وحدة الأمة واتباع السنة উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা : মতভিন্নতার মাঝেও সম্প্রীতি রক্ষা, সুন্নাহসম্মত পন্থায় সুন্নাহর প্রতি আহবান
গত ২৩ রবিউস সানী ১৪৩৩ হিজরী, মোতাবেক ১৭ মার্চ ২০১২ ঈ. শনিবার কাকরাইল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার উদ্যোগে ‘উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা’ শিরোনামে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সেমিনারে আলকাউসারের তত্ত্বাবধায়কের পক্ষ থেকে যে প্রবন্ধটি উপস্থাপিত হয়েছিল তা হুবহু বা তার সারসংক্ষেপ আলকাউসারে প্রকাশের জন্য অনেক বন্ধু/পাঠক জোর আবেদন জানিয়েছেন। উক্ত সেমিনারে উপস্থিত বন্ধুরা প্রবন্ধটি পুস্তক আকারে পেলেও আলকাউসারের অধিকাংশ পাঠকের কাছে তা পৌঁছেনি। এজন্য সামান্য পরিবর্তন-পরিমার্জনের পর প্রবন্ধটির সারসংক্ষেপ আলকাউসারে প্রকাশ করা হল। যাদের কাছে মূল প্রবন্ধটি রয়েছে তাদের জন্যও তা উপকারী হবে বলে আশা রাখি।-সম্পাদক
মুসলিম উম্মাহ পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং নিজেদের একতা ও সংহতি রক্ষা করা ইসলামের একটি মৌলিক ফরয। তেমনি সুন্নাহর অনুসরণ তথা আল্লাহর রাসূলের শরীয়ত এবং তাঁর উসওয়াহ ও আদর্শকে সমর্পিত চিত্তে স্বীকার করা এবং বাস্তবজীবনে চর্চা করা তাওহীদ ও ঈমান বিল্লাহর পর ইসলামের সবচেয়ে বড় ফরয।
সুতরাং সুন্নাহর অনুসরণ যে দ্বীনের বিধান উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষা এবং বিভেদ ও অনৈক্য থেকে বেঁচে থাকাও সেই দ্বীনেরই বিধান। এ কারণে এ দুইয়ের মাঝে বিরোধ ও সংঘাত হতেই পারে না। সুতরাং একটির কারণে অপরটি ত্যাগ করারও প্রশ্ন আসে না। কিন্তু এখন আমরা এই দুঃখজনক বাস্তবতার সম্মুখীন যে, হাদীস অনুসরণ নিয়ে উম্মাহর মাঝে বিবাদ-বিসংবাদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির প্রশ্নে মুজতাহিদ ইমামগণকে এবং তাদের সংকলিত ফিকহী মাযহাবসমূহকে দায়ী করা হচ্ছে। অথচ ফিকহের এই মাযহাবগুলো হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর বিধিবিধানেরই ব্যাখ্যা এবং তার সুবিন্যস্ত ও সংকলিত রূপ। মূলে তা ফকীহ ও মুজতাহিদ সাহাবীগণের মাযহাব, যা উম্মাহর অবিচ্ছিন্ন কর্মপরম্পরা তথা তাওয়ারুছের মাধ্যমে চলে এসেছে।
এই অবস্থা প্রমাণ করে, আমাদের অনেকে সুন্নাহ অনুসরণের মর্ম ও তার সুন্নাহসম্মত পন্থা এবং সুন্নাহর প্রতি আহবানের সুন্নাহসম্মত উপায় সম্পর্কে দুঃখজনকভাবে উদাসীন। তদ্রূপ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির সঠিক উপলব্ধি এবং ঐক্যবিনাশী বিষয়গুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তির শিকার।
সুন্নাহর অনুসরণ এবং উম্মাহর ঐক্য দুটো বিষয়ই অনেক দীর্ঘ এবং উভয় ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে চলমান অবহেলা ও ভুল ধারণা ব্যাপক। সবকটি দিক নিয়ে এ প্রবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়। এখানে শুধু প্রবন্ধের শিরোনাম (মতভিন্নতার মাঝেও সম্প্রীতি রক্ষা; সুন্নাহসম্মত পন্থায় সুন্নাহর প্রতি আহবান)-এর সাথে সম্পৃক্ত কিছু মৌলিক বিষয় আলোচনা করা উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক কথা বলার এবং ইখলাস ও ইতকানের সাথে উপস্থাপন করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
ঐক্য ও সংহতি এবং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির গুরুত্ব
ইসলাম তাওহীদের দ্বীন এবং ঐক্যের ধর্ম। এখানে শিরকের সুযোগ নেই এবং অনৈক্য ও বিভেদের অবকাশ নেই। ইসলামে ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ-এক আল্লাহর ইবাদত, এক আল্লাহর ভয়।
এই তাওহীদের সমাজকে ইসলাম আদেশ করে সীরাতে মুস্তাকীম ও সাবীলুল মুমিনীনের উপর একতাবদ্ধ থাকার, নিজেদের ঐক্য ও সংহতি এবং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি রক্ষা করার, ইজমা ও সাবীলুল মুমিনীনের বিরোধিতা পরিহার করার এবং এমন সব কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার, যা উম্মাহর একতা নষ্ট করে এবং সম্প্রীতি বিনষ্ট করে।
সাবীলুল মুমিনীন থেকে বিচ্যুত হওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে কুফর এবং পরস্পর কলহ-বিবাদে লিপ্ত হওয়া হারাম ও কবিরা গুনাহ।
কথাগুলো যদিও দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট এবং উম্মাহর সর্ববাদীসম্মত আকীদা তবুও পুনস্মরণের স্বার্থে কিছু আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করা হচ্ছে।
(এ প্রসঙ্গে মূল প্রবন্ধে আটটি সূরার সর্বমোট ২৭টি আয়াত রয়েছে। এখানে আরবী পাঠ ও তরজমাসহ কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হল।
إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ ۞ وَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ كُلٌّ إِلَيْنَا رَاجِعُونَ ۞
(তরজমা) ‘নিশ্চিত জেনো, এই তোমাদের উম্মাহ, এক উম্মাহ (তাওহীদের উম্মাহ) এবং আমি তোমাদের রব। সুতরাং আমার ইবাদত কর। কিন্তু তারা নিজেদের দ্বীনকে নিজেদের মাঝে টুকরা টুকরা করে ফেলেছে। (তবে) সকলেই আমার কাছে ফিরে আসবে।-সূরাতুল আম্বিয়া (২১) : ৯২-৯৩
وَإِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاتَّقُونِ ۞ فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ زُبُرًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ ۞ فَذَرْهُمْ فِي غَمْرَتِهِمْ حَتَّى حِينٍ ۞
(তরজমা) ‘নিশ্চিত জেনো, এই তোমাদের উম্মাহ, এক উম্মাহ (তাওহীদের উম্মাহ) এবং আমি তোমাদের রব। সুতরাং আমাকে ভয় কর। এরপর তারা নিজেদের দ্বীনের মাঝে বিভেদ করে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেল। প্রত্যেক দল (নিজেদের খেয়ালখুশি মতো) যে পথ গ্রহণ করল তাতেই মত্ত রইল। সুতরাং (হে পয়গাম্বর!) তাদেরকে এক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত মূর্খতায় ডুবে থাকতে দাও।-সূরা মুমিনুন (২৩) : ৫২-৫৩
উপরের দোনো জায়গায় নবীগণ যে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন তা বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে, আল্লাহর কাছে উম্মত একটিই। আর তা হচ্ছে তাওহীদের উম্মত। সূরা ইউনুস (১০ : ১৯) ও সূরা বাকারায় (২ : ২১৩) বলা হয়েছে যে, আদিতে সকল মানুষ এ সমাজেই ছিল। পরে লোকেরা কুফর ও শিরক অবলম্বন করে আলাদা উম্মত, আলাদা সমাজ বানিয়ে নিয়েছে।
তাই উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে তাওহীদ। تَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُم (তারা নিজেদের দ্বীনকে নিজেদের মাঝে টুকরা টুকরা করে ফেলেছে) বাক্যে আকীদায়ে তাওহীদ এবং দ্বীনের অন্যান্য মৌলিক ও অকাট্য আকীদা ও বিধানসমূহ (জরুরিয়াতে দ্বীনের) অস্বীকার বা অপব্যাখ্যার মাধ্যমে আলাদা মিল্লাত ও আলাদা উম্মত সৃষ্টির নিন্দা করা হয়েছে।
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ ۞ وَمَا تَفَرَّقُوا إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَلَوْلَا كَلِمَةٌ سَبَقَتْ مِنْ رَبِّكَ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ أُورِثُوا الْكِتَابَ مِنْ بَعْدِهِمْ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مُرِيبٍ ۞ فَلِذَلِكَ فَادْعُ وَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَقُلْ آَمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنْ كِتَابٍ وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ اللَّهُ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ لَا حُجَّةَ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ اللَّهُ يَجْمَعُ بَيْنَنَا وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ ۞
(তরজমা) তিনি তোমাদের জন্য সেই দ্বীনই স্থির করেছেন, যার হুকুম দিয়েছিলেন নূহকে এবং (হে রাসূল!) যা আমি ওহীর মাধ্যমে তোমার কাছে পাঠিয়েছি এবং যার হুকুম দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে; যে, কায়েম রাখ এই দ্বীন এবং তাতে সৃষ্টি করো না বিভেদ। (তা সত্ত্বেও) মুশরিকদের তুমি যে দিকে ডাকছ তা তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুভার মনে হয়। আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা বাছাই করে নিজের দিকে আকৃষ্ট করেন এবং যে আল্লাহর দিকে রুজু হয় তাকে নিজ দরবার পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য দান করেন।
এবং মানুষ যে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তা হয়েছে তাদের কাছে নিশ্চিত জ্ঞান আসার পরই, পারস্পরিক শত্রুতার কারণে। তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে যদি একটি কথা নির্ধারিত কাল পর্যন্ত পূর্বেই স্থির না থাকত তবে তাদের বিষয়ে ফয়সালা হয়ে যেত। তাদের পর যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছে তারা এ সম্পর্কে এক বিভ্রান্তিকর সন্দেহে পড়ে আছে।
‘সুতরাং (হে রাসূল!) তুমি ঐ বিষয়ের দিকেই মানুষকে আহবান কর এবং অবিচল থাক, যেরূপ তোমাকে আদেশ করা হয়েছে। এবং তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না। বল, আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তার প্রতি ঈমান এনেছি এবং আমি আদিষ্ট হয়েছি তোমাদের মাঝে ন্যায়বিচার করতে। আল্লাহ আমাদের রব এবং তোমাদেরও রব। আমাদের কর্ম আমাদের, তোমাদের কর্ম তোমাদের। আমাদের ও তোমাদের মাঝে কোনো তর্ক নেই। আল্লাহ আমাদের সকলকে একত্র করবেন এবং তাঁরই কাছে সকলের প্রত্যাবর্তন।-সূরাতুশ শূরা (৪২) : ১৩-১৫
দ্বীনের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির অর্থ, তাওহীদ বা অন্য কোনো মৌলিক বিষয় সরাসরি অস্বীকার করে কিংবা তাতে অপব্যাখ্যা করে তাওহীদের উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া।
হক সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান আসার পর এ বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা কেবল জিদ ও হঠকারিতার কারণেই হয়ে থাকে। শাখাগত বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর দলিলভিত্তিক যে মতপার্থক্য তা এখানে উদ্দেশ্য হতে পারে না। কারণ অনেক শাখাগত বিধানের ক্ষেত্রে স্বয়ং নবীগণের শরীয়তেও বিভিন্নতা ছিল। অথচ তাঁদের সবার দ্বীন ছিল এক। তাঁরা সবাই ছিলেন তাওহীদপন্থী এবং অভিন্ন।
অন্য অনেক আয়াতের মতো উপরের আয়াতগুলোতেও স্পষ্ট নির্দেশনা আছে যে, দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে মতভেদ হতে পারে না। এখানে মতভেদ অর্থই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা।
আর এই বিভেদের দায় ঐ মতভেদকারীকেই বহন করতে হবে। যারা হকপন্থী, তাদেরকে নয়। কারণ ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ ও মৌলিক আকিদা ও বিধান। যারা এর উপর আছে তারা তো মূল পথেই রয়েছে। যারা মতভেদ করেছে তারা এই পথ থেকে সরে গেছে এবং বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছে। আর এ কথা বলাই বাহুল্য যে, তাওহীদের বিষয়ে বা দ্বীনের অন্য কোনো মৌলিক বিষয়ে হক থেকে বিচ্যুত হওয়া বা সন্দেহ-সংশয় পোষণ করা খেয়ালখুশির অনুগামিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এখানে ইসলামের অতুলনীয় ও ন্যায়সঙ্গত শিক্ষাটিও লক্ষণীয় যে, যারা মৌলিক বিষয়ে মতভেদ করে বিচ্ছিন্ন হল তাদের সাথেও জুলুম-অবিচার করা যাবে না; তাদের সাথেও ন্যায়বিচার করতে হবে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ ۞ وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آَيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ ۞ وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ۞ وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ ۞ يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ ۞ وَأَمَّا الَّذِينَ ابْيَضَّتْ وُجُوهُهُمْ فَفِي رَحْمَةِ اللَّهِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ۞
(তরজমা) ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে সেভাবে ভয় কর যেভাবে তাকে ভয় করা উচিৎ। এবং (সাবধান) তোমাদের মৃত্যু যেন এ অবস্থায়ই আসে যে, তোমরা মুসলিম।
তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভেদ করো না। স্মরণ কর যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে তখন আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তিনি তোমাদের অন্তরসমূহ একে অপরের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছ। তোমরা তো ছিলে অগ্নিকুন্ডের প্রান্তে। আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের মুক্ত করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তাঁর বিধানসমূহ সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যেন তোমরা পথপ্রাপ্ত হও।
‘তোমাদের মধ্যে যেন এমন একটি দল থাকে, যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজে বাধা দিবে। আর এরাই তো সফলকাম।
‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল এবং মতভেদ করেছিল তাদের নিকট সুস্পষ্ট বিধানসমূহ পৌঁছার পর। এদের জন্যই রয়েছে ভীষণ শাসিত্ম।
