বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আর্থিক বছর হচ্ছে ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন। তাই চলতি জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে নতুন অর্থ বছর শুরু হয়ে গেছে ২৯ জুন পাশ হওয়া নতুন বাজেট দিয়ে। জাতীয় সংসদে এ বাজেট পেশ হয়েছিল গত ১১ জুন, যা বেশ কিছু সংশোধনীসহ জুনের শেষে সংসদে গৃহীত হয়েছে।
এবারের বাজেটের আয়তন প্রায় ১ লক্ষ ১৪ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের প্রাক্কলন সাড়ে উনাশি হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন অর্থ বছর ২০০৯-২০১০।
চলতি বাজেট সংসদের উত্থাপিত হওয়ার বেশ কিছু দিন আগেই এর অনেকগুলো বিষয় ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে গাড়িসহ বেশ কিছু পণ্যের বাজার মে মাস থেকেই অসি'তিশীল হয়ে উঠেছিল। মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হওয়ার পর অর্থমন্ত্রী তথ্য ফাঁসের দায়-দায়িত্ব নিজ কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে বলেছিলেন যে, একাজটি তিনি নিজেই করেছেন। অথচ এর সুযোগ নিয়ে শত কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে বিভিন্ন মহল।
আমাদের অর্থমন্ত্রীকে সম্পদ আহরণের চেয়ে খরচের প্রতি বেশি মনোযোগী মনে হয়েছে। কারণ ঘোষিত ১১৪ কোটি টাকা বাজেটের প্রায় এক তৃতীয়াংশই (৩৪ হাজার ৫০০ কোটি) হল ঘাটতি। অর্থাৎ সম্ভাব্য রাজস্ব আয় থেকে খরচ করা হবে অনেক বেশি টাকা, যা অর্জিত হবে বৈদেশিক ঋণ, বৈদেশিক অনুদান এবং ব্যাংক ব্যবস'া থেকে গৃহীত ঋণ ও এ ধরনের আরো কয়েকটি খাত থেকে। অর্থনীতিবিদরা এ ধরনের বাজেটকে উচ্চাভিলাসী বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।
আয়ের সাথে অসংগতিপূর্ণ বাজেট প্রণয়ণ এখন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আবার রাজস্ব আয়ের যে প্রাক্কলন করা হয়েছে বাস-বে তার কত ভাগ অর্জিত হবে তা নিয়েও ব্যাপক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অভিজ্ঞ মহল।
ঘাটতি বাজেট পূরণ করতে গিয়ে বিদেশীদের দ্বারস- হওয়া এবং দেশীয় ব্যাংক ব্যবস'া থেকে ঋণ নেওয়া এখন একটি সাধারণ নিয়ম। আর এ সকল ঋণের সুদ আদায় খাতেই প্রতি বছর সর্বোচ্চ বা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকে বাজেটে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
এ বছর সুদ পরিশোধের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৩.৯% অর্থাৎ পুরো বাজেটের প্রায় ১৪ শতাংশ ব্যয় হবে সরকারের নতুন ও পুরাতন ঋণের সুদ আদায় বাবদ। এ সংখ্যাটি হল সরকারী কর্মচারীদের বেতন ভাতার পর সর্বোচ্চ। গত বছরও শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দের পরই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ছিল সুদ আদায় খাতে। এবার শিক্ষা-প্রযুক্তিকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে সুদ।
ইসলামে নিকৃষ্টতম হারাম কাজগুলোর অন্যতম হচ্ছে সুদ দেওয়া-নেওয়া। কুরআন মজীদে সুস্পষ্টভাবে ইরশাদ হয়েছে ‘আল্লাহ সুদকে বিলুপ্ত করে দেন’। প্রায় ৯০% মুসলমানের রাষ্ট্র যদি এতই সুদী ঋণ নির্ভর হয় যে তার পুরো বাজেটের অন্যতম সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখতে হয় সুদ আদায়ের জন্য তাহলে সে জাতির ভবিষ্যতের কথা তো আর স্পষ্ট করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
সুদদাতা-গ্রহীতা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপর আল্লাহর অভিসম্পাতের কথা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। অথচ আমরা সুদী ঋণকেই বানিয়ে নিয়েছি রাষ্ট্রীয় খরচ চালানোর একটি বড় উপকরণ হিসাবে। প্র্রশ্ন হচ্ছে, বাজেটে সুদী ঋণের ব্যবস'া রাখা কি খুবই অপরিহার্য? নিশ্চয়ই নয়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস'া বিবেচনায় এনে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে চিন-া করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
এ বছরের বাজেটকেই হিসাবে আনা যাক। এবার সরকারের প্রাপ্তির খাতে বৈদেশিক ঋণের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭.৬%, ১ লক্ষ চৌদ্দ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।
আর দেশীয় ব্যাংকব্যবস'া থেকে সরকার ঋণ নিবে ১৬ হাজার কোটি টাকার মতো। সব মিলে যে অংক দাঁড়ায় তা পুরো বাজেটের ২১% এর মতো। যদি কোনো সরকার কৃচ্ছতা সাধনে সচেষ্ট হয় এবং আয়ের চেয়ে অধিক ব্যয় না করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয় তাহলে তার পক্ষে প্রচলিত বাজেটের চেয়ে ২৫-৩০% কম খরচ করে দেশ চালানো অবশ্যই সম্ভব। প্রচলিত রাষ্ট্রীয় অপচয়গুলো রোধ করা সম্ভব হলে এবং অনুন্নয়ন খাতের ব্যয়সমূহের লাগাম কিঞ্চিত টেনে ধরা গেলে একাজটি অনেক কঠিন হবে না। যে দেশের অর্ধেকের বেশি জনগণ দরিদ্র সে দেশের মন্ত্রী, এম.পি, সচিব, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউ.এন.ও এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ যদি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার ব্যাপারে সদয় হন তাতেও সাশ্রয় হবে হাজার হাজার কোটি টাকা। গরীব জনগণের কথা খেয়াল করে যদি তারা ৩৫-৪০ লাখ থেকে আরম্ভ করে কোটি টাকার গাড়ির বদলে ৮-১০ লাখ টাকার গাড়ি ব্যবহার করতেন তবে সে খাত থেকেও কয়েক হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় হতে পারে।
মোটকথা, দেশ ও সমাজকে ইতিবাচকভাবে বদলে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে অগ্রসর হলে ইনশাআল্লাহ দেশী-বিদেশী কোনো ঋণ ছাড়াই দেশ চলতে পারবে। আর বিদেশী ঋণের যে পরিমাণ বরাদ্দ বাজেটে থাকে (এবার ৭.৬%) তা তো খুবই নগণ্য। এটিকে এড়িয়ে চলা তো কঠিন কিছু হওয়ার কথা নয়। এভাবে যদি ধীরে ধীরে হলেও ঋণনির্ভর বাজেটের বদলে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাজেট তৈরি হয়ে তা যথাযথভাবে কার্যকর করা যায় তবে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম একটি স্বাধীন আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে এবং তারা মুক্তি পাবে অভিশপ্ত সুদের বোঝা বহনের কষ্ট থেকে।
এবারের বাজেটে উন্নয়ন খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বরাবরই এ খাতের বরাদ্দ মোট বাজেটের চেয়েও অনেক কম। কিন' অনুন্নয়ন খাতের খরচাদি প্রায়ই সংসদে পাশ হওয়া বাজেটকে অতিক্রম করে যায়। উন্নয়ন প্রশাসনকে কার্যকর করা না গেলে এমনটি হতেই থাকবে। অবস'াদৃষ্টে মনে হয় যে, সরকারগুলো অনুন্নয়ন ব্যয়ে যতটা তৎপর ঠিক ততটাই উদাসীন উন্নয়ন খাতের কাজ-কর্মের ব্যাপারে।
বাজেটে প্রথমে তিন বছরের জন্য কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন- তা এক বছরে সীমিত করা হয়, কিন' আগামী বছরও যে আবার এর সুযোগ দেওয়া হবে না তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হল, কালো টাকা বলতে যদি অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ বুঝানো হয়ে থাকে তবে সে অর্থ কখনো সাদা হওয়ার যোগ্য নয়। সীমাহীন দুর্নীতি ও বিভিন্ন অসৎ উপায়ে হাতিয়ে নেওয়া সকল কালো টাকার হকদার দরিদ্র জনগণ। ইসলামের বিধান হল, এ সকল হারাম টাকা গরীব-দুঃখীদের মাঝে ছওয়াবের নিয়ত ছাড়া সদকা করে দিতে হবে। যারা নিজ উদ্যোগে তা করবে না রাষ্ট্র তাদেরকে তা করতে বাধ্য করবে। হারাম অর্থ দিয়ে জাতীয় অর্থনীতি চাঙ্গা করার মানসিকতা পরিহার করা উচিত।
