Rajab 1432   ||   June 2011

ইসলাম ও নারী-২

আমাতুল্লাহ তাসনীম সাফফানা

জীবিকার দায় থেকে অব্যাহতি

মূল আলোচনায় ফিরে আসি। জীবনের সবচে কঠিন কাজ জীবিকার জন্য ঘাম ঝরানো এবং উপার্জনের জন্য দৌড়ঝাঁপ করা। ইসলাম নারীসমাজের প্রতি অনেক বড় একটি ইহসান এই করেছে যে, তার নিজের এবং পরিবারের অন্যসবার জীবিকা থেকে এবং যাবতীয় অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব থেকে তাকে সম্পূর্ণরূপে অব্যাহতি দান করেছে এবং তা পুরুষের কাঁধে অর্পণ করেছে। এটা কন্যা হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে এবং সন্তানের মা হিসাবে বাবার কাছে, স্বামীর কাছে এবং সন্তানের পিতার কাছে নারীর অধিকার ও প্রাপ্য।

মানবসমাজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার জন্য এবং সবচে বড় কথা, আল্লাহর পক্ষ হতে অর্পিত খেলাফতের দায়িত্ব বহন করার জন্য সবচে গুরুত্বপূর্ণ, সবচে কঠিন ও কষ্টকর যে দায়িত্ব তা হলো সন্তান ধারণ ও সন্তান প্রসব। কে পালন করবে এ মহা-দায়িত্ব? আমাদের আল্লাহ এজন্য পুরুষের পরিবর্তে নারীকে নির্বাচন করেছেন এবং নারীর দেহসত্তা ও মানসসত্তাকে সেভাবেই তৈরী করেছেন।

তারপর সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানের শারীরিক ও মানসিক প্রতিপালন, তার শিক্ষা, দীক্ষা, নৈতিক ও চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন। দুনিয়ার মানুষ গর্ব করে বলে, আজকের শিশু আগামী দিনের আদর্শ নাগরিক। আমরা বলি, আজকের শিশু হলো আগামী দিনের আদর্শ মা, আদর্শ বাবা এবং আলিমে দ্বীন, দাঈ ইলাল্লাহ ও মুজাহিদ ফী সাবীলিল্লাহ। তো কে পালন করবে শিশুকে গড়ে তোলার এ মহাদায়িত্ব? এখানেও নারীর ভূমিকাই বড়। এজন্যই ইসলাম নারীকে জীবিকার দৌড়ঝাঁপ থেকে এবং সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব থেকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রেখেছে, যেন সে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব স্বস্তির সঙ্গে, নিরাপত্তার সঙ্গে এবং মর্যাদার সঙ্গে পালন করে যেতে পারে। পুরুষের কর্তব্য নারীর এই ত্যাগ ও কোরবানিকে কৃতজ্ঞচিত্তে মূল্যায়ন করা এবং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারীর অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব কৃতার্থতার সঙ্গে পালন করে যাওয়া।

কৃতজ্ঞতা ও কৃতার্থতার সঙ্গে কেন? উত্তরে বলা যায়, মাতৃত্ব দিয়ে নারীকে আল্লাহ গৌরবান্বিত করেছেন, আর পিতৃত্ব দিয়ে পুরুষকে আল্লাহ মুক্তি দান করেছেন। মাতৃত্বের গৌরব অর্জন করার জন্য পৃথিবীর প্রতিটি নারীকে প্রতিবার জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে হয় এবং দীর্ঘ নয়মাস ব্যথার সাগর পাড়ি দিতে হয়। পক্ষান্তরে পুরুষকে শুধু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও ব্যয়ভার বহন করতে হয়।

আল্লাহ তো নারী ও পুরুষ উভয়ের স্রষ্টা। তিনি জানেন, মাতৃত্ব কীভাবে অর্জিত হয়, আর পিতৃত্ব লাভ হয় কার কষ্টের সুফলরূপে। আল্লাহ বলেছেন-

ووصينا الانسان بوالديه احسانا حمتله امه كرها ووضعته كرها

 (আর মানুষকে আমি উপদেশ দিয়েছি তার মা-বাবার সঙ্গে সদাচার করার। তার মা তাকে বহন করেছে কষ্ট করে এবং প্রসব করেছে কষ্ট করে।)

