Zilhajj 1432   ||   November 2011

ওয়ালস্ট্রিট দখল-আন্দোলন : পুঁজিবাদের পতন-ঘণ্টা ও আমাদের নিষ্ক্রিয়তা

Mufti Abul Hasan Muhammad Abdullah

তিন বছর পর আবার কেঁপে উঠেছে পুঁজিবাদী বিশ্ব। গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া ‘অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট’ বা ওয়ালস্ট্রিট দখল আন্দোলন নতুন করে ঘুম হারাম করে দিচ্ছে বিশ্ব পুঁজিপতিদের। ২০০৮ সনের অর্থনৈতিক মন্দা ও ধ্বংসের পর এটিই হচ্ছে পুঁজিবাদের উপর সবচেয়ে বড় আঘাত।

ওয়ালস্ট্রিট কী

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরীর একটি এলাকার নাম এটি। এই ওয়ালস্ট্রিট হচ্ছে পুঁজিবাদের গর্ব ও প্রতীক। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শেয়ারবাজার এখানেই অবস্থিত। দুনিয়ার বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থান এখানে। অর্থাৎ সর্ববৃহৎ স্টকএক্সচেঞ্জ ছাড়াও এখানে রয়েছে বৃহৎ ঋণ-বাজার, বন্ড-বাজার ও মুদ্রা-বাজার।

মোটকথা, বিশ্বের আর্থিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে নিউইয়র্ক শহর আর নিউইয়র্কের আর্থিক কর্মকান্ড কেন্দ্রীভূত হয়েছে এ ওয়ালষ্ট্রীটে।

এভাবেই এলাকাটি পুঁজিবাদের  প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

আন্দোলনের সূত্রপাত

সেপ্টেম্বর মাসের ১৭ তারিখ। একদল নারী-পুরুষ একত্রিত হয়েছে ওয়ালষ্ট্রীট সংলগ্ন জকোটি পার্কে। তারা হাতে বহন করছে ব্যানার ও প্লেকার্ড। তাতে লেখা রয়েছে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া। ওয়ালস্ট্রিট আমাদের ৯৯% কে খুন করছে। আমরাই ৯৯%, যুদ্ধ বন্ধ কর এবং ওয়ালস্ট্রিট দখল কর-জাতীয় কথাবার্তা। খুবই ছোট পরিসরে এ আন্দোলন শুরু হলেও ক্রমেই তা বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হতে থাকে এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। এ আন্দোলনকারীদের কোনো নির্দিষ্ট নেতা নেই। এরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এখানে জমা হয় এবং তাঁবু বানিয়ে সেখানে থাকা শুরু করে। শহর কর্তৃপক্ষের আইনে এখানে মাইক ব্যবহার নিষিদ্ধ তাই আন্দোলনকারীরা বেছে নিয়েছে প্রাচীন পন্থা। প্রথমে একজন কোনো একটি দাবি বা উক্তি করে। এরপর কাছাকাছি অন্যরা তাদের পার্শ্ববর্তীদের নিকট তা পৌঁছে দেয়। এভাবে পুরো পার্কজুড়ে সবাই একাত্ম ও একাকার হয়ে যায়। দূরে শব্দ পৌঁছে দেওয়ার এ পদ্ধতির নাম দিয়েছে তারা ‘হিউম্যান মেগা ফোন।’

আন্দোলনকারীরা পার্কেই ঘুমুচ্ছে, আবার ঘুম থেকে উঠেই আন্দোলন শুরু করছে। ছোটখাটো দোকানপাটও বসে গেছে সেখানে। যাতে থাকছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও খাবার-দাবার। এখন আর খানাপিনা নিয়েও তেমন ভাবতে হচ্ছে না এদের। আন্দোলনের সমর্থনকারীদের পাঠানো খাবার এবং আর্থিক অনুদানে এদের গুজারা হয়ে যাচ্ছে রাত দিন। এরা শুধু স্বদেশীদের সমর্থনই পাচ্ছে না; বরং বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই তাদের প্রতি সংহতি প্রকাশের জন্য প্রতিনিধি দল যাচ্ছে নিয়মিত।

