বাইতুল্লাহর ছায়ায় - ১৪
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হোটেলের নির্জন ছাদে অন্ধকার আকাশে তারকার প্রদীপমালার আলোতে আমি যেন দেখতে পেলাম, স্পষ্ট করে দেখতে পেলাম আমার আগামী দিনের ভাগ্য। আমি যেন সন্তুষ্টির একটি পবিত্র হাসির ‘অদৃশ্য ঝিলিক’ উপহার পেলাম আলোর আড়ালের ‘আলো’ থেকে, যে আলোর দ্যুতি ছাড়া জগতের সকল আলো শুধু অন্ধকার।
চাঁদ নেই তবু মনে হলো, আকাশে কত যেন আলো! পৃথিবীটা যেন কেমন জোসনা-ধোয়া! সেই শিশিরঝরা জোসনার সিণগ্ধ পরশে আমার সমগ্র সত্তা যেন সণাত হলো। মুহূর্তের মধ্যে মনের সব দ্বিধা-সংশয়ের অবসান হলো। পুরো ছাদটা যেন বসন্তের বাগান হয়ে গেলো। আমি যেন সবুজ হলাম, সজীব হলাম এবং সুবাসিত হলাম। হৃদয় যখন এমন স্বস্তি ও আশ্বস্তি, এমন শান্তি ও প্রশান্তি লাভ করে নিজেকে বড় সুখী, বড় সার্থক মনে হয়।
সুখের একটি অনির্বচনীয় তরঙ্গপ্রবাহ নিয়ে আমি ধীরে ধীরে ছাদ থেকে নেমে এলাম, আর ঠিক তখন শুনতে পেলাম যেন কোন ফিরেশতার নূরানি আওয়ায! ‘হাজী ছাহেবান, তৈয়ার; এখনই রওয়ানা হবে কাফেলা!’
সিঁড়ির কয়েক ধাপ নেমে মনে হলো, নাহ, তারাঝলমল আকাশটা আবার দেখে আসি! শান্তি ও প্রশান্তির ঐ নির্জন ছাদে কৃতজ্ঞতার একটু চিহ্ন রেখে আসি!
ফিরে এলাম ছাদে। শোকরের একটি সিজদা করলাম শিশিরসিক্ত ভূমিতে। তারপর আকাশ দেখলাম, আকাশের তারা দেখলাম এবং আলোর ঝিলিমিলি দেখলাম। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো আনন্দের অশ্রু। আমি হেসে উঠলাম অশ্রু-ধোয়া হাসি, আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার হাসি। তোমার শোকর হে আল্লাহ! আমি জানতাম, তুমি ডাকবে হে আল্লাহ! মেহমানকে তুমি কি ফেলে রাখতে পারো পথের ধূলায় অবহেলায়! এ শুধু তোমার লীলাখেলা! আনন্দের অনুভূতিকে আরো গভীর করার জন্য বেদনার একটু পরশ বুলিয়ে দেয়া! শীতল পানীয়ের স্বাদ বাড়িয়ে দেয়ার জন্য পিপাসাকে আরো উসকে দেয়া! আমি খুশী হে আল্লাহ! আমি কৃতজ্ঞ হে আল্লাহ! ফকীর বান্দার এই একটু শোকর ও কৃতজ্ঞতা তুমি গ্রহণ করো হে আল্লাহ!
পুরো হোটেলে তখন সাজসাজ রব; ‘চলো চলো’ ধ্বনি! বড় ভালো লাগলো এ সজীবতা, এ উচ্ছ্বাস, এ চঞ্চলতা! এতক্ষণ যেন প্রাণ ছিলো না এখানে: এখন যেন প্রাণের একটা উষ্ণ প্রবাহ!
কামরায় এসে দেখি, ইমাম ছাহেব হাম্মামে প্রস্ত্তত হচ্ছেন, আর শিকদার সাহেব কাঁদছেন। মানুষটা যেন সারা জীবনের হাসি-আনন্দের সব মলিনতা কান্নার পবিত্রতা এবং অশ্রুর শুভ্রতা দিয়ে ধুয়ে মুছে তবে ক্ষান্ত হবেন, শান্ত হবেন।
কেন এ কান্না, কেন এ চোখের পানি, তা কি আর জিজ্ঞাসা করতে হয়! তবু প্রশ্নটা এসে গেলো ঠোঁটের ফাঁকে, কী হলো? কাঁদছেন কেন? এখন তো খুশির খোশখবর এসে গেছে!
তিনি বললেন, নিজের জীবনের উপর আফসোস করছি। অর্থ ছিলো, বিত্ত ছিলো, যৌবন ছিলো এবং অটুট স্বাস্থ্য ছিলো, কিন্তু যিনি সব দিয়েছেন তাঁকেই ভুলে ছিলাম! দুনিয়ার মোহে এবং জীবনের ছলনায় বেহুঁশ ছিলাম। আজ সর্বস্ব হারিয়ে মাযূর অক্ষম হয়ে চলেছি তার ঘরের যিয়ারাতে। হায়, পূর্ণ যৌবন, আর অটুট স্বাস্থ্যের সময় যদি একটু হুঁশ হতো! তখন যদি আল্লাহর ঘরে রওয়ানা হতাম!