আল্লাহ তাআলা পিতামাতা উভয়ের প্রতি সদাচারের আদেশ করার পর বিশেষভাবে মার কষ্টের কথা বলেছেন। এভাবে আল্লাহ নারীর মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করেছেন এবং সম্ভবত এ বিষয়েও তাম্বীহ করেছেন যে, পুরুষের পিতৃত্বের পিছনেও নারীর গর্ভযন্ত্রণা ও প্রসববেদনার অবদান।

তো পুরুষ তার এমন জীবনসঙ্গিনীর জন্য একটু ছাদের ছায়া, একটুকরো রুটির অন্ন এবং একখন্ড বস্ত্রের আবরণ যোগাড় করবে না? করতে হবে এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই করতে হবে। পুরুষের এটা শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, আইনগত দায়িত্ব। ইসলামী খিলাফত কায়েম হলে রাষ্ট্রশক্তি পুরুষের এই দায়িত্বপালনের বিষয়টি নিশ্চিত করবে, করতে বাধ্য। এ জন্য নারীকে কেন তার মূল দায়িত্ব ছেড়ে ঘর থেকে বের হতে হবে? কেন তাকে দুনিয়ার ঝামেলায় জড়াতে হবে?

অন্তত মুসলিম বিশ্বে যত সরকার আছে, পাশ্চাত্য ও জাতিসঙ্ঘের হাতে নৃত্যপুতুল না হয়ে তারা সত্যি যদি নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে চায় তাহলে আইন করে এ বিষয়টি নিশ্চিত করুক।

সম্পদসঞ্চয়ের অধিকার

ইসলাম নারীসমাজের উপর দ্বিতীয় যে ইহসান করেছে তা এই যে, তাকে তার নিজস্ব পরিমন্ডলে সম্পদ উপার্জনের এবং সঞ্চয়ের অধিকার দান করেছে। মীরাছ ও মোহররূপে যে সম্পদ সে লাভ করবে, নিজের শ্রম দ্বারা যে সম্পদ সে উপার্জন করবে সেগুলোর উপর তার পূর্ণ অধিকার ইসলাম নিশ্চিত করেছে। নারী যতই সম্পদশালী হোক, তার ভরণপোষণের দায়িত্ব পুরুষের, নারীর নিজের নয়। হাঁ, সচ্ছল নারী যদি স্বামীকে হাদিয়া দেয়, ছাদাকা দেয়, দিতে পারে এবং সে জন্য সে দ্বিগুণ আজর পাবে। যেমন হাদীছ শরীফে এরকম মযমূন এসেছে-হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী হযরত যায়নাব রাদিয়াল্লাহু আনহা তার স্বামী ও কয়েকজন ইয়াতিমের জন্য খরচ করতেন। একবার নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে সদাকা করতে উৎসাহিত করলেন। তখন যায়নাব রা. স্বামীকে বললেন, তুমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর যে, তোমার জন্য ও আমার তত্ত্বাবধানে থাকা ইয়াতীম শিশুদের জন্য যে খরচ করে থাকি তা ঐ সদাকার মধ্যে গণ্য হবে কি না। তিনি বললেন, আমার লজ্জা করে, তুমিই গিয়ে জিজ্ঞাসা কর।

হযরত যায়নাব দরবারে নববীর দুয়ারে হাযির হলেন। দেখা গেলো, আরো কতিপয় নারী একই উদ্দেশ্যে সেখানে একত্র হয়েছে। এর পর তারা সকলে হযরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাধ্যমে বিষয়টি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে উত্থাপন করলেন, আর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে পাঠালেন যে, তারা দ্বিগুণ ছাওয়াব পাবে, সাদাকা করার এবং আত্মীয়তা রক্ষা করার। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৪৬৬)

