আসলাফের কিছু দৃষ্টান্ত : সন্তানের দ্বীনি শিক্ষায় মায়ের ভূমিকা
পৃথিবীতে সন্তানের সবচেয়ে নিকটতম মানুষ মা। সন্তানের জন্য মায়ের যে মমতা ও ব্যাকুলতা তার কোনো তুলনা নেই। তাই তো জনম দুঃখিনী মা নিজের সকল সুখ-শান্তি বিসর্জন দেন সন্তানের প্রশান্তি চেয়ে। মমতাময়ী মা ভুলে যান তাঁর দুঃখ যাতনা কলিজার টুকরো সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু প্রিয় সন্তানের কল্যাণ কামনায় একজন মায়ের করণীয় কী? মা কিভাবে গড়ে তুলবেন তার সন্তানকে? কিভাবে সন্তানকে সচেতন করবেন পিতা-মাতার মর্যাদা ও হক সম্পর্কে? পিতা-মাতা কিভাবে রক্ষা পাবেন সন্তানের অবাধ্যতা ও অসৎ আচরণ হতে? সন্তানের আসল ভবিষ্যত কী? কোন পথে সাধিত হবে তার ভবিষ্যতের কল্যাণ? এ সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি বক্ষ্যমান নিবন্ধে।
সন্তানের লালন-পালন ও উত্তম চরিত্র গঠনে মায়ের ভূমিকা অগ্রগণ্য। মায়ের কোল প্রতিটি সন্তানের প্রথম পাঠশালা। মায়ের কাছেই সন্তান গ্রহণ করে জীবনের প্রথম পাঠ। মায়ের ভাষাতেই ফোটে সন্তানের প্রথম কথা। মায়ের আচরণ থেকেই সে শিখে জীবন যাপনের নিয়ম। শৈশব-কৈশোরে সন্তানের মধ্যে যে স্বভাব-চরিত্র গড়ে উঠে, সেটাই তার জীবনের শেকড় ও ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এরপর যখন সে পরিণত বয়সে উপনীত হয়, তখন কৈশোরে গড়া সেই ভিত্তিই তার জীবন যাপনের ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তাই সন্তানের উষালগ্ন হতে যদি তাকে সঠিক তরবিয়ত দেয়া না হয়, উত্তম শিক্ষা-দীক্ষা ও আদব-কায়দায় গড়ে তোলা না হয়, তাহলে পরে আর কোনো পন্থাই কার্যকর হয় না।
প্রতিটি মুসলিম পরিবারের জানা থাকা উচিত, আমাদের আসল পরিচয় আমরা মুসলমান। আমাদের মূল ঠিকানা ও আসল গন্তব্য পরকাল। সুতরাং পার্থিব চাহিদা, ধন-সম্পদ ও প্রাচুর্যের অভিলাষ এবং তথাকথিত আধুনিকতার স্রোতে আমরা যেন আমাদের পরিচয় ভুলে না যাই। তাই প্রত্যেক পিতা-মাতার আবশ্যিক কর্তব্য হবে তাদের সন্তানদের দ্বীন ও ঈমান রক্ষা করা। তাদের অন্তরে আল্লাহ তাআলার পরিচয় গেঁথে দেয়া। তাওহীদ ও রিসালাতের বিশ্বাস তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল করা। কারণ সন্তান হয়ত প্রত্যাশামত দুনিয়ার সব কিছুই পেল। ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের সব উপকরণই অর্জন করল। কিন্তু সে আল্লাহকে পেল না, পরকাল চিনল না, মনে রাখতে হবে সে কিছুই পেল না।
যে পিতামাতা তাদের সন্তানদের আখেরাত ধ্বংস করল, মুসলমান হয়েও সন্তানকে মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করার সুযোগ দিল না সেই মা-বাবা সন্তানের মৌলিক অধিকার রক্ষা করল না, তাদের আসল দায়িত্বই পালন করল না। তারা হলেন জালিম আর সন্তান হল মাজলুম।
