কুরআন যেন হয় চোখের আলো, হৃদয়ের প্রদীপ
‘হিফযুল কুরআন’ কুরআন মজীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ হক। কুরআন মজীদ নিজে হিফয করা, সন্তান-সন্ততিকে হিফয করানো এবং সমাজে হিফযে কুরআনের ব্যবস্থা করা মুমিন বান্দার কর্তব্য।
আমাদের দেশে হাফেযের সংখ্যা কম নয়। তবে হাফেযার সংখ্যা কম। কারণ আমাদের দেশে বাবা-মা ছেলেকে হাফেয বানানোর ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু মেয়েকে হাফেযা বানানোর সাহস করেন না। তাঁরা আশঙ্কা করেন, মেয়েকে হিফয করানো হলে সে তা রক্ষা না-ও করতে পারে। শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার পর গৃহস্থালী ঝামেলায় যদি কুরআন পাঠে সময় দিতে না পারে! যদি তার হিফয ঠিক না থাকে! এ মনে করে মা বাবা তাদের মেয়েদেরকে কুরআন হিফয করাতে সাহস করেন না। কিন্তু এ আশঙ্কা এত বড় করে দেখা সম্ভবত ঠিক নয়। এর চেয়ে বরং মেয়ে বড় হয়েও যেন হিফয ঠিক রাখতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। কুরআন মজীদ আল্লাহর নিয়ামত। এটা এমন নয় যে, বারবার পড়লেই তা মুখস্থ হয়ে যাবে। এটা আল্লাহর দান। আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা করবেন সে-ই হাফিযুল কুরআন হতে পারবে। সুতরাং এই নেয়ামত যে লাভ করবে তাকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে তা রক্ষা করার। যে মেয়েটি মহববতের সাথে, আল্লাহকে রাজিখুশি করার জন্য কুরআন মজীদ হিফয করবে সে কোনোদিন কুরআনকে অবেহলা করবে না। তার শত কাজের মধ্যেও সে কুরআন পড়ার সময় বের করে নিবে। তাহলে বলুন, কেন মেয়েরা হিফযে কুরআনের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হবে? তাছাড়া কর্মজীবনের ব্যস্ততা তো ছেলেদেরও রয়েছে। তাদের বিষয়ে কি এই আশঙ্কা করা হয় যে, হিফয করার পর তারা ভুলে যেতে পারে? সুতরাং বাবা-মার কর্তব্য, ছেলেদের মতো মেয়েদেরও দ্বীনী তালীমের বিষয়েও মনোযোগী হওয়া।
মেয়েদের কুরআন হিফয করার জন্য পাঁচটি বিষয় দরকার :
১. ইচ্ছা। কুরআনকে সীনায় ধারণ করতে পারা হচ্ছে মুমিনের পরম সৌভাগ্য। যদি এই সৌভাগ্য অর্জনের প্রবল ইচ্ছা থাকে তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তাআলার নুসরত হবে। মনে রাখতে হবে, হিফযের কোনো বয়স নেই। যে কোনো বয়সের মানুষ হিফযে কুরআনের নিয়ত করতে পারেন এবং চেষ্টা অব্যাহত রাখলে ধীরে ধীরে পূর্ণ কুরআনও হিফয করতে পারেন। এককথায়, কুরআনের আকর্ষণ ও ভালবাসা বৃদ্ধি করতে হবে।
২. পরিশ্রম। যে কোনো বড় কাজেই পরিশ্রম লাগে। পরিশ্রম সৌভাগ্যের জননী। সুতরাং আল্লাহর কালামকে সীনায় ধারণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টায় নিবেদিত হতে হবে। একজন ঈমানদার যখন চেষ্টা ও সাধনায় নিয়োজিত হবেন তখন অবশ্যই আল্লাহর নুসরত হবে। সুতরাং হাফেযাকে হতে হবে উদ্যমী, পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী। সুসংবাদ এই যে, আল্লাহ তাআলা মুমিনের জন্য হিফযে কুরআন সহজ করে দিয়েছেন। তবে তিনি দেখতে চান, বান্দা এই নেয়ামত গ্রহণ করতে কতটুকু শ্রম দিতে আগ্রহী। তাই নিয়মিত তিলাওয়াত করতে হবে। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। অবশ্যই পর্দার মধ্যে থাকতে হবে। এবং সব সময় দেখতে হবে, আমি যে কুরআন হিফয করেছি তা সম্পূর্ণ আয়ত্ত আছে কি না? মাঝে মাঝে একটু ছুটে গেলে তা তাড়াতাড়ি ইয়াদ করে ফেলতে হবে। এককথায় অবহেলা মোটেও করা যাবে না। ৩. দুআ। দুআ এমন একটি উপায়, যা দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতের সকল মকসুদ হাসিল হয়। মনে রাখতে হবে যে, শুধু ইচ্ছার দ্বারা কোনো কাজ হয় না, যদি না চেষ্টা ও পরিশ্রম থাকে। আবার চেষ্টা ও পরিশ্রমও ফলপ্রসু হবে না যদি না আল্লাহর নুসরত থাকে। সুতরাং আল্লাহর কাছে দু হাত তুলে চাইতে হবে-ইয়া আল্লাহ! আমার সীনায় কুরআন দান কর। কুরআন আল্লাহর অতি বড় নিয়ামত। এই নিয়ামত আল্লাহর কাছ থেকে ভিক্ষা করে নিতে হবে। কুরআন যেন সীনায় আসে এ মহা সম্পদ যেন মৃত্যু পর্যন্ত সীনায় থাকে-এটা আল্লাহ রাববুল আলামীনের কাছ থেকেই মঞ্জুর করিয়ে নিতে হবে।