পাশ্চাত্যে নারীসমাজের দুর্দশা

আধুনিক যুগে নারী-স্বাধীনতার আন্দোলন মূলত শুরু হয়েছে পাশ্চাত্যে, ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহেরও শুরু হয়েছিলো পাশ্চাত্যসমাজে। নারী-স্বাধীনতা ও ধর্মের প্রতি বিদ্রোহ, এদুটোর পিছনে অভিন্ন কারণ কাজ করেছে। প্রথমেই আসে ধর্ম ও সভ্যতার দ্বন্দ্বের বিষয়টি। ইসলামের সোনালী যুগে মুসলিমসমাজে যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয় তখন বিজ্ঞানের সঙ্গে ইসলামের কোন দ্বন্দ্ব দেখা দেয়নি। বরং ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিচর্যায় এগিয়ে এসেছে। কারণ ইসলাম হলো বিজ্ঞানময় ধর্ম। তাই ইসলাম তার অনুসারীকে আলকোরআনের মাধ্যমে শুরু থেকেই আহবান জানিয়েছে যেন আল্লাহর পরিচয় লাভের জন্য সে সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তা করে। ইসলামী জাহানে যখন বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ, পাশ্চাত্য তখন অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলো। অনেক পরে মুসলিমজাহানের অনুসরণে পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানের চর্চা ব্যাপকভাবে শুরু হয়। তবে উভয় সভ্যতার মধ্যে একটি বুনিয়াদি পার্থক্য ছিলো। ইসলামে    জ্ঞানসাধনা ও বিজ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্য ছিলো সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তার মাধ্যমে আল্লাহ ও স্রষ্টার পরিচয় লাভ করা, যা অতি বড় ইবাদত;  পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য সভ্যতায় বিজ্ঞানচর্চার মূলে ছিলো প্রকৃতির গোপনশক্তিকে আয়ত্ত করে সম্পদ আহরণ করা।

মানবজাতির দুর্ভাগ্য এই যে, ইউরোপে গীর্জার ধর্মনেতারা বিজ্ঞানচর্চার বিরুদ্ধে চরম হিংস্রতার সঙ্গে রুখে দাড়িয়েছিলেন। সে ইতিহাস বড় মর্মন্তুদ, যার বিবরণ তুলে ধরার এখানে অবকাশ নেই। গীর্জার অসহায় ধর্মনেতাদের অবশ্য এছাড়া উপায়ও ছিলো না। কারণ বিজ্ঞান খৃষ্টধর্মের বিশ্বাসের বুনিয়াদ ধরেই নাড়া দিয়েছিলো। ফলে শুরু হয়ে যায় বিজ্ঞান ও খৃষ্টধর্মের সঙ্ঘাত। তাতে স্বাভাবিকভাবেই খৃষ্টধর্মের পরাজয় ঘটে।

যদি বিজ্ঞানের পথে অগ্রসর পাশ্চাত্যের খৃষ্টজগত ইসলাম ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারতো তাহলে মানবসভ্যতার ইতিহাস আজ অন্যরকম হতো, কিন্তু তা হয়নি। বিজ্ঞান পাশ্চাত্যকে নিয়ে গেছে নাস্তিক্যবাদ ও চরম ভোগবাদের দিকে।

একই ভাবে ইসলাম যেখানে আবির্ভাবলগ্নেই চরম লাঞ্ছনা ও দুর্গতির শিকার নারীজাতিকে তার প্রাপ্য মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে সেখানে পাশ্চাত্যে এই কিছুদিন আগেও নারী তার মৌলিক মানবিক অধিকার থেকেই ছিলো বঞ্চিত, যার সংক্ষিপ্ত চিত্র পিছনে আমরা তুলে ধরেছি। পাশ্চাত্যে ধর্ম, সমাজ ও সভ্যতা সবকিছু ছিলো নারী-নির্যাতনের হাতিয়ার। কিন্তু  প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই প্রতিটি ক্রিয়ার সমান একটি প্রতিক্রিয়া থাকে। সেই অনিবার্য প্রতিক্রিয়ারূপে সেখানে নারী-স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয় এবং শুরু হয় অবধারিত সংঘর্ষ। একদিকে ধর্ম, সমাজ ও সভ্যতা যেমন নারী-অধিকার আন্দোলনে সোচ্চার স্বাধীনচেতা নারীদের উপর চরম হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, অন্যদিকে নারীসমাজও সকল নিয়ম-কানুন ও বিধি-বন্ধন ছিন্ন-ভিন্ন করে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ইউরোপে নারীসমাজ যে অমানবিক নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার ছিলো তাতে তাদের বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ ছিলো স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক। কিন্তু তাদেরকে আলোর সিঁড়ি এবং মুক্তির রাজপথ দেখিয়ে দেয়ার কেউ ছিলো না। একথা বলারও কেউ ছিলো না যে, যে অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য ধর্ম, সভ্যতা ও সমাজের বিরুদ্ধে তোমাদের বিদ্রোহ, তা ইসলাম ও মুসলিম-সভ্যতা শুরু থেকেই তোমাদেরকে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে দিয়ে রেখেছে।