করমুক্ত আয়সীমায় কোনো বৃদ্ধি ঘটানো হয়নি এবার। অর্থাৎ এক লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার টাকা বার্ষিক আয় থাকলেই ট্যাক্স দেওয়া অপরিহার্য। এছাড়া বহু সাধারণ জরুরি কাজ-কর্মের জন্যও টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছে, গাড়ি থাকলেই কর দিতে হবে। অথচ কম দামী গাড়ি যে কোনো বিলাস পণ্য নয় তা তো বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।
টিআইএন এর ক্ষেত্রে একটি ছোট উদাহরণ টানা যেতে পারে। কেউ যদি সিটি এলাকায় জমি খরিদ করে তবে তার টিআইএন থাকতে হবে। যদিও জমিটি হোক খুবই নিম্নাঞ্চলের, একেবারেই ছোট। হয়তো পাঁচ/দশ হাজার টাকা মূল্যের। হয়তো বা তার বার্ষিক আয় ৫০ হাজার টাকাও নয়। বলাবাহুল্য, এ ধরনের অবিবেচনাপ্রসূত বিধি-বিধানই অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া ও জাল টিআইএন-এর সংখ্যা বাড়িয়ে থাকে।
যা হোক, উচ্চ দ্রব্যমূল্যের এ সময়ে বার্ষিক এক লক্ষ পঁয়ষট্টি বা মাসে ১৩৭৭৫/- টাকা আয় করলেই কর আদায়ের বাধ্যবাধকতা কতটা যুক্তিযুক্ত তা সহজেই অনুমেয়। ব্যাপক দাবি-দাওয়ার পরও এ সংখ্যা বাড়ানো হয়নি বাজেটে।
নতুন বাজেটের নতুন উপাদান হচ্ছে পিপিপি। সরকারী-বেসরকারী যৌথ উদ্যোগে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়া এবং অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার চিন-াকে আমরা সাধুবাদ জানাতে চাই। বৈদেশিক অনুদান, বৈদেশিক ঋণের মুখাপেক্ষী না হয়ে দেশীয় আয় দিয়ে চলার ইচ্ছা ও চেষ্টা যত প্রতিষ্ঠিত হবে ততই আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা সহজ হবে। এখন দেখা যাক সরকার নতুন উপাদান পিপিপি-কে কীভাবে অগ্রসর ও বাস-বায়ন করে।
কৃষি খাতে এবারের বরাদ্দ ৪.৫%, আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টিতে মনে হয় আরো নজর দেওয়া উচিত ছিল। জনগণ বেশি দামে চাল কিনতে বাধ্য হলেও এবারো কিন' দরিদ্র কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য পায়নি।
সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি প্রসংশণীয়। তবে তা দল নিরপেক্ষভাবে ইনসাফভিত্তিক বাস-বায়নই বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রাক্কলিত ৫৬.৬% রাজস্ব আয়ের ৩৭.৪%ই অর্জিত হবে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে, যা কি না ধনী-গরীব, ফকীর-ভিক্ষুক নির্বিশেষে দেশের সকল আমজনতা তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার কেনা-কাটার সময় পরিশোধ করে থাকে। এ সাধারণ জনগণ রাষ্ট্রের তেমন সুযোগ-সুবিধা না পেলেও রাজস্ব আয়ের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি অর্জিত হবে তাদের (অনেকেরই অজানে-) দেওয়া ভ্যাট থেকে।
বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী এমন অনেক প্রস-াব করেছেন যা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছে। ছোট ও কম দামী গাড়ি, যে কোনো মূল্যের মোবাইল সেট, নিউজপ্রিন্টের উপর কর বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়গুলো বাজেট পাসের সময় শেষ পর্যন- সংশোধিত হয়েছে। কিন' শুরুতেই যদি ভালো করে চিন-া-ভাবনা করে বাজেট পেশ করা হত তাহলে হয়ত সরকারকে এত সমালোচনার সম্মুখিন হতে হত না।
অনেক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাজেটে তেমন গুরুত্ব পায়নি, যার মধ্যে বিদ্যুত সমস্যা, ঢাকার অসহনীয় যানজট অন্যতম। মানুষের নীতি নৈতিকতার উন্নয়নে ধর্মীয় খাতের প্রতি ব্যাপক দৃষ্টিপাতের বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে গেছে বরাবরের মতোই। অথচ এ দিকে দৃষ্টিপাত ছাড়া দুর্নীতি ও সন্ত্রাস দমনের চিন-া যে শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইসলামের দৃষ্টিতে বাজেট মূল্যায়ন ও ইসলামী অর্থনীতির আলোকে বাজেটের স্বরূপ নিয়ে কিছু কথা মাসিক আলকাউসারের ২০০৭ সনের জুলাই এবং ২০০৮ এর জুন সংখ্যায় লেখা হয়েছে। সম্মানিত পাঠক আবার নজর বুলিয়ে নিতে পারেন।