সুন্দর মৃত্যুর জন্য-২
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দীর্ঘ আশার কুফল
দীর্ঘ আশা মানুষের জন্য অনেক বড় দুর্ভাগ্যের কারণ। শয়তান মানুষকে বলে, আরে বোকা! সামনে তো অনেক সময় আছে। এই সময়টা ভোগ করতে হবে এবং বড় বড় আশা-আকাঙ্খা পূরণ করতে হবে। শয়তানের এই কুমন্ত্রণায় প্রতারিত হয়ে মানুষ তার সকল মনোযোগ দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের পিছনে নিয়োজিত করে। বড় বড় স্বপ্ন দেখতে থাকে এবং সেই স্বপ্নের পিছনেই ছুটতে থাকে। এভাবে সে আখিরাতের কথা ভুলে যায়। মৃত্যুর কথাও ভাবতে চায় না।
এ কারণে দুনিয়ায় ভোগ-বিলাসের লম্বা লম্বা স্বপ্ন দেখতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আমি তোমাদের সম্পর্কে সবচেয়ে ক্ষতিকর যে বিষয়ের আশঙ্কা করি তা হচ্ছে দুটি : ১. প্রবৃত্তির অনুসরণ ও ২. দীর্ঘ আশা। কারণ প্রবৃত্তির অনুসরণ সত্য থেকে বিচ্যুত করে, আর দীর্ঘ আশা, এটাই তো হল দুনিয়ার মোহ।
সুতরাং মানুষ যখন দুনিয়াকে বেশি ভালবাসে তখন দুনিয়াকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য দেয় এবং আখিরাতে নাবিয়্যীন, সিদ্দীকিন, শুহাদা-সালেহীনের সাথে আল্লাহর সান্নিধ্যে জান্নাতে থাকার চেয়ে দুনিয়ার চাকচিক্য ও ভোগ-বিলাসকেই উত্তম মনে করে।
পক্ষান্তরে দুনিয়ার আশা-আকাঙ্খা যখন কম হয় এবং আখিরাতের ফিকির যখন অন্তরে থাকে তখন মানুষ নেক আমলের দিকে অগ্রসর হয় এবং জীবনের মূল্যবান সময়কে কাজে লাগায়। জীবনের সময় খুবই অল্প। আর যে সময়টুকু চলে যায় তা কখনো ফিরে আসে না। অন্যদিকে আখিরাতের পথে আছে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেসব প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কেও সাবধান করেছেন। এক হাদীসে ইরশাদ করেছেন, তোমরা সাতটি অবস্থা আসার আগেই আমল করে নাও। তোমরা কি শুধু অপেক্ষায় আছ ঐ দারিদ্রের, যাকে তোমরা ভুলে গেছ কিংবা ঐ ধনাঢ্যতার, যা মানুষকে বেপরোয়া করে দেয়, কিংবা ঐ অসুস্থতার, যা মানুষকে অক্ষম করে দেয় কিংবা ঐ বার্ধক্যের, যা মানুষকে বুদ্ধিহীন করে ফেলে কিংবা ঐ মৃত্যুর, যা দ্রুত এগিয়ে আসছে, কিংবা দাজ্জালের, সে তো প্রতীক্ষার সকল বস্ত্তর মধ্যে সর্ব নিকৃষ্ট, কিংবা অপেক্ষা করছ কিয়ামতের, কিয়ামত তো আরো ভয়াবহ ও ভীতিময়!!-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৪০৮
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাঁধ ধরলেন এবং বললেন, তুমি দুনিয়ায় এমনভাবে থাক, যেন একজন ভিনদেশী বা পথিক।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলতেন, তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকালের অপেক্ষা করো না। আর সকালে করো না সন্ধ্যার অপেক্ষা। তুমি সুস্থতাকেই গ্রহণ কর অসুস্থতার (ক্ষতিপূরণের) জন্য এবং জীবনকে গ্রহণ কর মৃত্যুর (পাথেয় সংগ্রহের) জন্য।-সহীহ বুখারী ১১/১৯০-২০০
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিনদেরকে এমন কিছু বিষয় শিখিয়ে দিয়েছেন, যা তাদেরকে দীর্ঘ আশার মরিচিকা থেকে রক্ষা করে এবং তাদের সামনে দুনিয়ার প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরে। তিনি আদেশ করেছেন মৃত্যুকে স্মরণ করার, কবর যিয়ারত করার, মৃতকে গোসল দেওয়ার, জানাযার সাথে যাওয়ার, অসুস্থের খোঁজখবর নেওয়ার ও নেককার মানুষের সান্নিধ্য গ্রহণ করার। কারণ এসব বিষয় মানুষকে সজাগ করে এবং অমোঘ ভবিষ্যতের প্রস্ত্ততি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। এখানে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল :
১. মৃত্যুর স্মরণ
বেশি বেশি মৃত্যুকে স্মরণ করলে দুনিয়ার মোহ কেটে যায় এবং আখিরাতের ফিকির পয়দা হয়। ফলে তা বান্দার মাঝে বেশি বেশি নেক আমলের প্রেরণা সৃষ্টি করে এবং ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় অবৈধ ভোগ-বিলাস থেকে বিরত রাখে।
আবু হুরায়রা রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সকল ভোগ-উপভোগ বিনাশকারীকে তোমরা বেশি বেশি স্মরণ কর।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৪০৯
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, একজন আনসারী ব্যক্তি (সাহাবী) আরজ করলেন, আল্লাহর রাসূল! সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তির পরিচয় কী? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে মৃত্যুকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করে এবং মৃত্যুর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। তাঁরাই তো দূরদর্শী। দুনিয়ার সম্মান ও আখিরাতের মর্যাদা তো তারাই নিয়ে গেল।-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৪০৯
কবরস্তানের অধিবাসীদের কথা স্মরণ করুন। একসময় তারাও তো এই পৃথিবীতে ছিল। তাদেরও ছিল সুঠাম দেহ, অগাধ সম্পদ ও বিপুল ক্ষমতা। কিন্তু আজ তারা কবরের বাসিন্দা। মাটির পোকা তাদের দেহকে খেয়ে ফেলেছে, তাদের হাড্ডিকে চূর্ণ করে দিয়েছে।
তো এই পরিণতি কি সকলেরই জন্য অপেক্ষা করছে না? তাহলে কেন আমি প্রস্ত্তত হচ্ছি না? আখিরাতের পুঁজি কেন সংগ্রহ করছি না? নেক আমলই হচ্ছে আখিরাতের পুঁজি, আখিরাতের একমাত্র মুদ্রা।
২. কবর যিয়ারত
কবর মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় তার পরিণামের কথা। মৃত্যুর পর আপনজনেরাই তো কবর খনন করে, মৃতকে ঐ অন্ধকার ঘরে শায়িত করে এবং মাটিচাপা দিয়ে ফিরে আসে। এরপর তার ধনসম্পদ ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যায়। তার একান্ত ব্যক্তিগত জিনিসগুলোও অন্যরা নিয়ে যায়। স্ত্রী চলে যায় নতুন সংসারে। কিছুদিন পর সবাই তাকে ভুলে যায়। অথচ একদিন সে-ই ছিল ঘরের কর্তা। সকলে তার আদেশ পালন করত এবং কোনো বিষয়ে নিষেধ করলে সকলে তা থেকে বিরত থাকত। তো একজন ঈমানদার যখন কবর যিয়ারত করে এবং এই পরিণতির কথা চিন্তা করে তখন সে অনুভব করে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত সত্য বলেছেন-তোমরা কবর যিয়ারত কর। কারণ তা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৯৭৬
৩. মৃতকে গোসল দেওয়া ও জানাযার পিছনে পিছনে যাওয়া
গোসলের খাটিয়ায় মাইয়েত কত অসহায়! গোসলদাতা যেভাবে ইচ্ছা উল্টেপাল্টে তাকে গোসল দেয়। অথচ সে-ও তো একদিন জীবিত ছিল। কেউ তাকে এভাবে ঘোরাতে পারত না। এমনকি অনুমতি ছাড়া তার কাছেও আসতে পারত না। এভাবে এখানে কত মানুষ ছিল, কত প্রবল ও প্রভাবশালী লোক ছিল। অথচ মৃত্যু সবাইকে পরিণত করেছে নিথর দেহে। শক্তি নেই, স্পন্দন নেই, নড়াচড়ার বিন্দুমাত্র ক্ষমতাও নেই। গোসলদাতা যেভাবে ইচ্ছা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে গোসল দেয়। আজ আর কেউ তার চোখ রাঙানির বিন্দুমাত্র ভয় করে না।
হযরত উসমান রা. যখন কোনো জানাযাকে এগিয়ে দিয়ে কবরের পার্শ্বে দাঁড়াতেন তখন খুব কাঁদতেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি তো জান্নাত-জাহান্নামের কথা হলেও কাঁদেন না। অথচ কবরের কাছে দাঁড়ালে কাঁদেন?
তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, কবর হল আখিরাতের প্রথম মনযিল। এখানে মুক্তি পেলে পরের মনযিলগুলো সহজ হয়ে যায়। আর এখানে মুক্তি না হলে পরের মনযিলগুলো আরো কঠিন হয়।-মুসনাদে আহমদ ১/৬৩; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৩০৯
৪. নেককার মানুষের সোহবত
নেককারদের সোহবত কলব ও হৃদয়ে প্রাণ সঞ্চার করে এবং হিম্মত ও প্রেরণা জাগ্রত করে। কারণ নেককার ব্যক্তিদের ইবাদত-মগ্নতা এবং পুণ্যের কাজে উদ্যম ও প্রতিযোগিতা যখন অন্য মানুষ প্রত্যক্ষ করে তখন তাদের মাঝেও পুণ্যের পথে চলার সাহস ও প্রেরণা জাগে। তেমনি তাদের আল্লাহ-মুখিতা ও দুনিয়া-বিমুখতা যখন মানুষ প্রত্যক্ষ করে তখন তাদের মনেও এই বৈশিষ্ট্য অর্জনের আগ্রহ জাগে।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ করেছেন তিনি যেন এ ধরনের লোকদের সাথে নিজেকে আবদ্ধ রাখেন। ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) ধৈর্য্য-স্থৈর্যের সাথে নিজেকে সেই সকল লোকের সংসর্গে রাখ, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে এ কারণে ডাকে যে, তারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায় তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়। এমন কোনো ব্যক্তির কথা মানবে না, যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে রেখেছি এবং যে নিজ খেয়াল-খুশির পেছনে পড়ে রয়েছে ও যার কার্যকলাপ সীমা ছাড়িয়ে গেছে।-সূরা কাহাফ (১৮) : ২৮
হাসান বসরী রাহ.কে জিজ্ঞাসা করা হল, আবু সায়ীদ! বলুন, আমাদের কী করা উচিত? আমরা কি এমন লোকদের সাথে বসব, যারা এত ভয়ের কথা বলে যে, আমাদের প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়? তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহর কসম! যারা তোমাকে ভয় দেখিয়ে সবধান করে, যার কারণে তুমি (ঐ ভীতিকর বিপদ থেকে মুক্তির উপায় অন্বেষণ করবে এবং) মুক্তি পেয়ে যাবে-তাদের সাথে থাকাই তোমার জন্য কল্যাণকর ঐ সকল লোকদের সাথে থাকার চেয়ে, যারা তোমাকে আশ্বস্ত করতে থাকে (ফলে তুমি বিপদ সম্পর্কে উদাসীন হবে এবং) পরিশেষে ঐ ভীতিকর বিপদের শিকার হয়ে যাবে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)