চিরন্তন দশ অসিয়ত
সূরা আনআমের ১৫১ থেকে ১৫৩ পর্যন্ত আয়াতের তরজমা : (তাদেরকে) বল, এসো, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের প্রতি যা কিছু হারাম করেছেন, আমি তা তোমাদেরকে পড়ে শোনাই। তা এই যে, তোমরা তার সঙ্গে কাউকে শরীক করো না, পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, দারিদ্রের কারণে তোমরা নিজ সন্তানদেরকে হত্যা করো না। আমি তোমাদের রিযিক দেব এবং তাদেরকেও, আর তোমরা প্রকাশ্য হোক বা গোপন কোনো রকম অশ্লীল কাজের নিকটেও যেও না। আর আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন তাকে যথার্থ কারণ ছাড়া হত্যা করো না। হে মানুষ! এই হচ্ছে সেই সব বিষয়, যার প্রতি আল্লাহ গুরুত্বারোপ করেছেন, যাতে তোমরা উপলব্ধি কর।
ইয়াতিম পরিপক্ক বয়সে না পৌঁছা পর্যন্ত তার সম্পদের নিকটেও যেও না, তবে এমন পন্থায় (যাবে তার পক্ষে) যা উত্তম হয় এবং পরিমাপ ও ওজন পরিপূর্ণ করবে। আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কষ্ট দেন না। এবং যখন কোনো কথা বলবে তখন ন্যায্য বলবে, যদিও নিকটাত্মীয়ের বিষয়েও হয়। আর আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবে। হে মানুষ! আল্লাহ এসব বিষয়ে তোমাদেরকে গুরুত্বের সাথে আদেশ করেছেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।
(হে নবী! তাদেরকে) আরো বল, এটা আমার সরল-সঠিক পথ। সুতরাং এর অনুসরণ কর, অন্য কোনো পথের অনুসরণ করো না। অন্যথায় তা তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। হে মানুষ! এসব বিষয়ে আল্লাহ তোমাদেরকে গুরুত্বের সাথে আদেশ করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। (তাওযীহুল কুরআন-বঙ্গানুবাদ থেকে)
দুই.
বর্ণিত তিন আয়াতে মূলত দশটি বিষয়ের উল্লেখ করে তা পালন করতে আদেশ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের শব্দ হচ্ছে, অসিয়ত, যা সাধারণ নসীহত বা আদেশের চেয়েও গুরুত্ববহ অর্থ ধারণ করে। যে কারণে সূক্ষ্মদর্শী অনুবাদকবৃন্দ অনুবাদ করেছেন ‘গুরুত্বের সাথে আদেশ’। মুফাসসিরগণ বলেছেন, এ আয়াতগুলোতে দশটি হারাম বিষয়ের উল্লেখই হচ্ছে উদ্দেশ্য। কিন্তু কুরআন মজীদের প্রজ্ঞাপূর্ণ পদ্ধতিতে এর কিছুর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা বাচক শব্দ এবং অপর কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে ধনাত্মক বা আদেশ বাচক শব্দ এরশাদ হয়েছে। যেখানে আদেশবাচক শব্দের উল্লেখ হয়েছে, সেখানে উদ্দেশ্য-তার বিপরীত করা হারাম। দশটি বিষয়কে নিষেধাজ্ঞার অর্থে গ্রহণ করলে এ ব্যাখ্যা যথার্থ। অন্যথায় পবিত্র কুরআনের বর্ণনার স্বাভাবিক ধারা অনুযায়ী মর্ম গ্রহণ করে নিলেও কোনো সমস্যা থাকে না। তখন সবকটিকেই নিষেধাজ্ঞার অর্থে নেওয়ার পরিবর্তে কিছু নিষেধাজ্ঞা ও কিছু নির্দেশের অর্থে গ্রহণ করা যায়। মোটকথা, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে দশটি বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে যে হুকুম দেওয়া হয়েছে সেই চিরন্তন হুকুম বা অসিয়তগুলোই এই আয়াতত্রয়ের মর্ম। দশ অসিয়ত বা চিরন্তন দশ গুরুত্বপূর্ণ হুকুম নামে অভিহিত এই বিষয়গুলোর প্রতিপালনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সব কালের মানুষের মুক্তি ও সাফল্যের পয়গাম।
নিষিদ্ধ দশটি বিষয় হচ্ছে
১. আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও আনুগত্যে কাউকে অংশীদার বানানো। ২. পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার না করা। ৩. দারিদ্রের ভয়ে সন্তান হত্যা করা
৪. প্রকাশ্যে বা গোপনে অশ্লীল কাজ করা ৫. কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা
৬. ইয়াতিমের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করা ৭. ওজন ও মাপে কম দেওয়া ৮. স্বাক্ষ্য, বিচার ও মীমাংসা বা কথাবার্তায় অবিচার করা ৯. আল্লাহ তাআলার সঙ্গে করা প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার পূরণ না করা
১০. আল্লাহ তাআলার সহজ-সরল পথ ছেড়ে অন্য পথে যাওয়া।
তিন আয়াতে বর্ণিত এই দশ অসিয়ত বা গুরুত্বপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা বা নির্দেশ সম্পর্কে তাফসীর গ্রন্থগুলোতে চারটি স্মরণযোগ্য উক্তির উদ্ধৃতি পাওয়া যায়।
তাফসীরে ইবনে কাসীরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর একটি উক্তি বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মোহরাঙ্কিত অসিয়তনামা দেখতে চায় সে যেন এ আয়াতগুলো পাঠ করে। এসব আয়াতে ওই অসিয়ত বিদ্যমান, যা আল্লাহর নির্দেশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে দিয়েছেন।
হযরত উবাদা ইবনে সামেত রা.-এর রেওয়ায়েতে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন হাকেম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কে আছে, যে আমার হাতে তিনটি আয়াতের আজ্ঞানুবর্তী হওয়ার শপথ করবে? তারপর তিনি আলোচ্য তিনটি আয়াত তেলাওয়াত করে বলেন-যে ব্যক্তি এ শপথ পূর্ণ করবে, তাকে পুরস্কৃত করা আল্লাহর দায়িত্ব।
তাফসীরে বাহরে মুহীত-এ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর একটি উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেন, সূরা আলে ইমরানে মুহকাম আয়াতের বর্ণনায় এ আয়াতগুলোকেই বুঝানো হয়েছে। হযরত আদম আ. থেকে শুরু করে শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সব পয়গাম্বরের শরীয়তই এ আয়াতগুলোর মর্ম সম্পর্কে একমত। কোনো ধর্ম ও শরীয়তে এগুলোর কোনোটিই মনসুখ বা রহিত হয়নি।
আগে ইহুদী ছিলেন, পরে ইসলাম গ্রহণ করেন হযরত কা’ব ইবনে আহবার। তিনি ছিলেন তাওরাত বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, আল্লাহর কিতাব তাওরাত বিসমিল্লাহর পর কুরআনে পাকের এসব আয়াত দিয়েই শুরু হয়, যেগুলোতে দশটি হারাম বিষয় বর্ণিত হয়েছে।
নিচে তিন আয়াতে বর্ণিত দশটি বিষয় সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্নভাবে সংক্ষিপ্ত আলোচনা আসছে। এ ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য তাফসীরগ্রন্থের আলোকপাত ও বর্তমান প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আলোচনা পেশ করা হচ্ছে।
তিন.
প্রথমেই মহাপাপ শিরকের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-‘তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না।’ ইবাদতে-আনুগত্যে কোথাও নয়। এর দ্বারা শিরকে জলী (স্পষ্ট শিরক) এবং শিরকে খফী (প্রচ্ছন্ন শিরক) উভয়টার বিষয়েই চূড়ান্ত সতর্কতার ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে। কোনো দেব-দেবী ও মূর্তিকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা, সেটা আনুগত্য কিংবা কোনো গুণ ও উপকারিতার ক্ষেত্রেই হোক না কেন, কোনো নবীকে কিংবা ফেরেশতাকে আল্লাহর সন্তান মনে করা অথবা কোনো নবী-ওলীকে কোনো বিষয়ে আল্লাহর সমতুল্য মনে করা হচ্ছে শিরকে জলী বা স্পষ্ট শিরক। এছাড়া ইবাদত ও পার্থিব ক্ষেত্রে আল্লাহকে কার্যনির্বাহী বিশ্বাস করেও কার্যত অপরকে কার্যনির্বাহী সাব্যস্ত করা এবং লোক দেখানো কিংবা নাম-যশের উদ্দেশ্যে ইবাদত ও দান-খয়রাত করা হচ্ছে শিরকে খফী বা প্রচ্ছন্ন শিরক। আর শিরকের অপরাধ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সিদ্ধান্ত