আল্লাহর যিকির : সুফল ও উপকারিতা
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. যিকিরের ফযিলত সম্পর্কে ‘আলওয়াবিলুছ ছাইয়িব’ নামে একটা কিতাব লিখেছেন। তাতে যিকিরের ফায়দা ও ফযিলত সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। ঐ কিতাবে তিনি যিকিরের একশরও বেশি ফায়দা উল্লেখ করেছেন। কিছু ফায়দা এখানে তুলে ধরা হল।
১. যিকির শয়তানকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং তার শক্তি নষ্ট করে দেয়।
২. আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয়।
৩. দুশ্চিন্তা দূর করে।
৪. প্রশান্তি দান করে।
৫. অন্তর ও শরীরে শক্তি যোগায়।
৬. চেহারা ও অন্তরকে নূরানী করে।
৭. রিযিকে বরকত আনে।
৮. যিকিরকারীর মাঝে মাধুর্য ও গাম্ভীর্য সৃষ্টি করে।
৯. আল্লাহর মহববত পয়দা করে। আর মহববতই হচ্ছে ইসলামের রূহ দীনের কেন্দ্র এবং মুক্তি ও সৌভাগ্যের উপায়। যে ব্যক্তি আল্লাহর মহববত পেতে চায় সে যেন বেশী বেশী যিকির করে।
১০. যিকির মোরাকাবার পক্ষে সহায়ক, যা যিকিরকারীকে এহসানের মাকামে পৌঁছে দেয়। আর এই মাকামে পৌঁছলে বান্দার এমন ইবাদত নছীব হয় যেন সে আল্লাহকে দেখছে।
১১. যিকির মানুষকে আল্লাহমুখী করে। ঘরে বাইরে তার হালত এমন হয় যে, সকল বিষয়ে আল্লাহ তাআলাকে্ই সাহায্যকারী মনে করে এবং যাবতীয় বিপদ আপদে তাঁরই আশ্রয় গ্রহণ করে।
১২. আল্লাহর নৈকট্য হাসিল হয়। যিকির যত বেশী হবে নৈকট্যও তত বৃদ্ধি পাবে। আর যিকির থেকে যতই গাফলতি করা হবে ততই আল্লাহ থেকে দূরে সরে যাবে।
১৩. আল্লাহর মারেফাতের দরজা খুলে যায়।
১৪. অন্তরে আল্লাহর ভয় ও বড়ত্ব সৃষ্টি হয় এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাকে দেখছেন, এই অনুভূতি সৃষ্টি হয়।
১৫. স্বয়ং আল্লাহ যিকিরকারীকে স্মরণ করেন।
১৬. দিলকে জিন্দা করে।
১৭. যিকির হল দিল ও রূহের গিযা। খাদ্যের অভাবে শরীর যেমন দুর্বল হয়ে পড়ে, তেমনি যিকিরের অভাবে দিলও মৃতপ্রায় হয়ে যায়।
১৮. দিলের মরিচা দূর করে। দিলের মরিচা হল খাহেশাত ও গাফলত। যিকির তওবা, ইস্তেগফারের মাধ্যমে তা দূর হয়।
১৯. গুনাহ মাফ হয়। কারণ যিকির হল সর্বোত্তম নেক আমলসমূহের অন্যতম। আর নেক আমলের মাধ্যমে গুনাহ মাফ হয়ে থাকে।
২০. আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করে এবং সম্পর্কহীনতা দূর করে। গাফিল আল্লাহ থেকে দূরে থাকে, শুধু যিকিরের মাধ্যমেই এই দূরত্ব দূর হয়।
২১. বান্দা তার প্রতিপালকের যে সমস্ত তাসবীহ আদায় করে যে কারণে কঠিন মুহূর্তে আল্লাহ তাকে স্মরণ করবেন।
২২. যে ব্যক্তি সুখ ও সচ্ছলতায় আল্লাহকে স্মরণ করে, দু:খ ও মুছিবতে আল্লাহ তাকে স্মরণ করেন।
২৩. যিকির আল্লাহর আযাব থেকে নাযাত দান করে।
২৪. যিকিরের কারণে ছাকিনা ও রহমত নাযিল হয়। ফেরেশতারা চতুর্দিক থেকে যিকিরকারীকে ঘিরে রাখে।
২৫. যিকিরের বরকতে গীবত, চোগলখুরী, মিথ্যাকথা, বেহুদা কথা ইত্যাদি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, যিকিরে অভ্যস্ত ব্যক্তি এই সব কাজ কর্মে লিপ্ত হয় না। পক্ষান্তরে যিকিরের বিষয়ে উদাসীন লোকেরা এই সব কর্মে লিপ্ত থাকে।