এসব কথা তাদের বলার কেউ ছিলো না, বরং লালসাগ্রস্ত সুচতুর একদল পুরুষ তাদের সামনে তুলে ধরে সমঅধিকার ও অবাধ স্বাধীনতার অলীক স্বপ্ন। কারণ তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিলো গৃহের নিরাপদ বেষ্টনীর বাইরে এনে নারীকে ভোগের পাত্রী ও লালসার শিকার করা। স্বাভাবিক কারণেই পুরুষের সে হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়েছে।

তো পাশ্চাত্যের নারী-আন্দোলনের ফল কী দাঁড়িয়েছে? নারী তার প্রাকৃতিক ও সামাজিক দায়-দায়িত্ব থেকে কোনভাবেই অব্যাহতি পায়নি এবং পাওয়া সম্ভবও নয়। তদুপরি নিজের ভরণপোষণের দায় এবং পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্বও চেপেছে তার উপর। জীবন ও জীবিকার কঠিন রণাঙ্গনে নারীকেও নামতে হয়েছে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে। একঠোঙ্গা মিষ্টি যত সহজলভ্য, পুরুষের কাছে নারী হয়ে উঠলো তার চেয়েও সহজলভ্য। অথচ শত লাঞ্ছনার পরও নারী ছিলো পুরুষের কাছে দুর্লভ সম্পদ।

স্বাধীনতার নামে কিছু সুযোগ, কিছু সুবিধা পাশ্চাত্য-নারীর সামনে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে, যা আগে সে কোনভাবেই ভোগ করতে পারেনি, কিন্তু বিনিময়ে তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে তার নারিত্ব, সতিত্ব, মাতৃত্ব, সম্মান, গৌরব ও মর্যাদা। ঘরে হয়ত তাকে একজন পুরুষের সেবা ও মনোরঞ্জন করতে হতো, এখন বাইরে তাকে হতে হয় বহুপুরুষের লালসার শিকার।

শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা তকী উছমানী, আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘজীবী করুন, বড় সুন্দর লিখেছেন, আশ্চর্য তামাশার বিষয় এই যে, নারী যখন ঘরে বসে স্বামী-সন্তানের সেবা করে, খাবার রান্না করে, ঘরদোর সাজায় তখন সেটা হয় পশ্চাদপদতা ও মৌলবাদিতা, পক্ষান্তরে এই নারী যখন বিমানবালা হয়ে চারশ পুরুষের জন্য ট্রে সাজিয়ে খাবার সরবরাহ করে, আর তাদের লালসা-দৃষ্টির শিকার হয় তখন সেটা হয় সম্মান ও মর্যাদা! (ইছলাহী মাওয়াইয, পৃ. ১৫৪)

এখানে আমি মুসলিম নারী-সমাজের পক্ষ হতে যথাযোগ্য বিনয়ের সঙ্গে নিবেদন করতে চাই যে, প্রত্যেক জাহিলিয়্যাতের মতো পশ্চিমা জাহিলিয়্যাত ও নারীর প্রতি পশ্চিমা প্রতারণামূলক শোষণ থেকে নিষ্কৃতির একমাত্র উপায় নিঃসন্দেহে ইসলামেই আছে। তবে তা যদি শুধু বইয়ের পাতায় কিংবা মৌখিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে এই শিক্ষার কোনো ফায়েদা চোখে পড়বে না। এর জন্য অপরিহার্য হল, খায়রুল কুরূনের পরিবারগুলোর মতো আমাদের সকল পরিবার নারীর জন্য ঐ ইসলামী শিক্ষার বাস্তব নমুনা হওয়া। আমাদের প্রত্যেক আলিম ও মুবাল্লিগের ঘর যেন অন্যদের জন্য উত্তম আদর্শ হয়। আর এর জন্য প্রয়োজন দাওয়াত ও ইলমে দ্বীনের ব্যাপক চর্চা এবং মুবাল্লিগ ও মুআল্লিমদের পরিবারে এর যথাযথ বাস্তবায়ন। এই দায়িত্ব পালনের এখন আর কোনো বিকল্প নেই।