হল, এর ক্ষমা নেই। অথচ আমাদের সমাজে বর্তমানে শিরকের ক্ষেত্রে নির্বিকারভাবে ধ্বংসাত্মক আচরণ করতে দেখা যায়। একটি মুসলিম সমাজে অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে ইতিপূর্বে কোথাও কোথাও শিরকে খফী বা প্রচ্ছন্ন শিরকের ঘটনা ঘটতে দেখা যেত। কিন্তু ইদানীং কেউ কেউ ঘোষণা দিয়ে শিরকে জলীতে পর্যন্ত লিপ্ত হওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে, শিরকে জলী করে অনেকে তার পক্ষে আবার যুক্তিও দিচ্ছে। আবু জেহেল-আবু লাহাবের মতো আরবের মুশরিকরাও আল্লাহকে মানতো। তার সঙ্গে তারা তাদের দেব-দেবীকেও আল্লাহর সমকক্ষ মনে করত। এ পর্যায়ের চূড়ান্ত শিরক করেও এখন কেউ কেউ যখন নিজেকে ‘উত্তম মুসলিম’ হিসেবে্প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে যান তখন তিনি ভেবে দেখেন না যে, তাহলে আবু জাহেলকেও তো তার মতো ‘উত্তম মুসলিম’ আখ্যা দিতে হবে। যে কোনো রকম দল, মত, প্রভাব ও গোষ্ঠির মায়াজাল ছিন্ন করে মুসলামনকে শিরকমুক্ত থাকতে হবে। আয়াতত্রয়ের প্রথম শিক্ষাই এটি।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার। আয়াতে কারীমার শব্দ হচ্ছে-‘পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।’ এতে উদ্দেশ্য হচ্ছে অসদ্ব্যবহার করো না। মুফাসসিরগণ বলেন, আয়াতে কারীমার ইঙ্গিত হচ্ছে, পিতামাতার সঙ্গে দুর্ব্যবহার না করা, কষ্ট না দেওয়া বা অবাধ্যতা না করাই যথেষ্ট নয়; বরং তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করা জরুরি। পবিত্র কুরআনের আরও বেশ কটি আয়াতে এই মর্মটি তুলে ধরা হয়েছে। একটি আয়াতে আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ এবং আরেকটি আয়াতে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার পরপরই পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই আয়াতেও আল্লাহর সঙ্গে শিরক না করার নির্দেশের পরপরই এসেছে পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ। বহু সহীহ হাদীসেও পিতামাতার প্রতি দুর্ব্যবহার না করা ও তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করে তাদের সন্তুষ্ট করার নির্দেশ ও প্রেরণা এসেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের সমাজে বহু ক্ষেত্রেই পিতামাতা অবাধ্যতা, অসদ্ব্যবহার কিংবা অবহেলার শিকার হয়ে থাকেন, যা কোনোভাবেই সমীচীন হতে পারে না। এমনকি ঈমান ও দ্বীনদারির ক্ষেত্রে পিতামাতার অবস্থান প্রতিপক্ষে হলেও তাদেরকে বাহ্যিক আচরণে কোনো কষ্ট না দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে ঈমান ও দ্বীনের পথে সন্তানের অবিচল থাকার নির্দেশ রয়েছে। বেদনাদায়ক ঘটনা হচ্ছে, সম্প্রতি পিতামাতার সঙ্গে চূড়ান্ত দুর্ব্যবহারের খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। অপরদিকে তাদের প্রতি নীরব অবাধ্যতা বা অবহেলার কালো মেঘে ছেয়ে আছে গোটা দেশ। বহু কোনঠাসা ও মনভাঙ্গা বৃদ্ধ পিতামাতাকে এখন এদেশে আশ্রয় নিতে হচ্ছে বৃদ্ধ-আশ্রমে। নিঃসন্দেহে এটা চরম দুর্ভাগ্যজনক বিষয়। মানবিকতা ও দ্বীনদারির সঙ্গে এ চিত্রটির কোনো মিল নেই। তাই সব পর্যায়ের সন্তানদেরই উচিত পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞচিত্তে সদ্ব্যবহার বজায় রাখা। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, সন্তানের জীবনে এই একটি বিষয়ই দুনিয়া ও আখিরাতে সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যের বড় উপলক্ষে পরিণত হতে পারে।