জীবনী ও ইতিহাসগ্রন্থে আমাদের আকাবির-আসলাফের এমন হাজারো ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে সন্তানকে জিহাদের ময়দানে এবং হিজরত ও দ্বীনের দাওয়াতে প্রেরণে আর দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করণে শুধু মায়েরাই বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। এখানে সে রকম কয়েকটি ঘটনা পেশ করছি।
উম্মে আনাস ইবনে মালেক রা. হযরত আনাস রা. বলেন, হযরত আবু তালহা রা. উম্মে সুলাইমকে বিবাহের
প্রস্তাব দিলেন। উম্মে সুলাইম বলেন, আমার ছেলে আনাস প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত এবং ইলমের মজলিসগুলোতে না বসা পর্যন্ত আমি বিবাহ করবো না। হযরত আনাস রা. বলেন, আল্লাহ তাআলা আমার আম্মাকে উত্তম বিনিময় দান করুন তিনি আমাকে উত্তমভাবে লালন-পালন করেছেন। হযরত আনাস রা. ইলম শেখা আরম্ভ করার পর তিনি আবু তালহা রা.-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।-তবাকাতে ইবনে সা’দ ৮ : ৩১১
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হযরত আনাস রা. যখন দশ বছর বয়সে উপনীত হলেন, তার আম্মা হযরত উম্মে সুলাইম তাকে নিয়ে রাসূলের দরবারে আগমন করলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই আমার ছেলে আনাস। আজ থেকে আপনার খেদমত করবে। তখন থেকেই আনাস রা. নিয়মিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমত করেছেন এবং আল্লাহর রাসূলের খাদেম হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। প্রাগুক্ত
উম্মে সুফিয়ান সাওরী : হযরত ওয়াকী ইবনুল জাররাহ রাহ. বলেন, সুফিয়ান সাওরীর আম্মা তার পুত্র সুফিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, হে বৎস! তুমি ইলম অর্জন করো। আমি সুতাকাটার বিনিময়ে যে পারিশ্রমিক পাব তা দিয়ে তোমার লালন-পালন ও ব্যয়ভার বহন করার জন্য যথেষ্ট হবো। হে আমার পুত্র ! তুমি দশটি হাদীস লেখার পর দেখ, তোমার মধ্যে জ্ঞানার্জনের চাহিদা, সহিষ্ণুতা, শিষ্টতা ও গাম্ভীর্য বেড়েছে কি না , তোমার মধ্যে যদি এ ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি না ঘটে, ইলমের চাহিদা বৃদ্ধি না পায়, তবে মনে রেখ এটা তোমার উপকার-অপকার, লাভ-ক্ষতি কিছুই করবে না।-তারিখে আবুল কাসেম জুরজানী
উম্মে রবীআতুর রাঈ
হযরত আদুল ওয়াহহাব ইবনে আতা রহ. বলেন, রবীআর পিতা আবু আবদুর রহমান-যার আসল নাম ফররুখ-বনু উমাইয়ার শাসনামলে একজন সৈনিক হিসেবে খোরাসানের যুদ্ধে যান। রবীআ তখন তার মায়ের গর্ভে ছিলেন। যাওয়ার সময় উম্মে রবীআর নিকট ত্রিশ হাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) রেখে যান। সুদীর্ঘ সাতাশ বছর পর তিনি মদীনায় ফিরে আসেন। পিতা ফররুখ ঘরে প্রবেশ করলেন। এখানে পিতা-পুত্রের অপরিচিতিজনিত একটি সুন্দর ঘটনা আছে। এরপর পুত্র রবীআর দিকে তাকিয়ে বললেন, এ-ই আমার ছেলে? স্ত্রী বললেন, হ্যাঁ। তারপর তিনি স্ত্রীকে বললেন, যাওয়ার সময় তোমার কাছে যে সম্পদ (দীনার) রেখে গিয়েছিলাম সেগুলো বের করে দাও। স্ত্রী বললেন, এগুলো আমি সংরক্ষণ করেছি। এখনই তা জানতে পারবেন।