২৬. যিকিরের মজলিস ফেরেশতাদের মজলিস। আর গাফলতি ও বেহুদা কথাবার্তার মজলিস হল শয়তানের মজলিস।
২৭. যিকিরের কারণে যেমন যিকিরকারী উপকৃত হয় তেমনি আশেপাশের লোকেরাও উপকৃত হয়। আর বেহুদা কথাবার্তায় লিপ্ত ব্যক্তি নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তার আশেপাশের লোকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২৮. যিকিরকারী কেয়ামতের দিন আফসোস করবে না। হাদীসে আছে, যে মজলিসে আল্লাহর যিকির হয় না। কেয়ামতের দিন তা আফসোস ও ক্ষতির কারণ হবে।
২৯. নির্জনে আল্লাহর স্মরণে যার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে সে কেয়ামতের দিন আরশের শীতল ছায়ায় স্থান পাবে। যখন মানুষ প্রচন্ড গরমে ছটফট করতে থাকবে।
৩০. দোয়াকারী দোয়ার মাধ্যমে যা কিছু পায় যিকিরকারী যিকিরের কারণে তার চেয়ে অনেক বেশি পায়।
৩১. যিকির যদিও সহজ ইবাদত কিন্তু তা সমস্ত ইবাদত থেকে উওম। সহজ এই জন্য যে, শুধু যবান নড়াচড়া করা সমস্ত অঙ্গ-পতঙ্গ নড়াচড়া করা থেকে সহজ।
৩২. আল্লাহর যিকির জান্নাতের চারাগাছ।
৩৩. যিকিরের মাধ্যমে যত পুরুস্কার ও ছওয়াব পাওয়া যায়। অন্য কোন আমলের দ্বারা তা পাওয়া যায় না।
৩৪. যে সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করে আল্লাহ তাকে রহমতের সাথে স্মরণ করেন। আর যে আল্লাহকে ভুলে যায় আল্লাহও তাকে ভুলে যান। আল্লাহ যাকে ভুলে যান দুনিয়া ও আখেরাতে তার চেয়ে দুর্ভাগা আর কে হতে পারে? সুতরাং যিকির হল সৌভাগ্য লাভ করার ও দুর্ভাগ্য থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়।
৩৫. যিকির মানুষকে সর্বাবস্থায় আল্লাহর রেযামন্দির পথে ধাবমান রাখে। বিছানায়, বিশ্রামে, সুস্থতায়, অসুস্থতায়, দুনিয়ার কাজকর্মে সর্বাবস্থায় যিকিরের মাধ্যমে উন্নতির পথে চলমান থাকা সম্ভব। যিকির ছাড়া আর কোন আমল নেই, যা সর্বাবস্থায় জারি রাখা যায়। ফলে যিকিরকারী বিছানায়, বিশ্রামরত অবস্থায় ও ঐ ব্যক্তির চেয়ে অগ্রগামী হয়ে যায়, যে গাফেল অবস্থায় রাত্রী জাগরণ করে।
৩৬. যিকির দুনিয়ার জীবনে নূর ও আলো, কবরের জগতে নূর ও আলো এবং আখেরাতে ও পুলসিরাতে নূর ও আলো। অন্য কিছুই বান্দাকে এত নূর ও নূরানিয়াত দান করে না।
৩৭. আল্লাহর স্মরণ ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়।এটি আল্লাহওয়ালাদের তরীকা এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উপায়।অতএব যিকিরের দরজা যার জন্য উন্মুক্ত হয়েছে তার জন্য আল্লাহর নৈকট্যের দরজা উন্মুক্ত হয়েছে। অতএব সে যেন যাহেরী ও বাতেনী পবিত্রতা অর্জন করে এবং আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করে। যে আল্লাহকে পেল সে সব পেল আর যে আল্লাহকে পেল না সে কিছুই পেল না।
৩৮. অন্তরের একটি চাহিদা আছে, যা যিকির ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে পূরণ হয় না। যিকির যখন অন্তরে বদ্ধমূল হয় এবং অন্তরই হয় প্রকৃত যিকিরকারী। আর যবান হয় তার অনুসারী,তখন তা শুধু অন্তরের চাহিদাকেই পূরণ করে না বরং যিকিরকারীকে সম্পদ ছাড়াই ধনী করে দেয়। আত্মীয়-স্বজন ও জনবল ছাড়াই শক্তিশালী বানিয়ে দেয় এবং ক্ষমতা ছাড়াই প্রভাবশালী বানিয়ে দেয়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি যিকির থেকে গাফেল সে ধন সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন ও রাজত্ব থাকা সত্ত্বেও লাঞ্ছিত, অপমানিত ও শক্তিহীন হয়ে যায়।