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, দারিদ্রের ভয়ে সন্তান হত্যা করার নিষেধাজ্ঞা। আয়াতে কারীমায় স্পষ্ট ভাষায় ইরশাদ হয়েছে-দারিদ্রের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। আমি তোমাদের এবং তাদেরকেও রিযিক দান করি। ‘জাহেলী যুগে মেয়ে সন্তানকে লজ্জার কারণ মনে করে হত্যা করা হতো। কখনো কখনো জীবিকা নির্বাহের ভয়েও নবজাতককে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো। আয়াতে কারীমায় এ ধরনের হত্যাকান্ডে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি এর কারণটি সম্পর্কেও মানুষকে নিঃসংশয় ও শঙ্কামুক্ত হতে প্রেরণা দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের ও তাদের রিযিক আমি দিয়ে থাকি।’ সুতরাং দারিদ্রের ভয়ে তাদের হত্যা করার বিষয়টি চূড়ান্ত ভাবেই অমূলক ভাতিপ্রসূত। রিযিকের বিষয়ে আল্লাহ তাআলাই সমাধানদাতা-এ বিশ্বাসকে জোরালো ও কার্যকর করতে পারলে সন্তান প্রতিপালন, ঘর-সংসার এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও ঈমান ও আমলে সৌন্দর্য ফুটে উঠবে। তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন-এ মুফতী শফী রাহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, চিন্তা করলে দারিদ্রের কারণে সন্তান হত্যার স্পষ্ট অর্থের বাইরেও আরেকটি অর্থ বুঝা যায়। সেটি হচ্ছে সন্তানকে উপযোগী দ্বীনী শিক্ষাদীক্ষা না দেওয়া এবং তার চরিত্র গঠন না করা। যে কারণে সে আল্লাহ, রাসূল ও পরকালের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে এবং অন্যায় ও গর্হিত বিষয়ে বা গুনাহর কাজে জড়িয়ে পড়ে, এটাও প্রকারান্তরে সন্তান হত্যা। এটা সার্বিক উদাসীনতার কারণেও ঘটতে পারে। আবার অতিরিক্ত দুনিয়ামুখিতা ও বিষয় সচেতনতার কারণেও ঘটতে পারে। জাগতিক শিক্ষাদীক্ষায় দক্ষ না হলে জীবিকা নির্বাহ হবে কীভাবে-এ ধরনের ভীতি তাড়িত হয়ে সন্তানকে প্রয়োজনীয় দ্বীনী শিক্ষা ও চরিত্র গঠন থেকে দূরে রাখা হয়। এটাও সন্তান হত্যার একটি প্রকার।
উপরন্তু এর প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী। এ কারণে অনেক সময় সন্তানের আখেরাত বরবাদ হয়ে যায়। বর্তমানে জীবিকা চিন্তার এই দুর্ভাবনার ছুরি দিয়েই লাখো-কোটি মুসলিম সন্তানের জীবনকে হত্যা করা হচ্ছে। সন্তানের প্রতি দরদ ও ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ মনে করেই এটা করা হচ্ছে। গোড়ার কারণ কিন্তু থাকছে সেই একটিই, দারিদ্রের ভয়। সেজন্যই সন্তানদের পুরোপুরি দ্বীনী শিক্ষা অথবা জাগতিক শিক্ষার সঙ্গে জরুরি দ্বীনী শিক্ষা ও পরিচর্যার বিষয়ে পিতামাতার কোনো অবহেলা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমন অবহেলা মানেই এক অর্থে দারিদ্রের ভয়ে সন্তান হত্যা না করার আল্লাহ তাআলার নির্দেশের লঙ্ঘন। এতে শেষ পরিণতিতে সন্তানেরও কোনো কল্যাণ হয় না, পিতা-মাতার জীবনেও সন্তানের মাধ্যমে প্রকৃত সুখ আসে না।
আয়াতে বর্ণিত চতুর্থ নিষিদ্ধ বিষয় হচ্ছে, প্রকাশ্যে ও গোপনে কোনো অশ্লীলতার কাছে যাওয়া। আয়াতে ‘ফাওয়াহেশ’ শব্দ বর্ণিত হয়েছে। এটি ‘ফাহেশা’ শব্দের বহুবচন। যার অর্থ এমন মন্দ কাজ, যার অনিষ্টতা সুদূরপ্রসারী। ব্যাপকভাবে ব্যভিচার ও ব্যভিচার সংশ্লিষ্ট কাজকেই ‘ফাহেশা’ বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ যেখানে অশ্লীলতা কিংবা নির্লজ্জতার উপাদান থাকে। প্রকাশ্য অশ্লীল কাজে যুক্ত হওয়ার অর্থ তো পরিষ্কার। গোপন অশ্লীল কাজ কী হতে পারে? মুফাসসিরগণ বলেন, যেসব অশ্লীল কাজ মানুষের চোখে পড়ে না কিংবা মানুষ অশ্লীল বলে মনে করে না। মূলত প্রকাশ্য অশ্লীল কাজে যারা অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাদের সংখ্যা তুলনামূলক কম থাকলেও