Rajab 1432   ||   June 2011

‘ফতোয়া বৈধ’ রায় : ধন্যবাদ! তবে বিস্তারিত রায়ের অপেক্ষা

Mufti Abul Hasan Muhammad Abdullah

 

চারদিক ঘন অন্ধকারে ছেয়ে আছে। এর মাঝে দেখা মিলল এক চিলতে আলোর। ৯০% মুসলমানদের দেশে ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতার উচ্চাসন থেকে সর্বোচ্চ আদালত, সংসদ থেকে সংসদীয় কমিটি, মিডিয়া থেকে সুশীল সমাজ, এ বাহিনী সে বাহিনীসহ সবমহলের পক্ষ থেকেই কুরআন-সুন্নাহ তথা ইসলাম হচ্ছে আক্রান্ত। সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম থাকা-না থাকার বিষয়টি পরিণত হয়েছে কোনো অমুসলিমের মুখের কৌতুক এবং হাতের পুতুলে। একই ব্যক্তি শেয়ারবাজারের লুটেরাদেরকে ইমাম, মুয়াজ্জিন ও দরবেশ খেতাব দেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েও স্বীয় মসনদে আসীন থাকে। সামরিক শাসকের কৃত আখ্যা দিয়ে সংবিধান সংশোধনী বাতিল করে তাদের অনেক কিছুকেই আবার ভালো মনে করে মার্জনা করা হচ্ছে, কিন্তু মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস বাক্যটি ছিড়ে ফেলা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। অপরদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার গান্ধা নীতি সংবিধানে ফিরিয়ে আনা জাতির জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে। ক্ষমতায় গেলে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন করা হবে না বলে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর  কুরআনবিরোধী নারী নীতি তৈরি হয়েছে। চালু করা হয়েছে ধর্মহীন শিক্ষানীতি। আর এসবের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ও ধর্মীয় অধিকার প্রয়োগ করে কেউ বিক্ষোভ প্রতিবাদ করতে গেলে সম্মুখিন হতে হয় দমন, পীড়ন, হামলা-মামলা ও বহুবিধ নির্যাতনের। মুসলিম নারীর শোভা এবং সম্ভ্রমের প্রতীক বোরকার উপর আঘাত আসে দেশের উচ্চ আদালত থেকে। এ রকম সময়কে অন্ধকার জাহেলী যুগ থেকে আর কতই ভালো বলা যায়। এমনই ঘোর আঁধারে একটু হলেও আলো ছড়িয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। গত ১৯ মে উক্ত আদালত ২০০১ সনে বিচারপতি গোলাম রববানীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ কর্তৃক সবধরনের ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় খারিজ করে দিয়েছেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছে ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দেওয়া যাবে এবং শিক্ষিত লোকেরাই শুধু ফতোয়া দিতে পারবেন এবং গ্রহণের বিষয়টি হতে হবে স্বতস্ফূর্ত, কারো উপর কোনো শাস্তি প্রয়োগ করা যাবে না। আদালত তার সংক্ষিপ্ত নির্দেশের শেষাংশে এও বলেছেন যে, যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন সে ঘটনায় দেওয়া ফতোয়াটি অবৈধই ছিল।

আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় পেতে হয়ত আরো অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে সংক্ষিপ্ত রায়টি ঘোষিত হওয়ার পর বিভিন্ন দিক থেকে কোনঠাসা ধর্মপ্রাণ নাগরিকগণ সস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। দেশ, জাতি ও উচ্চ আদালতের মাথা থেকে সরে গেছে এক দশক ধরে লেগে থাকা কলঙ্ক। 

সে কলঙ্কের সূত্রপাত হয়েছিল ২০০১ সনের শুরুতে। দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি তথাকথিত হিল্লা বিয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিচারপতি গোলাম রববানীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ সুয়োমেটো রুল জারি করেন এবং একপর্যায়ে সবধরনের ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করে রায প্রদান  করেন। সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ধর্মপ্রাণ জনগণ। রববানী সাহেবের এই অনধিকার চর্চায় কলঙ্কিত হয় ৯০% মুসলমানের দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় তথা রাষ্ট্র ও সমাজ। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন দুজন আলেম। দীর্ঘ এক দশক পর চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে আপিল বিভাগে মামলাটির পূর্ণাঙ্গ শুনানি হয় এবং সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষিত হয় মে মাসের ১৯ তারিখে।  

জনাব গোলাম রববানীর পক্ষ থেকে ইসলামের উপর এটি একমাত্র আঘাত ছিল না। বরং হাইকোর্টে থাকাকালীন তিনি আরো একাধিক মামলায় কুরআন বিরোধী রায় দিয়েছেন। এমনি একটি মামলা ছিল তালাক পরবর্তী খোরপোষ বিষয়ে। সেটিও আপিল বিভাগে বাতিল হয়ে গেছে। ঐ বিচারপতি শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য তৎকালীন আপিল বিভাগ কর্তৃক তিরস্কৃতও হয়েছিলেন। এখনও শ্রদ্ধার সাথে মনে পড়ে তখনকার বিচারপতি আফজাল সাহেব, বিচারপতি মোস্তফা কামাল সাহেব এবং তাদের সঙ্গীদের কথা। তাঁরা সম্পূর্ণ ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্য ও যথাযথ গুরুত্বের সাথে ঐ মামলার শুনানি করেছিলেন এবং শীর্ষ উলামায়ে কেরামের মতামতও নিয়েছিলেন। একশ্রেণীর এনজিও তখন রববানী সাহেবের কুরআনবিরোধী রায় বহাল রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তাদের পক্ষে একাট্টা করেছিল বড় বড় উকিল-ব্যারিস্টারদের। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রধান বিচারপতি এটিএম আফজাল নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ দৃঢ়তার সাথে ঐ কুরআন বিরোধী রায় পুরোপুরি খারিজ করে দেন। তখনকার সর্বজ্যেষ্ঠ আইনজীবী মরহুম ব্যারিস্টার ইসতিয়াক আহমদ উকিল সাহেবদের পক্ষ থেকে আদালত কর্তৃক উলামায়ে কেরামের মতামত নেয়ার সমালোচনা করে বক্তব্য দিতে চাইলে তাকে কঠোর ভাষায় ধমক দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন তখনকার আপিল বিভাগ। মনে পড়ে এক ব্যারিস্টার সাহেব কর্তৃক পবিত্র কুরআনের তরজমা পড়ে রেফারেন্স দেওয়ার চেষ্টা করলে প্রধান বিচারপতির ঈমানদীপ্ত নির্দেশ আপনাকে আল্লাহর কালাম আল্লাহর ভাষায় পড়তে হবে। এবং মনে পড়ে এরপর তার মেয়ের সহায়তায় ইংরেজি হরফে লিখিত উচ্চারণ পড়তে গিয়ে ঐ ব্যারিস্টার সাহেবের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ার কথা।

ঐ সময়ে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার পক্ষ থেকে আপিল শুনানিকালে আইনজীবীদেরকে শরীয়তের দলিলাদি সরবরাহ করে সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছিল এবং একই কারণে আপিল বিভাগে শুনানি চলাকালে কোর্টে উপস্থিত থাকারও সুযোগ হয়েছিল।

যা হোক, তাঁর শরীয়াবিরোধী রায় বাতিল হয়ে যাওয়ার পরও থেমে যাননি বিচারপতি গোলাম রববানী; বরং ২০০১ সনের শুরুতে তিনি এককথায় পুরো শরীয়তকেই নিষিদ্ধ করে দেন। রায় দেন সকল ফতোয়া অবৈধ বলে। অথচ কে না জানে যে, ফতোয়া হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানের জন্য অপরিহার্য বিষয়, শরীয়তের ছোট-বড় সকল ক্ষেত্রের সাথে এর সম্পর্ক। অতএব ফতোয়া নিষিদ্ধ করা মানেই কাউকে কুরআন-সুন্নাহ তথা ধর্মীয় বিধিবিধান জানানো থেকে বারণ করা এবং অনিবার্যভাবে ধর্মীয় বিষয়ে জিজ্ঞাসার পথও রুদ্ধ করা। তাহলে আর শরীয়ত থাকল কোথায়।

এ লেখার শুরুতে আমি উক্ত রায়কে দেশ-জাতি ও আদালতের জন্য একটি কলঙ্কিত অধ্যায় বলে উল্লেখ করেছি। দুটি বিষয় খেয়াল করলে এর যথার্থতা বুঝে আসবে। ১. সংবিধান কর্তৃক মানুষের ধর্মীয় অধিকার এবং বাক স্বাধীনতার অধিকারকে এ রায়ে অস্বীকার করা হয়েছে এবং বিশ্ব দরবারে এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মুখকে খাটো করা হয়েছে।

২. উচ্চ আদালত কর্তৃক কোনো রায় দেওয়া হয় যেন নির্দেশিত ব্যক্তিরা তা মেনে চলে এবং আদালতের উপর শ্রদ্ধাশীল থেকে এর খেলাপ কিছু না করে। কিন্তু বিগত ১০ বছরে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়ের উপর কজন লোক আমল করেছে। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিমও কি ঐ রায়ের ভয়ে মুফতীর নিকট তার প্রয়োজনীয় ধর্মীয় বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা থেকে বিরত থেকেছে অথবা ঐ মুফতী রববানী সাহেবের রায়ের তোয়াক্কা করে মানুষকে ধর্মীয় জিজ্ঞাসার জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সম্ভবত কোনোটিই ঘটেনি; বরং ইসলামবিরোধী ঐ নির্দেশ লঙ্ঘিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ বার। আসলে একজন ধর্মপ্রাণ লোকের জন্য এর কোনো বিকল্পও নেই। কারণ কুরআন-হাদীস তথা শরীয়ত তাকে বলে, ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে জ্ঞানীকে জিজ্ঞেস কর, আবার জ্ঞানীর প্রতি নির্দেশ হচ্ছে শরীয়তের কথা গোপন করা যাবে না। জিজ্ঞাসিত হলে বলে দিতে হবে। তাহলে মুফতী কী করবেন? তার দেশের আদালতের কথা অনুসরণ করবেন, না ঐ আদালতসহ সকলের মহাবিচারক সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ পালন করবেন?

মোটকথা, এভাবেই কিছু লোক অনধিকার চর্চা করে কিছুতেই পালন করা সম্ভব নয়-এমন রায় প্রদান করে নিজেদের পদ ও মর্যাদা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কিত করে ছিলেন।

আমাদের পড়াশোনা ইসলামী আইন বিষয়ে। কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক শরীয়তের আইন, আধুনিক বিষয়াবলির সাথে সেগুলোর সামঞ্জস্য যাচাই করা এবং প্রচলিত আইনের সাথে শরীয়ার তুলনামূলক বিশ্লেষণ আমাদের পেশাগত কাজের অন্তর্ভুক্ত। সঙ্গত কারণেই ফতোয়া বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের উপর লিভ টু আপিল ও আপিল শুনানির ক্ষেত্রে আমরা মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন এমিকাস কিউরি ও আইনজীবীদের তথ্য-উপাত্ত ও শরীয়তের দলিলাদি প্রদান করে সাহায্য করাকে জরুরি মনে করেছি এবং শরঈ দৃষ্টিকোণ থেকেই হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়ের সামান্য পর্যালোচনা পেশ করছি।

বিচারপতি গোলাম রববানীর রায়ে গোড়াতেই গলদ ছিল। তিনি ফতোয়ার যে সংজ্ঞা পেশ করেছেন তাই ছিল ভুল। তিনি বলেছেন, ফতোয়া হচ্ছে, আইনগত কর্তৃপক্ষের আইনানুগ মতামত। অথচ শরীয়তে ফতোয়ার সাথে আইনগত কর্তৃপক্ষ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই এবং এটি কোনো বিচারিক রায়ও নয়। এক্ষেত্রে রববানী সাহেব জেনে বা না জেনে ফতোয়ার ভুল সংজ্ঞার আশ্রয় নিয়েছেন সকল ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করার জন্য।

মুসলমানদের দুর্ভাগ্য যে, বৃটিশরা তাদের রাজত্ব এখান থেকে গুটিয়ে নিলেও তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিশেষ করে তাদের আইন ও বিচার ব্যবস্থা এখনও বহাল তবিয়তে এখানে বিদ্যমান রয়েছে। অন্যথায় ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় এ ধরনের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো প্রয়োজন হয় না; বরং শরীয়তের বিচারে মূর্খতাপূর্ণ এমন রায় গোড়াতেই বাতিল ও অকার্যকর বিবেচিত হয়। আলহিদায়াহসহ ফিহের বিশাল গ্রন্থগুলোর আদাবুল কাযী অধ্যায়ে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো বিচারক শরীয়া পরিপন্থী কোনো রায় দিলে তা আপনাআপনিই বাতিল বলে বিবেচিত হবে।

রববানী সাহেব তথাকথিত হিল্লা বিয়ের যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ রায় দিয়েছিলেন তাও কোনো ফতোয়া ছিল না; বরং তা ছিল একটি গ্রাম্য সালিশবিচার। তার সাথে হয়তো জড়ানো হয়েছিল সামান্য পড়ুয়া পোশাকধারী কোনো ব্যক্তিকে। জানা কথা যে, কোনো হাতুড়ে চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসাকে বিশেষজ্ঞ ব্যবস্থাপত্র বলে আখ্যা দিবেন না কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি। দেখা যাচ্ছে, রববানী সাহেবের রায়ের ভ্রান্তি রয়েছে শুরুতে (ফতোয়ার সংজ্ঞায়), মাঝে (আলোচিত ঘটনাকে ফতোয়া বলায়) এবং শেষে (সকল ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করা) তথা পুরো রায়ে।

তিনি তাঁর রায়ে সংসদকে ফতোয়াদাতাদের বিরুদ্ধে শাস্তির আইন প্রণয়ন করতে বলেছেন অথচ কোনো সংসদই সে কথা শুনেননি।

এবার নজর দেওয়া যাক, আপিল বিভাগের রায়ের দিকে। সংক্ষিপ্ত এই রায়ে ৫টি ধারা রয়েছে         (বিস্তারিত রায় পরে আসবে)। প্রথমেই বলা হয়েছে, আপিল আবেদনটি আংশিক গ্রহণ করার কথা। এরপর বলা হয়েছে ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দেওয়া যাবে তবে তা প্রদান করতে পারবে যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিরা আর তা গ্রহণ করা বা না করার বিষয়টি থাকতে হবে ঐচ্ছিক। এরপর চতুর্থ ধারায় বলা হয়েছে, ফতোয়ার মাধ্যমে কাউকে শারীরিক বা মানসিক শাস্তি দেওয়া যাবে না।

এ শর্তগুলো অবশ্য ফতোয়ার সংজ্ঞার মধ্যেই রয়েছে। ফতোয়াদাতাকে যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথাযথ শিক্ষিত হতে হবে সেটা তো অনিবার্য শর্ত। কিন্তু আমাদের সমস্যা হল, দুনিয়াবি ক্ষেত্রগুলোতে আমরা এ জাতীয় শর্ত মেনে চললেও শরীয়তের বিষয়ে এক্ষেত্রে অনেকেই তা বেমালুম ভুলে যাই। একজন যত বড় বিখ্যাত প্রকৌশলীই হোন না কেন তিনি ডাক্তারি ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেন না। আবার একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কখনো প্রকৌশল বিষয়ে অন্যকে জ্ঞান দেওয়ার চিন্তা করেন না। কিন্তু ধর্মীয় বিষয়াবলিতে আমরা অনেকেই বিশেষজ্ঞ সেজে যাই। অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন যে, আমি একজন ডক্টর, আমার পিএইচডি যে বিষয়েই হোক না কেন ধর্মীয় বিষয়ে আমি নাক গলাবই। আমি একজন আইনজীবী, ধর্মীয় জ্ঞান আমার থাকুক বা না থাকুক-এ সম্পর্কে মত দিবই। আমি একজন বুদ্ধিজীবী সুতরাং ধর্মীয় পড়াশোনা না থাকলেও আমাকে বিশেষজ্ঞ মতামত দিতে হবে অথবা মাদরাসায় সামান্য দু চার জামাত পড়েই আমি জটিল শরঈ বিষয়ে মতামত দেওয়া শুরু করলাম। এ ধরনের মানসিকতা এ সমাজের অনেকেরই আছে। অথচ অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শরীয়া বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য যে উচ্চাঙ্গের পড়াশোনা থাকতে হয় তা আমরা স্মরণে রাখি না। এজন্য দু ধরনের ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। একদিকে ধর্মের নামে দেওয়া যে কোনো ব্যক্তির বক্তব্যকে ফতোয়া আখ্যা দেওয়া হয় অন্যদিকে না জেনেও ধর্মীয় বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার খেসারত গুনতে হয় দেশ ও জাতিকে। এরই একটি উদাহরণ হাইকোর্টের রায় এবং আরেকটি উদাহরণ কতিপয় আইনজীবী কর্তৃক আপিল শুনানির সময় ফতোয়ার ভুল সংজ্ঞা পেশ করা। শরীয়তে মুফতীর জন্য আবশ্যকীয় কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে তাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথাযথ শিক্ষিত হওয়ার শর্তটি অন্যতম।

আর ফতোয়া তো কোনো বিচারিক রায় নয় যে, তা মানতে কাউকে বাধ্য করা যাবে বা মুফতীও কোনো বিচারক নন যে, তিনি এর মাধ্যমে কাউকে শাস্তি প্রদান করবেন। সুতরাং ফতোয়ার মাধ্যমে কাউকে শাস্তি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

তবে এ পর্যায়ে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায়ের তৃতীয় ধারাটির বিষয়ে আমরা এখন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম। বিস্তারিত রায় আসার পর এ বিষয়ে কথা বলা যাবে ইনশাআল্লাহ।

ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ আশা করেছিলেন, মাননীয় আদালত হয়ত ধর্মীয় নীতি ও অনুশাসন বিরোধী রায় দেওয়ার ব্যাপারে একটি নিষেধাজ্ঞা প্রদান করবেন। এমনিভাবে যেখানে সেখানে ফতোয়া শব্দের অপপ্রয়োগের ব্যাপারে মিডিয়াসহ অন্যদেরকে সতর্ক করবেন। কেননা এ অপপ্রয়োগ এবং অপপ্রচারের কারণেই  মূলত ফতোয়ার বাস্তব সংজ্ঞা ও চিত্র অনেকের সামনে অস্পষ্ট থেকে যায়; বরং ফতোয়া নয়-এমন বিষয়কে ফতোয়া আখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়।

এছাড়া আরেকটি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত রায়ে কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। তা হচ্ছে, হাইকোর্ট যে সুয়োমোটো বা স্বপ্রণোদিত রুল জারি করেছে তা এ পর্যায়ে আইন সিদ্ধ ছিল কি না। কারণ অনেক আইনজীবীই এমনকি কোনো কোনো এ্যামিকাস কিউরিও বলেছেন যে, এক্ষেত্রে সুয়োমোটোর সুযোগ নেই। যদি তা-ই হয় তাহলে তো মামলাটি গোড়া থেকেই অবৈধ ছিল। দেখা যাক, বিস্তারিত রায়ে এ ব্যাপারে আদালত কোনো বক্তব্য দেন কি না। আর আপিল বিভাগ রায়ের শেষাংশে যে কথা বলেছেন (হাইকোর্ট যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফতোয়াকে অবৈধ বলেছিলেন সেটি অবৈধ ফতোয়াই ছিল) সে বিষয়ে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, গ্রাম্য সালিশের সে রায়টি ফতোয়াই নয়। সুতরাং সেটিকে বৈধ বা অবৈধ ফতোয়া বলার সুযোগ ইসলামী আইনে নেই।

পরিশেষে আমরা আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতিদেরকে ফতোয়া বৈধ বলে রায় দেওয়ার জন্য মোবারকবাদ দিতে চাই। যদিও মুসলমানদের কাছে ফতোয়ার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা প্রমাণের জন্য কোনো রায়ের দরকার হয় না, তথাপি মাননীয় আদালত এক দশকের বেশি সময় ধরে জাতির ঘাড়ে ঝুলে থাকা একটি ভুল রায়ের বোঝা অপসারণ করেছেন। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকলকে সুমতি দান করুন।

সর্বশেষে মনে পড়ে গেল বিগত রবিউল আউয়াল মাসে হাইকোর্ট প্রাঙ্গনের সীরাতুন নবী মাহফিলে দেওয়া সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতির (যিনি ফতোয়া মামলার বেঞ্চের প্রধান ছিলেন) বক্তব্যের একটি অংশ। সেখানে তিনি এক পর্যায়ে বলেছেন, আমাদেরকে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শে আদর্শবান হতে হবে। কারণ রোজ হাশরে তিনি হবেন প্রধান উকিল ও ব্যারিস্টার। তিনি আমাদের পক্ষে সকল বিচারপতির প্রধান বিচারপতি আল্লাহ তাআলার দরবারে ওকালতি করবেন, যদি আমরা তাঁর তরীকার অনুসরণ না করি তাহলে তিনি কিভাবে আমাদের পক্ষে ওকালতি করবেন। (বক্তব্যের সারমর্ম)

এই বক্তব্যের বক্তা সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি এখন অবসরে চলে গেছেন। তিনি তাঁর পেশাগত জীবনে এই আদর্শ ধারণ করেছেন কি না সে প্রশ্নের জবাব দিবে ইতিহাস। তবে তাঁর এ চির সত্য বক্তব্যটি যদি মাননীয় বিচারপতি ও সম্মানিত আইনজীবীগণ ধারণ করেন তাহলে আমাদের কোর্টের মর্যাদা যে অনেক উঁচু হবে এবং পিছিয়ে পড়া দেশ ও জাতি যে এগিয়ে যেতে পারবে তাতে সন্দেহ করার কোনোই সুযোগ নেই।

আপিল বিভাগের এ রায় সতর্কবার্তা হোক সকলের জন্য এবং ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তি ইসলামবিরোধী কোনো রায় দেওয়ার দুঃসাহস না দেখাক, এটাই পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে আমাদের প্রার্থনা। 

 

 

advertisement