বাইতুল্লাহর ছায়ায়-২২
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মুযদালিফা থেকে মিনার জামারা, সুদীর্ঘ পথ। পথ তো নয়; ইহরামের সাদা লেবাসে হজ্বের নূর ও নূরানিয়াতে সণান করা লক্ষ মানুষের যেন নূরানি এক স্রোত! চারদিকে একই তরঙ্গধ্বনি, লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক।
আহা, সময় শেষ হয়ে আসছে; একটু পরেই থেমে যাবে বান্দেগির এই সুমধুর সঙ্গীত, লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক..। এখনো কিছুটা সময় আছে; শেষমুহূর্তের সুযোগ এখনো তোমার হাতে আছে। বান্দেগির সঙ্গীত-তরঙ্গে যত পারো অবগাহন করো। বলো, আবার বলো, লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক...।
জামারা-অভিমুখী নূর ও নূরানিয়াতের এই স্রোতে প্রতিটি মানুষ যেন একটি তরঙ্গ, আর প্রতিটি হৃদয় একটি সমুদ্র! কার হৃদয়-সমুদ্রে ভাবের কেমন উত্তাল ঢেউ তা জানার উপায় কী! প্রয়োজনই বা কী!! তুমি শুধু ডুব দিয়ে ডুবে থাকো তোমার হৃদয়-সমুদ্রে, আর চিন্তা করো, কোথায় চলেছো? কী উদ্দেশ্যে চলেছো? ‘সাতকঙ্করের’ যুগযুগের এ নূরানি কাফেলায় কেন তুমি আজ শরীক হয়েছো?
এ জামারা তো আর কিছু নয়; শুধু তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য যে, তুমি আল্লাহর খলীল হযরত ইবরাহীম আ.-এর পরিবারভুক্ত। তুমি তাওহীদের সন্তান। একমাত্র আল্লাহর হুকুম মেনে চলার জন্য তোমার জন্ম, তোমার জীবন এবং তোমার মৃত্যু। তাওহীদের জন্য, এক আল্লাহর দাসত্বের জন্য প্রয়োজনে তুমি কোরবানি দেবে জান- মালের, এমনকি প্রিয়তম সন্তানের। আল্লাহর ভালোবাসা হৃদয়ে লালন করার জন্য তুমি ত্যাগ করবে সকল ভালোবাসা, সবকিছুর ভালোবাসা; এমনকি তুমি বিসর্জন দেবে আপন সন্তানের ভালোবাসা। জগতের কোন সৌন্দর্য, কোন চাকচিক্য, কোন মায়া ও মায়াজাল তোমাকে বিচ্যুত করতে পারে না আল্লাহর ভালোবাসা ও আনুগত্য থেকে।
তোমার সিনায় রয়েছে তাওহীদের আমানত। পৃথিবীর কোন তাগুতি শক্তি তোমার সিনা থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে না এই পবিত্র আমানত। জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপের মাধ্যমে এ দৃপ্ত শপথ ঘোষণা করার জন্যই তো তুমি আজ এগিয়ে চলেছো এই শুভ্র সমুদ্রের তরঙ্গে দোল খেয়ে খেয়ে। এই ভাব ও অনুভব ছাড়া এখন কি তোমার অন্তরে অন্য কোন চিন্তা আসতে পারে! এখন কি তোমার ঠোঁটে লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক ছাড়া আর কোন উচ্চারণ সাজে!!
‘সাদা সাগরের জোয়ারে’ ভেসে ভেসে কখন যে এসে পড়েছি জামারার কাছে, বুঝতেই
পারিনি। পিছনে তাকিয়ে দেখি, সঙ্গীদের হারিয়ে ফেলেছি। এটা তো ঠিক হলো না! সঙ্গীদের খেয়াল রাখা তো আমার কর্তব্য ছিলো! তারা অবশ্য শক্ত-সমর্থ এবং অভিজ্ঞ। জামারা আদায় করে ইনশাআল্লাহ ঠিকঠাক পৌঁছে যাবে মক্কা শরীফে। তবু...
যাক, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। হয়ত আমার এখন নিঃসঙ্গতার প্রয়োজন ছিলো। কারণ নিঃসঙ্গতা অনেক সময় স্মৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা, এমনকি একাত্মতা সৃষ্টি করে। আর আমি এখন একাত্ম হতে চাই চার হাজার বছরের প্রাচীন সেই পবিত্র স্মৃতির সঙ্গে; আল্লাহর মুহববতের মোকাবেলায় সন্তানের মুহববত কোরবান করার পবিত্র স্মৃতির সঙ্গে; ত্যাগ ও কোরবানির পথে ইবলিসি চক্রান্তকে জয় করার ঈমানদৃপ্ত স্মৃতির সঙ্গে।
হাঁ, এই যে এসে গেছে আজকের জামারা। অসংখ্য হাত উঠছে, নামছে, আর কঙ্করবৃষ্টি চলছে। প্রত্যয়দৃপ্ত পদক্ষেপে আমিও এগিয়ে গেলাম জামারার দিকে।
পঁচিশ বছর আগে এখানে জামারায় রামী করেছিলেন হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.। খুব নিকট থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো তাঁর কঙ্কর নিক্ষেপ! সে স্মৃতি এখনো জাগরূক আমার অন্তরে। এখনো যেন কানে গুঞ্জরিত হয় সেই বৃদ্ধের সতেজ কণ্ঠের সজীব ধ্বনি-
بسم الله، الله أكبر، رضى للرحمن ورغما للشيطان.