বলছেন, আর কাঁদছেন! আমি শুনছি, আর কান্নার সৌন্দর্য দেখছি! শিশুর কান্না সুন্দর, কারণ সে কান্না নিষ্পাপ। বড়দের কান্নাও হতে পারে সুন্দর, অনেক সুন্দর, যদি থাকে তাতে পাপের অনুতাপ। আমি তার মাথায় হাত রাখলাম। ধীরে ধীরে কিছু কথা বলে সান্তবনা দিলাম, বললাম, অনুতাপদগ্ধ হৃদয় আল্লাহর বড় প্রিয়। অনুতাপের উত্তাপে বিগলিত অশ্রু আল্লাহর কাছে খুব মূল্যবান। ইনশাআল্লাহ দেখবেন, আপনার মাযূর বয়সের হজ্ব আল্লাহর কাছে যৌবন বয়সের হজ্বের চেয়ে বেশী কবুল হবে। তিনি তো দেয়ার জন্যই ডেকেছেন, মাহরূম করার জন্য নয়। তিনি না ডাকলে আপনি এভাবে ঘর থেকে বের হতে পারতেন!
সান্ত্বনার কথা শুনে শিকদার সাহেব শান্ত হলেন। আমার খুব ভালো লাগলো দগ্ধ হৃদয়ে সান্ত্বনার একটু প্রলেপ দিতে পেরে। এক অনুতপ্ত বান্দার মাথায় কোমলভাবে একটু হাত রেখেছি; কিছু সান্ত্বনার কথা বলেছি; তাঁর ক্ষমা ও করুণার এবং দয়া ও রহমতের কিছু আশ্বাসবাণী শুনিয়েছি, আল্লাহর যদি এটা ভালো লাগে! খুশী হয়ে আল্লাহ যদি বলেন, আয় বান্দা, কাছে আয়! অাঁচল পেতে দাঁড়া; তুইও কিছু নিয়ে যা!
***
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো সফরে একটি বিষয় বড় মর্মপীড়ার কারণ ছিলো; আমাদের তাড়াহুড়া, হৈচৈ ও হুলস্থুল অবস্থা। সববিষয়ে দেখেছি, আমাদের সবার আগে যাওয়ার প্রবণতা এবং কাউকে সামান্য ছাড় না দেয়া, বরং কতকটা যেন ইচ্ছে করে অন্যকে কষ্ট দেয়ার মানসিকতা। এমনিতেই তো এগুলো বড় দোষের কথা, তার উপর হজ্বের সফরে! এটা তো হজ্বের পবিত্রতাকে ভীষণভাবে ক্ষুণ্ণ করে! ‘আল্লাহর আশিক’ তকমা এঁটে বাইতুল্লাহর সফরে যারা রওয়ানা হয়েছেন তাদের এ আচরণ কি কোনভাবেই সঙ্গত! প্রত্যেকেরই কর্তব্য যথাসম্ভব শান্ত, সংযত ও সুশৃঙ্খল আচরণের গন্ডীতে থাকার চেষ্টা করা। এ সফর তো জীবনে বারবার হবে না, অথচ এর স্মৃতি সারা জীবনের! এর বরকত দুনিয়া ও আখেরাতের! এমন কষ্টভোগের সুযোগ তো বারবার আসে না, অথচ এর সুফল সারা জীবনের, দুনিয়া ও আখেরাতের! কিন্তু আমরা ভুলে যাই এবং মনে হয় ভুলে থাকতে চাই।
হোটেলে আসার সময় আমাদের তাড়াহুড়া ছিলো, কে কার আগে আসবে! কে কার আগে কামরা পাবে! হোটেল থেকে বের হওয়ার সময়ও হুলস্থুল, কে কার আগে বের হবে! কে কার আগে বাসে ওঠবে! আল্লাহর ঘরের যাত্রিদের জন্য এ দৃশ্য কীভাবে শোভনীয় হতে পারে! আমাদের কাফেলার আমীর ইমাম ছাহেব এ বিষয়ে খুব ধীর স্থির। ফলে আমরা কামরায় এসেছিলাম সবার পরে, বেরও হলাম সবার পরে, আর উঠলাম একেবারে শেষ বাসে।
দিনের দুপুর থেকে রাতের এই শেষভাগ পর্যন্ত কত কিছু হলো, কত কিছু ঘটলো! একটু আগের কথা জানি; একটু পরের কিছুই জানি না! জীবন কত অনিশ্চিত! তবু জীবন কত সুন্দর! হয়ত জীবনের অনিশ্চয়তার মধ্যেই জীবনের সৌন্দর্য! অনিশ্চয়তার জন্যই তো পরম সত্তার কাছে আত্মসমর্পণে এমন আত্মতৃপ্তি!