বিশ্বব্যাপী আন্দোলন

ওয়ালস্ট্রিট দখল কর-আন্দোলনের বয়স এক মাস হওয়ার আগেই এটি ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বে। ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়িয়ে এখন বিক্ষোভ হচ্ছে আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতেও। আন্দোলনকারীদের মতে এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ১০০ দেশের এক হাজারেরও বেশি নগরীতে বিক্ষোভ হয়েছে। তার মধ্যে ইতালিতে আন্দোলন হয়েছে সহিংস ও বৃহৎ আকারে। দুই লাখেরও বেশি লোক সেখানে একত্র হয়ে বিক্ষোভ করেছে। তাদের সাথে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। মোটকথা, অল্পদিনের মধ্যেই এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।

কী তাদের দাবি

আন্দোলকারীদের দাবিগুলোর সারকথা হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে। ধনী-দরিদ্রের তফাৎ কমাতে হবে। যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। সরকারের সামাজিক ব্যয় কমানো যাবে না। ৯৯% লোকের সম্পদ ১% লোকের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে, তা চলতে দেওয়া যাবে না। বেকারত্ব দূর করতে হবে। বড় বড় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তাদের কর্তৃত্ব খর্ব করতে হবে ইত্যাদি। এবং এসব উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য দখলে নিতে হবে পুঁজিবাদের প্রতীক ওয়ালস্ট্রিট। যদিও নিউইয়র্ক পুলিশ তাদেরকে ওয়ালস্ট্রিটের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছেও ভিড়তে দেয়নি তথাপি দমে যায়নি এদের আন্দোলন। নিউইয়র্ক স্টকএক্সচেঞ্জে (বিশ্বের সর্ববৃহৎ শেয়ার বাজার) বিনিয়োগ শুরু হওয়ার ঘণ্টা বাজে সকাল ৯টায়। এরাও তাদের বিক্ষোভের সূচনা করে প্রতিদিন সকাল ৯টায় ঘণ্টা বাজিয়ে। 

   আমেরিকার অর্থনেতিক হালহাকীকত

বাংলদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অনেকের কাছে যুক্তরাষ্ট এখনো স্বপ্নের দেশ হলেও সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কিন্তু ভাল নেই।   সেখানে ৫ কোটিরও বেশি লোক চরম দারিদ্রে্যর মধ্যে বাস করছে। চাকুরি ছাড়া আয়-রোজগারহীন মানুষ প্রতি ১০ জনে ১ জন। স্বাস্থ্যবীমা নেই ৬ কোটিরও অধিক লোকের। অথচ এ দেশটিই ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম নিধন ও যুদ্ধের পিছনে ব্যয় করছে প্রতি দিন লাখ লাখ ডলার। অন্যদিকে পুরো আমেরিকার জাতীয় আয়ের ৬০% সম্পদের সমপরিমাণ অর্থের মালিক হচ্ছে সে দেশের মাত্র ৬টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। মাত্র ৪টি ব্যাংক ইস্যু করে থাকে দেশের সকল ক্রেডিট কার্ড। অর্থাৎ এ ব্যবসার আধিপত্য শুধু ৪টি প্রতিষ্ঠানের হাতে।

২০০৮-এর ঘটনা

এই ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই চরম আর্থিক সংকটে পড়েছিল ২০০৮ সনে। সীমাহীন

মুনাফার লোভ সেগুলোকে নিয়ে গিয়েছিল ধ্বংসরে মুখে। বন্ধও হয়ে গেছে ছোট বড় ১০০টিরও বেশি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

আর বড় বড়গুলোকে জিইয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ১৬ হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ বা আর্থিক সহায়তা। এত বিশাল অর্থ পেয়ে আবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছে ঐ রাঘব-বোয়াল প্রতিষ্ঠানগুলো।

এখন তারা মুনাফা করছে পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু ভাগ্য বদলায়নি সে দেশের সাধারণ জনগণের। তাদের হালত হয়েছে কঠিন থেকে কঠিনতর। বে-রোজগারি ও দারিদ্র্য তাদেরকে ধুঁকে ধুঁকে মারছে। আর স্বঘোষিত বিশ্বমোড়ল ঐ দেশের সরকারের  ঋণের পরিমাণ জানেন? তাদের পুরো জিডিপির সমপরিমাণ, যা ক্রমেই বাড়ছে। সুতরাং এদের ধ্বংস ও পতনের ব্যাপারে সংশয় থাকতে পারে কেবল সন্দেহবাদীদেরই।

