বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা
গত ২৮ যিলকদ ১৪৩২ হিজরী, মোতাবেক ২৭ অক্টোবর ২০১১ বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক ছাত্রের অনুরোধে তাদের একটি ইজতিমায় ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে আলোচনা করেন মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার মুদীর, মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ।
ইশার নামাযের কিছুক্ষণ পর আলোচনা শুরু হওয়ায় সময়ের স্বল্পতায় তা পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। আলোচনার শেষে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রশ্নোত্তর পর্বেরও আয়োজন ছিল। ঐ সংক্ষিপ্ত আলোচনাতেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় এসেছে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে আলকাউসারের পাঠকদের জন্য আলোচনার সারমর্ম পেশ করা হল।
অডিও রেকর্ড থেকে বক্তব্যটি পত্রস্থ করেছেন-মাওলানা আবদুল্লাহ মাসুম।
হামদ ও সালাতের পর।
মুহতারাম হাজেরীন!
আজকে আমরা ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে বলা ও শোনার জন্য একত্র হয়েছি।
আমরা এমন একটা সময়ে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একত্রিত হয়েছি যখন বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। খুবই নাজুক। সুপার পাওয়ার দেশ আমেরিকা, যাকে বিশ্বের মোড়ল বলা হয়, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন কাহিল।
ওয়ালস্ট্রিট দখল আন্দোলন
আপনারা জানেন, বেশ কদিন থেকেই অব্যাহতভাবে ওয়ালস্ট্রিট দখল আন্দোলন হচ্ছে। এই ওয়ালস্ট্রিট পুঁজিবাদের প্রতীক। ক্যাপিটালিজমের স্বর্গস্থান। বিশ্বের বড় স্টক এক্সচেঞ্জ এখানে অবস্থিত। এখানের স্টক এক্সচেঞ্জের মূলধন বিশ্বের যেকোনো স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে বেশি। বিশ্বের বড় বড় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে অবস্থিত।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর আমেরিকার বিভিন্ন বয়সের লোকেরা ওয়ালস্ট্রিটের পার্শ্ববর্তী একটি পার্কে জড়ো হয়েছে। তারা অব্যাহতভাবে আন্দোলন করছে। এই আন্দোলন শুধু আমেরিকায় নয়; আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতেও হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ১০০ দেশের এক হাজারের বেশি নগরীতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে। আন্দোলনকারীদের অন্যতম দাবি, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে।
এটি একটি কাকতালীয় ব্যাপার যে, আমরা যে সময় অর্থনীতি বিষয়ে আলোচনা করছি ঠিক তখন বিশ্বের অর্থনীতির অবস্থা এরূপ।
বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা কিভাবে ভালো নয়
আমি শুরুতেই বলেছি, বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। কেননা, আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থাই যদি এরূপ হয় তাহলে অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কিরূপ হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশের বাজার পরিস্থিতি এবং সরকারের আর্থিক কর্মকান্ড দেখলে বিষয়টি পরিষ্কার বুঝে আসবে।
বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক ইজম
বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক ইজম বা মতবাদ হল পুঁজিবাদ। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ ও এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ সব জায়গায় এই মতবাদই বিরাজমান। তাদের অর্থনৈতিক মতবাদের বিপক্ষে তাদের দেশেই আন্দোলন হচ্ছে। আমাদের দেশের আন্দোলনের মতো নয়। আমাদের দেশে একদিন মিছিল হল, পুলিশ কাঁদানি গ্যাস ছুড়ল ব্যাস, সবাই চলে গেল-এরকম নয়। সেখানে পার্কে তাবু টানিয়ে অবিরাম আন্দোলন হচ্ছে।
বিশ্বের সাধারণ জনগণ প্রচলিত অর্থনীতির উপর খুশি নয়
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিশ্বের সাধারণ জনগণ প্রচলিত অর্থনীতির উপর খুশি নয়। এতে তাদের শান্তি আসছে না। দীর্ঘদিন যাবত যে ইজম রাজত্ব করেছে এর অবস্থা এখন ভালো নয়। এই খারাপটা এখন হয়নি। আরো আগেই হয়েছে। এতদিন কৃত্রিমভাবে জিইয়ে রাখা হয়েছে। আপনাদের হয়ত মনে আছে, ২০০৮ সালের কথা। বিশ্বে তখন অর্থনৈতিক মন্দার রব উঠেছিল। এর শুরু হয়েছিল আমেরিকা থেকে। এই মন্দার কারণে তাদের দেশে ১০০টিরও বেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বড় বড়গুলোকে জিইয়ে রেখেছে সেদেশের সরকারের ১৬ হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ বা আর্থিক সহায়তা তহবিল। এই অনুদান না পেলে ২০০৮ সালেই এই মতবাদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
সরকারি ভর্তুকি ও অনুদান পেয়ে তারা তো টিকে গেছে। কিন্তু সাধারণ জনগণ যারা সমাজের মূল শ্রেণী তাদের ভাগ্য বদলায়নি। তাদের অবস্থা হয়েছে কঠিন থেকে কঠিনতর। সেই খারাপের প্রভাবটা এখন ভালোভাবে ধরা পড়ছে। তারাই বলছে, তাদের দেশের প্রতি দশজনের একজনের চাকরি নেই। ৫ কোটিরও বেশি লোক তাদের ভাষায় দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। মোটকথা, সাধারণ জনগণ প্রচলিত অর্থনীতির উপর সন্তুষ্ট নয়।
সম্মানিত শ্রোতামন্ডলী
সময় অল্প। তাই পুরো অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। আর এর যে শাখা-প্রশাখা রয়েছে তথা ব্যাংক, বীমা, শেয়ারবাজার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা তো অনেক দূরের বিষয়, আমি শুধু ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক কিছু কথা বলব।
ইসলামী অর্থনীতি
শব্দটা অর্থনীতি। এর সাথে যোগ করলাম ইসলামী। এর থেকে বুঝলাম, অর্থনীতিটা দ্বীন তথা ইসলামের অঙ্গ। তাই শুধু অর্থনীতি বলিনি। তাহলে শুরুতেই অনেক কথা এসে গেল।
ক) ইসলাম এমন একটা দ্বীন, যার মাঝে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান রয়েছে।
খ) অর্থনীতিটি এমন হতে হবে, যার সকল বিষয় ইসলাম তথা কুরআন-সুন্নাহ সমর্থিত হবে। তবেই তা ইসলামী অর্থনীতি হবে। ইসলামী অর্থনীতি শব্দ থেকেই এসব বুঝা যায়।
ইসলাম ধর্মের বৈশিষ্ট্য
১. এটা বলার প্রয়োজন নেই, ইসলাম পূর্ণ দ্বীন। এতে মানুষের জীবনের সবধরনের সমস্যার সমাধান রয়েছে। শুধু সমাধান নয়; বরং নির্দেশনাও। শুধু সমাধান বললে মনে হয় বিষয়টা এরূপ, যেমন কোনো রোগের ক্ষেত্রে একেক ডাক্তার একেক সমাধান দিল। এলোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক, ইউনানী চিকিৎসক সবাই ভিন্ন ভিন্ন সমাধান দিল। ইসলামের সমাধানটা এরূপ নয়; বরং এ সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। অনিবার্য সমাধান।
