Jumadal Ula 1432   ||   April 2011

বাবরি মসজিদ-৪

সাইয়েদ সাবাহুদ্দীন আবদুর রহমান

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) 

এই বিবাদের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে বিবদমান তিনটি পক্ষ ছিল : ইংরেজ, হিন্দু ও মুসলমান। ইংরেজরা প্রথমে প্রপাগান্ডা করেছে যে, হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করে মুসলমানদের মসজিদ বানানো হয়েছে। এরপর হিন্দু-মুসলিম বিবাদ মেটানোর জন্য ইংরেজ বাহিনী ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে। হিন্দুদের দাবি ছিল, ধ্বংসকৃত মন্দিরসমূহ পুনর্নির্মাণ করা হোক এবং ঐসব স্থানে নির্মিত মসজিদগুলো ধ্বংস করা হোক। মুসলমানদের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ তাদের দৃষ্টিতে এইসব প্রচার-প্রচারণা ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, ঘটনার সমসাময়িক ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাস-গ্রন্থে যার কোনো প্রমাণ নেই। আর বহু যুগ পরের বইপত্রে এইসব কথা পাওয়া গেলে তা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? সুতরাং মসজিদ স্বস্থানে বহাল থাকবে, তাতে নামায আদায়ে বাধা দেওয়া যাবে না।

অযোধ্যায় মসজিদ-মন্দির বিবাদের সূচনা ১৮৫৫ খৃস্টাব্দে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঐ সময় থেকে আজ পর্যন্ত কোনো হিন্দু পন্ডিত বা ঐতিহাসিক (বাবরি মসজিদ নির্মাণের) সমসাময়িক কোনো হিন্দি বা সংস্কৃত সূত্র থেকে দেখাতে পারেননি যে, অযোধ্যার মসজিদগুলি হিন্দুদের মন্দির ভেঙ্গে বানানো হয়েছিল। কেবল গুজব ও রটনায় কান দিয়ে এবং ইংরেজদের প্রস্ত্ততকৃত বিবরণে বিশ্বাস করেই হিন্দুরা উত্তেজিত হয়েছেন।

১৯৬০ খৃস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যসরকারের পক্ষ থেকে যে গেজেটিয়ার প্রকাশিত হয়েছিল তাতে অযোধ্যার মসজিদ-মন্দির বিবাদের বিষয়ে কোনো হিন্দি বা সংস্কৃত সূত্র উল্লেখ করা হয়নি। শুধু মুসলমানদের লিখিত বই-পুস্তক, যেমন মির্জা জান রচিত হাদীকায়ে শুহাদা এবং কামালুদ্দীন হায়দার হাসানী-আলহোসায়নী আলমাশহাদীকৃত কায়সারুত তাওয়ারীখ ইয়া তাওয়ারীখে আওয়াধ-এর উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।

হাদীকায়ে শুহাদার লেখক মির্জা জান অযোধ্যার আঠার শ পঞ্চান্নর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের প্রত্যক্ষদর্শী। তার গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৬ খৃস্টাব্দে ঐ সংঘর্ষের পর পর। সঙ্গত কারণেই তার উপস্থাপন ঐতিহাসিক সুলভ নয়; বরং সংঘর্ষের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে যেমন হয়ে থাকে তেমনি।

পঞ্চান্নর সংঘর্ষে মুসলমানদের পরাজয় ও ব্যাপক মুসলিম-নিধনে লেখক ছিলেন নিদারুণ মর্মাহত ও বিক্ষুব্ধ। এজন্য তার লেখায় চরম ক্ষোভ ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তাছাড়া গ্রন্থটি যেহেতু বাবর ও আলমগীরের         শাসনামলের অনেক পরে লিখিত তাই তা ঐ স্থানের প্রাচীন মসজিদসমূহের নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠার সন-তারিখের জন্য নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে পারে না।