শেষ রাতের নির্জন পথে গাড়ী যখন রওয়ানা হলো বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে তখন ভিতরে যে কী উথাল-পাতাল অবস্থা তা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। মনে হলো, এখনই শুরু হলো আল্লাহর ঘরের সত্যিকারের সফর। লাববাইক ধ্বনি তো হিজাযভূমির ধ্বনি, কিন্তু বাসের যাত্রী আমরা সকলে ছিলাম ইহরামের শুভ্র লিবাসে। তাই মনে হলো, এ-ই তো আমাদের হিজাযভূমি! বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার শেষরাতের নির্জন পথে পঞ্চাশজন মুসাফির সমবেত কণ্ঠে অপরিসীম আবেগ ও জাযবার সঙ্গে যখন বলে উঠলাম, লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক, লা-শারীকা লাকা লাববাইক ... সে লাববাইক ধ্বনি নিশ্চয় পৌঁছে গিয়েছে আকাশের গন্তব্যে! বিমুগ্ধ ফিরেশতারা নিশ্চয় শ্রবণ করছে সে ধ্বনি! আরশের অধিপতি নিশ্চয় খুশী হয়েছেন তাঁর ঘরের অভিমুখী আশিক বান্দাদের লাববাইক ধ্বনিতে! এ ধ্বনি তো তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন তাঁর খলীলের মারফতে, তাঁর হাবীবের যবানিতে! লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা-শারীকা লাকা লাববাইক ...। বান্দা হাযির, হে আল্লাহ, বান্দা হাযির!
গাড়ী ধীরে ধীরে বিমানবন্দরে প্রবেশ করলো। ইনশাআল্লা্হ, আল্লাহর ঘর যিয়ারাতের আগে আর বের হবো না এ পথ দিয়ে।
গাড়ী থেকে নামলাম। যত নিরীহভাবে বললাম, ঠিক সেভাবে অবশ্য নয়। প্রথমে চেষ্টা করলাম একসঙ্গে নামার, পারা গেলো না। শেষে বাধ্য হয়ে কিছুটা শৃঙ্খলার সঙ্গে নামলাম। তবে একজন একজন করে নয়, দু’জন, তিনজন করে। কয়েকজন মহিলা ছিলো, তাদেরও ডিঙ্গিয়ে যেতে কারো যেন বাধলো না।
দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সত্যি বলতে কী! বুক দুরু দুরু করছিলো। কাল তো ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিলো এখান থেকেই। কিন্তু আজ! সবকিছু যেন অন্যরকম! দরজায় যারা দঁড়িয়ে ছিলো, চেহারায় তাদের ক্লান্তির ছাপ, তবু হাসিমুখে সালাম দিলো। টিকেট-পাসপোর্টও দেখতে চাইল না, সসম্ভ্রমে বললো, জ্বি ভিতরে যান। ইহরামের সাদা লেবাসই যেন বলে দিচ্ছে, আমরা কার ঘরের যাত্রী, কোন শাহানশাহের মেহমান! মনে মনে নিজেকে সম্মানিত বোধ করলাম, একটু যেন পুলকিত হলাম। কালকে আসামী হয়ে ধরা পড়েছি, আজ যেন বেকসুর খালাস!
ভিতরে কোলাহল নেই। শেষরাতের প্রায় শান্ত-নির্জন পরিবেশ। এটাও জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। এখান থেকেই যেন পেতে শুরু করলাম সেখানকার পবিত্র পরিবেশের সুবাস! ভিতর থেকে যেন একটা সুরঝঙ্কার শোনা গেলো, ইয়া হারাম! ইয়া হারাম! লাববাইক ইয়া হারাম! অদ্ভুত একটা ভালো লাগায় দেহ-মন আচ্ছন্ন হলো। আমি পুলকিত হলাম, শিহরিত হলাম এবং আন্দোলিত হলাম।
আমাদের কাফেলায় সাথী চৌদ্দজন। শিকদার সাহেবের সঙ্গে তো আগেই পরিচয় হয়েছে হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষে। আরেকজন হুমায়ূন কবীর। বাড়ী আমাদের দেশে, কুমিল্লায় এবং চান্দিনায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এককথায় ‘ভালো মানুষ’। পুরো সফরে ভালো মানুষই ছিলেন। আরেকজন মিনহাজ সাহেব (সম্ভবত মিনহাজুল আবেদীন)। বয়োবৃদ্ধ, প্রলম্বিত শশ্রুমন্ডিত নূরানি চেহারার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। এ দু’জনের সঙ্গেও পরিচয় হোটেলে। এখানে আরো কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হলো।
শিকদার সাহেব দেখি, ‘আলগথালগ’ একজায়গায় বসে আছেন। পুরো সফরেই তিনি নিজের মধ্যে নিজে গুটিয়ে ছিলেন। তার যা কিছু কথা, ইমাম সাহেবের সঙ্গে, আর আমার সঙ্গে।
দূর থেকে এমন বেচারাভাব দেখে মায়া হলো। কাছে গেলাম। আমাকে দেখে একটু যেন অসংলগ্ন হাসি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘নৌকা বাইয়া এই সাগর পাড়ি দেওয়া অনেক কষ্ট!’ আমি বোকার মত তাকিয়ে থাকলাম, তারপর কিছু না বলে আস্তে করে সরে এলাম। কারণ ‘নৌকা বেয়ে সাগর পাড়ি দেয়া’ আমার কাজ নয়!