তারপর পুত্র রবীআ মসজিদে গমন করলেন। যথারীতি তার মজলিসে গিয়ে বসলেন। ইমাম মালেক, হাসান ইবনে যায়দ, ইবনু আবু আলী লাহাবী ও মদীনার অন্যান্য গণ্য-মান্য ব্যক্তি উপস্থিত হলেন। উম্মে রবীআ স্বামীকে বললেন, যান, মসজিদে নববীতে গিয়ে নামায পড়ে আসেন। তিনি মসজিদে এসে নামায পড়লেন। অতঃপর লোকজনে ভরপুর মজলিসের দিকে তার নজর পড়লো। তিনি সেখানে গিয়ে বসলেন। তারা তার জন্য একটু জায়গা প্রশস্ত করে দিলেন। রবীআ এমনভাবে মাথানত করে রাখলেন, যেন তিনি তাকে (পিতা) দেখেননি। তার দেহ চাদর আবৃত ছিলো। পিতা ফররুখ কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, আল্লাহ তাআলা সন্তানকে অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন।
তারপর পিতা ঘরে ফিরে গেলেন এবং ছেলের মাকে বললেন, আজ তোমার ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখতে পেলাম, যে অবস্থানে কোনো আলেম বা মুফতীকে দেখতে পাইনি। উত্তরে তার আম্মা বললেন, এবার বলুন, আপনার নিকট কোনটি বেশি প্রিয়-ত্রিশ হাজার দীনার, নাকি সন্তানের এই উচ্চ মর্যাদা। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! সন্তানের এই মর্যাদাই আমার কাছে প্রিয়। উম্মে রবীআ বললেন, আপনার রেখে যাওয়া সব দীনার তার জন্যই ব্যয় করেছি। পিতা বললেন,
আল্লাহর কসম! তুমি তা অনর্থক কাজে নষ্ট করনি।
উম্মে মালেক ইবনে আনাস : ইমাম মালেক রহ. তখন কিশোর। সুললিত কন্ঠের অধিকারী ছিলেন। তাই তার গান শেখার ইচ্ছে হল। মাকে গান শেখার কথা বললেন। তাঁর আম্মা তাকে বললেন যে, তুমি তো গায়কদের মতো সুন্দর নও। গায়ক যদি দেখতে সুন্দর না হয় তাহলে মানুষ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। সুতরাং তুমি গানের চিন্তা বাদ দিয়ে ফিকহ অর্জন কর। ইমাম মালেক রহ. বলেন, তখন আমি গায়কদের পরিত্যাগ করে ফুকাহাদের অনুসরণ করলাম। ফলে
আল্লাহ তাআলা আমাকে কোন অবস্থানে পৌঁছিয়েছেন তা তো দেখতেই পাচ্ছেন।
অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, মা তার মাথায় টুপি পরিয়ে দিলেন এবং তার উপর ধবধবে সাদা একটি পাগড়ী বেঁধে দিয়ে বললেন, যাও! এখন তুমি রবীআতুর রাঈ-এর মজলিসে গিয়ে বস। তার নিকট থেকে ইলম শেখার পূর্বে আদব শেখ। ইমাম মালেক তার সান্নিধ্যে থেকে ফিকহ ও হাদীস অর্জন করেন। তিনি বলতেন, রবীআর মৃত্যুর পর থেকে ফিকহের স্বাদ নিঃশেষ হয়ে গেছে।
-তারতীবুল মাদারিক ১/১১৯; তানভীরুল হাওয়ালিক ১৬৪মাস খানেক আগের কথা। একদিন সকালে আমার ছোট ভাই ফোন করে বলল, ‘আপু তোমাদের স্কুলের সেই ... সাহেব গতকাল মারা গেছে। আমরা আজ সকালে তার জানাযা পড়েছি।’ আমি ‘ইন্নালিল্লাহ’ বললাম এবং ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলাম। আজ থেকে ১২/১৩ বছর আগের কথা। আমি এবং আমার প্রতিবেশী একটি মেয়ে প্রথম বোরকা পরে স্কুলে গিয়েছিলাম। অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল প্রায় ত্রিশ জনে। সবাই পড়াশোনায় ভালো ছিল। শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের আদর করতেন। আমাদের শিক্ষকদের অনেকেই বোরকা পছন্দ করতেন। তারা খুশি হলেন। কেউ কেউ অপছন্দ করতেন। তবে তারাও উচ্চবাচ্য করলেন না। আমরা এসএসসির প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলাম। কিছুদিন পর টেস্ট পরীক্ষা। হঠাৎ একদিন স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাদের সবাইকে তলব করলেন। আমরা দুরু দুরু বুকে উপস্থিত হলাম। দেখলাম স্কুলের সব শিক্ষক-শিক্ষিকা সেখানে আছেন। প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘তোমরা বোরকা পরে স্কুলে আসো ভালো কথা। কিন্তু আগামীকাল থেকে স্কুলের ভিতর এসে বোরকা খুলে ফেলবে। এটা উপরের নির্দেশ। আগামীকাল থেকেই তা কার্যকর করতে হবে।’ সহপাঠীরা আমাকে ইশারা করল কিছু বলার জন্য। আমি সাহস করে বললাম, ‘স্কুলের ভিতরে পুরুষ শিক্ষকরা তো আছেন। বোরকা খুলে ক্লাস করব কিভাবে?’ প্রধান শিক্ষক এবার একটি আশ্চর্য কথা বললেন, ‘শিক্ষকগণ পিতা-মাতার সমতুল্য। তাই তাঁদের সামনে বোরকা ছাড়া উপস্থিত হওয়া যাবে।’ আমরা চুপ করে আছি, তিনি বললেন, ‘তোমরা যাই বল, আমি কিছুই করতে পারব না। এটা উপরের নির্দেশ। আগামী কাল থেকেই তা কার্যকর করতে হবে।’ শিক্ষকরাও কিছু বলছেন না। আমরাও ভয়ে চুপ করে আছি, শেষে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললাম, ‘স্যার, এখানে এসে যদি বোরকা খুলতে হয়, তাহলে আগামীকাল থেকে আমি আর স্কুলে আসব না।’ ব্যাগ নিয়ে বাসায় চলে এলাম। পরদিন থেকে স্কুলে যাই না। আববু সফরে ছিলেন। সফর থেকে ফিরে সব শুনে বললেন, ‘শাবাশ’! কিন্তু যে বিষয়টি আমার মনে কাঁটার মত বিঁধত তা হচ্ছে আমার সহপাঠীদেরকে আরও অনেকদিন ঐ স্কুলে কাটাতে হয়েছে এবং ‘উপরের নির্দেশ’ মানতে হয়েছে। আমার বোরকার বন্ধুদের জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি। পরে আরও কয়েকজন স্কুল ছাড়ার হুমকি দিলে কর্তৃপক্ষ নির্দেশ শিথিল করেছিলেন এবং সাদা স্কার্ফে মুখ ঢাকার অনুমতি দিয়েছিলেন। তবে কমিটির সেই ‘উপরওয়ালা’ এলে তাদেরও নেকাব খুলতে হত। লজ্জায় তারা জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখত।
আমার ছোট ভাই আমাকে সেই ‘উপরওয়ালার’ মৃত্যুর সংবাদ দিল। যারা সেদিন তার নির্দেশ অমান্য করার সাহস করেনি তারাই তাকে মাটির ‘নীচে’ রেখে এসেছে। ‘উপর’ আর ‘নীচে’র মাঝে কত সামান্য ব্যবধান! তবুও আমরা কিছু মানুষ ‘উপরওয়ালা’ হয়ে যাই। আর কিছু মানুষ তাদের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি।
জানি না কী অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে। তিনি কি ঈমানের সাথে বিদায় নিয়েছেন? নিশ্চয়ই তার সামনে এসেছেন মুনকার নকীর। তারাও কি তার আদেশ পালন করেছেন?
ঈমানের সাথে মৃত্যু হলে আল্লাহ যেন তাকে ক্ষমা করেন।