তো ইসলামের একটি বৈশিষ্ট্য হল, এতে জীবনের সকল সমস্যার সমাধান ও নির্দেশনা রয়েছে। এ সমাধানটা অপশনাল বা ঐচ্ছিক নয়; বরং আবশ্যকীয়।
২. দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, দ্বীনুল আদল। ইসলাম হল দ্বীনুল আদল। এর এক অর্থ হল ইনসাফপূর্ণ দ্বীন। আরেক অর্থ মধ্যপন্থার বৈশিষ্ট্যের অধিকারী দ্বীন। এটি ইসলামের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে, এর কোনো বিষয়ের মধ্যেই কঠোরতা নেই আবার ছাড়াছাড়িও নেই; বরং মধ্যম পন্থা। কুরআন মজীদে এসেছে-
وكذلك جعلنكم امة وسطا
(তরজমা) এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি।-সূরা বাকারা : ১৪৩
উক্ত আয়াতে এটিই বলা হয়েছে।
আপনি ইসলামের বিষয়গুলো পূর্ববর্তী উম্মতের সাথে মিলালে, তদ্রূপ প্রচলিত ব্যবস্থার সাথে মিলালেও দেখবেন, ইসলামেরটি হচ্ছে মধ্যমপন্থা। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও বিষয়টি এরূপ। ইসলামের অর্থনীতিও মধ্যমপন্থার অধিকারী। বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত অর্থনীতি ও একসময় পৃথিবীর বিশাল অংশের রাজত্বকারী অর্থনীতি এ দুটির মাঝে তুলনা করলেই আপনি তা বুঝতে পারবেন। বিষয়টির সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করছি।
সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের সাথে ইসলামী অর্থনীতির তুলনা
পৃথিবীতে সোসালিজম বা সমাজতন্ত্র এসেছে পুঁজিবাদের প্রতিক্রিয়ারূপে। পুঁজিবাদের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য যখন বেশি হচ্ছিল এবং তা যখন অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ হল তখন কয়েকজন বড় বড় চিন্তাবিদ এর প্রতিক্রিয়ারূপে সমাজতন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। মানুষ সমাজতন্ত্রটা গ্রহণ করেছে এর বিশেষ কোনো মহত্বের কারণে নয়; বরং পুঁজিবাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েই বিকল্প হিসেবে একে গ্রহণ করেছে। যেমন-
সরকারের পালাবদল। এক সরকারের পর আরেক সরকার আসে। অনেক সময় জনগণ ভোট দিয়ে নতুন সরকার আনে তার বৈশিষ্ট্য বা কৃতিত্বের কারণে নয়; বরং আগেরটাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। ক্ষমতার বদলটা বিরূপ প্রতিক্রিয়াস্বরূপ হয়। পছন্দ হয়েছে এজন্য নয়। পছন্দ তো সাধারণ জনগণ কাউকেই করতে পারছে না। তারা বিরক্ত হয়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাচ্ছে।
একটা সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের আধিপত্য ছিল। কিছুদিন পর তাদের নিজেদের লোকদের কারণেই তাদের পতন হয়। তখন স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। এসুযোগে পুঁজিবাদ আবার আধিপত্য বিস্তার করে। পক্ষান্তরে ইসলামের অর্থনীতি কোনটার প্রতিক্রিয়া নয়। পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র এগুলো আসার বহু আগেই ইসলাম তার অর্থনীতির কথা বলেছে। এটি কোনোটার বিকল্পও নয়, মৌলিক নীতি। ইসলামের সব বিষয়ই এরূপ।
রাজনীতিও এরূপ। বিকল্প নয়। ওটা দ্বারা হচ্ছে না তাই অন্যটা নিচ্ছি-এমন নয়। ইসলামের অর্থনীতি মৌলিক। বিকল্প নয়। মানুষ মৌলিকটি বাদ দিয়ে বিকল্পটা নিচ্ছে। এরপর ব্যর্থ হচ্ছে, কিন্তু ব্যর্থতা স্বীকার করছে না।
সমাজতন্ত্রের কথা জানেন, তারা ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকার করে না। তারা বলে, রাষ্ট্র সব কিছুর মালিক। ব্যক্তি শুধু কাজ করবে আর রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নির্ধারিত ভাতা ও রেশন পাবে। এর বিপরীতে পুঁজিবাদে রয়েছে ব্যক্তির নিরঙ্কুশ মালিকানা। সব পন্থায় আপনি টাকা কামাতে পারেন। সব আপনার হয়ে যাবে। শুধু রাষ্ট্রীয় কিছু নিয়ম-নীতি মানলেই হবে। যেমন, চুরি-ডাকাতি না করা, নিয়মিত ট্যাক্স দেওয়া ইত্যাদি। না মানলেও সমস্যা নেই। তারাই আবার খুব সহজেই কালোকে সাদা করে দিবে।
এ দুটির বিপরীতে ইসলাম মাঝামাঝি কথা বলেছে। এখন বলেনি। এ দুটি মতবাদ পৃথিবীতে আসার বহু আগে বলেছে। তা হল, ব্যক্তি- মালিকানা দিতে হবে। তবে তা হবে নিয়ন্ত্রিত। একেবারে নেই তা নয়; আবার নিরঙ্কুশ মালিকানাও নয়। এখন প্রশ্ন : ক) নিয়ন্ত্রণ করবে কে? নিয়ন্ত্রিত শব্দ যখন বললাম, তখন বুঝলাম, একজন নিয়ন্ত্রক থাকবেন, কিছু নীতিমালার আওতায় তা নিয়ন্ত্রিত হবে।
এর জবাব হল, এর নিয়ন্ত্রক মহান আল্লাহ রাববুল আলামীন এবং তাঁর বেঁধে দেওয়া নীতিমালার আওতায় তা নিয়ন্ত্রিত হবে।
ইসলামী অর্থনীতির মালিকানা দর্শনের বিশ্লেষণ
ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা হল, পৃথিবীর সকল সম্পদের মালিকানা মহান আল্লাহর। সব কিছু তাঁরই সৃষ্টি। স্বয়ং আমাদের মালিকও তিনি। এরপর তিনি আমাদেরকে কিছু বিষয়ের নিয়ন্ত্রিত মালিকানা দিয়েছেন।
এটি প্রচলিত মালিকানা হস্তান্তরের মতো কোনো বিষয় নয় যে, হস্তান্তরের পর দাতার সাথে আর কোনো সম্পর্ক থাকে না। যাকে হস্তান্তর করা হয়েছে সে-ই এর নিরঙ্কুশ মালিক হয়ে যায়। বরং এখানে উদ্দেশ্য হল, কিছুদিনের জন্য একটি নিয়ন্ত্রিত মালিকানা দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি আরো সহজ করে যুক্তি দিয়ে বললে এভাবে বলা যায়, যত মৌলিক সম্পদ আছে যেমন-পানি, আগুন, মাটি ও বিভিন্ন খনিজ সম্পদ, বীজ ইত্যাদি। এসবের মালিকানা আল্লাহর। এগুলোর সৃষ্টিতে মানুষের হাত নেই। কৃষিবিদরা গবেষণা করে শুধু এটুকু বের করেন যে, উৎপাদন কিভাবে আরো বাড়ানো যায়। তারা বীজ তৈরি করেন না।
তদ্রূপ পানি ছাড়া উৎপন্ন হয় এমন জিনিস খুব কম। এই পানিও কেউ সৃষ্টি করতে পারে না। এমনিভাবে জমিনও সৃষ্টি হয় না। মোটকথা, এসব মৌলিক সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিকানা আল্লাহর। নিয়ন্ত্রিত মালিকানা হল মানুষের।
তিনি মানুষকে দুনিয়াতে পাঠানোর আগেই দুনিয়াকে প্রস্ত্তত করেছেন। এরপর পাঠিয়েছেন।
তিনি ইরশাদ করেছেন-
هو الذى جعل لكم الارض ذلولا فامشوا فى مناكبها وكلوا من رزقه واليه النشور
(তরজমা) তিনিই তো তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন। অতএব তোমরা এর দিগ-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তাঁর প্রদত্ত জীবনোপকরণ থেকে আহার্য গ্রহণ কর। পুনরুত্থান তো তাঁরই নিকট।-সূরা মুলক : ১৫
তিনি মালিকানা দিয়েছেন, সাথে মালিকানা ব্যবহারের কিছু নীতিও দিয়েছেন।
এটি ইসলামী অর্থনীতির একটি মৌলিক কথা যে, আমাদেরকে যা দিয়েছেন তা হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত মালিকানা। পবিত্র কুরআনের শুরুতেই বিষয়টি বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
ومما رزقنهم ينفقون
(তরজমা) তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দান করেছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।-সূরা বাকারা : ৩
উক্ত আয়াতে সংক্ষেপে ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক নির্দেশনা রয়েছে। তা এভাবে,رزقنا (আমি রিযিক দিয়েছি) এর থেকে স্পষ্ট যে, সম্পদের মৌলিক মালিকানা আল্লাহর।
هم (মানুষকে দিয়েছি) এতে বুঝা গেল, ব্যক্তি-মালিকানা আছে। সমাজতন্ত্রের মতো নয়। তবে এ মালিকানা নিয়ন্ত্রিত। পুঁজিবাদের মতো নিরঙ্কুশ নয়। তা من থেকে বুঝা গেল। অর্থাৎ মালিকানা দিয়েছেন এরপর বলেছেন, তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী এর এক অংশ নিজে ব্যবহার করবে আর আরেক অংশ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবে। সুতরাং এটি নিরঙ্কুশ নয়, নিয়ন্ত্রিত। বিষয়টি আরো বহু আয়াত ও হাদীসে বিস্তারিতভাবে এসেছে।
আমাকে এক ডক্টর ভদ্রলোক বলেছিলেন, আমাকে তিন মিনিটে ইসলামী অর্থনীতির উপর একটা বক্তব্য দিতে হবে। কিভাবে দিব আপনি শিখিয়ে দিন। আমি তখন এ আয়াতের কথা বলেছিলাম, যার মধ্যে সংক্ষেপে ইসলামী অর্থনীতির একটি মূলনীতি রয়েছে।
ইসলামী অর্থনীতির উৎস
কুরআন-সুন্নাহয় ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োজনীয় আলোচনা রয়েছে। হাদীসের কিতাবগুলোর একটি বৃহৎ অংশ মুআমালা বা অর্থনীতি সংক্রান্ত। তদ্রূপ ফিকহে ইসলামীর বৃহত্তর অংশ অর্থনীতি সংক্রান্ত। ৬ খন্ডের কিতাব হলে প্রথম খন্ডের কিছু অংশেই ইবাদাতের আলোচনা শেষ হয়ে যায়। বাকিগুলোতে সমাজ, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ের বিশদ আলোচনা থাকে।
মালিকানার নিয়ন্ত্রণগুলো কী কী
আমরা জানলাম, ইসলামী অর্থনীতির একটি মৌলিক কথা হল, ব্যক্তির মালিকানা আছে, তবে তা নিয়ন্ত্রিত। একটি নিয়ন্ত্রণ হল, মালিকানা অর্জনে সুদের উপাদান থাকা যাবে না। এর মাধ্যমে পুঁজিবাদ ও ইসলামী অর্থনীতির মাঝে তফাত হয়ে গেল। কেননা, পুঁজিবাদ শুরুই হয় সুদ দিয়ে এবং এর অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিই হল সুদ। পুঁজিবাদের সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড মৌলিকভাবে পরিচালিত হয় সুদের মাধ্যমে। বাংলাদেশে নাকি ২৮ হাজার কোটিপতি আছে। এদের অনেকেই ঋণখেলাপী। বহু লোক কোটিপতি হয়েছে সুদের মাধ্যমে। বড় কোনো ফ্যাক্টরি করতে চাইলে প্রজেক্ট লোন নেওয়ার কথা আছে। শেয়ারবাজারে ঋণ দেওয়ার জন্য আছে মার্চেন্ট ব্যাংক। ঘর বানাবেন, বা নিবেন এক্ষেত্রে লোন নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এভাবে পুঁজিবাদের সকল সেক্টরেই সুদ রয়েছে। মোটকথা, পুঁজিবাদে সুদ অনিবার্য। আর ইসলামে তা নিষিদ্ধ।
সুদ একটি অর্থনৈতিক আবর্জনা
সুদ একটি অর্থনৈতিক জঞ্জাল বা আবর্জনা। বর্তমানে অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্য এটি বড় দায়ী। এখন যারা ওয়ালস্ট্রিট দখল আন্দোলন করছে তারা মুসলমান নয়। তারা এজন্য আন্দোলন করছে না যে, সুদ বা পুঁজিবাদ ইসলামে নিষিদ্ধ। তারা আন্দোলন করছে এজন্য যে, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে গেছে। তারা বলছে, আমরা ৯৯% লোক। আমাদেরকে শাসন করছে ১% লোক।
বেশ কিছুদিন আগে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, পৃথিবীর ৯৯% সম্পদের মালিক হচ্ছে ১% লোক। আর মাত্র ১% সম্পদের মালিক বাকিরা। এতদিন পুঁজিবাদীরা সাধারণ মানুষকে ধোঁকায় রেখেছিল। এখন তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সম্পদ যেন কুক্ষিগত না হয় এ কথা ইসলাম বহু আগেই বলেছে, কুরআন মজীদে এসেছে-
كى لا يكون دولة بين الاغنياء منكم
(তরজমা) তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই যেন সম্পদ আবর্তন না করে।-সূরা হাশর : ৭
তোমাদের ধনী লোকদের মাঝে যেন সম্পদ ঘুরপাক না খায়।
পুঁজিবাদীরা বলছে, ব্যক্তি-মালিকানার কথা। কিন্তু মূল কথা হল, মাত্র ১% সম্পদ তোমাদের ৯৯% মানুষকে দিয়ে বাকিটার মালিক থাকব আমরা -সীমিত কিছু বিলিয়নিয়ার।
সুদভিত্তিক কারবারের স্বরূপ
পুরো বিশ্বে এখন সুদভিত্তিক কারবারের সয়লাব। এতে একপক্ষের লাভ নিশ্চিত থাকে। অপর পক্ষেরটা থাকে ঝুঁকিতে। যেমন-ব্যাংক লোন দেয় তবে রিস্ক নেয় না। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দার কারণ এটিই। আমেরিকায় ব্যাংকগুলো হাউজিং সেক্টরে ব্যাপকভাবে লোন দিয়েছে। কিন্তু এক সময় কিস্তি ফেরত আসেনি। তখন লোনগ্রহিতারা যে সিকিউরিটি দিয়েছিল তাকে পণ্য বানিয়ে ব্যাংকওয়ালারা সেকেন্ডারি মার্কেটে ছেড়ে দেয়। কিন্তু ততদিনে হাউজিং সেক্টরই ধ্বংস হয়ে গেছে। তখনি দেখা দেয় মন্দা। দেউলিয়া হয়ে পড়ে শত শত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সেদেশের সরকার তখন ১৬ হাজার কোটি ডলার অনুদান দিয়ে বড় বড় ব্যাংকগুলোকে অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল।
ধ্বংস অনিবার্য, তবে বিকল্প কী
মোটকথা, পুঁজিবাদের ধ্বংস শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু বিকল্প কী হবে? আমরা যদি আগে থেকেই রাস্তা পরিষ্কার করে রাখতাম, ইসলামী আন্তর্জাতিক বাজার, মুদ্রাবাজার এসব তৈরির প্রতি নজর দিতাম তাহলে এখন ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন করা সহজ হত। বিশেষ করে ওআইসি যদি আগেই এদিকে নজর দিত তাহলে এখন বিশ্ববাসীর কাছে তা সুস্পষ্ট মডেল হত।
আমি আগেই বলেছি, এত অল্প সময়ে ইসলামী অর্থনীতির মূল কথাগুলোও বলা সম্ভব নয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে সুদ, জুয়া, ফটকা, প্রতারণা, অন্যায়ভাবে গুদামজাত করা ও অসচ্ছতার সকল পথ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বাজারে অবাঞ্চিত হস্তক্ষেপ, অযৌক্তিকভাবে মূল্যবৃদ্ধি করা বা কমানো এবং সকল অবাঞ্চিত মধ্যসত্ত্বভোগে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। প্রচলিত কমিশন বাণিজ্যের অনেক কিছুই ইসলামী অর্থনীতির পরিপন্থী।
ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে সরকার হবে দেশের সেবক। মানুষের উপর অবাঞ্চিত কোনো কর চাপানোর অধিকার তাদের থাকবে না; বরং বিত্তহীন এতিম, বিধবা ও কর্মক্ষম দরিদ্র লোকদের অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে।
সম্মানিত উপস্থিতি
আয়োজকরা বলছেন, প্রশ্নোত্তরের সময় হয়ে গেছে। তাই এখানেই আমি আলোচনা শেষ করছি।
আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকলকে তাঁর দেওয়া বিধান অনুসরণ করে জীবন যাপনের তাওফীক দিন। আমীন।