আসলে তখন বুঝতে পারিনি। হজ্বের দু’মাস না তিনমাস পরে যখন তার ইনতিকালের খবর এলো তখন বুঝলাম তার ‘নৌকা বেয়ে সাগর পাড়ি দেয়া’ হজ্বের সফর থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো। প্রত্যেকেরই ‘এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি’। আল্লাহ যাকে সহজ করে দেন তার জন্য সহজ, নইলে বড় কঠিন।
اللّهُمَّ لاَ سَهْلَ إِلا مَا جَعَلْتَهُ سَهْلاً، وَأَنْتَ تَجْعَلُ الْحُزْنَ إِذَا شِئْتَ سَهْلاً.
হে আল্লাহ, কোন কিছু সহজ নয়, তবে তুমি যা সহজ করো, আর কঠিনকে তুমিই সহজ করো, যখন ইচ্ছা করো।
***
প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা অল্প সময়েই সম্পন্ন হলো। সংশ্লিষ্ট সকলে বেশ আন্তরিক আচরণই করলো। আমাদের দেশের মানুষগুলো, এখনো বলতে ইচ্ছে করে, মনের দিক থেকে নরম। একটুতেই মন গলে, অল্পতেই চোখ ভেজে। মিথ্যা বলে, কিন্তু সত্যকে ভালোবাসে। হাজী-নামাযীকে শ্রদ্ধা করে। স্বভাবের যা কিছু দোষ, তার উৎপত্তিটা হয়েছে অভাব থেকে। তবে কারো কারো, যে পথেই হোক, অভাব দূর হয়েছে, কিন্তু স্বভাবটা রয়ে গেছে।
এত কথা লিখলাম যে মানুষটাকে মনে করে, তার দেখা হয়ত আর কোন দিন পাবো না, পেলেও হয়ত চিনবো না, তবু তার কথা মনে আছে, তার কথা মনে থাকবে। বেশী কিছু নয়, একটু সাহায্য করেছিলেন খুব আন্তরিক হয়ে। সবাইকে তিনি একটা করে কাগজ ধরিয়ে দিলেন, আর তাড়াতাড়ি পুরা করতে বললেন। সবার কাছে কলম ছিলো, আমার ছিলো না। তিনি এগিয়ে এসে পুরা করে দিলেন। এর মধ্যেই জিজ্ঞাসা করলেন, হুজুর, হারাম পয়সা দিয়া হজ্ব করলে হজ্ব হইব?
বুঝলাম না, কী জন্য আচমকা এ প্রশ্ন? নিজেরই জন্য? কিছুটা অপ্রস্ত্তত হয়ে বললাম, আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন।
তিনি বললেন, আমীন। সালাম দিয়ে, দু‘আ চেয়ে চলে গেলেন। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলাম। মাঝে মধ্যেই মনে পড়ে মানুষটির কথা। আমার ভিতরে এখনো যেন তার ‘আমীন’ শব্দটি প্রতিধ্বনিত হয়।
ফজরের সময় হতে তখনো কিছু বাকি। উপরের তলায় নামাযের ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে গিয়ে প্রয়োজন সেরে অযু করে নামাযের অপেক্ষায় থাকলাম। অপেক্ষা বড় কষ্টকর এবং বড় প্রীতিকর। অপেক্ষা যদি হয় অপ্রিয় কিছুর দায় থেকে মুক্তির জন্য তাহলে এর চেয়ে কষ্টকর আর কিছু নেই। আবার অপেক্ষা যদি হয় প্রিয় কিছুকে বরণ করে নেয়ার জন্য তাহলে সেই অপেক্ষার মধুরতার কোন তুলনা নেই। নামাযের ক্ষেত্রেও অপেক্ষার ভিন্ন ভিন্ন রূপ বিভিন্ন মাত্রায় দেখা যায়। এটা আসলে নামাযের সঙ্গে নামাযীর সম্পর্কের ভিন্নতা ও বিভিন্নতা ছাড়া আর কিছু নয়। এটা অতীতেও ছিলো, এখনো আছে। যারা নামাযের অপেক্ষায় থাকে না, প্রতীক্ষায় থাকে