্রধান কর্তা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের আদালতে উপস্থিত হয়ে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য করেন। অনেক ক্ষেত্রে অপহৃতদের ফিরিয়ে দিতে তাদের ঘণ্টার হিসেবে সময় বেঁধে দেন। এভাবে বহু নিখোঁজ সরকারবিরোধী পাকিস্তানী নাগরিককে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। সর্বশেষ পাক প্রেসিডেন্ট জারদারির পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সামরিক কর্মকর্তার কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায়ের অভিযোগ সংবলিত চিরকুট দেওয়া (মেমোগেট কেলেঙ্কারি) বিষয়েও সাহসী সিদ্ধান্ত দেওয়ায় তিনি দৃষ্টি কাড়েন। তার অনমনীয়তার প্রভাব গোটা বিচারবিভাগে সাহসের সুবাতাস প্রবাহিত করে। এরই এক পর্যায়ে ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট মোশাররফ কর্তৃক বহু দুর্নীতি মামলা খারিজ করে দেওয়া একটি আইনকে উচ্চ আদালত বাতিল করে দেয়। সে আইন বাতিলের ধারায় প্রেসিডেন্ট জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা পুনরায় চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত সেটি মান্য না করায় প্রধানমন্ত্রীকে আদালত অবমাননার শাস্তি দেওয়া হয়।

বর্তমানে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি মুসলমানদের জন্য আকর্ষণীয় কোনো রাষ্ট্র নয়। ইসলামী বিধান ও অনুশাসনের প্রতি সেখানে বহু অবমূল্যায়নের ঘটনাও ঘটছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ঘাটতি সে দেশটির প্রায় অবধারিত বৈশিষ্ট্য। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ও কখনো কখনো প্রত্যক্ষ আগ্রাসনেরও শিকার এখন দেশটি। কিন্তু বহু বরেণ্য দ্বীনী ব্যক্তিত্ব, দ্বীনী কেন্দ্র, বহু দেশ ও ধর্মপ্রাণ নাগরিকের উজ্জ্বল উপস্থিতির মতো দেশটির সৎ, সাহসী বিচারবিভাগও ব্যতিক্রমী নমুনা হয়ে আছে। কোনো কোনো দেশের নমনীয় ও নতজানু বিচারবিভাগের জন্য পাকিস্তানের উচ্চ আদালতের এই রায়টি অনুসরণীয় হতে পারে। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দুর্নীতি, দুঃশাসন ও শাসকদের সর্বাত্মক জুলুমের বিরুদ্ধে কোনো দেশের আদালত-উচ্চ আদালত দৃঢ় ও সাহসী ভূমিকা রাখলে সমূহ বিপর্যয়ের হাত থেকে সে দেশটি রক্ষা পেতে পারে। 

 

advertisement