আমি আমার সমাজের পক্ষ হতে আবারও বলবো, আল্লাহর নামে, ইসলামের নামে আমাদের কোন শেকায়াত নেই। আল্লাহর কাছে, ইসলামের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ। আমাদের পেয়ারা নবী আমাদের অনেক দিয়েছেন, আমাদের পায়ের নীচে সন্তানের জান্নাত দিয়েছেন; ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কিন্তু আজকের মুসলিম সমাজ! আল্লাহর ওয়াস্তে ঘরে আমাদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকু নিশ্চিত করুন। আমাদের ত্যাগ ও আত্মত্যাগের মূল্যায়ন করুন। বুঝতে চেষ্টা করুন, নারীও মানুষ; তারও ইচ্ছা আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, চাহিদা ও প্রয়োজন আছে। বিশ্বাস করুন, আমাদের ঘরগুলোতে যদি ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারা  তাদের প্রাপ্য অধিকারসমূহ পেতে থাকেন তখন পৃথিবীর সকল নারী এই সত্যকে নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করবে এবং পশ্চিমা সভ্যতার আপাত সৌন্দর্য ও নারীবাদীদের কপট শ্লোগান তাদের প্রতারিত করতে পারবে না। তারা ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে নিজেই নিজের মান-মর্যাদা ও ইযযত-আব্রুর হেফাযত করবে।

পাশ্চাত্যে নারী-স্বাধীনতার বিষফল

আমাদের দেশে নারী-স্বাধীনতার যে সয়লাব শুরু হয়েছে এবং স্বার্থবাদী পুরুষদের সুচতুর প্রচারণা ও প্ররোচনায় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারীসমাজের একটা অংশ তাতে যথেষ্ট বিভ্রান্তও হয়েছে, আমার মনে হয়, এর পিছনে দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত কোরআন-সুন্নায় মুসলিম নারীর যে আদর্শ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এবং ইসলাম নারীকে যে অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে, সোনালী যুগের মুসলিমসমাজে যার বাস্তব নমুনা বিদ্যমান ছিলো, এখনকার মুসলিম সমাজে তা বিদ্যমান নেই। সুতরাং আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আমাদের প্রথম কাজ হবে, অন্তত নিজেদের সমাজে ইসলামের সোনালী অতীতের সেই নমুনা আবার ফিরিয়ে আনা, যা দেখে বৃহত্তর মুসলিম নারীসমাজ প্রতারণাকারীদের প্রতারণা বুঝতে পারবে, ইসলামের দেয়া নারী-অধিকারের প্রতি উদ্বুদ্ধ হবে।

দ্বিতীয়ত পাশ্চাত্যের চোখ ধাঁধানো নারী-স্বাধীনতার মোহজালে তারা আটকা পড়ছে; অথচ এর ভিতরের কদর্যতা তাদের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি। এখানে আমি সে বিষয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই।

একথা সত্য, পাশ্চাত্যের নারী আজ কিছু স্বাধীনতা ভোগ করছে। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে তারা যোগ্যতা ও প্রতিভার প্রমাণও দিচ্ছে। তাদের জীবনে আর্থিক সচ্ছলতা ও  প্রাচুর্যও এসেছে। কিন্তু একটা কথা আমরা ভুলে যাই, পাশ্চাত্যে প্রতিটি নারী হিলারি ক্লিন্টন নয়। (অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাকেও ক্লিন্টনের নাম, যশঃ ও অপযশঃ সবই বয়ে বেড়াতে হয়।)

শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা তকী উছমানী বড় শিক্ষণীয় কথা লিখেছেন, নারীরা এখন এ ধোকায় আছে যে, বাইরে বের হয়ে আমার মর্যাদা বেড়েছে। আসলে এ ধোকা দিয়েই তাকে বাইরে বের করে আনা হয়েছিলো। কিন্তু এখন সবকিছু বুঝেও আবার ঘরে ফিরে আসার ক্ষেত্রে সে দ্বিধা-দ্বন্দের শিকার।

তাকে এই ধোকা দেয়া হয়েছিলো যে, তোমরা বাইরে বের হও এবং পুরুষ যত মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করছে তোমরাও তা অর্জন কর। তোমরাও রাষ্ট্রপ্রধান হও। তোমরাও বড় বড় কাজ করো যেমন পুরুষ করছে। কিন্তু পরিসংখ্যান দেখুন, বাইরে বের হয়ে আসা কোটি কোটি নারীর মধ্যে কজন রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছে। হাতের আঙুলে তাদের গোনা যাবে, আর কোটি কোটি নারীকে রাস্তায় এনে বে-আব্রু করা হয়েছে। (ইছলাহী মাওয়াইয, পৃ. ১৫৩)

