Rabiul Auwal 1433   ||   February 2012

সিলেটের মাইমল সমাজ : ঐতিহ্য সত্ত্বেও উপেক্ষিত

Mawlana Abdullah Bin Sayeed Jalalabadi

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সিলেটের ঐ কালের ডেপুটি কমিশনার খান বাহাদুর সৈয়দ নবাব আলী এবং মাওলানা সৈয়দ তাফাজ্জল হোসেন প্রণীত উর্দু-বাংলা ইংরেজি ভাষায় রচিত ও প্রকাশিত সিলেটের গণভোট ও মাওলানা সহুল উসমানী শীর্ষক পুস্তকে মাওলানা আবদুর রশীদ, বাহরুল উলূম মাওলানা মোহাম্মাদ হোসেন ও বেগম সিরাজুন্নেসা (প্রাক্তন এমএনএ) প্রমুখ গণ্যমান্য মনীষীদের মূল্যবান অভিমত ও অনুমোদনসহ তা প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬৯ সালে।

উক্ত পুস্তকের সর্বপ্রথম অভিমতটি উক্ত মাওলানা আবদুর রশীদ মরহুমেরই। এ থেকেই গণভোটকালে ও পাকিস্তান আন্দোলনে মাওলানা আবদুর রশীদ রাহ.-এর ভূমিকা যে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। উক্ত পুস্তকে প্রকাশিত তার অভিমতে সিলেটের মাইমল সমাজের এ সংক্রান্ত অবদানের কথাও ফুটে উঠেছে।

উর্দু ভাষায় লিখিত বক্তব্যে মাওলানা আবদুর রশীদ রাহ. লিখেছিলেন, গণভোটের সময় সিলেট জেলাকে পাকিস্তানভুক্ত করার ব্যাপারে হযরত মাওলানা সহূল উসমানী রাহ.-এর যে বিপুল অবদান ছিল তার খুব কমই এ পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর প্রকৃত খিদমত অনেক গুণ বেশি। এ কথাটি ভুলে গেলে চলবে না যে, সিলেট (বিভাগকে) পাকিস্তানভুক্ত করা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। কেননা, সিলেটবাসীদের অধিকাংশই অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ। তাঁরা ওলামায়ে কেরামের অনুসরণ করে থাকেন এবং তাঁদের কথাই মেনে চলেন। সিলেটের অধিকাংশ আলেম-ওলামাই জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের অনুসারী ছিলেন এবং মুসলিম লীগ পন্থী আলেমের সংখ্যা খুবই কম ছিল। কিন্তু আমার উস্তাদ হযরত মাওলানা সহূল উসমানী রাহ.-এর বদৌলতে মুসলিম লীগ পন্থীদের পাল্লা ভারি হয়ে যায়। অধিকাংশ জেলাবাসী মুসলমান মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হন।

এ অকর্মণ্য বান্দা গণভোটের সময় একাধারে উত্তর সিলেট জেলা মুসলিম লীগ এবং সিলেট জেলা মুসলিম মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি। জেলা মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পাকিস্তান আন্দোলনের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেন। ফলে সিলেটের

পাকিস্তানভুক্তি আরো সুকঠিন হয়ে উঠে। কেননা, (মৎস্যজীবী সমাজের) তিন চার লাখ মুসলিম অধিবাসী মুসলিম লীগের পতাকার নিচ থেকে সরে গেলে এ জেলা (বর্তমান বিভাগ)-এর পাকিস্তানভুক্তি ছিল অসম্ভব ব্যাপার। সে সময় এ অকমর্ণ্য বান্দা উক্ত মুসলিম মৎস্যজীবী সমিতির বেশ কজন নেতাকর্মীর সহযোগিতা নিয়ে ঐ সময়ের মুসলিম লীগ এবং জেলা মৎস্যজীবী সমিতির আমানতদার (কোষাধ্যক্ষ) হায়দারপুর নিবাসী হাজী আবদুস সাত্তার ওরফে মুতলিব মিয়ার বাড়ির প্রাঙ্গণে জেলা মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদেরসহ একটি বিরাট সম্মেলন উস্তাদুনা হযরত উসমানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করি। হযরতের মর্মস্পর্শী দুআ ও ভাষণে অভিভূত উক্ত সমিতির লাখ লাখ নেতাকর্মী মুসলিম লীগের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ফলে পাকিস্তান হাসিলের পথ সুগম হয়ে যায়। এর অল্প কদিন পরেই গণভোট অনুষ্ঠিত হয় এবং আল্লাহর ফযলে সিলেট পাকিস্তানভুক্ত হয়ে যায়।

এতে তিনি তাঁর সাংগঠনিক পরিচয় ও তারিখ ২০ অক্টোবর ১৯৬৪ ইং স্বহস্তে লিখে স্বাক্ষর দান করেন।

মাওলানা সহূল উসমানী রাহ.-এর পৌত্র করাচিতে বসবাসরত বন্ধুবর সাদ আহমদ উসমানী-এর মারফত চাচাজানের স্বহস্তে লিখিত ও স্বাক্ষরিত মূল উর্দূ কপির আলোকচিত্র দেখার সুযোগও আমার হয়েছে।

আমার জন্মভূমি টুকের বাজার এলাকাটি যেহেতু সিলেট শহর থেকে মাত্র চার মাইল পশ্চিমে অবস্থিত এবং এলাকাবাসী মাওলানা আবদুর রশীদ মরহুমের নেতৃত্বে ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তাই এ এলাকার লোকজন সিলেট জেলা শহরের মুসলিম লীগের সভা, সমিতি ও মিছিলে রীতিমত  উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে হাজির হয়ে সেগুলোকে সফল করার ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করত। তাদের দেখাদেখি সিলেট শহরের ভাতালিয়া, শেখঘাট, মাছিমলের কুশিঘাট তথা টুলাটকর গাজী বুরহানুদ্দীন রাহ.-এর মাজার এলাকায় বসবাসকারী হাজার হাজার মুসলিম মৎস্যজীবী কর্মীগণ এসব সভা, সমিতিতে হাজির থাকতেন। আসাম সরকারের লাইন প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আইন অমান্য করে জেলে যাওয়ার জন্যও তারাই অধিক সংখ্যায় সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতেন।

চাচাজানের দীর্ঘ দিনের সহকর্মী সিলেট জেলা মুসলিম লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক ভাটিখলার হাজী মনীরুদ্দীন (কবি দিলাওয়ারের চাচা) সুদীর্ঘকাল জীবিত ছিলেন। তিনি আমার চাচার সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। একবার আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, চাচাজান! এত দেওয়ানে, চৌধুরী, জমিদার নেতা মুসলিম লীগে থাকতে একজন মৎস্যজীবী সমাজের আলেমকে কেন ঐ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্তে সিলেট জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি করা হয়েছিল? জবাবে একটি অর্থপূর্ণ হাসি উপহার দিয়ে তিনি বললেন, বাবা! ঐ সময় মৎস্যজীবী সমাজের কর্মীদের মতো মুক্তহস্তে দানকারী ও নিবেদিত নিঃস্বার্থ কর্মী আর কোনো সমাজে ছিল না। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের এক চতুর্থাংশ রাজস্বের জোগানদার সিলেট জেলা তথা আজকের সিলেট বিভাগকে পাকিস্তানভুক্ত (বাংলাদেশভুক্ত) করার ব্যাপারে সিলেটের মাইমল সমাজের অর্থদানের জন্য গোটা বাংলাদেশবাসীই তাদের কাছে ঋণী।

বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এই মাইমল সমাজেরই লোক। একজন শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসাবিদ, এ রাজধানী নগরীর একটি প্রাচীন ও শ্রেষ্ঠ মেডিক্যাল হাসপাতালের প্রিন্সিপ্যাল এ সমাজেরই লোক। মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার এবং উল্লেখযোগ্য একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এ সমাজেরই লোক। উভয় বাংলার শীর্ষস্থানীয় আলেম, বাগ্মী লেখক, সাংবাদিক ও আধ্যাত্মিক সাধক আল্লামা রুহুল আমীন বশিরহাটী এ পেশার একটি পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং মৎস্যজীবী সমাজের লোকজন তু্চ্ছ, হেয় ও নিচ-এরূপ ধারণা পোষণ করা কেবল ইসলাম ও মানবতার দিক থেকেই নয়, বাস্তবতার দিক থেকেও একটা অলীক ও অজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন।

বি.দ্র. মাওলানা জালালাবাদী-যীদা মাজদুহুম-এর প্রবন্ধটি আরো দীর্ঘ ছিল। প্রবন্ধের ওই অংশটুকুতে তিনি কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছেন। যাতে শুধু পেশার কারণে মাইমল সমাজের ভাইদের প্রতি বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। আমরা তা প্রকাশ করছি না। কারণ এই প্রবন্ধের উপকারিতা এসব ঘটনার উপর নির্ভরশীল নয়। আসলে বর্ণ, গোত্র, ভাষা, দেশ, অঞ্চল, পেশা, দৃষ্টিভঙ্গি, দল ইত্যাদি অজানা আরো কত কারণে মানুষ  আসাবিয়তের শিকার হয়ে থাকে। কমবেশি এই ব্যাধি-আল্লাহ হেফাযত করুন-প্রায় সব এলাকার মানুষের মধ্যেই আছে।

ইসলাম সব ধরনের আসাবিয়তকে রহিত করে দিয়েছে। এটাকে শুধু হারাম ঘোষণাই করেনি; বরং এ বিষয়ে উম্মতের মাঝে এতটা ঘৃণা জাগিয়েছে যে, কোনো মুসলিমের মাঝে

আসাবিয়ত থাকতে পারে-এ ধারণা করাও কঠিন। প্রতিটি রোগেরই প্রতিষেধকের প্রয়োজন। আর এই ব্যাধি তো অত্যন্ত গোপনীয় ও ক্ষতিকর। নিজের অজান্তেই এটি আচার-আচরণ, লেনদেন ও সামাজিকতাকে প্রভাবিত করে তোলে। তাই এর চিকিৎসা জরুরি।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন। আমীন।-তত্ত্বাবধায়ক

 

advertisement