তারা প্রিয়তমের আগমন-ব্যাকুলতার যেন এক ‘স্বর্গসুখ’ লাভ করে। যত প্রতীক্ষা, যত ব্যাকুলতা, হৃদয়ের গভীরে ততই যেন আনন্দ-তরঙ্গ। তাদেরই সম্পর্কে হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে, ‘যতক্ষণ তারা নামাযের প্রতীক্ষায় থাকে ততক্ষণ তারা নামাযের মধ্যেই থাকে এবং নামাযের আজর ও ছাওয়াব পেতে থাকে। এখান থেকে হয়ত বলা যায়, বাইতুল্লাহর মুসাফির যখন থেকে ইহরামের লেবাস ধারণ করে তখন থেকে তারা হজ্বের পরিমন্ডলে থাকে এবং হজ্বের আজর ও ছাওয়াব পেতে থাকে। তাদের হজ্ব আরাফার ময়দানে গিয়ে পূর্ণতা লাভ করে এবং মিনায় রামী জামারায় গিয়ে পরিণতি লাভ করে, কিন্তু তাদের হজ্বের সূচনা হয়, আরো আগে ইহরামের দিনটি থেকে। এখানেই বোধহয় পার্থক্য হজ্বের সঙ্গে হজ্বের। কোন হজ্ব শুধু আহকাম ও মাসায়েলের, কোন হজ্ব যেমন আহকাম ও মাসায়েলের তেমনি তা ইশক ও মুহববতের এবং কোরবানি ও আত্মত্যাগের।
বিমানবন্দরের নামাযকক্ষে ইহরামের লেবাসে যারা ফজরের ইনতিযারে ছিলো তাদের মধ্যেও ছিলো সেই রকম পার্থক্য ও বৈচিত্র। কারো মধ্যে ছিলো এমন ব্যাকুলতা, এমন প্রশান্তি, যেন নামাযের ইনতিযার ছাড়া আর কিছু তাদের সামনে নেই। আবার এমনো দেখেছি যে, ওয়াক্ত হওয়া না হওয়ার পরোয়া নেই; একা একা ‘নামায’ পড়ে হুড়মুড়িয়ে চলে যাচ্ছে। যেন তাকে ফেলে না উড়ে যায়, এ আশঙ্কা! অবস্থা অনুধাবনের জন্য আমি একটা জরীপ করলাম। তাতে দেখা গেলো, প্রায় পাঁচশ যাত্রীর মধ্যে অর্ধেকের বেশী জামাত ছাড়া একা নামায পড়েছেন এবং তাদেরও অন্তত দশভাগের খবর ছিলো না, ওয়াক্ত হয়েছে কি না? এযুগের হজ্বের সফরে এটা বড় ধরনের এক দুর্ভাগ্য যে, নামাযের ইহতিমাম নেই। এখনকার হজ্বের কাফেলা সম্মানজনক কিছু ব্যতিক্রম বাদে আগাগোড়া বাণিজ্যিক কাফেলা। সেই কাফেলার কর্তাব্যক্তিদের বলতে শোনা যায়, ‘নামাযের জন্য তো সারা জীবন পড়ে আছে। নামাযের তো কাযা আছে, হজ্বের তো আর কাযা নাই।’
অথচ নামাযের ইহতিমাম ছাড়া হজ্ব হলো এক মুর্দা আমল। নামায হলো ইসলামের দ্বিতীয় রোকন এবং প্রতিদিন পাঁচওয়াক্তের ফরয। পক্ষান্তরে হজ্ব হলো ইসলামের পঞ্চম রোকন এবং জীবনে একবার মাত্র ফরয। সুতরাং হজ্বের সফরে, বিশেষ করে নফল হজ্বের সফরে ফরয নামাযে অবহেলা করার মত দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। এ দুর্ভাগ্য আমি দেখেতে পেয়েছি পুরো সফরে। আমাদের কর্তব্য হলো, যে কোন অবস্থায় অন্তত ছোট ছোট জামাতে ওয়াক্তমত নামায আদায় করে নেয়া। মহিলাদের জামাতে শরীক হওয়ার প্রয়োজন নেই। তাদের শুধু পর্দা রক্ষা করে ওয়াক্তমত নামায আদায় করে নিলেই হয়ে গেলো। সবচে’ বড় কথা, এমন ঘটনা তো কখনোই ঘটেনি যে, নামাযের ইহতিমাম করার কারণে কারো বিমান ছুটেছে, কিংবা হজ্ব ফউত হয়েছে!