দ্বিতীয় বইটি অর্থাৎ কায়সারুত তাওয়ারীখ ইয়া তাওয়ারীখে আওয়াধ লিখিত হয়েছে খোদ লেখকের বিবরণ অনুযায়ী হেনরি এলিটের ইঙ্গিতে। এর প্রকাশকাল ১৮৯৬ খৃস্টাব্দ। হেনরি এলিয়ট সম্পর্কে এটুকু তথ্যই যথেষ্ট যে, তিনি হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া এজ টোল্ড বাই ইটস ঔন হিস্টোরিয়ান নামক দশ খন্ডের ঐ বৃহদাকার গ্রন্থটির রচয়িতা, যা হিন্দু ও মুসলমানের মাঝে এমন বিদ্বেষের আগুন প্রজ্জ্বলিত করেছে, যা আজ পর্যন্ত নির্বাপিত হয়নি। সুতরাং তার ইঙ্গিতে প্রস্ত্ততকৃত গ্রন্থও যে ইংরেজ বেনিয়াদের লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে তা তো খুব সহজেই অনুমেয়।

তবে এ জাতীয় বিবরণ ও উপস্থাপন বাদ দিলেও এই দুটি গ্রন্থে প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য রয়েছে। আমরা এখানে তা একত্র করার চেষ্টা করব।

‘‘হাদীকায়ে শুহাদা’’র লেখক বলেন, অযোধ্যার ফেদায়ী খান সুবেদার রামদরবারের মসজিদটি বানিয়েছিলেন। হিন্দুরা তা এমনভাবে গুড়িয়ে দিল যে, এক কোণায় কিছু দেয়াল ও দুই একটি মিনার ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না।

আমজাদ আলী শাহের আমলে তা পুনর্নির্মাণের আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সে আদেশ বাস্তবায়নের আগেই তার মৃত্যু হয়ে যায়। (পৃষ্ঠা : ৫, লোখনৌ এডিশন)

লক্ষণ মোহান্ত কেল্লার মসজিদটি দখল করল। তাতে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার নেই। (প্রাগুক্ত)

এই দুইটি মসজিদের পর বৈরাগিদের নজর পড়ল হনুমান গাড়ির মসজিদের উপর।

লেখক বলেন, ঐ স্থানে (অর্থাৎ হনুমান গাড়িতে) গাজি আওরঙ্গজেব একটি মসজিদ বানিয়েছিলেন। হিন্দুরা তা ভেঙ্গে ফেলার পাঁয়তারায় লিপ্ত ছিল। (প্রাগুক্ত)

সেখানে আগে থেকে মন্দির থাকলে আওরঙ্গযেব তা ভেঙ্গে মসজিদ বানাতে পারেন না। কারণ বিখ্যাত ফতোয়ার কিতাব ফতোয়া আলমগীরী তাঁর আদেশেই সংকলিত হয়েছে। অতএব তাঁর ভালোভাবেই জানা ছিল যে, জবরদখলকৃত জমিতে মসজিদ হয় না। আওরঙ্গযেবের বিদ্বেষী সমালোচক স্যার যদুনাথ সরকারও আওরঙ্গযেবকে অযোধ্যার কোনো মন্দির ভাঙ্গার বিষয়ে অভিযুক্ত করেননি। অথচ তিনি মন্দিরের তালিকা প্রস্ত্তত করে আওরঙ্গযেবকে ঐসব মন্দিরের জায়গায় মসজিদ নির্মাণের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। তাছাড়া কায়সারুত তাওয়ারীখে বলা হয়েছে যে, মসজিদটি সম্প্রতি ঐ স্থানে নির্মিত হয়েছিল।