পাশ্চাত্যে কর্মজীবী নারীদের শতকরা কজন সরকারী-বেসরকারী উচ্চ পদে চাকুরী করে? এবং সেজন্য তাদেরকে কী পরিমাণ মূল্য দিতে হয়? পনেরো দিনও হয়নি, আই, এম, এফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল)-এর ব্যবস্থাপনা প্রধান হোটেল পরিচারিকার উপর যৌননির্যাতনের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। এর আগে তিনি তার সহকর্মী একনারী অর্থনীতিবিদের উপরও যৌন হামলা চালিয়েছিলেন তবে ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছিলেন। এখন তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন নারীর পক্ষ হতে অসংখ্য অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। বলাবাহুল্য, এরা সবাই উচ্চসমাজের নারী। পক্ষান্তরে সিংহভাগ নারীকেই করতে হয় সামান্য বেতনের নিমণস্তরের অসম্মানজনক কাজ, আর তাদের মন ও দেহ ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে প্রতিদিন। তাদের কাঁদবারও সুযোগ নেই একথা বলেছেন আমেরিকার সি, এন, এন, এর একটি সামাজিক অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা। তিনি নিমণস্তরের কর্মজীবী নারীদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিলেন।

ড. মুস্তফা সিবাঈ বলেন, পাশ্চাত্য-নারীর স্বাধীন ও জৌলুসপূর্ণ জীবনের যে চিত্র আমাদের দেখানো হয়, বাস্তবে তা খুব কম নারীর ভাগ্যেই জোটে। কোটি কোটি সাধারণ নারীর জীবন সেখানে দাসীর চেয়েও জঘন্য। এমনকি বাইরের  জৌলুসি জীবনের ভিতরেও আছে এমন আগুন-যন্ত্রণা যা অতীতে কোন জাতির নারী কোন সভ্যতার অধীনে ভোগ করেনি।

 আমাদের দেশেও একই চিত্র আপনি দেখতে পাবেন। হাতে গোনা কিছু নারী কর্পোরেট চাকুরি করছে এবং ভোগবিলাসের জীবন যাপন করছে। অন্যরা হয় সাধারণ কর্মক্ষেত্রগুলোতে নিগৃহীত হয়, আর না হয় পথে মাথায় ইটের বোঝা বয়। এর নাম যদি হয় অধিকার ও স্বাধীনতা, তাহলে দূর থেকে তাকে প্রণাম!

পারিবারিক ব্যবস্থায় ধ্বস

পৃথিবীর সকল প্রাচীন ও আধুনিক সভ্যতা এবং সকল ধর্ম ও সমাজ-ব্যবস্থা এ বিষয়ে একমত যে, মানবসমাজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য  যে কোন মূল্যে পারিবারিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা অপরিহার্য। সেই সঙ্গে প্রাচীন ও আধুনিক সকল সমাজবিজ্ঞানী এটাও স্বীকার করেন যে, নারীই হলো পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। পরিবারব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার অর্থই হলো সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া, আর সমাজব্যবস্থা যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। প্রাচীন সভ্যতার ক্ষেত্রেও এটা হয়েছে, আধুনিক সভ্যতার ক্ষেত্রেও তা হতে বাধ্য।

নারীর বাইরে আসা এবং কর্মজীবী হওয়ার কারণে ইউরোপ আমেরিকায় আজ পারিবারিক ব্যবস্থা চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। একে তো পাশ্চাত্যের পুরুষ বিবাহবিমুখ হয়ে পড়েছে। তদুপরি কোন দাম্পত্য সম্পর্ক স্থায়ী হচ্ছে না। একজন সমাজবিজ্ঞানী দুঃখ করে বলেছেন, এমন স্বামী বা স্ত্রী এখন আপনি কমই দেখতে পাবেন, যে বলবে, এটা তার তৃতীয় বা চতুর্থ বিবাহ নয়। খুব কম সন্তানই এখন আপন মা, কিংবা আপন বাবাকে কাছে পায়। কুমারি মাতার সংখ্যা দিন দিন শুধু বেড়েই চলেছে না, বরং আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে।