অভিশপ্ত পুঁজিবাদ

সুদ, মুনাফাখোরী, ফটকাবাজি ও প্রতারণাভিত্তিক পুঁজিবাদি অর্থব্যবস্থা কখনো মানুষের জন্য কল্যাণকর ছিল না। অল্প কিছু লোকের পুরো পৃথিবীর সম্পদ কুক্ষিগত করার হাতিয়ার হয়ে আছে এ ক্যাপিটালিজম বা পুঁজিবাদ। বড় মাছ যেমনিভাবে ছোট ছোট মাছগুলোকে খেয়ে ফেলে তেমনিভাবে সাধারণ লোকজনের সম্পদ হাতিয়ে নেয় মুষ্ঠিমেয় কিছু পুঁজিপতি ও তাদের মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো। সুদখোর ইহুদীকেন্দ্রিক এবং অনেকটাই তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা শুধু গরীব তৃতীয় বিশ্বেরই নয়; বরং আমেরিকারও সর্বনাশ ডেকে আনছে। পুঁজিবাদীরা যেমনিভাবে নিজের দেশের জনগণকে শোষণ করে তেমনিভাবে অন্যান্য দেশের উৎপাদন ও খনিজ সম্পদ দখলের চেষ্টায় মেতে ওঠে। ভিন দেশের মূল্যবান সম্পদ দখলের জন্য প্রয়োজনে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, স্বৈরাচার দমনের অজুহাতে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে তাদের অনুগত ও সেবাদাস দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীনদের অবৈধ হাজার হাজার কোটি ডলার নিজেদের ব্যাংকে নিয়ে তা দিয়ে মুনাফা কামায়।

আবার বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এবং তাদের সেবাদাস অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে ক্ষুদ্র আয়ের দেশগুলোকে অসংখ্যা অবমাননাকর  শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ করে ঋণ বিলিয়ে হাতিয়ে নিয়ে থাকে চড়া সুদ। আবার তাদেরই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার করে স্বল্প আয়ের দেশগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য ও তেল-গ্যাস ইত্যাদি খনিজ সম্পদের উপর। সুতরাং অভিশপ্ত এ নীতির ক্ষয়-ক্ষতি ও কু-প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়াই স্বাভাবিক।

প্রতারণা আর প্রতারণা

বিগত শতাব্দী থেকে তিনটি শব্দ পুরো বিশ্বের মানুষকে ধোঁকা ও প্রতারণার বেড়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছে : ১) গণতন্ত্র, ২) মুক্তবাজার অর্থনীতির লেবাসধারী পুঁজিবাদ ও ৩) মানবাধিকার।

জনগণের শাসনের শ্লোগান তুলে ও গণতন্ত্রের কথা বলে পূর্ব থেকে পশ্চিম-পৃথিবীর দেশে দেশে চলছে এখন সংখ্যা লঘিষ্ট মুষ্টিমেয় দুর্নীতিবাজ ও একনায়কদের শাসন। নিজেদের সাজানো নির্বাচন ও সংসদ ইত্যাদিকে বাহানা বানিয়ে জনপ্রতিনিধিত্বের নামে পালাক্রমে তারা শাসন করে যাচ্ছে বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষকে। তথাকথিত গণতন্ত্রের কারিশমায় এখন অনেক দেশেই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, এমপি, মেয়র, মন্ত্রী, উপদেষ্টা হচ্ছে স্বীকৃত দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ও শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোটিপতি ব্যবসায়ীরা।

আর তাদের তথাকথিত মানবাধিকার কাজে লাগছে চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী একনায়কদের রক্ষা, নারীকে পণ্যে পরিণত করা, বিশ্বব্যাপী মিডিয়া সন্ত্রাস সৃষ্টি এবং মুসলমান ও ইসলামপন্থীদের দমনের ক্ষেত্রে।

অন্যদিকে মুক্তবাজার অর্থনীতিকে হাতিয়ার বানিয়ে দেশে দেশে সীমাহীন অর্থসম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছে মুষ্ঠিমেয় কিছু লোক, যার দরুণ তৈরি হচ্ছে মারাত্মক আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য। নিউইয়র্কে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু ঢাকা শহরের চারদিকে একটু নজর বুলালেই এ বৈষম্যের প্রমাণ পাওয়া যাবে। পুঁজিপতিরা কখনো ব্যবসা-বাণিজ্যের অসম প্রতিযোগিতা, কখনো শেয়ারবাজার, কখনো ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আবার কখনো পেপার-পত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে মজার মজার কথা বলে ও বলিয়ে প্রতারিত করছে সাধারণ জনগণকে। শেয়ারবাজারসহ যেখান থেকেই পারছে সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

মানুষ এখন বোঝে

দীর্ঘ দিন মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখলেও এখন অনেক সাধারণ মানুষও তাদের অপকৌশলগুলো বুঝে গেছে। তাই তো ওয়ালস্ট্রিট বিরোধী আন্দোলন। ওয়ালস্ট্রিটসহ পুরো বিশ্বের পুঁজিবাদের আখড়াগুলো দখলে নেওয়ার আহবান এবং সাধারণ জনগণের ক্ষমতা দখলের প্রত্যয়।

তারা কি জিতবে

প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলনের পরিণতি কী হবে? তারা কি ঘটাতে পারবে পুঁজিবাদের পতন? নাকি ব্যর্থ হয়ে ঘরে ফেরত যাবে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ আগুন বাড়বে বৈ কমবে না। যদিও বরাবরের মতো পুঁজিবাদীরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করার চেষ্টা করবে। হয়ত যুক্তরাষ্ট্রে এই সাধারণ জনগণকে উদ্দেশ্য করে কোনো অর্থনৈতিক প্যাকেজও ঘোষিত হতে পারে। নিজেদের নিয়ন্ত্রিত কর্পোরেট মিডিয়াগুলো (বড় ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন পেপার-পত্রিকা, রেডিও-টিভি ইত্যাদি) ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার আরো মজবুত করবে, যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। তাদের কিছু লোককে ভয় ও লোভ দেখিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টাও হতে পারে। আশ্রয় নেওয়া হতে পারে আরো বহুমুখী চালাকির। কিন্তু এ অভিশপ্ত মানবতাবিরোধী নীতির শেষ রক্ষা হবে বলে মনে হয় না।

তাহলে বিকল্প কী

অর্থনীতির বিকল্প পথ নয়; বরং আসল এবং মূলনীতি তো চৌদ্দশত বছর আগে থেকেই ঘোষিত আছে। ইসলামের মহাসড়কে প্রবেশ করলেই সেই রাস্তা সামনে পড়বে। মুক্তিকামী মানুষ পেয়ে যাবে আলোর দিশা।

পুঁজিবাদের যে সকল ত্রুটির কারণে বিশ্বব্যাপী সাধারণ জনগণ আন্দোলনমুখর হয়ে উঠেছে ইসলামী অর্থনীতি গোড়া থেকেই সে সবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। মুষ্টিমেয় হাতে সম্পদ ঘুরপাক খাওয়ার বিরুদ্ধে সূরাতুল হাশরে উচ্চারিত হয়েছে আল্লাহ তাআলার বাণী। পৃথিবীর সকল সম্পদের মালিকানা একচ্ছত্রভাবে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর। সে সম্পদে অধিকার রয়েছে বঞ্চিত, দরিদ্র ও অনাথদের-এমন ঘোষণা এসেছে কুরআনের বহু জায়গায়।

সুদ, জুয়া, মুনাফাখোরি, মজুতদারি, ফটকাবাজি, সিন্ডিকেটেশন, প্রতারণা, অপকৌশল প্রয়োগ ও চোরাগুপ্তা পথে সম্পদ আহরণের সকল পন্থা নিষিদ্ধ হয়েছে কুরআন ও হাদীসে। নিশ্চিত করা হয়েছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল মানুষের অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থানের বিষয়টি। সুতরাং ওয়ালস্ট্রিট তথা পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলনকারীরা যে বৈষম্য দূর করতে চাচ্ছে ইসলামী অর্থনীতিতে তা সৃষ্টি হওয়ারই সুযোগ নেই।