৪. পিতামাতার সহযোগিতা। প্রত্যেক পিতামাতাই সন্তানের উন্নতি ও সফলতা চান। আর সকল সফলতার মূল আলকুরআন। পিতামাতার অনুপ্রেরণায় ও সহযোগিতায় সন্তান কুরআন হিফয করতে পারে। ঈমানদার পরিবারে এই নীতি নির্ধারণ করতে হবে যে, আমরা প্রথমে আমাদের সন্তানদেরকে আলকুরআন হিফয করাব, তাদের অন্তরে কুরআনের নূর জ্বেলে দেওয়ার চেষ্টা করব। এরপর প্রয়োজনে অন্য শিক্ষা প্রদান করব। পিতামাতার উৎসাহ ও সহযোগিতা থাকলে মেয়েদের জন্যও হিফয করা খুবই সহজ। আমি এখানে আমার বাবার চেষ্টার কথা না বলে পারছি না। আল্লাহর ঘর যে দেশে অবস্থিত আমরা সেই দেশে ছিলাম। আমার বাবা বেলা ১২ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত তার কর্মস্থলে ব্যস্ত থাকতেন এরপর বাসায় ফিরতেন অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে। এ রকম ক্লান্ত অবস্থায়ও তিনি বিছানায় যেতেন না। প্রায় তিন ঘণ্টা পর্যন্ত তিনি আমার কাছ থেকে কুরআন মুখস্থ শুনতেন। তার একটি কথা-‘মা! তোমাকে আমি কুরআন হিফয করিয়েছি, তুমি এটার গুরুত্ব দিবে। সারাজীবন এমনভাবে চলবে, যেন কাল কিয়ামতের দিন আমি নূরের তাজ পরতে পারি।
এখন আমি শ্বশুর বাড়িতে আছি। এখনো আমার বাবা আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করেন, কতটুকু তেলাওয়াত করেছি। প্রতি শুক্রবার সূরা কাহফ পড়ি কি না ইত্যাদি। মোটকথা, একজন হাফেযার জন্য পিতা-মাতার অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা অপরিহার্য।
৫. একটি ভালো হেফযখানা ও শিক্ষক-শিক্ষিকার উৎসাহ। আমাদের দেশে মেয়েদের জন্য হেফযখানা নেই বললেই চলে। এমনকি অনেক মেয়ে সহীহ ও শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতেও অক্ষম।
এদিকে একটু নজর দেওয়া উচিত। আমরা নারীরাও যে দায়ী নই তা-ও নয়। আমরা এখন পুরুষের সমান অধিকার চাইছি। পুরুষের মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা, স্বাধীনভাবে ভার্সিটি-কলেজে পড়ালেখা করার সুবিধা দাবি করছি। কিন্তু দ্বীনী ইলমের জন্য আমাদের কোনো চাহিদা নেই, কোনো দাবি নেই! এখানে যে কোনো ভালো হেফযখানা নেই-সেই চিন্তাও কি আমাদের কখনো হয়েছে?
সৌদী আরবে হিফযুল কুরআনের গুরুত্ব অনেক বেশি। ঐখানে প্রায় প্রতিটি মহল্লায় মেয়েদের জন্য তাহফীযুল কুরআনের ব্যবস্থা আছে। প্রতিটি সেন্টারের অর্ধেক খরচ সরকার বহন করে। মেয়েদের হিফযখানায় শুধু মহিলা শিক্ষিকারা পড়ান। তারা এত সুন্দর কুরআন পড়েন এবং এত সুন্দরভাবে তাজবীদ-তারতীলের সাথে পড়ান যে, যে কেউ কুরআন হিফয করতে আগ্রহী হবে। মারধর নেই, সবক বেশি দেন না। তবে যতটুকু সবক দেন, তা খুব ভালো করে পড়ান এবং শোনেন। অনেক শিক্ষিকা আগামী সবকটি ছাত্রীকে পড়ে শোনান অথবা ক্যাসেট থেকে শোনান। ছাত্রীরা তা অনুকরণ করে। ফলে সবক দেওয়ার সময়ই তাদের তাজবীদ, মাখরাজ একদম শুদ্ধ হয়ে যায়। বেশিরভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকা কুরআন হিফয করার জন্য ছাত্রীদেরকে অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা, সাহস-মনোবল দেন।
আমাদের দেশেও যদি এ ধারা অনুসরণ করা হয় তাহলে এদেশের মুমিন মেয়েরাও তাদের যিন্দেগীকে কুরআনের নূরে আলোকিত ইলমী ও আমলী যিন্দেগীতে পরিণত করতে পারবে।
মুসলিম বোনেরা! কুরআনের প্রতিটি বাক্য কতই না উজ্জ্বল! কুরআনের প্রতিটি বাণী কতই না মধুর! আলোকিত কুরআন হৃদয়ে ধারণ করা কতই না সৌভাগ্যের বিষয়! তাই এসো না! আমরা কুরআনকে ধারণ করি আমাদের বুকে, আমাদের মুখে, আমাদের গোটা অস্তিত্বে।