আমাদের কাফেলার ইমাম ছাহেব নামাযের বিষয়ে খুবই সতর্ক ও সচেতন। তাই পুরো কাফেলা নামায ও জামাতের যথেষ্ট ইহতিমামের মধ্যে ছিলো, আলহামদু লিল্লাহ।
ফজরের ওয়াক্ত হলো। ছোট্ট করে আযান হলো। ইমাম ছাহেবের হুকুমে আমি ইমাম হলাম। সফরের কারণে খুব সংক্ষিপ্ত ক্কিরাত পড়লাম। বেশ বড় জামাত হলো। অন্যান্য কাফেলার হাজী ছাহেবানও শরীক হলেন।
তবে সালাম ফেরানোমাত্র সেই পরিচিত দৃশ্য! সেই হুড়োহুড়ি, সেই হুলস্থুল। ইমাম ছাহেবের সঙ্গে আমরা কয়েকজন ধীরে সুস্থে নীচে নেমে এলাম। ততক্ষণে ঘোষণা হয়ে গেছে ‘শেষ অপেক্ষার স্থলে’ পৌঁছার। হাতের ব্যাগ ও অন্যান্য সামান মেশিনে পরীক্ষা করা হলো। দেহতল্লাশির স্তর পার হয়ে ব্রিফকেস হাতে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেখি প্রায় রোয হাশরের অবস্থা। পাঁচশ যাত্রীর মধ্যে অন্তত অর্ধেকের ইচ্ছা, তিনি সবার আগে বিমানে ওঠবেন। অথচ প্রবেশপথ অত্যন্ত সরু এবং তখনো বন্ধ। অনন্যোপায় নিরাপত্তাকর্মীরা বলতে গেলে ‘অভদ্র’ আচরণ করেই কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন। গ্রামের সহজ সরল এক হাজী ছাহেব (সম্ভবত) তার স্ত্রীকে নিয়ে ভিড় ঠেলে অগ্রসর হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন। তাকে নিবৃত্ত করতে গিয়ে জানা গেলো, তার আশঙ্কা, পিছনে পড়ে গেলে আরবদেশ পর্যন্ত দাঁড়িয়েই যেতে হবে। ইতিমধ্যেই তিনি যথেষ্ট ধকল সয়েছেন নোয়াখালি থেকে ট্রেনে আসার পথে। তাকে বোঝানো হলো, বিমানে সে সমস্যা নেই। সবার শেষে উঠলেও তাদের দু’জনের আসন খালি থাকবে। মনে হলো, কথাটা তার বিশ্বাস হলো। হয়ত ভাবলেন, হাজী ছাহেবরা কি আর মিথ্যা বলবেন! তিনি শান্ত হয়ে স্ত্রীকে নিয়ে একপাশে চেয়ারে বসলেন।
সমস্যা হলো ‘পুরোনো ও অভিজ্ঞ’ একহাজী ছাহেবকে নিয়ে। তাকে কিছুতেই শান্ত করা যায় না। কারণ তিনি জানেন, আগে না গেলে জানালার পাশে ‘সিট’ পাওয়া যায় না। তাকে আর কী দোষ দেবো, এ দুর্বলতা তো আমারও। বড় ইচ্ছে করে জানালার ধারে বসে আকাশের সৌন্দর্য, আর পৃথিবীর বৈচিত্র অবলোকন করি। সৃষ্টির সৌন্দর্যের দর্পণে পরম সৌন্দর্যের প্রতিবিম্ব অনুভব করি। কিন্তু এজন্য তো আর হৃদয় ও আত্মার সৌন্দর্য বিসর্জন দিতে পারি না!
কাঁচের দেয়ালের ওপারে দেখা যাচ্ছে সউদিয়ার বিশাল জাহায, যেন ‘হুমা’ পাখী ডানা মেলে উড়ালের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মনে পড়লো, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় বিমানসংস্থার নাম হুমা। হুমাপাখী কেউ দেখেনি; বিশাল নাকি তার দেহ, আরো বিশাল তার দুই ডানা। বিমানের নাম হুমা হওয়াই সঙ্গত বটে। গাড়ী-রেলগাড়ী, জাহায-উড়োজাহায, এ চারটির মধ্যে উড়োজাহাযের দাঁড়াবার ভঙ্গিটাই যাকে বলে অভিজাত ও রাজকীয়।
মালপত্র তোলা হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায়। একই সঙ্গে জ্বালানী ভরা হচ্ছে। শুধু জ্বালানীর ওজনই সম্ভবত ত্রিশটন। যাত্রী, মাল ও জ্বালানী, সব মিলিয়ে কত ওজন হবে বিমানের! এই বিপুল ভার নিয়ে বিমান উড্ডয়ন করবে আকাশে। উঠে যাবে অনেক উপরে মেঘের রাজ্য ভেদ করে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আমাদের পৌঁছে দেবে হিজাযের পবিত্র ভূমিতে। অথচ মানুষ একদিন শুধু পাখীকেই উড়তে দেখেছে আকাশে, আর স্বপ্ন দেখেছে ডানা মেলে আকাশে ওড়ার। মুসলিম বিজ্ঞানী আববাস বিন ফিরনাস প্রথম মানুষ, যিনি দু’টি ডানা তৈরী করে পাখীর মত আকাশে ওড়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং প্রাণ দিয়েছিলেন। অতীতের সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব, তবে আববাস বিন ফিরনাসের উত্তরসূরীদের হাতে নয়, অন্যদের হাতে।
আল্লাহ মানুষকে বুদ্ধি দিয়েছেন। সেটা কাজে লাগিয়ে মানুষ আজ কত অগ্রসর! উটের কাফেলার স্থান নিয়েছে গাড়ীর বহর। পালতোলা কিশতির জায়গা দখল করেছে বাস্পীয় জাহায। আর সবকিছুকে ছাড়িয়ে আকাশে ডানা মেলেছে বিমান। সফর এখন ঘরের চেয়ে আরামের। পথচলায়, সাগরে ভাসায়, আকাশে ওড়ায় এখন শুধু গতির উন্মাদনা। সব আল্লাহর দান। আল্লাহর দেয়া বুদ্ধি দিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ এগিয়ে চলেছে সামনে, আরো সামনে। ভবিষ্যতে সে আরো কত দূর যাবে তা হয়ত এখন কল্পনা করাও সম্ভব নয়। আল্লাহ তো বলে দিয়েছেন, ‘ঘোড়া, খচ্চর, গাধা, এগুলোকে তিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের বাহনরূপে, আর (সামনে) তিনি এমন কিছু সৃষ্টি করবেন যা তোমরা জানো না।’
সেই না-জানার গর্ভে, কে জানে লুকিয়ে আছে কত বিপুল বিস্ময়! কিন্তু আফসোস, শক্তি ও প্রযুক্তির কোন কিছু আমাদের নয়। এই যে চোখের সামনে সউদিয়ার বিশাল বিমান, এটা সউদী আরবের নয়। ঐ দূরের ছোট বিমানটিও বাংলাদেশের নয়। ওরা আবিষ্কার করে, উদ্ভাবন করে এবং উৎপাদন করে; আমরা শুধু ক্রয় করি এবং ব্যবহার করি, (যতটুকু ওরা নিজেদের গরজে আমাদের ব্যবহার করতে দেয়।) আমরা কেন গতির রহস্য উদ্ঘাটন করলাম না, অন্তত এই নিয়তে যে, আমাদের হজ্বের সফর যেন আরো সহজ হয়? আমরা কেন শক্তির উৎসগুলো আয়ত্ত করলাম না, অন্তত এই উদ্দেশ্যে যে আমাদের মাতৃভূমি ও পবিত্রভূমি যেন নিরাপদ হয়? তাহলে তো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চাই হয়ে যেতো ইবাদত এবং শ্রেষ্ঠ ইবাদত!
ইউরোপ যখন গতির পিছনে ছুটছে দ্রুতগতিতে, পাশ্চাত্য যখন শক্তির সন্ধ্যানে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সর্বশক্তি নিয়ে, আমরা তখন কোথায় ছিলাম? ঘুমের ঘোরে, আলহামরার শাহী মহলে, হিন্দুস্তানের তাজমহলে?
এখন তো শূন্য ও মহাশূন্য সবই শত্রুর দখলে। উপগ্রহের গোয়েন্দা দৃষ্টির সমানে গোটা মুসলিম বিশ্ব প্রায় নগ্ন। ইরানের কোথায় গোপনে কী হয়; পাকিস্তানের কোথায় কে লুকিয়ে থাকে; সবছবি চলে যায় পেন্টগনে, ওয়াসিংটনে; অথচ শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে আমরা থাকি অন্ধকারে!
ইসলামী জাহানের যেখানে যত মুসলিম বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ সকল হুমকি ও ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে উম্মাহর উন্নতির সাধনায় নিয়োজিত, তাদের আমি শ্রদ্ধা জানাই। আমি বিশ্বাস করি, এ যুগে তারা সেই দল যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে
وعين باتت تحرس في سبيل الله
আগুন ঐ চোখ স্পর্শ করবে না, যা আল্লাহর রাস্তার পাহারায় বিনিদ্র রাত কাটিয়েছে।
আমার বড় দুর্বলতা, আমি চিন্তার রাজ্যে হারিয়ে যাই, আর অনেক সময় তা প্রসঙ্গহীন হয়ে পড়ে। কাঁচের দেয়ালের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা সউদিয়ার বিমানটি দেখে কেন জানি ওটাকে ‘আপন’ মনে হলো না, আজনবী মনে হলো, আর আজনাবিয়াতের এ অনুভূতি-ই আমাকে চিন্তার রাজ্যে নিয়ে গেছে এত দূর। হজ্বের সফরে এসব চিন্তা হয়ত প্রসঙ্গহীন এবং হজ্বের সফরনামার সঙ্গে সঙ্গতিহীন। আরো অনেক কিছু ভাবনায় এসেছে; সেগুলো হয়ত আরো অপ্রাসঙ্গিক। সুতরাং থাক সেসব কথা।
আমি চাই বা না চাই, আল্লাহর ঘরে যাওয়ার জন্য আমাকে এখন উঠতে হবে ‘ইউরোপের’ তৈরী বিমানে, যদিও নাম তার সাউদিয়া। হয়ত বিমানের পাইলটও হবে ইউরোপের কোন অমুসলিম। বাংলাদেশ বিমান অবশ্য এদিক থেকে ভাগ্যবান যে, ভাড়া করা পাইলট তাদের লাগে না। তাদের রয়েছে নিজস্ব পাইলট।
মনে পড়ে মাওলানা আব্দুল মাজেদ দরয়াবাদী (রহ.)-এর সফরনামার কথা। ‘পানির জাহাযে ছিলো ইংরেজ ‘কাপ্তান’। জিদ্দার কাছাকাছি আসার পর লঞ্চে করে এসে জাহাযে উঠলেন আরব কাপ্তান এবং জাহাযচালনার ভার গ্রহণ করলেন ইংরেজ কাপ্তানের হাত থেকে।’ দরয়াবাদী লিখেছেন, ‘এতক্ষণে মনটা আমার খুশী হলো, যাক, আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে জাহাযের বাকি পথটা আমরা অতিক্রম করবো একজন আরব মুসলিম কাপ্তানের পরিচালনায়।’
পরবর্তী কোন একসফরে হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী (রহ.)ও একই অনুভূতির কথা লিখেছেন তার ছোট্ট সফরনামায়। তাঁদের তবু সৌভাগ্য যে, অন্তত কিছুটা পথ তাঁরা অতিক্রম করেছিলেন মুসলিম কাপ্তানের পরিচালনায়। উনিশশ আটাত্তর সনে ইমাম ছাহেব ও আমি আল্লাহর ঘরে গিয়েছিলাম সাউদিয়ার বিমানে করে, জিদ্দার মাটি স্পর্শ করা পর্যন্ত বিমানটি ছিলো অমুসলিম পাইলটের পরিচালনায়। শেষ মুহূর্তেও মেঘের রাজ্য থেকে নেমে আসেনি কোন মুসলিম পাইলট!
***
বিমানে আরোহণের জন্য প্রবেশপথ খুলে দেয়া হলো; অমনি সবাই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়লো। আমরা দূরে দাঁড়িয়ে সে বিশ্রী দৃশ্য দেখলাম। হাতমাইক থেকে বারবার অনুরোধ করা হচ্ছে সুশৃঙ্খল হয়ে লাইন ধরার। শেষে হুমকি দেয়া হলো প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়ার। আমরা এবং আরো অনেকে লজ্জায় যেন মাটির সঙ্গে মিশে গেলাম। ভাগ্য ভালো, কোন বিদেশী সেখানে ছিলো না। তবে হজ্ব থেকে ফেরার সময় বহু বিদেশী আমাদের এ দৃশ্য উপভোগ করেছিলো।
এখানে আমাদের কাফেলার একমাত্র যুবক সদস্য কামরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি বুদ্ধিমান। কাল দুপুরে অবস্থা সুবিধার নয় দেখে ফোননম্বর রেখে বাসায় চলে গিয়েছিলেন। খবর পেয়ে এখন এসেছেন। তিনি সাগ্রহে আমার দিকে মোবাইল এগিয়ে দিলেন ঘরে ফোন করার জন্য। করলাম; স্ত্রী ধরলেন। প্রবল আবেগের তোড়ে প্রথমে কিছুক্ষণ তো কথাই বলা হলো না: শেষে বললাম, ‘আমার চোখের সামনে বিশাল একটা পাখী দাঁড়িয়ে আছে। ইনশাআল্লাহ এখনই এ পাখী আমাদের নিয়ে আকাশে ওড়বে। এখনই আমরা রওয়ানা হচ্ছি আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে।’
তার কণ্ঠস্বরে বোঝা গেলো, এতক্ষণ তিনি বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন। আরো আগে ফোন করতে পারলে ভালো হতো। তিনি বললেন, ‘আলহামদু লিল্লাহ, ছুম্মা আলহামদু লিল্লাহ! আমরা সবাই দু‘আ করছি, আল্লাহ তোমাকে নিরপদ রাখুন এবং মকবূল হজ্ব নছীব করুন।’
মেয়ে ছেলে সবাই কথা বললো, দু‘আ জানাল এবং দু‘আ চাইল।
ভাই কামরুল ইসলামকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন ফেরত দিলাম। এতক্ষণে যাত্রীরা প্রায় সবাই বিমানে উঠে গেছেন। একজন শিকদার সাহেবকে ধরে ধরে নিয়ে গেলো। ইমাম ছাহেব এবং আমি ধীরে ধীরে অগ্রসর হলাম।
এখন আর বাসে করে যাত্রিদের বিমানের সিঁড়ির কাছে নিয়ে যাওয়া হয় না। এখন সুড়ংপথের মত তৈরী করা হয়েছে। বোর্ডিংব্রিজ মনে হয় বলে। তার মাথায় বিমান এসে দাঁড়ায়। দরজার সঙ্গে ব্রিজের মুখ লাগানো থাকে। হেঁটে হেঁটেই বিমানের দোরগোড়ায় চলে যাওয়া যায়। আমরা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্রথম শ্রেণীর আসনগুলো এতক্ষণ খালি ছিলো। অভ্যর্থনাকারী মৃদু হেসে হাতের ইশারায় প্রথম শ্রেণীতে আসন গ্রহণ করতে বললেন। শেষে এসে তাহলে মন্দ হলো না! একেবারে প্রথম কাতারে গিয়ে বসলাম, যাকে বলে ‘প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করা’! আমাদের দিয়ে শুরু, এরপর যারা এলেন তারা সবাই প্রথম শ্রেণীতে আসন পেলেন।
দু’জন দুই কাতারে বসলে দু’জনই জানালার ধারে বসতে পারি, কিন্তু তাতে সঙ্গসৌভাগ্য হারাতে হয়। ইমাম ছাহেব আমার বন্ধু হলেও কাফেলার আমীর। সুতরাং ইকরামের নিয়তে জানালার পাশের আসনটি তার জন্য ‘উৎসর্গ’ করলাম।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)