গোপন অশ্লীলতার পরিমাণ বর্তমানে অনেক বেশি। মিডিয়ার যাবতীয় অনিয়ন্ত্রিত উপাদান এই ধ্বংসাত্মক বিষয়টিকে এখন আবদ্ধ ঘরেও ঢুকিয়ে ছেড়েছে। দুনিয়ার কেউ জানতে না দিয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখন চোখের, মনের, দেমাগের অশ্লীলতায় ডুবে থাকার আয়োজন রয়েছে। গোপন অশ্লীলতার এই জগত এখন বিশাল-ব্যাপক; সর্বগ্রাসী। এ ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হবে। আয়াতে কারীমায় ইরশাদ হয়েছে-অশ্লীলতার কাছেও যেও না। অর্থাৎ অশ্লীলতায় লিপ্ত না হওয়াই যথেষ্ট নয়, লিপ্ত না হয়ে কাছাকাছি থাকলেও ক্ষতি হতে পারে। বাস্তবে হয়ও তাই। অশ্লীলতার আকর্ষণ শুদ্ধ মানুষকে পঙ্কিলতায় টেনে নামায়। এজন্য সব রকম প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা থেকে দূরত্ব বজায় রাখা নাজাতকামী সচেতন সব মানুষের জন্য জরুরি।
পঞ্চম নিষিদ্ধ বিষয় হচ্ছে অন্যায় হত্যা। আয়াতে কারীমায় ইরশাদ হয়েছে-আর আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন তাকে যথার্থ কারণ ছাড়া হত্যা করো না।’ যথার্থ কারণের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-তিনটি কারণ ছাড়া কোনো মানুষের খুন হালাল নয়। (এক) বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ব্যভিচারে লিপ্ত হলে, (দুই) অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে তার কেছাছ হিসেবে তাকে হত্যা করা যাবে এবং (তিন) ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে গেলে। মূলত এসব কারণ ঘটলে এবং তা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত হলে ইসলামী আদালতের বিচারক প্রাণদন্ড দেবেন এবং এরপর সেটি কার্যকর হবে। এছাড়া সাধারণভাবে অন্য কোনো কারণে বা উপলক্ষে কাউকে হত্যা করার বিষয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। একই সঙ্গে মনে রাখার বিষয় হচ্ছে, যথার্থ কারণ ছাড়া কোনো মুসলমানকে হত্যা করা যেমন হারাম, তেমনিভাবে এমন কোনো অমুসলমানকে হত্যা করাও হারাম, যে কোনো ইসলামী দেশের প্রচলিত আইন মান্য করে বসবাস করে কিংবা যার সাথে মুসলমানদের চুক্তি থাকে।
বর্তমানে দেশে হত্যাকান্ড নাগরিক সাধারণের মাঝে সাধারণ ব্যাধি হিসেবে ছড়িয়ে না পড়লেও একথা মিথ্যা নয় যে, হত্যাকান্ডের প্রবণতা ও পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। রাজনৈতিক কারণে, বৈধ-অবৈধ ব্যবসায়িক ও বৈষয়িক স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সমাজ এখন অধিকতর হত্যাপ্রবণ হয়ে পড়েছে। বিরোধ-মীমাংসার সীমা পার হয়ে গেলেই প্রত্যক্ষভাবে কিংবা ভাড়াটে খুনীর সহযোগিতা নিয়ে হত্যার পথ ধরছে একশ্রেণীর মানুষ। একটি শ্রেণীর মাঝে এটি মহামারির রূপ নিয়েছে। এর বিষময় ফল ভোগ করছে পুরো সমাজ। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে হত্যার পার্থিব দন্ড ও আখিরাতের শাস্তির কথা। এ প্রবণতা থেকে, এ জাতীয় প্রবণতার প্রতি সমর্থন-সম্মতি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। সমাজকে হত্যাপ্রবণতা থেকে মুক্ত করতে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে যার যার অবস্থান থেকে সোচ্চার ও সক্রিয় হতে হবে।
ষষ্ঠ নিষিদ্ধ বিষয় হচ্ছে ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ কিংবা অন্যায় তসরুফ। আয়াতে কারীমায় ইরশাদ হয়েছে, ইয়াতিম পরিপক্ক বয়সে না পৌঁছা পর্যন্ত তোমরা তার সম্পদের কাছেও যেও না। তবে এমন পন্থায় (যাবে তার পক্ষে) যা উত্তম হয়।’ মূলত ইয়াতিমের নিকটতম প্রকৃত অভিভাবক থাকে না বলেই তার সম্পদ অন্যের দায়িত্বে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এসব ক্ষেত্রে দায়িত্ব গ্রহণকারীদের কেউ যেন সঠিক উপায় বা পন্থা অবলম্বন ছাড়া ইয়াতিমের মালের কাছেও না ঘেঁষে সে নির্দেশই দেওয়া হয়েছে। ইয়াতিমের সম্পদ যথাযথ হেফাযত এবং সম্ভাব্য অধিকতর নিরাপদ খাতে বিনিয়োগ করতে পারে দায়িত্বশীল ব্যক্তি। এতে অর্জিত লাভ আবার ইয়াতিমের সঞ্চয়েই জমা করতে হবে। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর পর বুঝবুদ্ধি স্বাভাবিক থাকলে সে সম্পদ তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তা না হলে সর্বোচ্চ পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত ইয়াতিমের সম্পদের তদারকি করা যাবে। তবে তদারকিকালে কিছুতেই সেখানে ছলচাতুরি কিংবা গোঁজামিল দিয়ে ইয়াতিমকে ঠকানো যাবে না। অন্য আয়াতের মর্ম অনুযায়ী ইয়াতিমের সম্পদ খাওয়া মানে আগুন দিয়ে উদরপূর্তি করা।
আমাদের সমাজে জবাবদিহিতা নেই কিংবা ধরা পড়ার আশঙ্কা নেই-এমন ক্ষেত্রগুলোতে তসরুফ কিংবা অসততার ঘটনা ঘটে বিস্তর। ইয়াতিম মানেই পিতৃহীন নাবালেগ শিশু। যার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ হেফাযতের সামর্থ্য নেই। নিকটাত্মীয় কিংবা দৃশ্যমান নিকটজনদের কেউ না কেউ সেটা দেখাশোনা করে থাকে। আর সে ক্ষেত্রে যথাযথ হিসাব-নিকাশ ও জবাবদিহিতা গ্রহণের পর্যায়ে কেউ থাকে না। এসব ক্ষেত্রে তাই কখনো কখনো লোভ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঘটে তসরুফ ও অসততার ঘটনা। তাই সদুপায় ও উত্তম পন্থা অবলম্বন ছাড়া ইয়াতিমের সম্পদের কাছে ঘেঁষতে নিষেধ করা হয়েছে।
সপ্তম নিষিদ্ধ বিষয় হচ্ছে ওজন ও মাপে ত্রুটি করা। আয়াতে করীমায় পরিমাপ ও ওজনে ন্যায়সঙ্গতভাবে পরিপূর্ণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এক পক্ষ আরেক পক্ষের কাছ থেকে কোনো পণ্য কিংবা পাওনা যতটুকু পাবে ততটুকুর চেয়ে কম না দেওয়া এবং যে নেবে তার বেশি না নেওয়া। তবে সতর্কতামূলকভাবে দাতা কিছুটা বেশি দিলে দিতে পারে। মূলত ওজন ও মাপের যতগুলো ক্ষেত্র হতে পারে, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন, কেনাকাটা, ভাগ-বাটোয়ারা সবক্ষেত্রের জন্যই আয়াতের এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর। অর্থাৎ ওজনে ত্রুটি করা যাবে না। এ কারণেই মুফাসসিরগণ বলেন, শ্রমিক, কর্মচারী, কর্মকর্তা, প্রশাসকদের সবাই কাজ, সময় ও দায়িত্বের ক্ষেত্রেও ওজনের কমবেশির হিসাবে পড়বেন। অর্থাৎ নির্ধারিত সময় কিংবা কাজে গাফলতি করলে তিনি ওজনে কম দিলেন বলে ধর্তব্য হবে। এ আয়াতের নির্দেশ লঙ্ঘনের দায়ে তখন দায়ী হবেন। এজন্য যার যার ক্ষেত্রে সবাইকে সতর্ক হতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে। অবশ্য নিজের দিক থেকে ওজন পূর্ণ করার পরিপূর্ণ আস্থা থাকার পর এবং সেক্ষেত্রে কোনো আপত্তি উত্থাপিত না হলে আর বাস্তবক্ষেত্রে সেটা সামান্য কমবেশি হলে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দেবেন। আয়াতে কারীমায় ওজন পূর্ণ করার হুকুমের পরপরই ইরশাদ হয়েছে-আমি কাউকে সাধ্যের অতীত কোনো কষ্ট দেই না।’ তাফসীরে ইবনে কাসীরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর একটি রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ওজন ও মাপ এমন একটি কাজ যে, এক্ষেত্রে অন্যায় আচরণ করে তোমাদের আগে অনেক উম্মত আল্লাহর আযাবে পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। তোমরা এ ব্যাপারে পুরোপুরি সাবধানতা অবলম্বন করবে।
অষ্টম বিষয়টি হচ্ছে ন্যায়সঙ্গত কথা বলার নির্দেশ। আয়াতে কারীমায় ইরশাদ হয়েছে- এবং যখন কোনো কথা বলবে তখন ন্যায়সঙ্গতভাবে কথা বলবে। যদিও নিকটাত্মীয়ের বিষয়েও হয়।’ এখানে কথা বলার দ্বারা উদ্দেশ্য ব্যাপক। মুফাসসিরগণ বলেন, এর দ্বারা সাক্ষ্য, বিচারিক রায়, সাধারণ মতামত ও কথাবার্তা সবই উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে কোনো এক পক্ষে নিজের নিকটাত্মীয় হলেও কথা বা রায়ে কোনো পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারবে না। নিকটাত্মীয় দ্বারা উদ্দেশ্য নিকটজন, নিজ পছন্দের ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠি সব।
এতে বোঝা যায়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলাপচারিতার পাশাপাশি সাক্ষ্য ও বিচারিক রায়ের ক্ষেত্রে ন্যায়ানুগতা বজায় রাখার বিষয়টি এতে পরিষ্কার। কিন্তু চিন্তা করলে আরো দেখা যাবে, বর্তমানে বিভিন্ন ঘটনায় গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘সুশীল’ নামের বিশিষ্ট নাগরিকদের মতামত ও বক্তব্যের ক্ষেত্রেও এ নির্দেশটি প্রযোজ্য হবে। এসব ক্ষেত্রে মূর্খতা ও পক্ষপাতিত্বের কারণে অনেক সময় বড় রকম নৈরাজ্য ও জুলুমের ঘটনা ঘটে যায়। মিথ্যা স্বাক্ষ্য ও পক্ষপাতমূলক রায়ের মতই এসব ক্ষেত্রে একপেশে অন্যায় বক্তব্য কিংবা ভূমিকা ও আল্লাহ তাআলার ভয়ঙ্কর শাস্তির কারণ হবে।
নবম বিষয়টি হচ্ছে, আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণ করার নির্দেশ। সব বান্দাই জন্মের আগে ‘আলমে আরওয়াহ’ বা রূহের জগতে থাকাকালে আল্লাহকে রব মানা ও তার হুকুম মেনে চলার অঙ্গীকার করে এসেছে। মুফাসসিরগণ এ আয়াত দ্বারা প্রথমত সে অঙ্গীকার পূরণের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং আল্লাহর সাথে কৃত সে অঙ্গীকার পূরণের অর্থ হচ্ছে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। এছাড়া নযর-মান্নতসহ বিভিন্ন সময় বান্দা নিজ থেকেই আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার করে থাকে। এ আয়াতে সেসব অঙ্গীকার পূরণেরও নির্দেশ হয়েছে। কষ্ট কিংবা প্রতিকূলতার সময় আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার করার পর আনুকূল্য ও স্বাচ্ছন্দ চলে আসলে সাধারণত সেসব অঙ্গীকার পূরণে মানুষের মধ্যে গাফলতি চলে আসে। তখন অঙ্গীকার পূরণের কথা বেমালুম ভুলে যায় মানুষ। এ আয়াতে অঙ্গীকার করার পর পরবর্তীতে যেন গাফলতের ঘটনা না ঘটে সেদিকে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে।
দশম বিষয় হচ্ছে, আল্লাহর দেওয়া সরল-সঠিক পথকে অনুসরণের নির্দেশ এবং অন্যসব পথ থেকে সরে থাকার নিষেধাজ্ঞা। আয়াতে কারীমায় ইরশাদ হয়েছে-এবং ইহাই আমার সরল-সঠিক পথ। তাই তোমরা এ পথ অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না। অন্যথায সেসব পথ তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে।’
মুফাসসিরগণ বলেন, আয়াতে বর্ণিত ‘ইহা’ বা ‘এই পথ’-এর দ্বারা উদ্দেশ্য দ্বীনে ইসলাম অথবা পবিত্র কুরআন। এমনকি সূরা আনআমের প্রতিও ইশারা হতে পারে। কারণ এই সূরার মধ্যে তাওহীদ, রিসালাতসহ ইসলামের মূলনীতি ও মূল বিধিবিধানের উল্লেখ আছে। মোটকথা, ইসলামের সরল পথ অনুসরণ ও অন্যান্য পথে চলা থেকে বিরত থাকার নির্দেশই এ আয়াতের মর্ম। আগের নয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভিন্ন ভিন্ন নিষেধাজ্ঞা বা নির্দেশ হিসেবে বর্ণিত হওয়ার পর শেষ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে সামগ্রিক অর্থে। অর্থাৎ দ্বীনে ইসলামকে আঁকড়ে ধরা ও অন্যসব মত-পথকে বর্জন করা। সামগ্রিক ও নির্যাসমূলক এ নির্দেশটিকেও ভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে অধিক গুরুত্বের জন্য।
চার.
১৫১ থেকে ১৫৩ সূরা আনআমের এই তিনটি আয়াতে গুরুত্বপূর্ণ দশটি নিষেধাজ্ঞা বা নির্দেশ এসেছে। এগুলোর প্রতিটির ক্ষেত্রেই ‘আমর’ বা আদেশবাচক ও ‘নেহি’ বা নিষেধবাচক শব্দ বর্ণিত হয়েছে। যার অর্থ সরাসরি নির্দেশ বা নিষেধাজ্ঞা। উত্তম-অনুত্তমের দ্বন্দ্ব বা পছন্দ-অপছন্দের অবকাশ এখানে নেই। যার ফিকহী মর্ম হচ্ছে এসব নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘণ করা হারাম এবং এগুলো মেনে চলা ফরয। তিন আয়াতের মধ্যে দ্বিতীয় আয়াতের শুরু পর্যন্ত পাঁচটি বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা এবং একটি বিষয়ে আদেশবাচক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং দ্বিতীয় আয়াতের মাঝামাঝি থেকে তৃতীয় আয়াতের শেষ পর্যন্ত চারটি বিষয়ে ‘আদেশবাচক’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতিটি আয়াতের শেষেই আছে ‘তিনি তোমাদের প্রতি গুরুত্বের সাথে আদেশ করেছেন।’
প্রথম আয়াতে চারটি নিষেধাজ্ঞা ও একটি আদেশ বর্ণনার পর আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, যাতে তোমরা উপলব্ধি কর। দ্বিতীয় আয়াতে চারটি বিষয় (একটি নিষেধাজ্ঞা ও তিনটি নির্দেশ) বর্ণনার পর বলা হয়েছে-যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। এবং শেষ আয়াতে একটি বিষয়, (নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞার সমন্বয়) বর্ণনার পর বলা হয়েছে ‘যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। আল্লাহ তাআলার হিকমতপূর্ণ ভাষার এক অপূর্ব নিদর্শন এতে ফুটে উঠেছে। উপলব্ধি গ্রহণ, উপদেশ গ্রহণ ও তাকওয়া অর্জনের এক ধারাবাহিক স্তর বিন্যাসের মাধুর্য উদ্ভাসিত হয়েছে।
কুরআনে কারীমের এই তিন আয়াতে নাজাত ও মুক্তির জন্য মানবতার সামনে এক সার্বজনীন ও সর্বকালীন চিরন্তন কর্মসূচি বর্ণিত হয়েছে। এ আয়াতগুলোতে উচ্চারিত হয়েছে ঈমানিয়াত ও মানবিকতার চূড়ান্ত পাঠ। তাফসীরে বাহরে মুহীতে বলা হয়েছে-এতে যদিও সরাসরি মক্কার মুশরিকদের সম্বোধন করা হয়েছে, কিন্তু বিষয়টি ব্যাপক হওয়ায় সমগ্র মানবজাতিই এর আওতাধীন-সে মুমিন হোক কিংবা কাফের, আরব হোক কিংবা অনারব, উপস্থিত লোকজন হোক কিংবা অনাগত বংশধর।’ অতএব আমাদের বিশ্বাস এবং এটাই সত্য যে, আল্লাহ তাআলার শ্বাশ্বত এই দশ অসিয়তকে মেনে চলার মধ্যেই সব মানুষের ইহকালীন সাফল্য ও আখিরাতের নাজাত নিহীত। আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেককে আমল করার তাওফীক দিন।