‘‘হাদীকায়ে শুহাদা’’য় এই মসজিদ-ধ্বংসের যে বিবরণ (পৃষ্ঠা : ১১২) আছে তার সারাংশ হচ্ছে, দর্শন সিং ব্রাহ্মণ পশ্চিম রাল্টার নাযিম হওয়ার পর হনুমান গাড়ির টিলায় একটি দেয়াল ঘেরা দুর্গ নির্মাণ করল, যার কারণে ঐ স্থানের বৈরাগিদের শক্তি   বৃদ্ধি পেল এবং তারা মসজিদের আকার-আকৃতি পরিবর্তন করতে থাকল। ঐ মসজিদে একটি দেয়াল বানিয়ে তার নাম দিল হনুমান গাড়ি। সকাল-সন্ধ্যা তাতে পুজার আগুন জ্বলত। একপর্যায়ে মিম্বার ও মিহরাব ভেঙ্গে মসজিদটি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হল। (হাদীকায়ে শুহাদা,   পৃ. ৬-৭)

‘‘কায়সারুত তাওয়ারীখ ইয়া তাওয়ারীখে আওয়াধ’’ গ্রন্থে বলা হয়েছে-কিছু কাল আগেও আওয়াধের উচ্চভূমিতে একটি মসজিদ ছিল, যা বিগত সুলতানদের আমলে নির্মিত হয়েছিল। হিন্দুরা ঐ জায়গাটিকে হনুমান গাড়ি বলে নামকরণ করল।

মসজিদের পার্শ্বে একটি চবুতরা ছিল, যাতে আশুরার দিন তাযিয়া রাখা হত। একজন দরিদ্র মুসলিম মসজিদটি ঝাড়ু দিতেন। কিছু দিন পর একজন দরিদ্র হিন্দু ঐখানে ঝান্ডা গাড়ল এবং একটি ছোট কক্ষ বানিয়ে তাতে মূর্তি স্থাপন করল। সে জায়গাটির নাম দিল হনুমান-স্থান। নবাব বোরহানুল মুলকের আমলে কতিপয় হিন্দু মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলে। তখন সরকারী ফৌজ এসে দুষ্কৃতিকারীদের শাস্তি দেয় এবং মন্দির ভেঙ্গে মসজিদের জায়গায় মসজিদ নির্মাণ করে। কিছুদিন পর বৈরাগীরা মন্দির নির্মাণ করল এবং মসজিদে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকল। রাজা দরশন বাহাদুর পশ্চিম রাঠ প্রভৃতি স্থানের ক্ষমতা লাভ করলে এ অঞ্চলের হিন্দুদের অর্থ ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তখন তারা মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলে এবং মসজিদের জায়গা দুর্গের  অন্তর্ভুক্ত করে। রামঘাটদরবারের মসজিদটিও তাদের হস্তক্ষেপের শিকার হল। তারা মসজিদের আঙ্গিনায় বসতবাড়ি তৈরি করল এবং মসজিদের ভিতর ময়লা-আবর্জনা ফেলতে থাকল। মুসলমানদের অসংখ্য কবর  ভেঙ্গে ঐ ইট-পাথর দ্বারা সুউচ্চ মন্দির নির্মাণ করল। (খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১১০)