(রহমানের সন্তুষ্টির জন্য, শয়তানকে অপদস্থ করার জন্য আল্লাহর নামে শুরু করছি; আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।)
তিনি একটি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন, আর আমি উদ্দীপ্ত হই! শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণায় একটি ঐশী নির্ভয়তা যেন আমাকে উদ্দীপ্ত করে! আমি এক দুর্বল সিপাহী, কিন্তু সামনে যার এমন সিপাহসালার, তার ভয় কিসের!
সম্বিত ফিরে পেলাম যখন তিনি বললেন, ‘কই কঙ্কর মারো!’
কিতাবের সব পড়া তখন হারিয়ে গেছে। আমি বললাম, ‘কীভাবে মারবো দেখিয়ে দেন।’
হায়, এখন কোথায় সেই মানুষ! সেই সেণহ, সেই মমতা!!
আমাদের বড় সৌভাগ্য যে, আলোকিত মানুষের স্মৃতিও আলো দান করে। আজকের জামারায় সেই আলোকিত মানুষটি নেই, কিন্তু তাঁর জাগ্রত স্মৃতি আমাকে যেন আলোকিত করলো, বরং সুদূর অতীত থেকে স্মৃতির যে আলোকধারা প্রবাহিত, আমাকে যেন সেই আলোক- ধারায় ...!
মনে হলো, একটি অদৃশ্য আলোকরেখা অনুসরণ করে আমি জামারার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে একে একে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করলাম। কঙ্করের প্রতিটি নিক্ষেপ আমার ভিতরে যেন আলোর অপূর্ব এক উদ্ভাস সৃষ্টি করলো। মনে হলো, ভিতরে আর কোন অন্ধকার নেই! কিন্তু হায়, হৃদয়ে আলোর এ উদ্ভাস তো আমরা ধরে রাখতে পারি না! পাপের অন্ধকার বারবার ফিরে আসে জীবনের চলার পথে!
কঙ্কর নিক্ষেপের পর পিছনে সরে এসে কিবলামুখী হয়ে দু‘আ ও মুনাজাত করলাম। আল্লাহর পেয়ারা হাবীব এখানে দীর্ঘ সময় দু‘আ করেছেন; ছাহাবা কেরাম দু‘আ করেছেন; যুগে যুগে আল্লাহর পেয়ারা বান্দাগণ দু‘আ করেছেন। সেই নূরানি কাফেলায় আল্লাহ তার গোনাহগার বান্দাকে আবার শামিল করেছেন। তোমার শোকর, হে আল্লাহ, তোমার শোকর!
মুনাজাতে হাত উঠলো, কিন্তু ভাষা হারিয়ে গেলো। একেবারে নির্বাক হয়ে গেলাম। কী বলবো, কীভাবে বলবো; কী চাইবো, কীভাবে চাইবো; সব যেন মুছে গেলো মনের পাতা থেকে! নীরব ভাষায় শুধু এই নীরব আকুতি নিবেদন করলাম; ‘হে আল্লাহ, এখানে তুমি তোমার নেক বান্দাদের যত দু‘আ কবুল করেছো, এ অধম বান্দাকেও তার কিছু হিস্সা দান করো। তোমার পেয়ারা হাবীব তাঁর পেয়ারা উম্মতের জন্য যত দু‘আ করেছেন সেই দু‘আর কিছু নূরানিয়াত, আদনা উম্মতি হিসাবে আমাকেও দান করো।
হে আল্লাহ, আমার প্রয়োজন তুমি আমার চেয়ে ভালো জানো; সুতরাং আমার দ্বীন-দুনিয়ার সকল প্রয়োজন তুমি পূর্ণ করো। হে আল্লাহ, তোমার প্রত্যেক বান্দার দিলের সমস্ত নেক তামান্না তুমি পূর্ণ করো।
হে আল্লাহ, মুসলিম উম্মাহকে যালিমদের যুলুম থেকে তুমি রক্ষা করো। তাদের জান-মাল, ইয্যত-আবরু তুমি হিফাযত করো।’