‘যেদিন কতক মুখ উজ্জ্বল হবে আর কতক মুখ কালো হয়ে যাবে। যাদের মুখ কালো হবে তাদেরকে বলা হবে, তোমরা কুফরি করলে ঈমান আনার পর?! সুতরাং স্বীয় কুফরির দরুণ শাস্তির স্বাদ গ্রহণ কর।
‘পক্ষান্তরে যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে তারা আল্লাহর রহমতের মধ্যে থাকবে। সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে।’-সূরা আলে-ইমরান (৩) : ১০২-১০৭
‘হাবলুল্লাহ’-আল্লাহর রজ্জু অর্থ আলকুরআন এবং আল্লাহর সাথে কৃত বান্দার সকল অঙ্গিকার, যার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গিকারটি এই যে, আমরা শুধু রবেরই ইবাদত করব, অন্য কারো নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, এই তাওহীদ ও কুরআনকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর। তাওহীদ ত্যাগ করে কিংবা কুরআনের কোনো বিধান থেকে বিমুখ হয়ে বিভেদ করো না। তো এখানেও ঐ কথা-ঐক্যের ভিত্তি তাওহীদ ও কুরআন।
আরো বোঝা গেল যে, তাওহীদপন্থী উম্মাহর পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত। আর এ নেয়ামত হাসিল হবে সর্বপ্রকার ‘আসাবিয়াত’ থেকে মুক্ত হয়ে শুধু এবং শুধু ইসলামের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ এবং ইসলামী বিধিবিধানের আনুগত্যের দ্বারা। আউস ও খাযরাজের দৃষ্টান্ত স্মরণ করুন, এই নেয়ামতে তাঁরা এতই সৌভাগ্যশালী হয়েছিলেন যে, তাঁদের গোত্রীয় পরিচয় ছাপিয়ে গেল এবং দ্বীনী পরিচয়ে-‘আনসার’ নামেই তাঁরা প্রসিদ্ধ হয়ে গেলেন।
‘বাইয়িনাত’ অর্থ কিতাব-সুন্নাহর অকাট্য ও সুস্পষ্ট দলিল, যা থেকে বিমুখ হয়ে মতভেদ করার অর্থই হল এ বিষয়ে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করা, যা সম্পূর্ণ গর্হিত ও বর্জনীয়। যেমন ঈমানদার ও তাওহীদপন্থীদের সাথে কাফির-মুশরিকদের মতভেদ। কট্টর বিদআতীদের মতভেদও অনেক সময় এই সীমানায় প্রবেশ করে। এই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শাস্তি আখেরাতে মুখ কালো হওয়া।
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. এ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন-
تبيض وجوه أهل السنة والجماعة، وتسود وجوه أهل البدعة والفرقة
অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মুখ উজ্জ্বল হবে এবং আহলুল বিদআহ ওয়াল ফুরকার মুখ কালো হবে।-তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/৫৮৪
এ থেকে বোঝা যায়, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অনুসারীগণ ‘আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করার এবং বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন না হওয়ার’ আদেশ পালন করছেন, যার পুরস্কার তারা দুনিয়াতে পেয়ে থাকেন পরস্পর সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মাধ্যমে। আর আখিরাতের পুরস্কার এই হবে যে, তাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে। পক্ষান্তরে যারা কালিমা পাঠ করেও সুন্নাহ ছেড়ে বিদআ অবলম্বন করবে কিংবা উম্মাহর ঐক্যে আঘাত করে ‘আলজামাআ’ এর নীতি থেকে বিচ্যুত হবে তাদেরও আশঙ্কা আছে আয়াতের কঠিন হুঁশিয়ারির মাঝে পড়ে যাওয়ার।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামদের মাঝে শাখাগত বিষয়ে দলিলের ভিত্তিতে যে মতপার্থক্য, তা যেমন বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা নয় তেমনি এ আয়াতের হুঁশিয়ারিরও আওতাভুক্ত নয়। কারণ এ জাতীয় মতপার্থক্যের পরও তাঁরা একতাবদ্ধ ছিলেন এবং তাঁদের মতপার্থক্য-আল্লাহর পানাহ-স্পষ্ট বিধান থেকে বিমুখতার কারণেও ছিল না। তা তো ছিল ‘বাইয়্যিনাত’-এর উপর ইজমা ও ইত্তিহাদের পর কিছু শাখাগত বিষয়ে দলিলভিত্তিক ইখতিলাফ। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসছে ইনশাআল্লাহ।
وَلَقَدْ آتَيْنَا بَنِي إِسْرَائِيلَ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ ۞ وَآتَيْنَاهُمْ بَيِّنَاتٍ مِنَ الْأَمْرِ فَمَا اخْتَلَفُوا إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ إِنَّ رَبَّكَ يَقْضِي بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ ۞ ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ۞ إِنَّهُمْ لَنْ يُغْنُوا عَنْكَ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَإِنَّ الظَّالِمِينَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُتَّقِينَ ۞ هَذَا بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ ۞
(তরজমা) ‘আমি তো বনী ইসরাইলকে কিতাব, রাজত্ব ও নবুওয়ত দান করেছিলাম। তাদেরকে উত্তম রিযিক প্রদান করেছিলাম এবং জগদ্বাসীর উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম।
‘আমি তাদেরকে দ্বীনের সুস্পষ্ট বিধানাবলি দান করেছিলাম। অতপর তারা যে মতভেদ করল তা তাদের কাছে ইলম আসার পরই করেছিল শুধু পরস্পর বিদ্বেষবশত। তারা যে বিষয়ে মতভেদ করত তোমার প্রতিপালক কিয়ামতের দিন সে বিষয়ে তাদের মাঝে ফয়সালা করে দিবেন।
‘এরপর আমি তোমাকে দ্বীনের এক বিশেষ শরীয়তের উপর রেখেছি। সুতরাং তা অনুসরণ কর, অজ্ঞদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করো না।
‘আল্লাহর মুকাবিলায় তারা তোমার কিছুমাত্রও কাজে আসবে না। বস্ত্তত জালিমরা একে অপরের বন্ধু। আর আল্লাহ বন্ধু মুত্তাকীদের।
‘এটি (কুরআন) সকল মানুষের জন্য প্রকৃত জ্ঞানের সমষ্টি এবং দৃঢ়বিশ্বাসীদের জন্য গন্তব্যে পৌঁছার মাধ্যম ও রহমত।’-সূরা জাছিয়া (৪৫) : ১৬-২০
‘বাইয়িনাত’ তথা অকাট্য ও সুস্পষ্ট দলিল দ্বারা হকের নিশ্চিত জ্ঞান অর্জিত হয়। যে তা থেকে বিমুখ হয়ে মতভেদ করে তার মতভেদের ভিত্তি হঠধর্মিতা ও সীমালঙ্ঘন। এই মতভেদ হচ্ছে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা।
এ আয়াতে এ কথাও দ্ব্যর্থহীনভাবে আছে যে, তাওহীদের সাথে শরীয়তের আনুগত্যও অপরিহার্য। শরীয়তকে মেনে নেওয়া প্রকৃতপক্ষে ‘তাওহীদ ফিততাশরী’ তথা বিধানদাতা একমাত্র আল্লাহ-এ বিশ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ। সূরা মায়েদা (৫) : ৪৮ এবং অন্য অনেক জায়গায় সাবধান করা হয়েছে যে, ‘শরয়ে মুনাযযাল তথা আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিলকৃত সুস্পষ্ট বিধানাবলির কোনো একটি বিধানের বিরোধিতাও হারাম ও কুফর।
বস্ত্তত জালিমরা একে অপরের বন্ধু আর আল্লাহ বন্ধু মুত্তাকীদের-এ বাক্যে ولاء ও براء বা موالاة ও معاداة তথা বন্ধুতা ও শত্রুতার নীতি বলা হয়েছে। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি এই যে, ‘মুয়ালাত’ বা বন্ধুত্বের মানদন্ড হচ্ছে ঈমান ও ইসলাম। আর ‘মুআদাত’ বা শত্রুতার মানদন্ড হচ্ছে শিরক ও কুফর। যে কেউ শরীয়তের দৃষ্টিতে মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত সে কেবল তার ঈমান ও ইসলামের কারণেই, অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য ছাড়াই, মুয়ালাত ও বন্ধুত্বের এবং সকল ইসলামী অধিকার পাওয়ার হক রাখে। আর যে এই মানদন্ডে উত্তীর্ণ নয়, অর্থাৎ যে শিরক বা কুফরে লিপ্ত (প্রত্যেক কুফর শিরকেরই বিভিন্ন প্রকার) তার সাথে ‘মুয়ালাত’ বা বন্ধুত্ব হারাম; বরং তা কুফরের আলামত।
(এরপর এ বিষয়ে চারটি সূরা : সূরায়ে তাওবা (৯) : ৩, ২৩-২৪, ৭১; সূরা লুকমান (৩১) : ১৪-১৫; সূরা মুমতাহিনা (৬০) : ১, ৪; সূরা মুজাদালা (৫৮) : ১৪-২২ আয়াতের তরজমা উদ্ধৃত করা হয়েছে। সূরায়ে মুজাদালার (৫৮) : ১৪-২২ আয়াতগুলো উদ্ধৃত করার পর প্রবন্ধকার বলেন-)
দল মূলত দুটি :
১. হিযবুল্লাহ বা আল্লাহর দল
২. হিযবুশ শয়তান বা শয়তানের দল।
যার অন্তরে ঈমান আছে এবং মুমিনদের সাথে মুয়ালাত ও হৃদ্যতা পোষণ করে আর কাফির-মুশরিকদের থেকে বারাআত ও সম্পর্কহীনতা প্রকাশ করে সে হিযবুল্লাহর অন্তর্ভুক্ত। তাকে হিযুবল্লাহ থেকে খারিজ করা কিংবা হিযবুশ শয়তানের দিকে নিসবত করা সম্পূর্ণ হারাম। হিযবুল্লাহর মাপকাঠি হচ্ছে ঈমান, মুমিনদের প্রতি মুয়ালাত ও হৃদ্যতা এবং আহলে কুফর ও শিরকের সাথে মুআদাত ও শত্রুতা।
মুয়ালাত ও বারাআতের এই ইসলামী নীতি থেকে পরিষ্কার হয় যে, ঐক্যের অর্থ ঈমান ও ইসলামের সূত্রে একতাবদ্ধ থাকা। ঐক্যের ভিত্তি হবে তাওহীদ। তাওহীদ ত্যাগ করে এবং দ্বীনের মূলনীতি বিসর্জন দিয়ে কোনোরূপ ঐক্য গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ তা করলে সে আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং তাওহীদ ও ইত্তিহাদ দুটোই তার হাতছাড়া হয়।
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُوا إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। পরস্পর বিবাদ করো না তাহলে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য্য ধারণ কর। নিশ্চিত জেনো, আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে আছেন।-সূরা আনফাল (৮) : ৪৬
এ আয়াতে ‘তাওহীদ ফিততাশরী’ তথা একমাত্র আল্লাহকেই বিধানদাতা বলে বিশ্বাস করার আদেশ আছে। শর্তহীন আনুগত্য একমাত্র আল্লাহর এবং আল্লাহর আদেশে তাঁর রাসূলের। অন্য সকলের আনুগত্য এ আনুগত্যের অধীন। সাথে সাথে কলহবিবাদ থেকে বিরত থাকার আদেশ করা হয়েছে এবং এর বড় দুটি কুফল সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে : এক. এর দ্বারা উম্মাহ শক্তিহীন হয়ে পড়বে, দুই. তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি লোপ পাবে।
বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, রাসূলের আনুগত্য তথা সুন্নাহর অনুসরণের আদেশের সাথে ঐক্য ও সংহতি রক্ষা এবং কলহবিবাদ থেকে আত্মরক্ষার তাকীদ করা হয়েছে।
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ۞ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ ۞ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ ۞ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ۞
(তরজমা) ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মাঝে মীমাংসা করে দাও। আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।
‘হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে। সে (অর্থাৎ যাকে উপহাস করা হচ্ছে) তার চেয়ে উত্তম হতে পারে। এবং কোনো নারীও যেন অপর নারীকে উপহাস না করে। সে (অর্থাৎ যে নারীকে উপহাস করা হচ্ছে) তার চেয়ে উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ করো না এবং একে অন্যকে মন্দ উপাধিতে ডেকো না। ঈমানের পর ফিসকের নাম যুক্ত হওয়া কত মন্দ! যারা এসব থেকে বিরত হবে না তারাই জালেম।
‘হে মুমিনগণ! অনেক রকম অনুমান থেকে বেঁচে থাক। কোনো কোনো অনুমান গুনাহ। তোমরা কারো গোপন ত্রুটি অনুসন্ধান করবে না এবং একে অন্যের গীবত করবে না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? এটা তো তোমরা ঘৃণা করে থাক। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই তিনি বড় তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে এবং তোমাদের মাঝে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্র বানিয়েছি। যাতে একে অন্যকে চিনতে পার। নিশ্চিত জেনো, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন।’-সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০-১৩
এই আয়াতগুলোতে মুমিনদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের চেতনা জাগ্রত করা হয়েছে এবং মুমিনের কাছে মুমিনের প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই আয়াতগুলো থেকে প্রমাণ হয়, ভ্রাতৃত্বের মানদন্ড শুধু ঈমান। সুতরাং উল্লেখিত অধিকারগুলো মুমিনমাত্রেরই প্রাপ্য তার মুমিন ভাইয়ের কাছে।
ঈমানী ভ্রাতৃত্বের রয়েছে অনেক দাবি। এ আয়াতে বিশেষভাবে এমন কিছু দাবি উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো পূরণ না করার কারণে সমাজে কলহ-বিবাদ সৃষ্টি হয়। তেমনি কলহ-বিবাদ সৃষ্টি হলে এই বিষয়গুলো আরো বেশি লঙ্ঘিত হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, দ্বীনী-দুনিয়াবী মতভেদের ক্ষেত্রে একে অপরকে উপহাস ও তাচ্ছিল্য করা, গীবত করা, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া, কুধারণা পোষণ করা, কটুক্তি করা, খারাপ নামে বা মন্দ উপাধিতে ডাকা-এই সব বিষয়ের চর্চা হতে থাকে। লোকেরা যেন ভুলেই যায় যে, কুরআন মজীদে এ বিষয়গুলোকে হারাম করা হয়েছে। প্রত্যেকের আচরণ থেকে মনে হয়, প্রতিপক্ষের ইজ্জত-আব্রু নষ্ট করা হালাল! মতভেদের কারণে তার কোনো ঈমানী অধিকার অবশিষ্ট নেই। অথচ এ তো শুধু মুমিনের হক নয়, সাধারণ অবস্থায় মানুষমাত্রেরই হক। একজন মানুষ অপর একজন মানুষের কাছে এই নিরাপত্তাটুকু পাওয়ার অধিকার রাখে। এমনকি যদি সে মুসলিমও না হয়।
হায়! বিরোধ ও মতভেদের ক্ষেত্রে যদি আমরা প্রতিপক্ষকে অন্তত একজন মানুষ মনে করে তার গীবত-শেকায়েত থেকে, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া থেকে, উপহাস-বিদ্রূপ করা থেকে ও মন্দ নামে ডাকা থেকে বিরত থাকতাম! আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহয় তো জীবজন্তু, এমনকি জড় বস্ত্তরও হক ও অধিকার বর্ণিত হয়েছে। তো মতভেদকারী আর কিছু না হোক একজন প্রাণী তো বটে!!
লক্ষ্য করুন, আল্লাহ তাআলা কী বলেছেন-
بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ
অর্থাৎ এই সকল হক যে ব্যক্তি রক্ষা করে না সে সমাজ ও শরীয়ত উভয়ের দৃষ্টিতে ফাসিক উপাধির উপযুক্ত হয়ে যায়। একজন মুমিনের জন্য তা কত বড় লজ্জা ও দুর্ভাগ্যের বিষয়?
তো দ্বীনী মতভেদের ক্ষেত্রে যদি এইসব আচরণ করা হয় এবং এ কারণে দ্বীনের পক্ষ হতেই ঐ ‘খাদিমে দ্বীনে’র নামের সাথে ফাসিক উপাধি যুক্ত হয় তাহলে তা দ্বীন ও শরীয়তের কেমন খেদমত তা খুব সহজেই অনুমেয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন।
শেষ আয়াতে সমগ্র মানবজাতির জন্য ন্যায় ও সাম্যের এই গুরুত্বপূর্ণ নীতি ঘোষণা করা হয়েছে যে, বংশীয়, গোত্রীয় বা আঞ্চলিক পরিচিতি মর্যাদা ও শরাফতের মাপকাঠি নয়। মর্যাদার মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া ও খোদাভীরুতা। সকল মানুষ এক পুরুষ ও এক নারীর সন্তান। এরপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আলাদা আলাদা কওম, গোত্র বা খান্দানের পরিচয় এজন্য দান করেননি যে, এরই ভিত্তিতে তারা একে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করবে; বরং এই বৈচিত্রের একমাত্র উদ্দেশ্য, তাদেরকে ছোট ছোট শ্রেণীতে ভাগ করা, যাতে অসংখ্য আদমসন্তানের মাঝে পারস্পরিক পরিচিতি সহজ হয়।
ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও অঞ্চল এসব ছিল আরব জাহিলিয়াতে একতা ও জাতীয়তার মানদন্ড। আধুনিক জাহিলিয়াতে এসবের সাথে আরো যোগ হয়েছে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন দর্শন ও মতবাদকেন্দ্রিক একতা ও জাতীয়তা। এভাবে অসংখ্য বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে একতা শব্দটি একটি অসার শব্দে পরিণত হয়েছে।
প্রাচীন ও আধুনিক উভয় জাহিলিয়াতে মর্যাদা ও শরাফতের মাপকাঠি ধরা হয়েছে আপন আপন পসন্দের নিসবত ও সম্বন্ধকে। এর বিপরীতে ইসলামের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা-ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু তাওহীদ, উম্মাহর জাতীয়তা ইসলাম, আর মর্যাদা ও শরাফতের মাপকাঠি তাকওয়া। এভাবে শ্রেষ্ঠত্বের সকল জাহেলী মাপকাঠিকে ইসলাম বাতিল সাব্যস্ত করেছে এবং সব ধরনের আসাবিয়ত, অহংকার ও সাম্প্রদায়িকতাকে হারাম ঘোষণা করেছে।
আয়াতের উপরোক্ত শিক্ষা থেকে এ নীতিও প্রমাণিত হয় যে, পরিচিতির জন্য বংশীয় ও গোত্রীয় সম্বন্ধ ছাড়া আরো যে সকল জায়েয সম্বন্ধ ব্যবহার করা হয় সেগুলোকেও মর্যাদার মাপকাঠি মনে করা কিংবা সেসবের ভিত্তিতে মুয়ালাত ও বারাআত তথা বন্ধুত্ব ও শত্রুতার আচরণ করা হারাম। মর্যাদার মাপকাঠি তাকওয়া। মুয়ালাত ও বন্ধুত্বের মানদন্ড ঈমান আর কারো থেকে বারাআত ও সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কহীনতা ও দায়মুক্ততার কারণ শুধু শিরক ও কুফরই হতে পারে।
এ সকল জায়েয সম্বন্ধের মাঝে জন্মস্থান বা আবাসস্থলের সম্বন্ধ, ফিকহী মাযহাবের সম্বন্ধ, সুলুক ও ইহসানের তরীকাসমূহের সম্বন্ধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্বন্ধ সবই অন্তর্ভুক্ত। কেউ যদি তার শিক্ষাকেন্দ্রের হিসাবে নামের সাথে মাদানী, আযহারী, নদভী বা দেওবন্দ্বী/কাসেমী লেখে তাহলে তা নাজায়েয নয়। তেমনি ফিকহী মাযহাবের হিসাবে মালেকী, হাম্বলী, হানাফী বা শাফেয়ী লিখলে, কিংবা বিশেষ মাসলাক ও মাশরাব হিসাবে সালাফী বা আছারী লিখলে অথবা সুলূক ও ইহসানের তরীকা হিসাবে কাদেরী বা নকশবন্দী লিখলে তা নাজায়েয নয়। কিন্তু এই সম্বন্ধগুলোকেই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি মনে করা, এসবের ভিত্তিতে বিভক্ত হওয়া, এসবের প্রতি আসাবিয়াত ও অন্যায় পক্ষপাত লালন করা, নিজের সম্বন্ধের, প্রতিষ্ঠানের, মাযহাব-মাশরাবের এবং তরীকার কোনো বিষয় সুস্পষ্ট দলিল দ্বারা ভুল প্রমাণিত হলেও তার উপর জিদ করা এবং ঈমানী ভ্রাতৃত্বের দাবি পূরণের ক্ষেত্রে এসকল সম্বন্ধকে মাপকাঠি ও মানদন্ড মনে করা সম্পূর্ণ হারাম ও ফাসেকী।
হকের মানদন্ড হচ্ছে শরীয়তের দলিল, যাতে সীরাত ও আছারে সাহাবাও অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর কাছে মর্যাদার মাপকাঠি তাকওয়া। ঈমানী ভ্রাতৃত্ব ও তার হকসমূহের মানদন্ড ঈমান। ঈমানের অতিরিক্ত অন্য কোনো নিসবত বা সম্বন্ধের উপর এই সব হকের কোনোটিকে মওকুফ মনে করা কিংবা মওকুফ রাখা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী।
হাদীস
কুরআন মজীদের আয়াতের পর আলোচ্য বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিছু হাদীস পেশ করছি। প্রথমে ঈমানী ভ্রাতৃত্বের বিষয়ে কিছু হাদীস উল্লেখ করব। এরপর ঐক্যের অপরিহার্যতা এবং অনৈক্যের বর্জনীয়তা সম্পর্কে কিছু হাদীস উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ।
(ঈমানী ভ্রাতৃত্বের বিষয়ে মূলপ্রবন্ধে সর্বমোট দশটি হাদীস রয়েছে। তন্মধ্যে দুটি হাদীস উল্লেখ করা হল।)
عن أبي هريرة رضي الله تعالى عنه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إياكم والظن، فإن الظن أكذب الحديث، ولا تَحَسَّسُوا، ولا تَجَسَّسُوا، ولا تَنَافَسُوا، ولا تَحَاسَدُوا، ولا تَبَاغَضُوا، ولا تَقَاطَعُوا، وَلا تهجروا، ولا تَدَابروا، ولا تناجشوا، ولا يبع بعضكم على بيع بعض، وكونوا كما أمركم الله عباد الله إخوانا.
المسلم أخو المسلم، لا يظلمه ولا يخذله ولا يحقره، التقوى ههنا، ويشير إلى صدره، ثلاث مرات.
بحسب امرئ من الشر أن يحقر أخاه المسلم، إن الله لا ينظر إلى أجسادكم، ولكن ينظر إلى قلوبكم، وأشار بأصابعه إلى صدره.
كل المسلم على المسلم حرام دمه وماله وعرضه.
رواه البخاري ومسلم، والسياق مأخوذ من مجموع رواياتهما.
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাক। কারণ ধারণা হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যা। তোমরা আঁড়ি পেতো না, গোপন দোষ অন্বেষণ করো না, স্বার্থের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ো না, হিংসা করো না, বিদ্বেষ পোষণ করো না, সম্পর্কচ্ছেদ করো না, পরস্পর কথাবার্তা বন্ধ করো না, একে অপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিও না, দাম-দস্ত্তরে প্রতারণা করো না এবং নিজের ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের মাঝে ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করো না। হে আল্লাহর বান্দারা! আল্লাহ যেমন আদেশ করেছেন, সবাই তোমরা আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও।’-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫১৪৩, ৬০৬৪, ৬০৬৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৬৩/২৮, ২৯, ৩০ ও ২৫৬৪/৩২, ৩৩
عن أبي برزة الأسلمي قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : يا معشر من آمن بلسانه ولم يدخل الإيمان قلبه لا تغتابوا المسلمين ولا تتبعوا عوراتهم فإنه من يتبع عورة أخيه يتبع الله عورته حتى يفضحه في بيته.
رواه أحمد وأبو داود، وهو صحيح لغيره، ومن شواهده حديث ثوبان عند أحمد برقم : ٢٢٤٠٢ وحديث ابن عمر عند الترمذي برقم : ٢١٥١ وابن حبان في صحيحه برقم : ٥٧٦٣
আবু বারযা আলআসলামী রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ওহে যারা মুখে মুখে ঈমান এনেছ, কিন্তু ঈমান তাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি তারা শোন, মুসলমানের গীবত করো না এবং তাদের দোষত্রুটি অন্বেষণ করো না। কারণ যে তাদের দোষ খুঁজবে স্বয়ং আল্লাহ তার দোষ খুঁজবেন। আর আল্লাহ যার দোষ খুঁজবেন তাকে তার নিজের ঘরে লাঞ্ছিত করবেন।’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৯৭৭৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৮৮০
এ সকল হাদীসের শিক্ষা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য এক হাদীসে এক বাক্যে ইরশাদ করেছেন-
المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده
অর্থ : মুসলিম সে, যার মুখ ও হাত থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১০
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর হক আদায়ের সাথে বান্দার হকও আদায় করে সে-ই প্রকৃত মুসলিম।
ইমাম নববী রাহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন-
فيه جمل من العلم، ففيه الحث على الكف عما يؤذي المسلمين، بقول أو فعل، بمباشرة أو سبب، وفيه الحث على الإمساك عن احتقارهم، وفيه الحث على تألُّف قلوب المسلمين واجتماع كلمتهم، واستجلاب ما يُحصّل ذلك. قال القاضي عياض : والألفة إحدى فرائض الدين وأركان الشريعة، ونظام شَمْل الإسلام.
‘‘এ হাদীসে রয়েছে অনেক ইলম : যেমন-নিজের কথা বা কাজের মাধ্যমে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো মুসলিমকে কষ্ট না দেওয়ার আদেশ, কোনো মুসলিমকে উপহাস ও তাচ্ছিল্য না করার আদেশ, মুসলমানদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার এবং এর জন্য সহায়ক সকল পন্থা অবলম্বনের আদেশ ইত্যাদি।
কাযী ইয়ায রাহ. বলেছেন, ‘সম্প্রীতি দ্বীনের অন্যতম ফরয, শরীয়তের অন্যতম রোকন এবং বৈচিত্রে পূর্ণ মুসলিমসমাজকে একতাবদ্ধ করার উপায়’।’’-শরহু সহীহ মুসলিম ২/১০, বৈরুত
এই সকল হাদীসে যে হকগুলো বর্ণিত হয়েছে তা মুসলমানের সাধারণ হক। তা পাওয়ার জন্য মুমিন ও মুসলিম হওয়া ছাড়া আর কোনো শর্ত নেই। সুতরাং দুজন মুসলিমের মাঝে বা দুই দল মুসলমানের মাঝে কোনো দ্বীনী বা দুনিয়াবী বিষয়ে মতভেদ হলে সেখানেও এ সকল হক রক্ষা করতে হবে এবং শরীয়তের এ সকল বিধান মেনে চলতে হবে।
কোনো হাদীসে বলা হয়নি যে, দুই মুসলিমের মাঝে মতভেদ হলে তখন আর এ সকল হক রক্ষা করতে হবে না; বরং সেটিই তো আসল ক্ষেত্র এই হকগুলো রক্ষা করার। সাধারণত মতপার্থক্য দেখা দিলেই এই হকগুলো বিনষ্ট করা হয়। সুতরাং ঐ ক্ষেত্রেই যদি সকলে তা রক্ষায় সতর্ক না হয় তাহলে আর সুন্নাহর অনুসরণ এবং হাদীস মোতাবেক আমলের কী অর্থ থাকে?
ইত্তিবায়ে সুন্নতের বিষয়ে এ হাদীস সবাই জানি-
من أحب سنتي فقد أحبني، ومن أحبني كان معي في الجنة.
‘যে আমার সুন্নতকে ভালবাসে সে আমাকে ভালবাসে। আর যে আমাকে ভালবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।’
কিন্তু এটি একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ। পূর্ণ হাদীসটি এই-
عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال : قال لي رسول الله صلى الله عليه و سلم : يا بني إن قدرت أن تصبح وتمسي وليس في قلبك غش لأحد فافعل، ثم قال لي : يا بني وذلك من سنتي ومن أحيا سنتي فقد أحبني ومن أحبني كان معي في الجنة.
رواه الترمذي في كتاب العلم، وقال: هذا حديث حسن غريب من هذا الوجه.
আনাস রা.কে সম্বোধন করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বেটা! সকাল-সন্ধ্যায় যদি এমনভাবে থাকতে পার যে, তোমার মনে কারো প্রতি বিদ্বেষ নেই তাহলে এমনভাবেই থাক। বেটা! এটি আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নতকে যিন্দা করে সে আমাকে ভালবাসে। আর যে আমাকে ভালবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।’-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৬৭৮
এই সুন্নতের সম্পর্ক যেহেতু অন্তর্জগতের সাথে, তাই এর আলোচনা কম হয়ে থাকে। আমাদের কর্তব্য, ইত্তিবায়ে সুন্নতের সময় এ সুন্নতটি যেন না ভুলি এবং হাদীস অনুসরণের আহবানের সময় এ হাদীসটি যেন বিস্মৃত না হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন। আমীন।
এবার আমরা ঐক্য ও সম্প্রীতির অপরিহার্যতা এবং কলহ-বিবাদের বর্জনীয়তা সম্পর্কে কিছু হাদীস উল্লেখ করছি। (এ বিষয়েও হাদীসের বিভিন্ন কিতাব থেকে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু একটি হাদীস তুলে দেওয়া হল।)
عن النعمان بن بشير رضي الله تعالى عنه قال : قال النبي صلى الله عليه وسلم على المنبر : من لم يشكر القليل لم يشكر الكثير، ومن لم يشكر الناسَ لم يشكر الله عز وجل، والتحدُّث بنعمة شكر، وتركها كفر، والجماعة رحمة، والفرقةُ عذاب.
قال المنذري في الترغيب : بإسناد لا بأس به.
নুমান ইবনে বাশীর রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বারের বয়ানে বলেছেন, যে অল্প কিছুর উপর শোকরগোযারী করে না সে অনেক কিছুর উপরও শোকরগোযারি করে না। যে মানুষের শোকর করে না সে আল্লাহরও শোকর করে না। নেয়ামত পেয়ে তা বর্ণনা করাও শোকরগোযারি আর তা না করা নেয়ামতের না-শোকরী। জামাআ হল রহমত আর বিচ্ছিন্নতা হচ্ছে আযাব।-যাওয়াইদুল মুসনাদ, হাদীস : ১৮৪৪৯, ১৯৩৫০; কিতাবুস সুন্নাহ, ইবনু আবী আসিম, হাদীস : ৯৩
মুসলমানের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য অনেক নীতি ও বিধান দেওয়া হয়েছে। ইসলামের এ সকল বিধানের উপর সংক্ষেপে নজর বুলিয়ে গেলেও পরিষ্কার হয়ে যায়, বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা পরিহার করা ইসলামের দৃষ্টিতে কত গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবারে পুরুষকে কর্তা বানানো হয়েছে এবং স্ত্রী ও সন্তানদেরকে তার অনুগত থাকার আদেশ করা হয়েছে। আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে বলা হয়েছে। জাতির সকল শ্রেণীর হক ও অধিকার নির্ধারণ করে এককে অপরের সাথে যুক্ত করা হয়েছে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে-
كلكم راع وكلكم مسؤول عن رعيته
প্রত্যেকেই তোমরা দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার অধীনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।
অন্যদিকে একে অপরকে সালাম দেওয়া, অসুস্থকে দেখতে যাওয়া এবং এ জাতীয় সাধারণ হক সম্পর্কে সচেতন করে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বীজ বপন করা হয়েছে।
সফরে বের হলে একজনকে আমীর বানানোর আদেশ করা হয়েছে। সুলতান ও তার স্থলাভিষিক্ত, যারা উলূল আমরের অন্তর্ভুক্ত, তাদের অনুগত থাকার জোরালো আদেশ করা হয়েছে। তবে এখানে শরীয়তের এ বিধানও আছে যে-
لا طاعة لمخلوق في معصية الله عز وجل
অর্থ : আল্লাহর অবাধ্য হয়ে মাখলুকের আনুগত্য বৈধ নয়।
ছোট ব্যক্তি, বড় ব্যক্তি, ক্ষুদ্র সমাজ, বৃহৎ সমাজ সবার আনুগত্যের ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য।
মসজিদের জামাতে ইমামের অনুসরণ জরুরি। তার আগে দাঁড়ানো বা তার আগে কোনো রোকন আদায় করা নিষেধ। কাতার সোজা করা ওয়াজিব। কাতার বাঁকা হলে আছে মনের ঐক্য অন্তর্হিত হওয়ার হুঁশিয়ারি।
দ্বীন-দুনিয়ার যে কোনো যৌথ কাজে আছে শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের বিধান এবং উম্মাহর সকল শ্রেণীর জন্য রয়েছে এই গুরম্নত্বপূর্ণ নীতি- وأمرهم شورى بينهم ও
تعاونوا على البر والتقوى، ولا تعاونوا على الإثم والعدوان
কওমকে বলেছে আলিমের কাছে যাও এবং মাসাইল জিজ্ঞাসা করে সে অনুযায়ী চল। আরো বলা হয়েছে, দ্বীনদার, নেককার মানুষের সাহচর্য গ্রহণ কর। তালিবানে ইলমকে বলা হয়েছে উস্তাদের সোহবত ও সান্নিধ্য গ্রহণ কর। সর্বোপরি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে-
ليس منا من لم يُجِلُّ كبيرنا، ويَرْحَمْ صغيرنا، ويَعْرِف لعالمنا.
قال الهيثمي في المجمع : 8/14 : رواه أحمد والطبراني، وإسناده حسن.
অর্থাৎ যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের দয়া করে না এবং আলিমের (হক) অনুধাবন করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।-শরহু মুশকিলিল আছার, হাদীস : ১৩২৮; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২২৭৫৫
قال الهيثمي في المجمع : رواه أحمد والطبراني، وإسناده حسن.
-মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/১৪
উম্মাহর প্রত্যেক ব্যক্তিকে এই দীক্ষা দেওয়া হয়েছে যে-
الدين النصيحة، لله ولرسوله ولكتابه ولأئمة المسلمين وعامتهم.
অর্থাৎ দ্বীন হল ওফাদারি-আল্লাহর সাথে, আল্লাহর রাসূলের সাথে, মুসলমানদের নেতৃবৃন্দের সাথে এবং সাধারণ মুসলমানদের সাথে।
মোটকথা, যৌথ ও সামাজিক জীবনের বিধিবিধান এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে, যেন সকল ক্ষেত্রে ঐক্য, সম্প্রীতি এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার এক শান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করে। গোটা সমাজ যেন হয় এ হাদীসের জীবন্ত নমুনা-
المسلمون كرجل واحد، إن اشتكى عينه اشتكى كله، وإن اشتكى رأسه اشتكى كله.
অর্থাৎ মুসলিমেরা সকলে মিলে একটি দেহের মতো, যার চোখে ব্যথা হলে গোটা দেহের কষ্ট হয়, মাথায় ব্যথা হলেও গোটা দেহের কষ্ট হয়।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৮৬/৬৭
এই সুশৃঙ্খল ও শান্তিময় জীবনের সকল উপাদান সংরক্ষণ করতে হবে। কলহ-বিবাদের উপাদানগুলোকে ক্রিয়াশীল হতে দেওয়া যাবে না এবং শান্তির সমাজে অশান্তির আগুন জ্বলতে দেওয়া যাবে না। এটি ঐ হাদীসের দাবি, যাতে বলা হয়েছে, ‘জামাআ হচ্ছে রহমত আর ফুরকা হচ্ছে আযাব।’ নববী ও কাযী ইয়াযের যে কথাগুলো ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে তাতেও এদিকে ইঙ্গিত রয়েছে।
জামাআতে শামিল থাকার বিষয়ে অনেক হাদীস ও আছার রয়েছে, যা পাওয়া যাবে হাদীসগ্রন্থের কিতাবুল ফিতান, কিতাবুল ইমারাহ, কিতাবুল ইতিসাম বিলকিতাবি ওয়াস সুন্নাহ প্রভৃতি অধ্যায়ে।
এসকল হাদীস সামনে রেখে চিন্তা করলে প্রতীয়মান হয়, আলজামাআ শব্দে নিমেণাক্ত বিষয়গুলো শামিল আছে :
১. আমীরুল মুমিনীন বা সুলতানের কতৃত্ব স্বীকারকারীদের সঙ্গে থাকা এবং শরীয়তসম্মত বিষয়ে তার আনুগত্য বর্জন না করা। (দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারী ১৩/৩৭, হাদীস : ৭০৮৪-এর আলোচনায়)
২. শরীয়তের আহকাম ও বিধানের ক্ষেত্রে উম্মাহর ‘আমলে মুতাওয়ারাছ’ তথা সাহাবা-তাবেয়ীন যুগ থেকে চলে আসা কর্মধারা এবং উম্মাহর সকল আলিম বা অধিকাংশ আলিমের ইজমা ও ঐক্যের বিরোধিতা না করা। (দ্রষ্টব্য : উসূলের কিতাবসমূহের ইজমা অধ্যায়)
৩. হাদীস-সুন্নাহ এবং ফিকহের ইলম রাখেন, এমন উলামা-মাশাইখের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখা। ইমাম তিরমিযী রাহ. আহলে ইলম থেকে আলজামাআর যে ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেন তা এই-
أهل الفقه والعلم والحديث
অর্থাৎ জামাআ হচ্ছে ফিকহ ও হাদীসের ধারক আলিম সম্প্রদায়। (কিতাবুল ফিতান, বাবু লুযুমিল জামাআ, হাদীস : ২১৬৭-এর আলোচনায়)
৪. মুসলিমসমাজের ঐক্য, সংহতি এবং ঈমানী ভ্রাতৃত্বের উপাদানসমূহের সংরক্ষণ এবং অনৈক্য, বিবাদ ও হানাহানির উপকরণসমূহ থেকে সমাজকে মুক্ত করার প্রয়াস, যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলা হয়েছে।
এখানে যে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হল সাধারণত আলজামাআর ব্যাখ্যায় এগুলোকে আলাদা আলাদা মত হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এদের মাঝে কোনো সংঘর্ষ নেই। প্রত্যেকটি হচ্ছে আলজামাআর বিভিন্ন দিক। একেকজন একেকটি দিক আলোচনা করেছেন।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা
এখানে যে কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা এই যে, উপরোক্ত হাদীসসমূহে ‘আলজামাআ’র বিপরীতে এসেছে ‘আলফুরকা’; ‘আলইখতিলাফ’ নয়। অনেকে ফুরকা বা বিচ্ছিন্নতা শব্দের তরজমা করে ফেলেন ইখতিলাফ বা মতভেদ। এই তরজমা আপত্তিকর। সামনে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ।
মতভেদ কখন বিভেদ হয়
উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস থেকে ঐক্য ও সম্প্রীতির গুরুত্ব যেমন বোঝা যায় তেমনি বোঝা যায়, সকল মতভেদ বিভেদ নয়। কারণ কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট বর্ণনা অনুযায়ী নবী ও রাসূলদের মাঝে কোনো বিভেদ ছিল না। তারা পরস্পর অভিন্ন ছিলেন। যদিও শরীয়তের বিধিবিধান সবার এক ছিল না, পার্থক্য ও বিভিন্নতা ছিল। কিন্তু তা ছিল দলিলভিত্তিক, খেয়ালখুশি ভিত্তিক -নাউযুবিল্লাহ- ছিল না। সুতরাং বোঝা গেল, ফুরূ বা শাখাগত বিষয়ে দলিলভিত্তিক মতপার্থক্য বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা নয়।
সবাই জানেন, দাউদ আ. ছিলেন আল্লাহর নবী। তাঁর পুত্র সুলায়মান আ.ও নবী ছিলেন। এক মোকদ্দমার রায় সম্পর্কে দুজনের মাঝে ইজতিহাদগত মতপার্থক্য হল। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে তাদের মতপার্থক্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন এবং সুলায়মান আ.-এর ইজতিহাদ যে তাঁর মানশা মোতাবেক ছিল সেদিকেও ইশারা করেছেন। তবে পিতাপুত্র উভয়ের প্রশংসা করেছেন। তো এখানে ইজতিহাদের পার্থক্য হয়েছে, কিন্তু বিভেদ হয়নি। এই পার্থক্যের আগেও যেমন পিতাপুত্র দুই নবী এক ছিলেন, তেমনি পার্থক্যের পরও।
(দেখুন : সূরা আম্বিয়া (২১) : ৭৮-৭৯)
তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাফসীরে কুরতুবী (১১/৩০৭-৩১৯) ও অন্যান্য তাফসীরের কিতাব দেখে নেওয়া যায়।
তো বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার ছূরতগুলো ভালোভাবে জেনে নেওয়া চাই। আর তা এই-
১. দ্বীন ইসলামে দাখিল না হওয়া, ইসলামের বিরোধিতা করা বা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়া-এগুলো সর্বাবস্থায় দ্বীনের ক্ষেত্রে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা।
তাওহীদ এবং দ্বীনের অন্যান্য মৌলিক বিষয়, যেগুলোকে পরিভাষায় ‘জরূরিয়াতে দ্বীন’ বলে, তার কোনো একটির অস্বীকার বা অপব্যাখ্যা হচ্ছে ইরতিদাদ (মুরতাদ হওয়া), যা দ্বীনের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার জঘন্যতম প্রকার। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় দ্বীন ইসলামকে মনে প্রাণে গ্রহণ করা।
২. দ্বীনে ইসলাম গ্রহণের পর কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী আকীদাসমূহ বোঝার ক্ষেত্রে খেয়ালখুশির অনুসরণ করে সাহাবীগণের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া। এটাও বিচ্ছিন্নতা। হাদীস শরীফে কঠিন ভাষায় এর নিন্দা করা হয়েছে এবং তা থেকে বাঁচার জন্য দুটি জিনিসকে দৃঢ়ভাবে ধারণের আদেশ করা হয়েছে : ‘আসসুন্নাহ’ এবং ‘আলজামাআ’। এ কারণে যে জামাত সিরাতে মুসতাকীমের উপর অটল থাকে তাদের নাম ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ।’
তাদের পথ থেকে যারাই বিচ্যুত হয়েছে তারাই এই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়েছে। অতপর কোনো দল ও ফের্কার জন্ম দিলে তা তো আরো মারাত্মক।
৩. আলজামাআর ব্যাখ্যায় উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির প্রসঙ্গে প্রথম যে বিষয়ের কথা বলা হয়েছে তার কোনো একটি ভঙ্গ করা কিংবা কোনো একটি থেকে বিচ্যুত হওয়া পরিষ্কার বিচ্ছিন্নতা।
আর ‘আলজামাআর’ ব্যাখ্যায় উল্লেখিত চতূর্থ বিষয়টি অর্থাৎ মুসলিম সমাজের ইজতিমায়ী রূপরেখা বিনষ্ট করা বা এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে তা বিনষ্ট হয় তাও বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শামিল।
ফুরূয়ী মাসাইল বা শাখাগত বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণের যে মতপার্থক্য, যাকে ফিকহী মাযহাবের মতপার্থক্য বলে, তা দ্বীনের বিষয়ে বিচ্ছিন্নতা নয়। আগেও এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কারণ ফিকহের এই মাযহাবগুলো তো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামগণেরই মাযহাব। এগুলো ‘বিচ্ছিন্নতা নয়; বরং গন্তব্যে পৌঁছার একাধিক পথ, যা স্বয়ং গন্তব্যের মালিকের পক্ষ হতে স্বীকৃত ও অনুমোদিত। ফির্কা ও ফিকহী মাযহাবের পার্থক্য বুঝতে ব্যর্থ হওয়া খুবই দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক বিষয়।
সাহাবায়ে কেরামের যুগেও ফিকহের মাযহাব ও ফিকহের মতপার্থক্য ছিল, অথচ তাঁরা খেয়ালখুশির মতভেদ কখনো সহ্য করতেন না। তাদের কাছে এ জাতীয় মতভেদকারীদের উপাধি ছিল ‘আহলুল আহওয়া’, ‘আহলুল বিদা ওয়াদ দ্বলালাহ’ এবং ‘আহলুল বিদআতি ওয়াল ফুরকা’।
সাহাবায়ে কেরামের যুগে ফিকহের মাযহাব
এ সম্পর্কে ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর বিবরণ শুনুন :
ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. (১৬১ হি.-২৩৪ হি.) ছিলেন ইমাম বুখারী রাহ.-এর বিশিষ্ট উস্তাদ। তিনি সাহাবায়ে কেরামের সেসব ফকীহের কথা আলোচনা করেছেন, যাদের শাগরিদগণ তাঁদের মত ও সিদ্ধান্তগুলো সংরক্ষণ করেছেন, তা প্রচার প্রসার করেছেন এবং যাদের মাযহাব ও তরীকার উপর আমল ও ফতওয়া জারি ছিল। আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. এই প্রসঙ্গে বলেছেন, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এমন ব্যক্তি ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. (মৃত্যু : ৩২ হিজরী), যায়েদ ইবনে ছাবিত রা. (জন্ম : হিজরতপূর্ব ১১ ও মৃত্যু : ৪৫ হিজরী) ও আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. (জন্ম : হিজরতপূর্ব ৩ ও মৃত্যু : ৬৮ হিজরী)।
তাঁর আরবী বাক্যটি নিমণরূপ-
ولم يكن في أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم من له صُحَيْبَةٌ، يذهبون مذهبه، ويفتون بفتواه ويسلكون طريقته، إلا ثلاثة : عبد الله بن مسعود وزيد بن ثابت وعبد الله بن عباس رضي الله عنهم، فإن لكل منهم أصحابا يقومون بقوله ويفتون الناس.
এরপর আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. তাঁদের প্রত্যেকের মাযহাবের অনুসারী ও তাঁদের মাযহাব মোতাবেক ফতওয়া দানকারী ফকীহ তাবেয়ীগণের নাম উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর কিরাত অনুযায়ী মানুষকে কুরআন শেখাতেন, তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মানুষকে ফতওয়া দিতেন এবং তাঁর মাযহাব অনুসরণ করতেন তারা হলেন এই ছয়জন মনীষী : আলকামাহ (মৃত্যু : ৬২ হিজরী), আসওয়াদ (মৃত্যু : ৭৫ হিজরী), মাসরূক (মৃত্যু : ৬২ হিজরী), আবীদাহ (মৃত্যু : ৭২ হিজরী), আমর ইবনে শুরাহবীল (মৃত্যু : ৬৩ হিজরী) ও হারিস ইবনে কাইস (মৃত্যু : ৬৩ হিজরী)।
ইবনুল মাদীনী রাহ. বলেছেন, ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. (৪৬-৯৬ হিজরী) এই ছয়জনের নাম উল্লেখ করেছেন।
ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর উপরোক্ত বিবরণের সংশ্লিষ্ট আরবী পাঠ নিমণরূপ-
الذين يقرؤن الناس بقراءته ويفتونهم بقوله وبذهبون مذهبه ...
এরপর আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. লিখেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর (ফকীহ) শাগরিদদের সম্পর্কে এবং তাঁদের মাযহাবের বিষয়ে সবচেয়ে বিজ্ঞ ছিলেন ইবরাহীম (নাখায়ী) (৪৬-৯৬ হিজরী) এবং আমের ইবনে শারাহীল শাবী (১৯-১০৩ হিজরী)। তবে শাবী মাসরূক রাহ.-এর মাযহাব অনুসরণ করতেন।
আরবী পাঠ নিমণরূপ-
وكان أعلم أهل الكوفة بأصحاب عبد الله ومذهبهم إبراهيم والشعبي إلا أن الشعبي كان يذهب مذهب مسروق.
এরপর লিখেছেন-
وكان أصحاب زيد بن ثابت الذين يذهبون مذهبه في الفقه ويقومون بقوله هؤلاء الاثنى عشر ...
অর্থাৎ যায়েদ ইবনে ছাবিত রা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং তাঁর মত ও সিদ্ধান্তসমূহ সংরক্ষণ ও প্রচার প্রসার করতেন তাঁরা বারো জন।
তাঁদের নাম উল্লেখ করার পর ইবনুল মাদীনী রাহ. লেখেন, এই বারো মনীষী ও তাদের মাযহাবের বিষয়ে সবচেয়ে বিজ্ঞ ছিলেন ইবনে শিহাব যুহরী (৫৮-১২৪ হিজরী), ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আনসারী (মৃত্যু : ১৪৩ হিজরী), আবুয যিনাদ (৬৫-১৩১ হিজরী) এবং আবু বকর ইবনে হাযম (মৃত্যু ১২০ হিজরী)।
এদের পরে ইমাম মালেক ইবনে আনাস রাহ. (৯৩-১৭৯ হিজরী)।
এরপর ইবনুল মাদীনী রাহ. বলেছেন-
‘তদ্রূপ আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর মত ও সিদ্ধান্তসমূহ সংরক্ষণ ও প্রচার করতেন, সে অনুযায়ী ফতওয়া দিতেন এবং তার অনুসরণ করতেন, তাঁরা ছয়জন।
وكما أن أصحاب ابن عباس ستة الذين يقومون بقوله ويفتون به ويذهبون مذهبه.
এরপর তিনি তঁদের নাম উল্লেখ করেন।
ইমাম ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর পূর্ণ আলোচনা তাঁর ‘কিতাবুল ইলালে’ (পৃষ্ঠা : ১০৭-১৩৫, প্রকাশ : দারুবনিল জাওযী রিয়ায, ১৪৩০ হিজরী।) বিদ্যমান আছে এবং ইমাম বায়হাকী রাহ.-এর ‘আলমাদখাল ইলাস সুনানিল কুবরা’তেও (পৃষ্ঠা : ১৬৪-১৬৫) সনদসহ উল্লেখিত হয়েছে। আমি উক্তিটি দোনো কিতাব সামনে রেখেই উদ্ধৃত করেছি। এই কথাগুলো আলোচ্য বিষয়ে এতই স্পষ্ট যে, কোনো টীকা-টিপ্পনীর প্রয়োজন নেই। সুতরাং মনে রাখতে হবে, ইমামগণের ফিকহী মাযহাবের যে মতপার্থক্য তাকে বিভেদ মনে করা অন্যায় ও
বাস্তবতার বিকৃতি এবং সাহাবায়ে কেরামের নীতি ও ইজমার বিরোধিতা। আর এ পার্থক্যের বাহানায় মাযহাব অনুসারীদের থেকে আলাদা হয়ে তাদের নিন্দা-সমালোচনা করা সরাসরি বিচ্ছিন্নতা, যা দ্বীনের বিষয়ে বিভেদের অন্তর্ভুক্ত।
মাযহাবকে আসাবিয়াতের কারণ বানানো
তেমনি ফিকহী মাযহাবের অনুসারী কোনো ব্যক্তি বা দল যদি মাযহাবকে জাহেলী আসাবিয়াত ও দলাদলির কারণ বানায় তাহলে তার/তাদের এই কাজও নিঃসন্দেহে ঐক্যের পরিপন্থী এবং বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার শামিল।
দেখুন, ‘মুহাজিরীন’ ও ‘আনসার’ কত সুন্দর দুটি নাম এবং কত মর্যাদাবান দুটি জামাত। উভয় জামাতের প্রশংসা কুরআন মজীদে রয়েছে। কিন্তু এক ঘটনায় যখন এ দুই নামের ভুল ব্যবহার হয়েছে তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গে সঙ্গে তাম্বীহ করেছেন।
জাবির রা. থেকে বর্ণিত, এক সফরে এক মুহাজির তরুণ ও এক আনসারী তরুণের মাঝে কোনো বিষয়ে ঝগড়া হয়। মুহাজির আনসারীকে একটি আঘাত করল। তখন আনসারী ডাক দিল, يا للأنصار! হে আনসারীরা!; মুহাজির তরুণও ডাক দিল-يا للمهاجرين! হে মুহাজিররা!; আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আওয়াজ শোনামাত্র বললেন-ما بال دعوى الجاهلية এ কেমন জাহেলী ডাক! কী হয়েছে?
ঘটনা বলা হল।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এমন জাহেলী ডাক ত্যাগ কর। এ তো দুর্গন্ধযুক্ত ডাক!
অন্য বর্ণনায় আছে, এতে তো বিশেষ কিছু ছিল না। (কেউ যদি কারো উপর জুলুম করে তাহলে) সকলের কর্তব্য, তার ভাইয়ের সাহায্য করা। সে জুলুম করুক বা তার উপর জুলুম করা হোক। জালিম হলে তাকে বাধা দিবে। এটাই তার সাহায্য। আর মাজলুম হলে তার সাহায্য করবে (জুলুম থেকে রক্ষা করবে)।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৪৯০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৮৪/৬২, ৬৩
হাদীসের অর্থ হচ্ছে, কারো উপর জুলুম হতে থাকলে সাহায্যের জন্য ডাকতে বাধা নেই। কিন্তু ডাকবে সব মুসলমানকে। যেমন উপরোক্ত ঘটনায় আনসারী মুহাজিরদেরকেও ডাকতে পারতেন এবং মুহাজির আনসারীদেরকে ডাকতে পারতেন। কিংবা ভাইসব! মুসলমান ভাইরা! বলেও ডাকা যেত। কিন্তু এমন কোনো ডাক মুসলমানের জন্য শোভন নয়, যা থেকে আসাবিয়ত ও দলাদলির দুর্গন্ধ আসে। কারণ তা ছিল জাহেলী যুগের প্রবণতা। ঐ সময় সাহায্য ও সমর্থনের ভিত্তি ছিল বংশীয় বা গোত্রীয় পরিচয়। ইসলামে সাহায্যের ভিত্তি হচ্ছে ন্যায় ও ইনসাফ। ইরশাদ হয়েছে-
وتعاونوا على البر والتقوى، ولا تعاونوا على الإثم والعدوان
এ কারণে ইসলামের নিয়ম, জালিমকে আটকাও সে যেই হোক না কেন। হাদীসে আছে-
ليس منا من دعا إلى عصبية، وليس منا من قاتل عصبية، وليس منا من مات على عصبية
‘ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়তের দিকে ডাকে, সেও আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আসাবিয়তের কারণে লড়াই করে এবং সে-ও নয়, যে আসাবিয়তের উপর মৃত্যুবরণ করে।’-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১২১
অন্য হাদীসে আছে-
يا رسول الله! ما العصبية؟ قال : أن تعين قومك على ظلم.
‘আল্লাহর রাসূল! আসাবিয়ত কী? বললেন, নিজের কওমকে তার অন্যায়-অবিচারের বিষয়ে সাহায্য করা।’-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫১১৯
তো ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এই যে, ‘মুহাজির’ ও ‘আনসার’ দুটি আলাদা নাম, আলাদা জামাত, আলাদা পরিচয়-এতে আপত্তির কিছু নেই। আপত্তি তখনই হয়েছে যখন নাম দুটি এমনভাবে ব্যবহার করা হল, যা থেকে আসাবিয়তের দুর্গন্ধ আসে। এ শিক্ষা ফিকহি মাযহাবের ভিত্তিতে আলাদা জামাত ও আলাদা পরিচয় কিংবা অন্য কোনো বৈধ বা প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে শ্রেণী ও পরিচয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ নীতি সব ক্ষেত্রেই মনে রাখা উচিত।
কথা দীর্ঘ হয়ে গেল। আমি আরজ করছিলাম, ফুরূয়ী ইখতিলাফকে দ্বীনের বিষয়ে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দাখিল করা এবং ফিকহী মাযহাবের অনুসরণকে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা সাব্যস্ত করা জায়েয নয়।
যে বিষয়গুলো ঐক্যের পরিপন্থী নয়
উপরোক্ত আলোচনায় ঐ বিষয়গুলো সামনে এসেছে, যা উম্মাহর ঐক্যের পরিপন্থী। সংক্ষেপে ঐ বিষয়গুলোও উল্লেখ করে দেওয়া প্রয়োজন, যেগুলোকে কোনো লোক ঐক্যের পরিপন্থী মনে করতে পারে অথচ তা উম্মাহর ঐক্য রক্ষার জন্যই জরুরি। যেমন :
১. আহলে কুফর ও আহলে শিরক থেকে আলাদা থাকা। তাদের বাতিল বিষয়াদিতে সঙ্গ না দেওয়া। তাদের জাতীয় নিদর্শন ও সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা। তাদের সাথে অন্তরঙ্গতা না রাখা। রাজনৈতিক প্রয়োজনে (মুসলিম উম্মাহর রাজনীতি হবে সর্বদা দ্বীনের অধীন) তাদের সাথে সন্ধির প্রয়োজন হলে তা শরীয়তের বিধান মোতাবেক হতে পারে।
২. ‘আহলুল বিদআ ওয়াল ফুরকা’র সাথে তাদের বিদআত ও বিচ্ছিন্নতার বিষয়ে একমত না হওয়া। তালীম-তরবিয়ত, সুলুক ও তাযকিয়ার প্রয়োজনে তাদের সাহচর্য গ্রহণ না করা। কারণ সাহচর্যের দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয়। ‘আহলুল আহওয়া’র সাহচর্য গ্রহণ করার বিষয়ে সাহাবা-তাবেয়ীন নিষেধ করেছেন।
৩. প্রকাশ্যে ফিসক-ফুজুরে লিপ্ত ব্যক্তিদের সংশ্রব থেকে দূরে থাকা।
৪. অন্যায় ও ভুল কাজে কারো সাহায্য না করা। আসাবিয়ত ও দলাদলির ক্ষেত্রে কাউকে সঙ্গ না দেওয়া।
৫. ‘যাল্লাত’( যেসব ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে ভুল হয়েছে এমন) ক্ষেত্রে আকাবির ও মাশাইখের তাকলীদ না করা।
৬. জালিমকে জুলুম থেকে বিরত রাখা।
৭. ওয়াজ-নসীহত
৮. শরীয়তের নীতি ও বিধান অনুযায়ী আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকার করা।
৯. ইলমী আদব রক্ষা করে মতবিনিময়ের উদ্দেশ্যে মতভেদপূর্ণ ইজতিহাদী বিষয়াদিতে দলিলের ভিত্তিতে আলোচনা-পর্যালোচনা করা।
১০. কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনে শরীক না হওয়া, কিংবা বলুন, পশ্চিমাদের পদ্ধতিতে রাজনীতিকারী কোনো সংগঠনে শামিল না হওয়া।
শাখাগত মতভেদের ক্ষেত্রে সুন্নাহ অনুসরনের সুন্নাহসম্মত পন্থা
ইতিপূর্বের আলোচনায় সম্ভবত স্পষ্ট হয়েছে যে, শরীয়তের শাখাগত বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণের মতভিন্নতাকে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা মনে করা ভুল। কুরআন-সুন্নাহয় যে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাইয়িনাত তথা কিতাব-সুন্নাহর অকাট্য ও সুস্পষ্ট দলিল থাকার পরও মতভেদ করার যে নিন্দা করা হয়েছে মুজতাহিদ ইমামগণের মতপার্থক্যকে তার অন্তর্ভুক্ত করা প্রকৃতপক্ষে জেনে কিংবা না জেনে উপরোক্ত নুসূসেরই অপব্যাখ্যা। কেননা এসব নুসূসের উদ্দেশ্য নিষিদ্ধ মতভেদ, যা স্পষ্টত বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা। যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
তবে কোনো ব্যক্তি বা দল যদি শাখাগত মতভিন্নতার ক্ষেত্রে শরীয়তের নীতি ও বিধান অনুসরণ না করে উম্মাহর মাঝে কলহ-বিবাদ ছড়ায় তাহলে সে উম্মতের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবে। তাই আমাদেরকে এসব নীতি ও বিধান জানতে হবে এবং শাখাগত মতভিন্নতার ক্ষেত্রে সুন্নাহ অনুসরণের এবং সুন্নাহর প্রতি দাওয়াতের মাসনুন ও মুতাওয়ারাছ তথা সুন্নাহসম্মত ও অনুসৃত পন্থা জানতে হবে। যেন ঐসব নীতি ও বিধানের বিরোধিতার কারণে বিচ্ছিন্নতার শিকার না হয়ে যাই।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, কোনো কোনো বন্ধু বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার আয়াত ও হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামদের ফিকহী মাযহাবের উপর বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তির আপত্তি তুলছেন তারা একটুও চিন্তা করছেন না যে, নির্ভরযোগ্য ফিকহি মাযহাবের মতভিন্নতা সম্পূর্ণ বৈধ ও শরীয়তসম্মত। এটি নিষিদ্ধ বিভেদ-বিচ্ছিন্নতার আওতাভুক্ত নয়। অন্যদিকে তারা হাদীস ও সুন্নহার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকারী ফিকহের মাযহাবগুলোকে হাদীসের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে তার সম্পর্কে লোকদেরকে বিরূপ করে এবং বৈধ মতভিন্নতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তারা নিজেরাই বিভেদ-বিচ্ছিন্নতায় লিপ্ত। এজন্য প্রথমে শাখাগত বিষয়ে ফিকহের ইমামগণের মতভিন্নতার প্রকার ও বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা উচিত।
ফিকহি মাসায়েলের প্রকারসমূহ
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর যে কোনো ফিকহী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে, সকল মাসায়েল মৌলিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত : ১. ঐ সকল মাসাইল, যার বিধান সকল মাযহাবে এক ও অভিন্ন। যেমন-পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয, সর্বমোট সতের রাকাত নামায ফরয, প্রতি রাকাতে একটি রুকু ও দুইটি সিজদা, তাকবীরে তাহরীমার মাধ্যমে নামায শুরু হয় এবং সালামের মাধ্যমে শেষ হয় ইত্যাদি। ইবাদত থেকে মীরাছ পর্যন্ত শত শত নয়; হাজার হাজার মাসআলা আছে, যা ‘মুজমা আলাইহি’। অর্থাৎ এসব মাসআলায় গোটা উম্মাহর; বা বলুন, মুজতাহিদ ইমামগণের ইজমা রয়েছে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবে ভিন্ন বিধান পাওয়া যাবে না।
এসব বিষয়ে ইজমা এ কারণেই হয়েছে যে, এই বিধানগুলো হয়তো কোনো আয়াত বা মুতাওয়াতির সুন্নাহয় সরাসরি বিদ্যমান আছে। কিংবা এমন কোনো সহীহ হাদীসে আছে, যা উসূলে হাদীসের মানদন্ডে দলিলযোগ্য হওয়ার বিষয়ে হাদীস বিচারক মুহাদ্দিসদের মাঝে কোনো মতভিন্নতা নেই। অথবা সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগে কিংবা পরবর্তী ফকীহগণের মাঝে ঐ বিষয়ে ইজমা সংগঠিত হয়েছিল।
২. ঐ সকল মাসাইল, যাতে ইমামগণের মাঝে মতভিন্নতা রয়েছে।
এই মতভিন্নতা সম্পর্কে কিছু মানুষের মাঝে এই কু-ধারণা লক্ষ্য করা যায় যে, এ মতভিন্নতার সূচনা হয়েছে খায়রুল কুরুনের পর। আর তা হয়েছে হাদীস বিষয়ে ইমামগণের অজ্ঞতা কিংবা হাদীস অনুসরণে অনীহার কারণে। অথচ ইসলামী ফিকহের ইতিহাস যারা পড়েছেন এবং মুজতাহিদ ইমামগণের মর্যাদা, ইলম-আমল ও খোদাভীরুতা সম্পর্কে যারা অবগত অথবা অন্তত ফিকহের দীর্ঘ ও দলিল-প্রমাণের আলোচনা সম্বলিত কিতাবাদি অধ্যয়নের সুযোগ যাদের হয়েছে তারা জানেন, এই কুধারণা কত জঘণ্য ও অবাস্তব।
বাস্তবতা এই যে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ফিকহের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহে যেসব মাসআলায় মতভিন্নতা পাওয়া যায় তার অধিকাংশেই সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের যুগ থেকেই মতভিন্নতা চলে আসছে কিংবা বিষয়টিই এমন যাতে কোনো আয়াত বা সহীহ হাদীস নেই, এমনকি এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা অথবা কোনো আছারও পাওয়া যায় না। মুজতাহিদ ইমামগণ শরঈ কিয়াসের ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে এসব সমাধান বের করেছেন।
হ্যাঁ, ফিকহের কিতাবসমূহে হাতে গোনা কিছু মাসআলা পাওয়া যাবে, যেগুলোকে ‘যাল্লাহ’ (বিচ্যুতি), শায, কিংবা আলইখতিলাফু গায়রুস সায়েগ (অগ্রহণযোগ্য মতভেদ) বলা হয়। এসব মাসআলায় কোনো মুজতাহিদ থেকে নিশ্চিত ভ্রান্তি হয়ে গেছে। এজন্য উসূলে ফিকহ ও উসূলে ইফতার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, এসব মাসআলা ‘মামুল বিহী ফিকহ’ (আমলযোগ্য ফিকহ) ও ‘মুফতা বিহী কওল’ (ফতওয়া প্রদানযোগ্য সিদ্ধান্ত) নয়। কোনো মাযহাবের দায়িত্বশীল কোনো মুফতী এসব মাসআলা অনুযায়ী ফতওয়া প্রদান করেন না। এ ধরনের হাতে গোনা কিছু মাসআলা ছাড়া ফিকহের সকল মতভেদপূর্ণ মাসআলা তিন প্রকারে বিভক্ত।
প্রথমে তিন প্রকারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পেশ করব। এরপর প্রত্যেকটির উপর বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
১. সুন্নাহর বিভিন্নতার ক্ষেত্রে মতভেদ
অর্থাৎ কোনো ইবাদতের পদ্ধতি (যেমন-নামায, হজ্ব ইত্যাদি) সম্পর্কিত এমন কিছু পার্থক্য, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগেও ছিল এবং খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামের যুগেও ছিল। কারণ এসব ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই একাধিক সুন্নাহ বা পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। আর সাহাবায়ে কেরামের মাঝেও উভয় পদ্ধতি অনুসারেই কমবেশি আমল হয়েছে। এভাবে পরবর্তী যুগেও উভয় পদ্ধতি অনুযায়ী আমল হয়েছে। এ ধরনের মতভিন্নতার অপর নাম ‘ইখতিলাফুত তানাওউ’ অর্থাৎ সুন্নাহর বিভিন্নতার কারণে মতভিন্নতা। আরেক নাম ‘আলইখতিলাফুল মুবাহ’ অর্থাৎ এমন মতপার্থক্য, যার উভয় পদ্ধতি সকল মুজতাহিদের নিকট বৈধ।
২. দলিলের মর্মোদ্ধার, গ্রহণযোগ্যতা বিচার ও দলিলসমূহের পরস্পর বিরোধের ক্ষেত্রে মতভেদ
অর্থাৎ কোনো বিষয়ের বিধান কোনো আয়াত বা হাদীস থেকে গ্রহণ করা যায়, তবে ঐ আয়াত বা হাদীসটি ঐ সিদ্ধান্তের জন্য ‘নসসে মুহকাম’ নয়। অর্থাৎ আরবী ভাষার নিয়ম-কানুন ও মর্মোদ্ধারের নীতিমালা, এক শব্দে বললে, উসূলে ফিকহের নীতিমালা অনুযায়ী এ আয়াত বা হাদীসে একাধিক অর্থের বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে মুজতাহিদ ইমাম কিংবা ফকীগণের মাঝে মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে।
আবার এমনও হয় যে, মাসআলার বিধান সম্পর্কে কোনো হাদীস আছে, কিন্তু ইলমুল ইসনাদ বা উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী তা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত কি না; পারিভাষিক শব্দে বললে, ঐ হাদীসটি সহীহ বা দলিলযোগ্য কি না-এ বিষয়ে হাদীস বিচারক মুহাদ্দিসগণের মাঝে মতভিন্নতা আছে।
প্রসঙ্গত মনে রাখা উচিত, মুজতাহিদ ইমামগণও হাফিযুল হাদীস হয়ে থকেন এবং হাদীস বিচারেও পারদর্শী হয়ে থাকেন।
হাদীসটি যেহেতু এমন যে, ইলমুল হাদীসের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সহীহ, অন্য সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যয়ীফ বা মালুল কিংবা শায ও মুনকার তাই যে ইমাম হাদীসটি সহীহ মনে করেছেন তিনি এই মাসআলায় এক ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আর যিনি একে দলিল হওয়ার যোগ্য মনে করেননি তিনি অন্য কোনো দলিল দ্বারা, যেমন-কোনো সাহাবী বা তাবেয়ীর আছর দ্বারা কিংবা শরঈ কিয়াস দ্বারা ইজতিহাদ করে সমাধান দিয়েছেন এবং তার সিদ্ধান্ত ভিন্ন হয়েছে।
তো সারকথা এই যে, এই প্রকারের মাসআলায় কুরআন-হাদীসের দলিল বিদ্যমান থাকার পরও মতভেদ হয়েছে। কারণ সংশ্লিষ্ট আয়াতটি নসসে মুহকাম নয়। আর হাদীসটি হয়তো সর্বসম্মত সহীহ নয় অর্থাৎ তার সহীহ হওয়ার বিষয়টি স্বয়ং হাদীস বিচারকদের মাঝেই মতভেদপূর্ণ। অথবা তা নসসে মুহকাম নয়। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট মাসআলায় তা দ্ব্যর্থহীন নয়, একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে।
দলিলের বিশুদ্ধতা বা অর্থের ক্ষেত্রে যেখানে মতভেদের অবকাশ রয়েছে সেখানে মুজতাহিদ ইমাম ও ফকীহগণকে সংশ্লিষ্ট সমস্যার সমাধান ইজতিহাদের মাধ্যমেই করতে হয়।
এরচেয়েও জটিল বিষয় হল বিভিন্ন দলিলের বিরোধ। অর্থাৎ যেসব মাসআলায় মুজতাহিদ ফকীহ তার সামনে বিদ্যমান দলিলসমূহের মাঝে বিরোধ অনুভব করেন সেখানে মাসআলার বিধান নির্ণয়ের জন্য তাঁকে ঐ বিরোধ নিরসন করতে হয়। আর এর জন্য যে কাজগুলো করতে হয় তার পারিভাষিক নাম এই :
১. الجمع বা التطبيق (সমন্বয়)।
২. الترجيح বা معرفة الراجح والمرجوح (অগ্রগণ্য নির্ণয়)।
৩. النسخ বা معرفة الناسخ والمنسوخ (নাসিখ-মানসূখ নির্ণয়)।
দলিলসমূহের বিশ্লেষণ ও তা থেকে বিধান গ্রহণের সময় এই তিনটি কাজ একজন মুজতাহিদ ফকীহকে করতে হয়। আর কাজ তিনটি করা হয় ইজতিহাদের ভিত্তিতে। যার দরুণ মুজতাহিদ ফকীগণের মাঝে এই কাজগুলো সম্পন্ন করে মাসআলার বিধান নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতভিন্নতা হয়ে থাকে।
এটি অতি দীর্ঘ ও গভীর একটি বিষয়। সংক্ষিপ্ত আলোচনার জন্যও দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রয়োজন। এখানে শুধু ইঙ্গিত করা হল।
৩. রায় ও কিয়াসের বিভিন্নতাজনিত মতভেদ
অর্থাৎ ঐ সকল নতুন সমস্যা, যা নবী-যুগ ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগের পরে সৃষ্টি হয়েছে, যার সমাধান না কোনো আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে, না কোনো হাদীসে, আর না এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ফকীগণের ইজমা আছে। এক্ষেত্রে যা আছে তা হল, কোনো সাহাবীর আছর বা কোনো তাবেয়ীর কোনো ফতওয়া এবং তাতেও দুই মত অথবা এর সমাধান কোনো সাহাবী বা বড় তাবেয়ীর আছরেও পাওয়া যায় না। এ ধরনের বিষয়ে মুজতাহিদ ইমামগণকে ‘রায়’ ও শরঈ কিয়াসের দ্বারা ইজতিহাদ করতে হয়েছে। আর ইজতিহাদের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
উপরোক্ত উভয় প্রকারের মাসআলাকে (অর্থাৎ যেসব মাসআলায় দলিলের গ্রহণযোগ্যতা বিচার কিংবা মর্মোদ্ধার কিংবা বাহ্যত অনুমেয় বিরোধ নিষ্পত্তিজনিত মতপার্থক্য হয়েছে এবং যেসব মাসআলায় রায় ও কিয়াসের বিভিন্নতাজনিত মতপার্থক্য হয়েছে) ইলমুল ফিকহের পরিভাষায় ‘মাসাইলুল ইজতিহাদ’ বা ‘ইজতিহাদী মাসাইল’ বলে। যদিও একাধিক সুন্নাহ সম্বলিত বিষয়েও ইজতিহাদের কিছু প্রয়োজন হয় তবে পরিভাষায় সাধারণত শেষোক্ত দুই প্রকারকেই ‘মাসাইলুল ইজতিহাদ’ বলা হয়। এ প্রকারের মাসআলায় ইমামগণের মাঝে মতভিন্নতা কেন হয়েছে তা উপরোক্ত আলোচনা থেকেই অনুমান করা যায়। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা بيان أسباب اختلاف الفقهاء ‘ফকীহগণের মতভিন্নতার কারণ’ শীর্ষক কিতাবসূমহে পাওয়া যাবে।
সুন্নাহর বিভিন্নতা সম্বলিত বিষয়ে মতপার্থক্যের ধরন
এ বিষয়ে শুধু শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. (৭২৮ হি.)-এর কিছু কথা উল্লেখ করছি।
১. শায়খ ইবনে তাইমিয়া রাহ.বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের নীতিই সর্বাধিক সঠিক যে, ইবাদতের বিষয়ে একাধিক পদ্ধতি যদি গ্রহণযোগ্য বর্ণনায় পাওয়া যায় তবে কোনো পদ্ধতিকেই মাকরূহ বলা যাবে না; বরং সবগুলো শরীয়তসম্মত হবে। যেমন-সালাতুল খাওফের বিভিন্ন পদ্ধতি; তারজীসহ আযান ও তারজীবিহীন আযান; ইকামতের শব্দাবলি একবার করে উচ্চারণ করা বা দুবার করে উচ্চারণ করা; তাশাহহুদের বিভিন্ন প্রকার; নামাযের শুরুতে পড়ার বিভিন্ন দুআ; কুরআন মজীদের বিভিন্ন কিরাত; ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তাকবীরের বিভিন্ন নিয়ম; জানাযার নামায ও সিজদায়ে সাহুর বিভিন্ন তরীকা; রাববানা লাকাল হামদ বা রাববানা ওয়া লাকাল হামদ বলা ইত্যাদি সব বিষয়ে আমরা এটাই বলে থাকি। তবে কখনো কোনো একটি নিয়ম মুস্তাহাব হিসেবে বিবেচিত হয় এবং দলিলের কারণে অপরটির উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রেও অপরটিকে মাকরূহ বলা যায় না।-মাজমূউল ফাতাওয়া ২৪/২৪২-২৪৩; আরো দেখুন : আলফাতাওয়াল কুবরা ১/১৪০
এ প্রকার ইখতিলাফ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রাহ. অন্য কিতাবে লেখেন, ইখতিলাফে তানাওউ কয়েক প্রকার : তন্মধ্যে একটি হচ্ছে এমন মতভেদ, যেখানে প্রত্যেক বক্তব্যই সঠিক এবং প্রত্যেক আমলই শরীয়তসম্মত। যেমন ঐ সমস্ত কিরাত (যেগুলো ‘সাবআতু আহরুফে’র অন্তর্ভুক্ত। তথাপি মূল বিষয়টি জানার পূর্বে) সাহাবায়ে কেরামের মাঝে (কোনো কোনোটি) নিয়ে বিবাদ হয়েছিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে এ নিয়ে ঝগড়া করতে নিষেধ করলেন এবং বললেন, তোমাদের উভয়ের পড়া সঠিক।
‘এমনভিাবে আযান-ইকামতের পদ্ধতি; নামাযের শুরুতে পড়ার দুআ, তাশাহহুদ, সালাতুল খাওফ, জানাযা ও ঈদের নামাযের তাকবীর সংক্রান্ত ইখতিলাফ, যেখানে সব পদ্ধতিই শরীয়তসম্মত। যদিও কিছু পদ্ধতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
‘অনেক লোককে দেখা যায়, ইকামতের শব্দ একবার বলা-দুইবার বলা বা এ ধরনের বিষয় নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। এটা একেবারেই হারাম। আর কেউ কেউ এ পর্যায়ে না পৌঁছলেও দেখা যায়, তারা কোনো একটি পদ্ধতির প্রতি অন্যায় পক্ষপাত পোষণ করে এবং অপরটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিংবা মানুষকে তা গ্রহণ করতে নিষেধ করে। ফলে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিষেধের আওতায় এসে যায়। (অর্থাৎ তারা ঐ বিবাদে লিপ্ত হল, যা থেকে রাসূল নিষেধ করেছেন। কারণ তিনি বৈধ মতভিন্নতাকে বিবাদের ভিত্তি বানাতে নিষেধ করেছেন।)-ইকতিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম ১/১৩২-১৩৩
তিনি আরো বলেন-
وهذا القسم الذي سميناه اختلاف التنوع كل واحد من المختلفين مصيب فيه
بلا تردد، لكن الذم واقع على من بغى على الآخر فيه، وقد دل القرآن على حمد كل واحدة من الطائفتين في مثل ذلك إذا لم يحصل بغي.
আর এ প্রকার মতভেদ, যাকে আমরা বলছি-اختلاف التنوع বা আমলের পদ্ধতির বিভিন্নতার ইখতিলাফ কোনোরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়া প্রত্যেকেই সঠিক। কিন্তু এ ধরনের ইখতিলাফের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি অন্যের উপর বাড়াবাড়ি করে সে নিন্দিত। কারণ কুরআন মজীদ থেকে বুঝে আসে যে, এ ধরনের ইখতিলাফের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই প্রশংসনীয়। যদি এক পক্ষ অপর পক্ষের উপর বাড়াবাড়ি না করে।’-ইকতিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম ১/১৩৫; আরো দেখুন : মাজমূউল ফাতাওয়া ২৪/২৪৫-২৪৭
মাসাইলুল ইজতিহাদে মতভিন্নতার ধরন ও তার শরঈ বিধান
ইজতিহাদী মাসআলায় মতভিন্নতার ধরন সম্পর্কে প্রথমে বর্তমান যুগের প্রায় সব মাযহাবের বড় বড় মনীষী, যাদেরকে সমগ্র ইসলামী বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে ‘রাবেতাতুল আলামিল ইসলামী’র আলমাজমাউল ফিকহী (ফিকহী বোর্ড)- এ এই বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ করা হয়েছিল তাদের মতামত উল্লেখ করছি।
ঐ মজলিসের সিদ্ধান্তের সারকথা হল, আকীদা ও বিশ্বাসগত বিষয়ে মতভেদ হচ্ছে يجب أن لا يكون অর্থাৎ তা না হওয়া অপরিহার্য। আর আহকাম ও বিধানের বিষয়ে যে মতভেদ তা لا يمكن أن لا يكون অর্থাৎ তা না হওয়া অসম্ভব।
(মূল প্রবন্ধে দীর্ঘ সিদ্ধান্তটির আরবী পাঠ ও তরজমা উল্লেখিত হয়েছে।)
এই সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে শায়খ ইবনে বায রাহ. (১৪২০ হি.) ও শায়খ আবদুল্লাহ উমর নাসীফ-এর স্বাক্ষরও আছে। ইজতিহাদী বিষয়ে মতভিন্নতার এই পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য যদি প্রত্যেকের স্মরণ থাকে তাহলে এর ভিত্তিতে পরস্পর কলহ-বিবাদে লিপ্ত হওয়ার সুযোগই হবে না।
পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে ইজতিহাদী মাসায়েলের পরিচয় সম্পর্কে এবং তাতে মতপার্থক্য হওয়ার কারণ সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণার নিরসন প্রয়োজন। পূর্বের আলোচনা থেকে এ বিষয়টি বোঝা গেলেও আরো স্পষ্ট করার জন্য আলাদা শিরোনামে কিছু কথা আরজ করছি।
ইমামগণের মতভিন্নতার বড় কারণ কি হাদীস না জানা কিংবা না মানা?