৩৯. যিকির বিক্ষিপ্তকে একত্র করে এবং একত্রকে বিক্ষিপ্ত করে। দূরবর্তীকে নিকটবর্তী করে এবং নিকটবর্তীকে দূরবর্তী করে।বিক্ষিপ্তকে একত্র করার অর্থ হল, মানুষের ইচ্ছা, সংকল্প ও একগ্রতা ফিরিয়ে দেয় এবং তা শক্তিশালী করে। আর একত্রকে বিক্ষিপ্ত করার অর্থ মানুষের অন্তরের দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী দূর করে দেয়। যিকিরের মাধ্যমে পেরেশানি দূর হয় এবং অন্তরে প্রশান্তি আসে। তেমনি কৃতকর্মের ফলে যে পাপরাশি একত্র হয়েছে যিকির তা দূর করে এবং আমলনামাকে পাপমুক্ত করে। তেমনি শয়তানের যে বাহিনী মানুষকে ঘেরাও করে যিকির তাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। মানুষ যত আল্লাহর পথে আগুয়ান হয় এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কে গড়তে সচেষ্ট হয়, ততই শয়তান তার বাহিনীকে মানুষের প্রতি ধাবিত করে। যিকির ছাড়া এই বাহিনীকে পরাস্ত করার আর কোনো উপায় নেই।
৪০. যিকির মানুষের অন্তরকে নিদ্রা থেকে জাগ্রত করে। অন্তর যখন ঘুমন্ত থাকে তখন সে লাভ ও পুঁজি দুটো থেকেই বঞ্চিত থাকে। এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর যখন সে জাগ্রত হয় এবং কী হারিয়েছে তা বুঝতে পারে তখন ক্ষতিপূরণের জন্য কোমর বাঁধে। গাফলত ও উদাসীনতার গভীর নিদ্রা থেকে যিকিরই মানুষকে জাগ্রত করতে পারে।
৪১. যিকির একটি বৃক্ষ তাতে মারেফাতের ফল ধরে। আল্লাহর মারিফাত ও মহববতই হচ্ছে আল্লাহ প্রেমীদের পরম লক্ষ। সুতরাং যিকির এই লক্ষ্য পূরণের প্রধান অবলম্বন। যিকির বৃক্ষ যত বড় হবে তাতে তত বেশি ফল ধরবে।
৪২. যিকির প্রথমে মানুষকে জাগ্রত করে তারপর তাকে তাওহীদ পযন্ত পৌঁছে দেয়।যা সকল মাকাম ও মারিফাতের মূল।
৪৩. যে আল্লাহর যিকির করে আল্লাহ তার সঙ্গে থাকেন। অর্থাৎ তাকে ভালবাসেন এবং তার সাহায্য করেন।
৪৪. যিকির গোলাম আযাদ করা, আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা ও মুজাহিদকে সওয়ারী দ্বারা সহযোগিতা করার সমতুল্য।
৪৫. যিকির হচ্ছে শোকর গোযারির প্রধান উপায়। যে ব্যক্তি আল্লাহর যিকির করে না প্রকৃতপক্ষে সে তার শোকর আদায় করেনা।
৪৬. আল্লাহর নিকট ঐ মুত্তাকি বান্দা বেশি সম্মানিত যার যবান আল্লাহর যিকিরে তরতাজা থাকে। যে আল্লাহর ভয়ে তার আদেশ নিষেধ মেনে চলেছে এবং সর্বদা আল্লাহর যিকির করেছে । তাকওয়া ও পরহেযগারের কারণে আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন। এবং জাহান্নাম থেকে নাযাত দিবেন । এটা হল তার কর্মের প্রতিদান। আর যিকিরের কারণে সে লাভ করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য। এটা হল তার বিশেষ মর্যাদা।
৪৭. মানুষের অন্তরের কাঠিন্য যিকির ছাড়া অন্য কিছুর দ্বারা দূর হয় না। তাই বান্দার কর্তব্য দিলের কাঠিন্যকে আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমে দূর করা।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)