এর প্রধান কারণ হলো, স্ত্রী অর্থ উপার্জন করে সংসারে অর্থের যোগান দিচ্ছে, কিন্তু স্বামীকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছে না। ফলে পুরুষ ঘরের বাইরের জীবনের প্রতি অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে নারীও শেষ পর্যন্ত একই পথে পা বাড়ায়। ফলে পারস্পরিক অবিশ্বাস এমন চরম আকার ধারণ করে যে, বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। এ ক্ষেত্রে তাদের অল্পবয়স্ক ছেলে-মেয়েরা হয় সবচে ক্ষতিগ্রস্ত। তারা ব্যাপকহারে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন সহিংস অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, যার প্রধান কারণ পারিবারিক তত্ত্বাবধানের অনুপস্থিতি। পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে খোদ পাশ্চাত্যের         চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তারা সমাজ ও সভ্যতার পতন ঘনিয়ে আসছে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে শুরু করেছেন। তারা প্রায় সবাই একমত যে, নারীর বহির্মুখী কর্মজীবনই পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার একমাত্র কারণ। পাশ্চাত্যের  পূজনীয় দার্শনিক রাসেলও এ কথা বলেছেন।

প্রখ্যাত তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ জন সিমন বলেন, নারী হয়ত কিছু অর্থ উপার্জন করছে, কিন্তু এর ফলে পরিবার ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

আগস্ট কাউন্ট তার রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রন্থে বলেন, সঠিক অর্থে মানব-উন্নয়ন করতে হলে নারী-জীবন যথাসম্ভব পরিবারকেন্দ্রিক ও ঘরোয়া হতে হবে এবং বাইরের কাজ থেকে তাকে মুক্ত রাখতে হবে, যাতে সে তার প্রধান দায়িত্ব পালন করতে পারে।

তিনি আরো বলেন, এজন্য স্ত্রীর খাদ্যের ব্যবস্থা করা স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট গর্ভাচোভ তার সুবিখ্যাত প্রেস্ট্রয়কা গ্রন্থে বলেছেন, মেয়েদের আমরা বাইরের কর্মক্ষেত্রে নিয়ে এসেছি। তাতে উৎপাদন হয়ত কিছু বেড়েছে, কিন্তু এত বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে যা রোধ করার কোন উপায় নেই। আমাদের পারিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন চিন্তা করে উপায় বের করতে হবে, কীভাবে নারীকে ঘরে আনা যায়।

ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থা

সবকিছু হারিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার চিন্তানায়কগণ পরিবার সম্পর্কে আজ যা ভাবছেন, ইসলাম চৌদ্দশ বছর আগেই তা বলে দিয়েছে এবং এরই উপর গড়ে উঠেছে ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থা। কোরআন বলেছে-হে নারীসমাজ, তোমরা তোমাদের ঘরে স্থির থাকো।

ইসলামী বিশ্বে এত অন্যায়-অনাচার, এত অবক্ষয়-অধপতন এবং দুশমনানে ইসলামের এত ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের পরো এখন পর্যন্ত  যে পারিবারিক ব্যবস্থা কিছু না কিছু টিকে আছে তার মূল কারণ কিন্তু এটাই যে, মুসলিম উম্মাহর সিংহভাগ নারী এখনো ঘরে আছে এবং পরিবার ও সন্তান-সন্তুতির দেখভাল করছে, যদিও অধিকাংশেরই সে শিক্ষা নেই।

পৃথিবীতে কোন প্রতিষ্ঠান একজন পরিচালক ও ব্যবস্থাপক ছাড়া টিকে থাকতে পারে না, একই ভাবে টিকে থাকতে পারে না দুজন পরিচালকের উপস্থিতিতে। সুতরাং পৃথিবীর সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচে মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পরিবার যেন সুষ্ঠুরূপে পরিচালিত হয় এবং উদ্দেশ্য অর্জনে সফল হয়, পরিবারের জন্য পরিচালক দরকার এবং একজন পরিচালক দরকার। তো ইসলাম তাকেই পরিবার-পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে যার কাঁধে পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক দায়িত্ব অর্পণ করেছে। এটাই একমাত্র যুক্তিপূর্ণ ব্যবস্থা। এর বাইরে যা কিছু করা হবে তা শুধু বিপর্যয়ই ডেকে আনবে।

পাশ্চাত্য কী চায়?