আমাদের নিষ্ক্রিয়তা

কিন্তু আমরা মুসলমানরা কি প্রস্ত্তত অভিশপ্ত পুঁজিবাদকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে কোনো আদর্শ অর্থনীতি গ্রহণের জন্য? যখন ক্ষেত্র পুরো প্রস্ত্তত, বিশ্বের আপামর জনসাধারণ যখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় তখন মুসলমান শাসকগোষ্ঠি, ওআইসি, ইসলামী অর্থনীতির বিশেষজ্ঞগণ, আলেম-ওলামা, মুবাল্লিগণ তথা আমরা মুসলমানরা কি তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি? পুরো বিশ্বের এতগুলো মুসলিম-রাষ্ট্রের কেউ তো তাদের দেশে সে নীতির অনুসরণ করছে না। শিক্ষা ও সংস্কৃতির মতো তারা নিজেদের অর্থনীতিকেও বাদ দিয়েছে।

ওআইসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে। এ সময়ের মধ্যে কি তারা ইনসাফপূর্ণ আন্তর্জাতিক ইসলামী বাজার, ইসলামী মুদ্রাবাজার প্রচলন করতে পারত না। আইডিবিসহ ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রচলনের সময় পার হয়ে গেছে ৪ দশক কাল। কিন্তু ব্যাংকগুলো হেঁটেছে হীলা-তাবীলপূর্ণ মুরাবাহা, ইজারা পথেই। ঝুঁকিমুক্ত সম্পদ কুক্ষিগত করার রাস্তাই যে পথে প্রসারিত হয়। তারা কি আংশিকভাবেও চলতে পারত না সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণের অন্যতম মাধ্যম মুযারাবা, মুশারাকার মহাসড়কে? তারা কি এ ৪০ বছরে মুসলমান বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের ইসলামী অর্থনীতির আদর্শ বৈশিষ্টগুলো বুঝিয়ে তাদেরকে সে পথে অগ্রসর করতে পারত না?

অন্যদিকে আমরা যারা ইসলামের দাঈ, আলেম-উলামা বা মুবাল্লিগ তারাও কি নিজ নিজ দায়িত্ব আদায় করে চলেছি? পুঁজিবাদী অর্থনীতির কুফল এবং ইসলামী অর্থনীতির সুফল সম্পর্কে আমরা কতটুকু জনসচেতনতা সৃষ্টি করেছি। আমরা যারা দ্বীনদার বা আলেম বলে পরিচিত তাদের লেনদেন, কায়-কারবার ও ব্যবসা-বাণিজ্য কতটুকু শরীয়তসম্মত ও ইসলামের আদর্শ নীতি অনুযায়ী হচ্ছে তার মূল্যায়ন কি আমরা করছি? নিশ্চয় এসব কিছুর উত্তরই নেতিবাচক। যার দরুণ প্রস্ত্তত ক্ষেত্র পেয়েও আমরা বিশ্বের দিশেহারা জনগণের কাছে ইসলামের অর্থনৈতিক আদর্শ পৌঁছে দিতে পারছি না।

আমার তো মনে হয়, পুঁজিবাদের পতনে বিলম্ব যা হওয়ার তা হবে আদর্শ বিকল্পের অভাবে। মানুষ আন্দোলন করছে, কিন্তু তারা জানে না, বিকল্প

রাস্তা কোনটি। এ নিষ্ক্রিয়তার জন্য আমরা শুধু নিজেদেরকেই ভৎর্সনা করতে পারি। এর জন্য এখন দায়ী করতে হবে সর্বপ্রথম নিজেদেরকেই। শত্রুকে দুর্বল পেয়েও যারা জয় ছিনিয়ে নিতে পারে না তারা অভাগা নয় কি?

সুতরাং

ওআইসি, মুসলিম রাজা-বাদশাহ, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীদের যদি বাগে আনা না যায় তবে নিজেরাই সাধ্য অনুযায়ী শুরু করি। নিজেদের লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য শরীয়ার মৌলিক নীতি অনুযায়ী করি। অলি-গলি ও হীলার পথে না যাই। জনগণকে বলা, লেখা ও মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামী অর্থনীতির যথার্থতা ও বৈশিষ্ট্য বোঝাতে সচেষ্ট হই। এভাবে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে পারলে ক্ষমতাসীনরাও একদিন বদলাতে

বাধ্য হবে।

 

advertisement