অনেকে মনে করেন, অধিকাংশ বিষয়ে মতভিন্নতার মৌলিক কারণ হল, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতিপক্ষের হাদীস সম্পর্কে অবহিত না থাকা বা সহীহ হাদীস পরিত্যাগ করে যুক্তি বা কিয়াসের আশ্রয় গ্রহণ করা। অথচ আইম্মায়ে দ্বীন ও উলামায়ে হকের যে মতভিন্নতা সে সম্পর্কে এ ধারণা মোটেও সঠিক নয়। কেননা তাদের কেউ কিয়াস বা যুক্তিকে হাদীসের উপর প্রাধান্য দেন না। তাদের কোনো কোনো ফতওয়া যদিও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের হাদীসের ব্যাপারে অবগতি না থাকার কারণে প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু এর সংখ্যা নিতান্তই কম।
আহলে হক উলামায়ে কেরামের মধ্যে বিদ্যমান মতভিন্নতার অধিকাংশের মূলেই ইখতিলাফে মাহমুদ বা ইখতিলাফে মাশরূ-এর শরীয়ত স্বীকৃত বাস্তবিক কারণ বিদ্যমান রয়েছে। এজন্য হাদীসের ইমামগণের মধ্যেও বহু বিষয়ে ইখতিলাফ হয়েছে। ইমাম আহমদ, ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী, ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিযী, ইবনে খুযাইমা, ইবনে হিববান, দাউদ জাহেরী, ইবনে হাযম জাহেরী তাদের ব্যাপারে হাদীসের বিরোধিতা বা হাদীসের ব্যাপারে অনবগতির অভিযোগ কি কেউ করতে পারে?
শুধু তাই নয়, পরবর্তী যুগের এবং বর্তমানের ঐসব আলেমের মধ্যেও ইখতিলাফ হয়েছে, যারা আহলে হাদীস বা সালাফী নামে পরিচিত। এদের ব্যাপারে সকল আহলে হাদীস বা সালাফী বন্ধু একমত যে, এরা সবাই হাদীসবিশারদ এবং হাদীসের অনুসারী ছিলেন। তাঁদের মতপার্থক্যের কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি।
প্রথম উদাহরণ
মিসরের প্রসিদ্ধ শায়খ সাইয়েদ সাবেক রাহ. (১৩৩৩-১৪২৫ হি.) ‘ফিকহুস সুন্নাহ’ নামে একটি বেশ বড়, সহজ ও ভালো কিতাব রচনা করেছেন-আল্লাহ তাআলা তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন-যা মাশাআল্লাহ নতুন প্রজন্মের মাঝে খুবই প্রসিদ্ধ ও সমাদৃত। অনেক তরুণ-যুবক এটিকে মুতাওয়ারাছ ফিকহী কিতাবের উত্তম বিকল্প মনে করে বরণ করে নিয়েছে! তাফাক্কুহ ফিদ দ্বীনের স্বল্পতার কারণে অনেকে এমনও মনে করে যে, ফিকহের কিতাবগুলোতে আছে ইমামদের ফিকহ আর এই কিতাবে আছে হাদীস ও সুন্নাহর ফিকহ! অথচ মূল বিষয় এই যে, হাদীস ও সুন্নাহর ফিকহ সেটাও এবং এটাও। পার্থক্য শুধু এই যে, এখানে ফকীহ ও লেখক হলেন শায়খ সাইয়েদ সাবেক আর ওখানে ফকীহ হলেন খায়রুল কুরূন বা তার নিকটতম যুগের মুজতাহিদ ইমাম আর লেখক হলেন পরবর্তী সময়ের কোনো ফকীহ বা আলেম।
যাই হোক, আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে, এ কিতাবের শুরুতে লেখক লেখেন-
أما بعد! فهذا الكتاب "فقه السنة" يتناول مسائل من الفقه الإسلامي مقرونة بأدلتها من صريح الكتاب وصحيح السنة، ومما أجمعت عليه الأمة ...
والكتاب في مجلداته مجتمعة يعطي صورة صحيحة للفقه الإسلامي الذي بعث الله به محمدا صلى الله عليه وسلم، ويفتح للناس باب الفهم عن الله وعن رسوله، ويجمعهم على الكتاب والسنة، ويقضي على الخلاف وبدعة التعصب للمذاهب، كما يقضي على الخرافة القائلة : بأن باب الاجتهاد قدسد.
উপরোক্ত কথায় যে চিন্তাগত বিচ্ছিন্নতা রয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলছি যে, তাঁর দাবি, এই কিতাবের মাসআলাগুলো সরাসরি কুরআনের আয়াত, সহীহ সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মাহর দলিলনির্ভর।
এ কিতাবটি যখন বর্তমান যুগের একজন প্রসিদ্ধ আলেম শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. (১৩৩২-১৪২০ হি.)-এর সামনে এল, যিনি চিন্তা-চেতনায় সাইয়েদ সাবেকের থেকে আলাদা নন, একই ঘরানার। শায়খ আলবানীর কিতাবাদি; বিশেষত ‘ছিফাতুস সালাহ’র ভূমিকা পাঠ করলেই তা বোঝা যাবে। তিনি যখন এই কিতাবটি অধ্যয়ন করলেন তখন এর উপর টীকা লেখার প্রয়োজন অনুভব করলেন এবং ‘তামামুল মিন্নাহ ফিততালীকি আলা ফিকহিস সুন্নাহ’ নামে তা লিখলেন। পৃষ্ঠাসংখ্যা চার শরও অধিক। এর পঞ্চম সংস্করণ (১৪২৬ হি.) আমার সংগ্রহে আছে।
এতে তিনি ফিকহুস সুন্নাহর মাত্র সিয়াম অধ্যায়-পর্যন্ত টীকা লিখেছেন, যা মূল কিতাবের চার ভাগের এক ভাগ। ১ রজব ১৪০৮ হিজরীর তথ্য অনুযায়ী তিনি শুধু এটুকুরই টীকা লিখতে পেরেছেন। অবশিষ্ট অংশের টীকা লেখার জন্য দুআ করেছেন।
শায়খ আলবানী রাহ. ‘তামামুল মিন্নাহ’র ভূমিকায় ‘ফিকহুস সুন্নাহ’র ভুল-ত্রুটির প্রকার সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত সূচি উল্লেখ করেছেন, যাতে চৌদ্দটি প্রকার রয়েছে। নিমেণ তার কিছু উল্লেখ করা হল :
১. সাইয়েদ সাবেক অসংখ্য যয়ীফ হাদীস সম্পর্কে নীরব থেকেছেন।
২. অন্যদিকে অনেক ‘ওয়াহী’ (মারাত্মক যয়ীফ) হাদীসকে শক্তিশালী বলেছেন।
৩. কিছু হাদীসকে যয়ীফ বলেছেন, অথচ তা সহীহ।
৪. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের উদ্ধৃতিতে হাদীস উল্লেখ করেছেন অথচ তাতে সে হাদীস নেই।
৫. এমন কিছু হাদীস উল্লেখ করেছেন, যা হাদীসের কোনো কিতাবেই নেই।
৬. যাচাই বাছাই ছাড়া কোনো কিতাবের উদ্ধৃতিতে কোনো হাদীস উল্লেখ করেছেন অথচ খোদ ঐ কিতাবের লেখকই তাতে হাদীসটি সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছেন, যা তার সহীহ হওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
৭. কখনো কখনো দলিল ছাড়া মাসআলা উল্লেখ করেছেন, কখনো কিয়াসের ভিত্তিতে মাসআলা প্রমাণ করেছেন। অথচ সে বিষয়ে সহীহ হাদীস বিদ্যমান। আবার কখনো সাধারণ দলিল উল্লেখ করেছেন, অথচ সেই মাসআলার সুনির্দিষ্ট দলিল রয়েছে।
৮. কখনো কখনো এমন মত বা সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়েছেন, যার প্রমাণ দুর্বল। অথচ বিপরীত মতটির দলিল শক্তিশালী।
৯. সবচেয়ে আপত্তিকর কাজ এই যে, যে কিতাব সুন্নাহ মোতাবেক আমলের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার জন্য লেখা হয়েছে তাতে এমন অনেক মাসআলা আছে, যা সহীহ হাদীসের বিপরীত। অথচ ঐ সহীহ হাদীসগুলোর বিরোধী কোনো হাদীসও নেই।
শায়খ আলবানী রাহ.-এর সব আপত্তি সঠিক নাও হতে পারে। তবে তার গবেষণা ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী তো ‘ফিকহুস সুন্নাহ’য় এ ধরনের অনেক ভুল রয়েছে।
তামামুল মিন্নাহ প্রকাশিত হওয়ার পরও শায়খ সাইয়েদ সাবেক রাহ. দীর্ঘ সময় জীবিত ছিলেন। কিন্তু দু’/চারটি স্থান ব্যতীত তিনি ‘ফিকহুস সুন্নাহ’য় কোনো পরিবর্তন করেননি। এর দ্বারা বোঝা যায়, তার দৃষ্টিতে শায়খ আলবানী রাহ.-এর এই আপত্তিগুলো সঠিক নয়। কিংবা তা গ্রহণ করা অপরিহার্য নয়।
এই দুই ব্যক্তিত্বের কেউই হানাফী নন। অন্য কোনো মাযহাবেরও অনুসারী নন। তারা ছিলেন (অনুসৃত ফিকহের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি) সুন্নাহর অনুসরণ ও হাদীস অনুযায়ী আমলের প্রতি আহবানকারী নিষ্ঠাবান দুই ব্যক্তি। দুজনই ছিলেন হাদীসের আলেম এবং নির্ঘণ্ট ও কম্পিউটার যুগের আলেম। তারা উভয়েই উম্মতের সামনে (তাদের ভাষায়) ‘ফিকহুল মাযাহিব’-এর স্থলে ‘ফিকহুস সুন্নাহ’ পেশ করতে চেয়েছেন।
প্রশ্ন এই যে, ফিকহি মতভিন্নতার প্রধান কারণ যদি শুধু এই হয় যে, যাদের মাঝে মতভিন্নতা হয়েছে তাদের একজন হয়তো হাদীস জানতেন না কিংবা হাদীস মানতেন না, অন্তত ঐ মাসআলার হাদীসটি তিনি জানতেন না তাহলে এই দুই শায়খের মাঝে এত বড় বড় এবং এত অধিক মাসআলায় মতভেদ কেন হল?
দ্বিতীয় উদাহরণ
সম্প্রতি ১৪৩০ হি., মোতাবেক ২০০৯ ঈ. সালে ড. সাদ ইবনে আবদুল্লাহ আলবারীকের দুই খন্ডের একটি কিতাব প্রকাশিত হয়েছে, যার নাম
الإيجاز في بعض ما اختلف فيه الألباني وابن عثيمين وابن باز رحمهم الله تعالى
কিতাবটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮ শ’র অধিক।
কিতাবটির নাম থেকেই বোঝা যায়, এই কিতাবে তিনি এমন কিছু মাসআলা উল্লেখ করেছেন, যেসব মাসআলায় এ যুগের তিনজন সম্মানিত সালাফী আলেম : শায়খ আবদুল আযীয বিন আবদুল্লাহ বিন বায রাহ. (১৩৩০-১৪২০ হি.), শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সালেহ ইবনে উছাইমীন রাহ. (১৪২১ হি.) ও শায়খ (মুহাম্মাদ ইবনে নূহ) নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. (১৩৩২-১৪২০ হি.)-এর মাঝে মতভেদ হয়েছে।
কিতাবের নাম থেকে এ বিষয়টিও স্পষ্ট যে, তিনজনের মাঝে যেসব মাসআলায় মতপার্থক্য হয়েছে তার সবগুলো লেখক এখানে উল্লেখ করেননি। তাছাড়া তিনি শুধু ‘কিতাবুর রাযাআ’ দুগ্ধপান অধ্যায় পর্যন্ত মাসআলাগুলো এখানে এনেছেন। এরপরও এতে মাসআলার মোট সংখ্যা দঁড়িয়েছে ১৬৬। আকীদা সংক্রান্ত কিছু মাসআলাও এতে রয়েছে, যেগুলো আকীদার মৌলিক নয়, শাখাগত মাসআলা এবং যার কিছু নমুনা উদ্ধৃতিসহ
البشارة والإتحاف بما بين ابن تيمية والألباني في العقيدة من الاختلاف
নামক পুস্তিকায়ও রয়েছে।
জেনে রাখা দরকার যে, ‘আলইজায’ কিতাবে ‘মাসাইলুল ইজতিহাদে’র উভয় প্রকারের মাসআলাই উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ কিছু মাসআলা এমন, যার কোনো শরঈ নস নেই অথবা শরঈ নস পাওয়া গেলেও তা থেকে সংশ্লিষ্ট মাসআলার বিধান আহরণ করতে হলে ইজতিহাদ প্রয়োজন।
তৃতীয় উদাহরণ
ড. বকর ইবনে আবদুল্লাহ আবু যায়েদ রিয়ায-এর পুস্তিকা ‘লা-জাদীদা ফী আহকামিস সালাহ’। ইন্টারনেট সংস্করণ (তৃতীয় সংস্করণ) অনুযায়ী এতে তিনি নামাযের এমন আটটি মাসআলা উল্লেখ করেছেন, যে সম্পর্কে কিছু সালাফী আলেমের ফতওয়া বা আমল তার দৃষ্টিতে প্রমাণহীন ও সুন্নাহবিরোধী।
চতুর্থ উদাহরণ
ড. ইউসুফ কারযাবী-হাফিযাহুল্লাহু তাআলা ওয়া রাআহু-এর কিতাব ‘আলহালাল ওয়াল হারাম ফিলইসলাম’-এর সাথে ড. সালেহ ফাওযানের পুস্তিকা ‘আলই’লাম বিনাকদি কিতাবিল হালালি ওয়াল হারাম’ এবং শায়খ আলবানী রাহ.-এর কিতাব ‘গায়াতুল মারাম ফী তাখরজি আহাদীসিল হালালি ওয়াল হারাম’ অধ্যয়ন করা যেতে পারে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)