 পাশ্চাত্যসভ্যতার কর্ণধারগণ আজ পরিষ্কার বুঝতে পারছেন যে, তাদের সমাজ ও সভ্যতার অবক্ষয়ের মূল কারণ কী এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় কী? কিন্তু অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে এবং পরিবার-ব্যবস্থা ভেঙ্গে গিয়ে সমাজ ও সভ্যতার দেহে পচন ধরা শুরু হয়ে গেছে। এখন আর ফিরে আসার কোন উপায় নেই। এ বিষয়ে মিসরের প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ, ড. মুস্তফা সিবাঈ নিজের বড় শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন।  তিনি বলেন, ১৯৫৬ সালে লন্ডনে জনৈক ইংরেজ অধ্যাপকের সঙ্গে আমার কথা হয়। তিনি আমার কাছে পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাইলেন। আমি বললাম, আমরা এর ভালোটুকু গ্রহণ এবং মন্দটুকু বর্জন করি।

তিনি বললেন, এটা সম্ভব নয়। কারণ সভ্যতার সত্তা অবিভাজ্য। যেমন, ইউরোপে শিল্পবিপ্লব পরিবার ভেঙ্গেছে, কারণ কাজের জন্য নারীকে বাইরে আসতে হয়েছে, যা অনিবার্য ছিলো, অথচ সেটাই পরিবার ভাঙ্গার কারণ ছিলো। (এখন কোনটা নেবেন, কোনটা বাদ দেবেন?)

আমি বললাম, আমার মতে শিল্প বিপ্লব আপনাদের পরিবার ভাঙ্গার কারণ ছিলো না, কারণ ছিলো নারীর গৃহত্যাগ, আর তা অনিবার্য ছিলো না; বরং আপনারাই নারীকে বের করেছেন, প্রথমত  নিজেদের প্রবৃত্তির তাড়নায়, দ্বিতীয়ত অর্থনৈতিক স্বার্থপরতার কারণে। আপনারা চাননি কন্যা হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে এবং মা হিসাবে নারীর আর্থিক দায়িত্বভার বহন করতে। ফলে তারা বাড়ির বাইরে যেতে বাধ্য হয়েছে।

তিনি জানতে চাইলেন, এরূপ সমস্যায় আপনারা কী করবেন?

আমি বললাম, ইসলামে নারীর জীবিকা হয় পিতার উপর, না হয় স্বামীর উপর, (কিংবা সন্তানের উপর।) কোন অবস্থাতেই তার নিজের উপর নয়।

তিনি অবাক হয়ে বললেন, পাশ্চাত্য এতটা স্বার্থত্যাগে অক্ষম।

আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে। পানির জাহাযে বেলজিয়াম যাওয়ার পথে এক ইতালীয় তরুণীর সঙ্গে কথা হয়। অক্সফোর্ডে অধ্যয়নরতা এই তরুণী আমার কাছে ইসলামে নারীর অধিকার সম্পর্কে জানতে চায়। আমি যখন বললাম, ইসলাম নারীকে উপার্জনের কষ্ট থেকে অব্যাহতি দিয়েছে, সে গৃহকর্ত্রীরূপে তার দায়িত্ব পালন করতে পারে, তখন সে অকপটে বললো, মুসলিম নারীর প্রতি সত্যি আমার ঈর্ষা হয়। কত ভালো হতো আপনাদের দেশে যদি আমার জন্ম হতো! আমি বললাম, তুমি কি পারো তোমার সমাজের নারীকে গৃহমুখী হওয়ার এবং পুরুষকে তার দায়িত্ব পালন করার আবেদন জানাতে?

এবারও সে অকপটে বললো, সময় পার হয়ে গেছে। নারী এখন বাইরের জীবনের স্বাধীনতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন ঘরোয়া জীবন তার জন্য কঠিন হবে, যদিও আমি বিশ্বাস করি, এতেই তার শান্তি নিহিত।

মোটকথা পাশ্চাত্যের  চিন্তানায়কগণ জানেন যে এটা এখন অসম্ভব, অন্যদিকে মুসলিম সভ্যতায় পারিবারিক ব্যবস্থা এখনো সম্পূর্ণ অটুট। সুতরাং দুই সভ্যতার সঙ্ঘাতে ইসলামী সভ্যতার বিজয় এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, যদি না মুসলিম পারিবারিক ব্যবস্থাকেও গুঁড়িয়ে দেয়া যায়। এজন্যই পাশ্চত্যের চিন্তানায়কগণ তথাকথিত নারী-স্বাধীনতার নামে তাদের সমাজদেহের পচনব্যাধি আমাদের সমাজেও ছড়িয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement