Rabiul Auwal 1433   ||   February 2012

স্মৃতিতে ভাস্বর এক জুমআ

মুহাম্মদ জাহিরুল আলম

সময়টা ১৯৯৩ ঈসায়ী সালের রমযান মাস। ঘটনাটা ঘটেছিল সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আমার আম্মা তখন নিউইয়র্ক স্টেটের ব্রুকলিনের ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আমি পরিবার-পরিজন নিয়ে ব্রঙ্কস-এ থাকি। প্রতিদিন আম্মার হাসপাতালে পাঁচ ঘণ্টা করে ডিউটি করি। ব্রঙ্কস থেকে ব্রুকলিনের দূরত্ব অনেক। তাই পাতাল ট্রেনেই যাতায়াতে সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা। মোট নয় ঘণ্টা প্রতিদিন আম্মার জন্য নির্ধারিত।

রমযান মাস হওয়ায় খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা নেই। সকাল সাতটায় বাসা থেকে রওনা দিয়ে নয়টার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছি। আর ইফতারের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে হাসপাতাল থেকে বের হই। ট্রেনে বসে অরেঞ্জ জুস আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে সংক্ষিপ্ত ইফতার সেরে ট্রেনেই ফাঁকমতো মাগরিবটা পড়ে ফেলি। প্রাত্যহিক এ রুটিন চলছিল মাসখানেক ধরে। তারপর এল জুমাতুল বিদা। অর্থাৎ পবিত্র রমযান মাসের শেষ শুক্রবার। রমযানের অন্যান্য জুমআর মতো আজো আমি জুমআ পড়তে মসজিদে যাব। ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল থেকে নিকটতম মসজিদও অনেক দূর। মাঝে ট্রেন পরিবর্তন করতে হয়। হাসপাতালের নিকটবর্তী পাতাল রেল স্টেশন থেকে আর ট্রেনে যেতে হবে ৫৯ স্ট্রীট স্টেশন এবং সেখান থেকে এন ট্রেনে করে ৮-এভিনিউ স্টেশন। ৮-এভিনিউতেই রয়েছে একটি বিশাল জমকালো মসজিদ। মার্কিন মুলুকে বসবাসকারী তুর্কীরা বিপুল অর্থ ব্যয়ে মসজিদটি নির্মাণ করেছে। টার্কিস কারুকার্য খচিত মসজিদটি এককথায় অপরূপ। এককালে তুর্কীরা শাসন করেছে আরব দেশ। সেই শাসন আমলের নিদর্শন হল এই মসজিদটি। মনোমুগ্ধকর কারুকার্যখচিত মসজিদটি সে সময়ের মুসলিম তুরস্কের স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতেই মসজিদ হয়ে থাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিমছাম একটি জায়গা। যেখানে মানুষ পরওয়ারদেগারের সান্নিধ্যের উদ্দেশ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচ্ছদে সমবেত হয় এবং রুকু-সেজদায় মিলিত হয়। এই স্থাপত্যের মাঝে ফুটে ওঠে তাদের অনুরাগ-ভালবাসা এবং মানসিক আকর্ষণ ও শ্রদ্ধাবোধ। মুঘল স্থাপত্য বলুন বা টার্কিসস্থাপত্য, তাদের এই সৃষ্টিকর্ম শুধু মার্জিত রুচির পরিচয়ই বহন করে না তার মধ্যে ধরা পড়ে ধর্মের অর্থাৎ ইসলামের প্রতি গভীর অনুরাগ। টার্কিস মসজিদটিও এর ব্যতিক্রম নয়। নির্মাণ সৌন্দর্যের সাথে বর্ণিল ক্যালিগ্রাফি মসজিদটিকে এক ভিন্ন মাত্রা দান করেছে, যা যে কোনো দেশের মুসলমানকে এবং যে কোনো পথচারিকে আকর্ষণ করতে পারে।

তুরস্কের মুসলমানেরা খুবই সত্যনিষ্ঠ। আল্লাহর প্রতি তাদের যে ভালবাসা তা শুধু তাদের নামায-কালিমা বা প্রাত্যহিক ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি; তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে তাদের সকল সৃষ্টিকর্মের মধ্যে। তাই তাদের ক্যালিগ্রাফ বিশ্ব ক্যালিগ্রাফের মধ্যে প্রথম সারিতে স্থান করে নিতে পেরেছে এবং যেখানেই তারা কিছু সৃষ্টি করেছে সেখানেই তারা তাদের চিন্তা-ভাবনার স্বকীয়তায় ছাপ রাখার প্রয়াস পেয়েছে। উন্নততর রুচিবোধের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

এই মসজিদটিতেই আমি জুমআর নামায আদায় করতে পছন্দ করতাম। হাসপাতাল থেকে মসজিদটি নিকটতম বিধায় সে মসজিদটিতেই আমি জুমআর নামায আদায় করব বলে ঠিক করি।

জুমআর দু তিন দিন আগে নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে এক ভয়ঙ্কর তুষার ঝড় হয় (ঝহড়ঝিঃৎড়স) যা স্পর্শ করে সংলগ্ন  আরো কয়েকটি অঙ্গরাজ্যকে। যথা নিউজার্সি, কানেক্টিকাট ইত্যাদি অঙ্গরাজ্যকে। খবরে এসেছিল যে, এমন তুষার ঝড় প্রায় অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে আর হয়নি। এটা জনজীবনকে সর্বদিক থেকে তছনছ করে দিয়েছিল। পরদিন নিউ ইয়র্ক টাইমসের ব্যানার হেড লাইন দিল ব্লিজার্ড অব নিউ ইয়র্ক। এমনি একটি মহাদুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে এল পবিত্র রমযানের শেষ শুক্রবার। এই শুক্রবারটি একটি ভিন্ন মাত্রা নিয়ে এসেছিল আমার জীবনে।

জুমআর নামাজের বেশ আগে হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে মসজিদে রওনা হলাম। যথারীতি সাবওয়ের ওপর পাতাল ট্রেন স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু ট্রেনের দেখা নেই। ইতিপূর্বে অনেকবার জুমআর নামায ধরতে এই ট্রেনে যাতায়াত করেছি, কিন্তু এমনটি কখনো হয়নি। প্রতি দুই-তিন মিনিট

অন্তর যে ট্রেনটি নিয়মিত এসেছে কোনোদিন মিস করেনি, সেটিই আজ হঠাৎ করে এমন অনিয়মিত হয়ে গেল কেন বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এক ঘণ্টারও বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন ট্রেনটি এল না তখন অসম্ভব রকমের অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। ট্রেনের কী হল-এই জন্য নয়! আমার জুমআর নামায কি হবে-এই চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠলাম। জীবনে কবে, কখন জুমআর নামায প্রথম পড়তে শুরু করেছিলাম তা আজ আর স্মরণ করতে পারছি না সত্য, কিন্তু সাথে সাথে এটাও স্মরণে আনতে পারব না যে, শৈশবে জুমআর নামায শুরু করার পর কোনোদিন তা ছুটে গেছে কি না। জুমআর দিনটি এমনিতেই একটি বিশেষ দিন। সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। হাদীসে যে দিনটিকে সাপ্তাহিক ঈদ হিসেবে গণ্য করা হয়। নামাযকে ভালবাসার হাদীস রয়েছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সকল জিনিসকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন নামায তার অন্যতম। যা হোক, জুমআর নামায পাওয়ার সব রকমের আশাই হারিয়ে ফেললাম। একবার মনে হল কোনো রকমে সাবওয়ে থেকে নিস্ক্রান্ত হই। তারপর সব কিছু করা যাবে। পাতাল রেল স্টেশন থেকে উপরে এসে দেখি ঘড়িতে একটা বাজে।

ঐ মসজিদে জুমআর নামায শুরু হয় দুপুর একটায়। কোনো অবস্থাতেই তা পরিবর্তন হতে দেখিনি। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সময়ের হিসাব সবচেয়ে বড় হিসাব। সময় ধরে চলাফেরা, সময় ধরে রেল, বাস, উড়োজাহাজ সবকিছু। বেশিরভাগ চাকরি চলে ঘড়ির কাটা ধরে। সময়ের হিসাবে গোলমাল মানে সবকিছুতে গোলমাল। সবকিছু বে হিসাব। ঘড়িতে একটা বাজে দেখে আমারও সব হিসাব গোলমাল হয়ে গেল। ভাবতে পারছি না যে, আজ আমি জুমআর নামায পড়তে পারব কি না। ব্যতিক্রমী তুষার ঝড়ের কারণে রাস্তায় কোনো গাড়িও নেই। যারা আছে তারা অতি জরুরি কাজে ভেবেচিন্তে রাস্তায় বেরিয়েছে। অতি সাবধানে আর সন্তর্পণে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। অতি ঠান্ডায় বরফ ভীষণ শক্ত হয়ে পাথরের মতো হয়ে গেছে। হাঁটাচলা একেবারেই বন্ধ। এ ছাড়াও রাস্তা বোঝা, চেনা না চেনার বিষয় তো রয়েছেই।

আমেরিকায় যারা সর্বদা পাতাল ট্রেনে চলাফেরা করে তাদের কাছে উপরের রাস্তা চিরদিনই অচেনা। তারা কখনো বলতে পারবে না, কোন রাস্তা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে বা কোন গন্তব্যে পৌঁছেছে। আমার মাথায় স্বাভাবিক কারণেই আর কোনো চিন্তা স্থান দিতে পারছি না। উপরের রাস্তায় এসে বরফ ঢাকা পিছল রাস্তার দিকে তাকিয়ে কান্নাকাটি করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। দু দুটো ট্রেন বদলিয়ে যেখানে মসজিদে যেতে হয় সেখানে আমি কি করে জুমআর নামায ধরব-মাথায় আসছে না। উপরন্তু রাস্তাও জানা নেই, চেনা নেই আমার একেবারেই। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বোকার মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করব। ভাবতে ভাবতে বরফ ঢাকা পিচ্ছিল অচেনা রাস্তায় নেমে পড়ি। প্রায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অসম্ভব পিছল বরফ আচ্ছাদিত রাস্তায় সামনের দিকে না বুঝে দৌড়াতে থাকি। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, গন্তব্য কোথায়-কিছুই জানা নেই। শুধু দৌড়াচ্ছি সামনের দিকে। দু দুবার পা পিছলে বরফের ওপর পড়েও গেছি। যারা রাস্তার পাশ থেকে লক্ষ্য করছে তারা খুব স্বাভাবিক কারণেই এক নির্বোধ বৃদ্ধের কান্ড দেখে অবাক হচ্ছে। আমার তখন দু চোখ বেয়ে অশ্রুর বন্যা। জীবনের স্বাভাবিকতাকেই আমি তখন হারিয়ে ফেলেছি। আমার অজান্তেই আমি আমার সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে নয়, মন দিয়ে কটি কথা বললাম। হে আমার আল্লাহ! হে আমার সৃষ্টিকর্তা! হে আমার মৃত্যুর আদেশ দানকারী! আমি নামাযকে ভালবাসি। আমার প্রিয় নবীজী নামাযকে ভালবাসতেন। স্মরণকালে আমার মনে পড়ে না প্রিয় জুমআর নামাযকে পাশ কাটিয়ে কখনো সামনে এগিয়ে গেছি। আজ আমার জুমআর নামাযের কি হবে? হে আল্লাহ! দয়া করে আমাকে জুমআর পবিত্র নামায ধরিয়ে দাও। তোমার অলৌকিক হস্তক্ষেপ ছাড়া আজ আর তা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। আর যদি তুমি তা না দাও তবে তার পূর্বেই আমার জীবনের অবসান ঘটাও। জুমআর নামায অথবা জীবনাবসান এটাই আমার আজকের প্রার্থনা। তুমি আমার প্রার্থনা পূরণ কর।

আমার চলা শেষ হয়নি, একটুখানি থেমেছি চারদিকটা দেখে নেওয়ার জন্য যে, কোথায় এসেছি এবং কোথায় যাব। ভাবছি আশপাশের কাউকে জিজ্ঞেস করব টার্কিস মসজিদটি কোন দিকে। কিন্তু কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই দেখতে পেলাম যে, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার এক ব্লকের মধ্যেই টার্কিস মসজিদটির সুউচ্চ গম্বুজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের চোখকেই আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। সামনে এগিয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে মসজিদে ঢুকবার পথে শুনলাম নামাজের পূর্বে ইকামত দেওয়ার শব্দ। মসজিদ লোকে পরিপূর্ণ। জুমাতুল বিদার দিন। মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম সাধারণত আমি মসজিদের সম্মুখ দিকে যে স্থানগুলোতে দাঁড়াতে ভালবাসি ঠিক সে জায়গাটিতেই মাত্র একজন লোক দাঁড়াবার মতো ফাঁকা জায়গা রয়েছে। আমি প্রশান্ত মনে জুমআর নামায আদায় করলাম। আজ অবধি বুঝতে পারিনি, কীভাবে সেদিন মসজিদে পৌঁছেছিলাম!

 

নামাজান্তে খবর নিয়ে যখন জানতে পারলাম যে, নামাজ চিরাচরিত নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ঠিক বেলা একটায়ই দাঁড়িয়েছে তখন অদ্ভূত এক অনুভূতি আমাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে যে, সম্বিত হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা হল। কারণ বেলা একটায় আমি ছিলাম পাতাল রেল স্টেশনের উপরের রাস্তায়। আমি আজো জানি না কীভাবে তা ঘটল। আমার মালিক কি আমাকে দান করেছিলেন সময়ের চেয়েও দ্রুতগতি? কিংবা গুটিয়ে দিয়েছিলেন আমার পায়ের তলার মাটি? আমি জানি না। জানতেও চাই না। শুধু চাই, এই অলৌকিক জুমআর কথা এবং জুমআর ধরার চেতনা চির জীবন্ত থাকুক আমার হৃদয়াঙ্গনে। 

 

advertisement