***
সময় তার নিজের গতিতে বয়ে যায়; সবকিছু শুরু হয় এবং শেষ হয়ে যায়। যেন স্বপ্নের ঘোর থেকে জেগে উঠি, আর স্বপ্ন হারিয়ে যায়! এই তো কাল আরাফায় তাঁবুর নীচে, নিমগাছের ছায়ায় ছিলাম। অকুফ হলো, মুনাজাত হলো; কত মানুষ কাঁদলো, কত চোখ থেকে অশ্রু ঝরলো। আরাফার সূর্য বিদায় নিলো। মুযদালিফার রাত এলো এবং দেখতে দেখতে ছুবহে ছাদিক হয়ে গেলো। একটু আগে লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক-এর কী মধুর সুরঝঙ্কার ছিলো! কঙ্কর নিক্ষেপ শুরু হলো, আর সেই সুরঝঙ্কার থেমে গেলো! এভাবেই জীবন শেষ হয় এবং জীবন থেমে যায়।
এই যে আমার চোখের সামনে হাজার হাজার মানুষ এবং আমি, কে জানে, কার জীবনের এটাই শেষ হজ্ব, আখেরি ইহরাম! সবকিছু শেষ হতে দেখি, তবু আমরা জীবনের পিছনে ছুটে চলি, আর শেষ দিনটির কথা ভুলে থাকি।
পঁচিশ বছর আগে এই জামারা থেকে ফেরার পথে একটি মর্মান্তিক উপলক্ষ তৈরী হয়েছিলো, আর হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. বলেছিলেন, ‘মিয়াঁ আবুতাহির, মউতকে যত ইয়াদ করবে, দিল তত যিন্দা হবে, আমলের শউক তত বাড়বে, যিন্দেগি তত ‘পুরলুতফ’ হবে, আর মউত তত আসান হবে।
মিয়াঁ আবু তাহির, শয়তান কো তুমনে কঙ্কর মারা, আব মাউত কি ইয়াদ কো ঢাল বানাও, তাকে শয়তানকে হামলুঁ সে বাচ সেকো।
(শয়তানকে তুমি কঙ্কর মেরেছো; এখন মৃত্যুর স্মরণকে ঢাল বানাও, যাতে শয়তানের হামলা থেকে বাঁচতে পারো।)
***
একটু দূরে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কঙ্করবৃষ্টি দেখতে লাগলাম। শয়তানের প্রতীক যে খুঁটিটা, তাতে হাজার হাজার কঙ্কর পড়ে, আর অদ্ভুত এক আওয়ায ওঠে! যেন দূর হ! দূর হ! এরকম একটানা আওয়ায! সেই আওয়াযে অন্যরকম একটা ভাব সৃষ্টি হলো আমার ভিতরে। জীবনের প্রতিটি কাজে, প্রতিটি কর্মে যদি আমরা শয়তানের প্রতি এই ‘দূর হ, দূর হ’ অনুভূতিটি ধরে রাখতে পারতাম!
জীবনের জটিল অঙ্গনের কথা থাক, স্বয়ং জামারাক্ষেত্রেও ছিলো কিছু দুঃখজনক দৃশ্য। কঙ্কর তো মারা হচ্ছে শয়তানকে, কিন্তু নমুনা দেখে মনে হলো, শয়তান এখানেও আদমের বেটার ঘাড়ে চড়ে বসতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি যেন শয়তানকে বাড়তি সুযোগ এনে দিয়েছে! অনেকের হাতে মোবাইল ক্যামেরা। চারদিক থেকে ভিডিও দ্বারা চিত্র- ধারণের, এককথায় যেন উৎসব চলছে! একবন্ধু আরেক বন্ধুর কঙ্করনিক্ষেপের চিত্র ধারণ করছে। আরো আশ্চর্যের বিষয় একহাজী ছাহেব, অপরিচিত আরেক হাজী ছাহেবের হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে অনুরোধ করছেন তার কঙ্করনিক্ষেপের দৃশ্য তুলে দিতে! হাজী ছাহেবও সানন্দে রাজী হলেন, যেন বান্দার খেদমত করে ছাওয়াব হাছিলের নিয়ত!
এ যেন এক তামাশা; তামাশা ছাড়া আর কী! শয়তানের তো এখন অপদস্থ হওয়ার কথা, কিন্তু আদমের বেটার নির্বুদ্ধিতা দেখে শয়তান হয়ত এখন আনন্দে বগল বাজায়!
আমাদের কি ভেবে দেখা উচিত নয় যে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হজ্ব একটি ইবাদত, ইসলামের পঞ্চম রোকন; আর ইবাদত হলো খুশূ-খুযূওয়ালা আমল। এটা ভিডিও করে রাখার কোন আনন্দ অনুষ্ঠান নয়! এভাবে তো হজ্বের প্রাণ ও রূহ এবং হজ্বের আসল শিক্ষাই শেষ হয়ে যায়! তাতে তো খালি হাতে আসা, আর খালি হাতে ফিরে যাওয়ার মতই হতে পারে অবস্থা!
আনন্দ-অনুষ্ঠানের কথায় মনে পড়ে গেলো একটি ঘটনা। পাকিস্তানের শহীদ প্রেসিডেন্ট যিয়াউল হক সম্পর্কে সম্ভবত হযরত আলী নদবী রহ. লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট সাহেব তাঁর কোন সন্তানের বিবাহ অনুষ্ঠানে হাকীমুল উম্মত হযরত থানবী রহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা ডাক্তার আব্দুল হাই রহ.কে দাওয়াত করেছিলেন। তিনি মজলিসে এসে দেখেন, অনুষ্ঠানটি ভিডিও করার আয়োজন করা হয়েছে। প্রেসিডেন্টকে তিনি তাঁর অসন্তুষ্টির কথা জানালেন, আর তিনি সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও বন্ধ করার আদেশ দিলেন।’
হযরত আলী নদবী রহ. লিখেছেন, ‘এরকম ক্ষেত্রে এধরনের আদেশ সাধারণ মানুষের পক্ষেও রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে, অথচ ভরা মজলিসে প্রেসিডেন্টকে তিরস্কার করা হয়েছিলো, আর তিনি অম্লান বদনে তা গ্রহণ করেছিলেন।’
ফিরে আসি আগের কথায়। হজ্বের প্রতিটি আমলে এমনকি তাওয়াফের ক্ষেত্রেও মোবাইল ও ভিডিওর অনাচার এমন চরম আকার ধারণ করেছে যে, আল্লাহ পানাহ!
তবে একটি প্রীতিকর ঘটনাও এখানে বলতে হয়; যুবকটি পাকিস্তান বা হিন্দুস্তানের। দেখে মনে হলো ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত। মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলছেন। তোলে তো অনেকেই, কিন্তু কেন জানি মনে হলো, তাকে কিছু বলা দরকার, হয়ত শোনবেন। কাছে গিয়ে বললাম, ‘ভাই তোমার ভিডিও করার প্রয়োজন নেই। আসমানওয়ালার হুকুমে আমাদের প্রতিটি আমলের ভিডিও করা হচ্ছে। শুধু চেষ্টা করো, ভিডিওতে যেন সুন্দর কিছু আসে, অসুন্দর কিছু না আসে।’
আল্লাহ তাওফীক দিলেন, দরদের সঙ্গেই বললাম কথাগুলো। যাকে বললাম তারও দিলটা ছিল নরম, আল্লাহর রহমতে এমন আছর হলো যে, আমি নিজেই অবাক! সঙ্গে সঙ্গে এক আছাড়ে মোবাইলটা তিনি ভেঙ্গে ফেললেন। আমার চোখে পানি এসে গেলো। আনন্দের আতিশয্যে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আল্লাহ তোমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। অশ্রুছলছল চোখে তিনি বললেন, ‘চাচ্চা, আপ কো ভী আল্লাহ তা‘আলা জাযায়ে খায়র আতা ফরমায়ে।’
একই রকমের ঘটনা ঘটেছিলো মদীনা শরীফে মসজিদে কোবার সামনে। তিনিও ছিলেন যুবক।
আসলে যুগে যুগে যত কঠিন দুর্যোগে এই যুবসমাজই ছিলো উম্মাহর আশা-ভরসার স্থল। সময়ের প্রয়োজনে যখনই উম্মাহর কোন মহান সংস্কারক সংস্কারের ডাক দিয়েছেন যুবসমাজই সবার আগে তা গ্রহণ করেছে এবং ধারণ করেছে। তাদের দিয়েই শুভ পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। উম্মাহর দেহে তারাই হলো ‘সচল শিরা’; তারাই হলো নতুন রক্ত। প্রয়োজন শুধু হিকমত ও প্রজ্ঞা এবং ধৈর্য ও সহনশীলতা। এই সফরে বিশেষ করে ভাই কামরুল ইসলামকে দিয়ে এ সত্য নতুন করে আমি উপলব্ধি করেছি। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
হিকমত ও প্রজ্ঞার কথায় মনে পড়ে গেলো মহান যুগসংস্কারক দাঈ ইলাল্লাহ হযরত মাওলানা মুহম্মদ ইলয়াস রহ.-এর যিন্দেগির একটি ঘটনা। আমাদের হযরত আলী নদবী রহ. ‘দ্বীনী দাওয়াত’ কিতাবে লিখেছেন, ‘এক তবলীগী সফরে হযরত মাওলানা মসজিদে অবস্থান করছেন। জামাত গাশত থেকে ফেরার সময় এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে এলো। মাওলানা তখন কোন উদ্দেশ্যে মসজিদ থেকে বের হচ্ছেন; জামাতের লোকেরা আরয করলো, ‘হযরত, এ যুবক নামায তো পড়েই না, বরং নামায নিয়ে উপহাস করে।’ যুবক ভক্তি তাযীমের পরিবর্তে মাওলানার সামনেই শব্দ করে হেসে উঠলো। মাওলানা সসেণহে তার চিবুক স্পর্শ করে বললেন, ‘তোমার মুখের হাসি আল্লাহ অব্যাহত রাখুন’
এরপর তিনি খুব সরলভাবে তাকে নামাযের উপদেশ দিলেন এবং আশ্চর্য, যুবক সঙ্গে সঙ্গে দাওয়াত কবুল করলো এবং মসজিদে দাখেল হলো।
হায়, কোথায় এখন আমাদের মধ্যে এই নবী-চরিত্র! এই নববী হিকমত ও প্রজ্ঞা! উর্দূভাষার কবি সত্যই বলেছেন, ‘এ মাটি এখনো আছে আর্দ্র-উর্বর, অভাব শুধু দরদী মালীর।’
***
এবার জামারার পুরো ব্যবস্থা বেশ সুশৃঙ্খল, দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। অতীতে জামারায় বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। গতবছর তো বহু লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। বিশেষ করে বার তারিখে তিনটি জামারায় কঙ্কর মেরে মানুষ যেহেতু মিনা থেকে বিদায় নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় সেহেতু সবাই সামানপত্র সঙ্গে নিয়ে, এমনকি শিশুদের কোলে করে জামারায় আসে। ফলে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়।
গতবছরের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় বেশ কিছু বাংলাদেশী হাজীও মৃত্যুবরণ করেছেন। আমার ছোট মেয়ে সাফফানাও স্বামীর সঙ্গে ফরয হজ্ব করতে এসেছিলো। জামারার বিষয়ে তাদের আমি সতর্ক করে দিয়েছিলাম।
আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে জামারার দুর্ঘটনার খবর তো প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জানা হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু তিনদিন যাবত তাদের কোন খবর না পেয়ে আমরা অকল্পনীয় এক পেরেশানির মধ্যে ছিলাম। দুর্ঘটনার সময় তারা নাকি সেখানেই ছিলো এবং সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলো, তবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর খাছ কুদরত দ্বারা তাদের হিফাযত করেছেন।
গতবছর হজ্বের পরদিন থেকেই সউদী হুকুমত জামারার সমগ্র স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার কাজ শুরু করে। সেই সঙ্গে শুরু করে নতুন নকশা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশাল স্থাপনা গড়ে তোলার কাজ। আগে ছিলো দ্বিতল স্থাপনা, এখন হচ্ছে পাঁচতালাবিশিষ্ট। দু’দিকে থাকবে চলন্ত সিঁড়ি। একবছরেরও কম সময়ে আগের স্থাপনা ভেঙ্গে নতুন স্থাপনার কাজ দোতালা পর্যন্ত হয়ে গেছে। অবাক কান্ডই বটে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত এলাহী কান্ডের আদৌ প্রয়োজন ছিলো না। এখন যেমন আসা ও যাওয়ার পথ এবং উপর ও নীচের পথ আলাদা করা হয়েছে, আগের স্থাপনা মোটামুটি অক্ষুণ্ণ রেখে এটা করলেই সমস্যার সমাধান হতে পারতো। তাছাড়া আগে কঙ্কর মারার স্থানটি ছিলো সংক্ষিপ্ত ও বৃত্তাকার। ফলে সেখানে প্রচন্ড ভীড় হতো। এখন প্রতিটি জামারার স্থানকে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাত লম্বা করা হয়েছে। ফলে একসঙ্গে বহু মানুষ স্বচ্ছন্দে রামী করতে পারে। তো পুরোনো স্থাপনার মধ্যেই এ ব্যবস্থাটা করে দিলেই হয়ে যেতো। বর্তমান স্থাপনায় যে বিপুল ব্যয় করা হচ্ছে তার কোন প্রয়োজন ছিলো না।
আসলে সউদীদের তেল আছে, তবে ‘তলানি’ নেই। ওরা কোন কিছু গড়ার আগে ভাবে না, আর ভাঙ্গার আগে তো বিলকুল ভাবে না। হারামের আশেপাশে বিশাল বিশাল কত ইমারত গড়তে দেখেছি এবং দেখেছি ভাঙ্গতে তার ইয়ত্তা নেই। এই যে মক্কা টাওয়ার, সেটা দোতালা পর্যন্ত নির্মাণ করে, তারপর আবার ভেঙ্গে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে মক্কা টাওয়ার পুরোটাই ভেঙ্গে ফেলা হবে।
আমার কলম সম্ভবত আবার সংযম হারাতে বসেছে, আল্লাহ মাফ করুন।
***
জামারা থেকে ফারেগ হয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। রামীর স্থান থেকে সোজা সামনে বিরাট উন্মুক্ত স্থান। এখান থেকে হারামের উদ্দেশ্যে বাস যায়। কিন্তু বাসে ওঠার কোন উপায় ছিলো না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তাই হেঁটে যাওয়াই ভালো মনে হলো। মিনা থেকে মক্কা পর্যন্ত পথচারীদের জন্য আলাদা পথ রয়েছে। কিছু দূর খোলা পথ, রোদে কিছুটা কষ্ট হয়, তারপর লম্বা টিনশেডের পথ। ছায়ায় ছায়ায় বেশ আরামেই যাওয়া যায়। তারপর পাহাড়ের ভিতর দিয়ে বিশাল সুড়ঙ্গ কেটে পথ করা হয়েছে। তাতে আলোবাতাসেরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। সাতাশি সনে আমি ও ইমাম সাহেব সুড়ঙ্গপথেই আসা-যাওয়া করেছি। সোজা পথ, সময়ও লাগে কম। সবচে’ বড় কথা, যানজটের অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অবশ্য এই সুড়ঙ্গ পথে বড় বড় দুর্ঘটনাও ঘটেছে কয়েকবার এবং পদচাপে পিষ্ট হয়ে বহুপ্রাণহানি ঘটেছে।
একজন বয়স্ক হাজী সম্ভবত তার বৃদ্ধা মাকে হুইলচেয়ারে ঠেলে নিচ্ছেন। খেয়াল করেননি, পিছন থেকে আমার পায়ে লেগে গেলো এবং কেটে গিয়ে রক্ত পড়া শুরু হলো। বেচারা বিব্রত হলেন, বৃদ্ধা আরো বেশী পেরেশান হয়ে বলে উঠলেন, হায়, কেয়া হো গ্যায়া! আমি মৃদু হেসে বললাম, কুছ নেহী হোয়া, ইনশাআল্লাহ ঠিক হো যায়েগা।
এপর্যন্ত ঠিক ছিলো। গোলমাল শুরু হলো এর পরে, যার জন্য আমি মোটেই প্রস্ত্তত ছিলাম না। ঐ বয়স্ক হাজী ছাহেবের যুবক সঙ্গী আমাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, ‘পীছে ভী খায়াল রাখনা চাহিয়ে আঙ্কেল!’
এর মধ্যে দু’চারজন দাঁড়িয়ে গেছে। ‘আঙ্কেল কিছু বলার আগেই এক বাঙ্গালী অথবা বাংলাদেশী ‘জড়াখিচুড়ি’ উর্দূতে কড়া জবাব দিলেন, ‘ওনার তো পিছনে চোখ নাই, তোমাদের তো সামনে চোখ ছিলো, দেখে চালাতে পারো না!
আমার পিছনের দিকে চোখ নেই, আর হুইলচেয়ারওয়ালা হাজী ছাহেবের সামনের দিকে একজোড়া চোখ আছে, দু’টোই সত্য কথা, কিন্তু দুর্ঘটনার কোন ‘চোখ’ নেই এটাও তো সত্য কথা! তার চেয়ে সত্য কথা হলো, হজ্বের সফরে এভাবে গায়ে পড়ে ঝগড়া বাঁধানোর প্রয়োজন ছিলো না।
তবে আল্লাহর শোকর, অল্পের মধ্যেই ব্যাপারটা মিটে গেলো। ডায়াবেটিস রোগীর জন্য এধরনের জখম ঝুঁকিপূর্ণ। হলে অনেক কিছুই হতে পারে, না হলে অল্পতেই সেরে যায়। আল্লাহর মেহেরবানি, আমার অল্পতেই সেরে গিয়েছিলো। তবে মনের ঐ জখমটা সারতে সময় লেগেছিলো, ‘পীছে ভী খায়াল রাখনা চাহিয়ে আঙ্কেল!’
মানুষ মানুষকে কেন এভাবে কষ্ট দিয়ে কথা বলে! এমন পবিত্র স্থানে, এমন পবিত্র সফরে!!
ঘটনাটা ছিলো টিনশ্যাডের একটু আগে খোলা স্থানে। রোদে কষ্ট হচ্ছিলো। তাই ধীরে ধীরে হেঁটে টিনশেডের নীচে গিয়ে বসলাম। অনেক্ষণ বসে থাকলাম। এখন আর রক্ত পড়ছে না, আর জ্বলুনিটাও কমে এসেছে। আবার হাঁটা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ হাঁটি, কিছুক্ষণ বিশ্রাম করি, আর দেখি প্রবহমান জনস্রোত। ভালোই লাগে, আরো ভালো লাগে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ হতে বড় বড় গাড়ীতে করে ঠান্ডা পানি ও পানীয় এবং প্যাকেটজাত হালকা খাবার বিতরণের ব্যবস্থা। তবে সেখানে যে হুড়োহুড়ি ও কাড়াকাড়ি তা বেশ দৃষ্টিকটু। আরেকটা কষ্টের বিষয়, হাজী ছাহেবান পথের উপরেই ফেলে দেন পানির বোতল এবং খাবারের খালি প্যাকেট। হাজার হাজার প্যাকেট। একটা হাতে নিয়ে দেখি, এক পিঠে পবিত্র কা‘বার ছবি, আরেক পিঠে সবুজ গম্বুজের। হাজার হাজার মানুষ সেগুলো মাড়িয়ে যাচ্ছে। খুব কষ্ট লাগলো। কী প্রয়োজন ছিলো খাবারের প্যাকেটে এই ছবি ব্যবহার করার। কী উদ্দেশ্য? বরকত লাভ করা?
মন তো চায়, পড়ে থাকা প্রতিটি কাগজ তুলে নিই, কিন্তু তা তো সম্ভব নয়, একটা দু’টো তুলে বেগে রেখে দিলাম, আর মনে মনে বললাম, আল্লাহ, তুমি আমাদের সবাইকে মাফ করে দাও।
কিছু দূর গিয়ে আবার বসলাম একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য। কাছেই একটা গাড়ী থেকে খাবার ও পানীয় বিতরণ করা হচ্ছে। গাড়ীর গায়ে লেখা অমুক মরহুমের পরিবারের পক্ষ হতে হাজী ছাহেবানের জন্য হাদিয়া। আশা করি, মরহূমকে নেক দু‘আয় স্মরণ করা হবে।
ক্ষুধা যাই হোক, পিপাসা ছিলো খুব, কিন্তু গাড়ীর সামনে যে অবস্থা তাতে ঐ পর্যন্ত যাওয়া এবং হাদিয়া যোগাড় করা অন্তত আমার পক্ষে অসম্ভব। থাক বাবা, হাদিয়া ছাড়াই মরহূমের জন্য দু‘আ করি; আল্লাহ তোমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন এবং বেলাহিসাব জান্নাত নছীব করুন।
এর পর যা ঘটলো সেটা কি লিখবো? গাড়ী থেকে যারা বিতরণ করছিলেন তাদের একজন হঠাৎ এদিকে তাকালেন, আর خذ يا حاج বলে খাবারের প্যাকেট এবং পানির বোতল ছুঁড়ে দিলেন। এমনই নিখুঁত নিশানা যে, দু’টোই এসে পড়লো আমার কোলে। কী ব্যাখ্যা হতে পারে এর! সবই আল্লাহর দয়া ও দান! ক্ষুধা ও পিপাসার সময় সেই খাবার ও শীতল পানি ..., শোকর আলহামদু লিল্লাহ!
নিজের কথা থাক, আমার ভাই আছিম ও সীরাজীর কথা বলি, তারা বেশ কয়েকজনের কাফেলা, হেটে আসছিলেন আরাফা থেকে মুযদালিফায়। সঙ্গে ছিলো অসুস্থ মহিলা। একস্থানে নাচার হয়ে বসে পড়লেন। যেমন ক্ষুধা তেমন পিপাসা। ভাই আছিম বলেন, মনে মনে ভাবছি, কিছু খাবার যদি পাওয়া যেতো!
বান্দা শুধু ভেবেছে, আর খানা হাযির! আল্লাহর এক বান্দা, পলিথিন ভরা কাবাব, রুটি আর পানি সামনে রেখে চলে গেলেন। আমরা তো অবাক এবং হতবাক! একটু যে ধন্যবাদ জানাবো তারও সুযোগ হলো না।
হজ্বের সফরে এমন সব গায়বি ইনতিযামের ঘটনা অসংখ্য যাকে জিজ্ঞাসা করবে, সেই কিছু না কিছু ঘটনা শোনাবে। অবশ্য ছবর ও ইমতিহানের ঘটনাও কম নয়। আল্লাহর তাঁর বান্দার সঙ্গে যখন যে আচরণ করেন তাতেই স্বাদ, তাতেই শান্তি।
টিনশেড শেষ হলো, প্রথম সুড়ঙ্গটা শুরু হলো। সুড়ঙ্গে উপরে লেখা আয়াতটা আফসোস এখন মনে পড়ছে না, অথচ তখন কী যে শান্তি লেগেছিলো! পথ চলার সব ক্লান্তি যেন দূর হয়ে গিয়েছিলো!
আচ্ছা, এ আয়াতটি তো ভুলে গিয়েছি, যে আয়াতটির কথা মনে আছে, বলি!
হজ্বের পর হঠাৎ আমাদের এক সফরসঙ্গী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শেষে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, প্রায় অচেতন। মুখ থেকে লালা ঝরতে শুরু করেছে। এ কঠিন সময়ে এমন অনেক কিছু নযরে এসেছে যা কখনো কল্পনাও করিনি। আল্লাহ আমাদের এ প্রশ্ন করবেন না যে, তুমি এতটা নফল হজ্ব করোনি কেন? তবে এ প্রশ্ন অবশ্যই করবেন, ‘আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি আমার দেখভাল করোনি কেন? এ বিষয়টা আমাদের সবসময় মনে রাখা দরকার। যাই হোক, ইমাম ছাহেব বেচারাকে নিয়ে যাকে বলে ‘দিশেহারা’ অবস্থায় পড়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর মেহেরবানি, মুআল্লিমের মাধ্যমে রাত দশটায় এ্যাম্বুলেন্স এলো এবং তাকে হাসপাতালে নেয়া হলো।
এ আরেক অদ্ভুত অবস্থা! সঙ্গে কাউকে যেতে দেয়া হলো না। ফলে রোগী কোন্ হাসপাতালে কী অবস্থায় আছে জানার কোন উপায় থাকলো না।
পরের দিন খোঁজখবর নিতে নিতে জানা গেলো হাসপাতালের ঠিকানা। আর জানা গেলো রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
সেদিন ইমাম ছাহেব একজনকে পাঠালেন। পরের দিন আমাকে নিয়ে তিনি গেলেন।
প্রথমে গেলাম তানঈমে। মসজিদে আয়েশা (রা.)-এ। ইহরাম ধারণ করে রওয়ানা হলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। তানঈম থেকে মদীনার পথে হেঁটে গেলে ত্রিশ মিনিটের পথ। আমরা হেঁটেই গেলাম। মূল সড়কের সঙ্গেই হাসপাতালের সীমানা- প্রাচীর। সোজা একটা পথ গেছে। শেষ মাথায় হাসপাতালের মূল ভবন। ডান পাশে মসজিদ।
যে জন্য এতকথা বলা, হাসপাতালের প্রবেশপথে উপরে লেখা কোরআনের আয়াত-
واذا مرضت فهو يشفين.
(আর আমি যখন অসুস্থ হই, তিনিই আমাকে শিফা দান করেন।)
বিশ্বাস করো প্রিয় পাঠক, এক আজীব ঠান্ডক, একটি আশ্চর্য শীতলতা যেন সমগ্র অন্তর্সত্তায় ছড়িয়ে পড়লো। ইমাম ছাহেবকে বললাম, জাহাঙ্গীর, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, ইনশাআল্লাহ আমাদের রোগীকে আল্লাহ পূর্ণ শিফা দান করবেন।
মানুষ যখন অন্তর্লোক থেকে আশ্বাস লাভ করে কিছু বলে তখন তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু থাকে যা শ্রোতাকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করে। ইমাম ছাহেবও নিজের অজান্তেই যেন আমার দিকে ফিরে তাকালেন, অন্তহীন বিস্ময় নিয়ে? আমি কিছু বললাম না, চোখের ইশারায় প্রবেশপথের উপরে উৎকীর্ণ লেখাটি দেখালাম। তিনি দেখলেন আর উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন, আলহামদু লিল্লাহ।
হাসপাতালের সবকিছু, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, সেবক, সেবিকা ও চিকিৎসক সবার আন্তরিক আচরণ আমাদের মুগ্ধ করলো। রোগী দেখলাম, অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। দু’জন সেবিকা ছিলো বাংলাদেশী, ফাতেমা ও মুসলিমা। তাদের কথা ভুলিনি, কখনো ভোলবো না। দেশে রোগীর দু’জন মেয়ে আছে। তিনি বললেন, নিজের মেয়েরাও এর চেয়ে বেশী সেবা আমার করতে পারতো না। আমাকে বাবা ডেকে তাদের কত কষ্টের কথা যে বললো! মুসলিমার এ কথাটা এখনো আমি ভুলতে পারি না; ‘আপনেরা এত দূরের তে আইসা হজ্ব কইরা যান, আমরা দুই বছর ধইরা এত কাছে থাইকাও হজ্ব করতে পারলাম না! হাজী সাহেব গো খেদমত করি এই মনে কইরা যে আল্লায় যেন আমাগরেও কবুল করে।’
আমি শুধু বলতে পেরেছিলাম, দেইখো মা, আল্লায় তোমাগরেও কবুল করবো।
আমার কলমের এই এক দোষ, কোত্থেকে কোথায় চলে যাই! তারপরো বলার মত কত কথা থেকে যায়।
ফেরার পথে গাছের ছায়ায় ছায়ায় দুই বন্ধু সেদিন কত যে শান্তি পেয়েছিলাম। সবুজ পাতাগুলো আমাদের আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো, আর অন্তরে আশ্চর্য এক প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিলো। বেলা তখন দশটা, আকাশে সূর্য আছে এবং আশ্চর্য, চাঁদও আছে!
গিয়েছিলাম রোগীর ইয়াদাত করতে, ফিরে এসেছিলাম ‘আয়াতে শিফা’-এর পরম বিশ্বাসকে অন্তরে ধারণ করে। কোন্ ভাষায় আল্লাহর শোকর আদায় করবো! কত তিলাওয়াত করেছি এ পবিত্র আয়াত, কিন্তু সত্যি বলছি, একটি হাসপাতালের মাথায় এ আয়াতের শোভা ও আলোকচ্ছটা ছিলো অন্যরকম। আমাদের দেশে রাজধানীতে একটি হাসপাতাল আছে ‘আলখিদমাহ’। প্রশাসনে সংশ্লিষ্ট সবাই দ্বীনদার, তাবলীগী, আহলে ইলমের প্রতি আচরণে অতি আন্তরিক। নামে যেমন, কর্মেও তেমন সেবাই উদ্দেশ্য। বড় কঠিন অবস্থায় আমার আম্মাকে এখানে দু’বার এনেছি। সকলে তার সেবা করেছেন মায়ের মত করেই। এখন যিনি আলখিদমাহর প্রধান তাকে মক্কার তানঈম হাসপাতালের ঘটনা বলে অনুরোধ করেছি, আলখিদমাহর প্রবেশ পথেও এই আয়াতটি উৎকীর্ণ করে রাখতে। হয়ত কারো অন্তর এমনি শান্তি ও প্রশান্তির পরশ লাভ করবে, যেমন আমার অন্তর লাভ করেছে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)