প্র তি বে শ : সংখ্যাগুরুর মনে উৎকণ্ঠা তৈরি না হোক
হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ভাংচুর করে সাম্প্রদায়িক শক্তি রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ করেছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেছেন। চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে মন্দির ভাংচুরের ঘটনায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থীরা’ মানববন্ধনের আয়োজন করলে সেখানে এসে তিনি এ বক্তব্য দেন। তাতে আরও বক্তব্য রাখেন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ড. অজয় কুমার দাস ও ছাত্রলীগ নেতা জয়দেব নন্দী। একই দিনে একই ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সেখানে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় ও ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকরা।
১৩ ফেব্রুয়ারি রোববারের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, মন্দির ভাংচুরের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় আগের দিন ১২ ফেব্রুয়ারি শনিবার। একটি অরাজেয় বাংলার পাদদেশে, অপরটি ডাকসু সংগ্রহশালার সামনে।
আপাত দৃষ্টিতে এ খবর পড়ে মনে হতে পারে, উদার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রকাশক দুটি ঘটনার খবর আমরা পড়ছি। মনে হতে পারে, এক তরফা কিছু উগ্রপন্থীর আক্রমণে চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্য কিছু আর ঘটেনি সেখানে। ঢাবির মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে কেবল মানবিক প্রেরণা থেকেই সাম্প্রদায়িতকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। অথচ বাস্তব ঘটনার আঙ্গিকে এ খবরটিকে বিশ্লেষণ করলে চমকে উঠতে হয়।
১১ ফেব্রুয়ারির পত্রিকাগুলোতে হাটহাজারির ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, ৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুরে যোহরের নামাযের সময় হাটহাজারি লোকনাথ সেবাশ্রমের একটি মিছিল কাজীপাড়া জামে মসজিদের সামনে আসে। এ সময় মসজিদে যোহরের নামায চলছিল। স্থানীয় কয়েকজন মুসলিম নামাযের সময় মিছিলের ঢোল-তবলার বাজনা বন্ধ করতে বললে লোকনাথ আশ্রমের কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক তাদের ওপর চড়াও হয় এবং তাদের পিটিয়ে আহত করে। এ ঘটনায় আহতদের কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকেই গ্রামবাসীরা দুভাগ হয়ে যায়। এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ওই রাতে কাজীপাড়া মসজিদ ও লোকনাথ মন্দিরে কে বা কারা হামলা চালায়। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, মসজিদের দেয়াল শাবল-গাইতি দিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়। আর মন্দিরের সামনের প্যান্ডেল ভাংচুর করা হয়। এ কারণে শুক্রবার সকাল থেকেই আবারও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে ৮/১০ টি দোকান ও ৪/৫টি বাড়ি ভাংচুর করা হয়। রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। উভয় পক্ষে অর্ধ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে শুক্রবার বিকেলের দিকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
হাটহাজারির ঘটনার সূচনাই হয় লোকনাথ আশ্রমের অনুসারী মারমুখী যুবকদের মাধ্যমে। তারাই প্রথমে নামাযের সময় ঢোল-তবলার বাদ্য বন্ধের দাবি জানানো মুসলমানদের ওপর চড়াও হয়। তাদের পিটিয়ে আহত করে। ওই দিন রাতে মসজিদ-মন্দির দু সম্প্রদায়ের দুই প্রতিষ্ঠানের ওপরই হামলা হয়। কে কে ওই হামলায় অংশ নিয়েছে-তার বিবরণ গণমাধ্যমে আসেনি। কিন্তু ঢাবি ভিসি ও শাসক দলের ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে শুধু মন্দিরের ওপর হামলার বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে কঠোর বক্তব্য দেওয়া হয়। এটিকে কি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কোনো উদ্যোগ বলা যায়? মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতির প্রতি পরিষ্কার একতরফা বিদ্বেষয় থেকেই যে এ প্রতিবাদ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়নি-এটা কিভাবে দাবি করা যাবে? এখানে আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলা দরকার মনে করি যে, মসজিদ-মন্দির উভয় উপাসনালয়ে হামলাই মারাত্মক অপরাধ। হিন্দুদের পক্ষ থেকে হোক কিংবা মুসলমানদের পক্ষ থেকেই হোক, কোনো সাম্প্রদায়িক আচরণ বরদাশত করা প্রশাসনের উচিত নয়। কিন্তু যেখানে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে যে, লোকনাথ আশ্রমের হিন্দু যুবকরা প্রথমে মুসলমানদের ওপর চড়াও হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক জিঘাংসার পরিচয় দিয়েছে সেখানে এ ঘটনার জন্য মুসলমানদের টার্গেট করে প্রতিবাদ মহড়া অনুষ্ঠানের তাৎপর্য তো রহস্যজনক! যেখানে মসজিদ-মন্দির উভয় প্রতিষ্ঠানই আক্রান্ত হয়েছে সেখানে কেবল ‘মন্দির ভাংচুর করে সাম্প্রদায়িক শক্তি রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ করেছে’ কথাটি বলার মানে কি? ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থী’ নামের আড়ালে এটা নতুন কোনো সাম্প্রদায়িকতার পদধ্বনি নয়তো!
‘সচেতন শিক্ষার্থী’র ব্যানার আর শাসকদলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ‘মন্দির ভাংচুর’ নিয়ে এই হঠাৎ ব্যস্ততা কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বর্বর বিএসএফের উপুর্যপরি হত্যাকান্ড ও অমানবিক কর্মকান্ড নিয়ে এদেরকে কখনো কোনো কথা বলতে দেখা যায়নি। বাঁধ দিয়ে তিতাস নদী হত্যা আর ভারতকে নিঃশর্ত ট্রানজিট দেওয়া নিয়েও এদের কারোরই ‘সচেতন’ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি গত বছরের ১০ জুলাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শংকর বিশ্বাস আর ২৬ জুলাই ঢাকার ধানমন্ডিতে মদন মোহন দাসের চরম অবমাননাকর উক্তির পরও তারা কোনো সাম্প্রদায়িক আচরণের গন্ধ পাননি। হাটহাজারির ঘটনায় মসজিদ-মন্দির উভয় প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হওয়ার পরও তারা কেবল ‘মন্দির ভাংচুর’ নিয়েই কথা বললেন, বিধ্বস্ত মসজিদ তাদের চোখে পড়ল না। এরপর উল্টো মুসলমানদেরকেই তারা ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে শাসানো ও ভয় দেখানোর পথে হাঁটলেন। এটা কেন হল? এটা কি ‘সাম্প্রদায়িকতা বন্ধে’র নামে মুসলিম বিরোধী নতুন কোনো সাম্প্রদায়িকতার দুয়ার খোলার আয়োজন? বিষয়টি সব মহলেরই ভেবে দেখা উচিত। বিপুল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের এই দেশে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মর্যাদার সঙ্গে যথাযথ নাগরিক সুবিধা নিয়ে বসবাস করবেন-এটাই স্বাভাবিক। এটা তারা করছেনও। এদেশ উদার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু এখন আশঙ্কা জেগেছে, কোনো কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো কোনো অনুসারীর অব্যাহত উস্কানিমূলক ও আক্রমণাত্মক আচরণ এ স্বাভাবিক পরিবেশকে ভেঙ্গে দিতে পারে।
একশ্রেণীর আত্মবিক্রিত ও পরগাছা মুসলমানের তোষামোদ পেয়ে কোনো মহল যদি সাম্প্রদায়িক সুরসুরি বোধ করেন এবং মনে করেন যে, যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারি তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায়, এর ফল কারো জন্যই শুভ হবে না। একপক্ষের চোখবন্ধ তোষামোদ ও উস্কানিতে কারো কান দেওয়া উচিত নয়। সচেতন সব মহলের সক্রিয় হওয়া উচিত সবপক্ষের মঙ্গলের জন্য। কেউ কেউ বলেন, আক্রমণাত্মক সংখ্যালঘু উৎকণ্ঠিত সংখ্যাগুরুর পথ রচনা করে। সংখ্যাগুরুর মনে উৎকণ্ঠার জন্ম দেয়। আর উৎকণ্ঠাই এক সময় পাল্টা আক্রমণের পথে ধাবিত হয়। আর এ রকম হলে তো সবার ক্ষতিই অবধারিত হয়ে যায়। আমরা এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার যুক্তি খুঁজে পাই না। কিন্তু আমরা এনতর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত থাকতে চাই।