এই বিবরণ থেকে বোঝা যায়, এখানেও দুটি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল। সঙ্গত কারণেই মুসলমানদের মাঝে উত্তেজনার সৃষ্টি হল এবং তারা মসজিদ পুনরুদ্ধারের জন্য প্রস্ত্তত হলেন। প্রথমে তাদের দলনেতা ছিলেন শাহ গোলাম হুসাইন। তিনি যখন বাবরি মসজিদে অবস্থান নিলেন তখন আলেকজান্ডার আর ও তার বাহিনী সেখানে পৌঁছল। এরপর ফয়েজাবাদ থেকে এল জন হরসি। হাদীকায়ে শুহাদার বিবরণ অনুযায়ী ইংরেজদের আগমনে বৈরাগীরা আনন্দিত হল। কারণ ইংরেজদের তারা পক্ষের লোক মনে করত এবং বিশ্বাস করত যে, ইংরেজরা তাদের কোনো ক্ষতি করবে না। হঠাৎ বৈরাগীরা মসজিদে (অর্থাৎ বাবরি মসজিদে) হামলা করল এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল। মুসলমান মুজাহিদরা তাদের হামলা প্রতিহত করে হনুমান গড়হির দরজা পর্যন্ত খেদিয়ে নিয়ে গেলেন। অনেক বৈরাগী নিহত হল এবং মুসলমানরা মসজিদে ফিরে এলেন। এ সময় আলেকজান্ডার ও জন হোর্সে মুসলমান মুজাহিদদের নিকট বার্তা পাঠাল যে, এবার নিশ্চিন্ত মনে মসজিদে অবস্থান করুন। (হনুমান গাড়ির) মসজিদের ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত কেউ আপনাদের লক্ষ করে টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করবে না। তাদের কথায় বিশ্বাস করে মুসলমানরা খাবার খেতে লাগলেন এবং দুই ইংরেজ তাদের   বাহিনী নিয়ে দূরে গেল। আসলে এটা ছিল বৈরাগীদের জন্য সবুজ সংকেত। হাজার হাজার বৈরাগী অকস্মাৎ মসজিদে আক্রমণ করল এবং কসাই যেভাবে গরু জবাই করে ঠিক ঐভাবে মুসলমানদের জবাই করা হল। মসজিদ-প্রাঙ্গণে রক্তের স্রোত বইতে লাগল। কুরআন মজীদ আগুনে পোড়ানো হল। এরপর মুসলমানদের মৃতদেহ পদদলিত করে হিন্দুরা বাড়ি ফিরে গেল।

‘‘হাদীকায়ে শুাহাদা’’র লেখক বলেন, দুই ইংরেজ অফিসার ও তাদের বাহিনীকে দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের জবাই হওয়ার দৃশ্য দেখল, তাদের কোনো সাহায্যই করল না। অবশ্য তাদের কাছে এই আশা করাও অন্যায়। কারণ এটা তো ছিল আলেকজান্ডার ও জন হোর্সেরই বাহিনী! পরের দিন নেছার হোসাইন কোতোয়াল মসজিদের দরজার সম্মুখে গর্ত খনন করে লাশগুলো সমাহিত করল। (হাদীকায়ে শুহাদা, পৃ. ১০-১৮)

এই ঘটনাটির আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মির্জা আলা আলীর বিবরণে এসেছে এভাবে-দুই ইংরেজ অফিসার, আমি ও মির্জা নেছার হোসাইন নিজ নিজ ফৌজ ও তোপ নিয়ে সেখান থেকে সরে এলাম এবং অনেক দূরে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম। এদিকে এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে হাজার হাজার বৈরাগী গুলি করতে করতে এগিয়ে গেল এবং মসজিদ ঘেরাও করে ফেলল। তারা রজব আলী শাহ ফকীরের কুঠিতে চড়ে গোলাম হোসাইনের সঙ্গীদের দিকে গুলি বর্ষণ করতে থাকল। এরপর মসজিদে ঢুকে ২৬৯ জন মুসলমানকে জবাই করল এবং লাশগুলো টুকরা টুকরা করে ফেলল। মসজিদে রক্তের স্রোত বয়ে গেল। মসজিদের কুরআন মজীদগুলোও ছিড়ে টুকরা টুকরা করল এবং (নাউযুবিল্লাহ) পদদলিত করে আগুনে পোড়ালো।  মসজিদের দেয়ালগুলি ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল। মুসলমানদের লাশ কাফন-দাফনহীন পড়ে রইল। পরের দিন মির্জা নেছার হোসাইন মসজিদের দরজায় একটি বড় কবর খুড়ে লাশগুলি দাফন করল। (খ. ২, পৃ. ১১২)

‘‘হাদীকায়ে শুহাদা’’য় আছে যে, বাবরি মসজিদের চরম অবমাননা ও মুসলমানদের নৃশংসভাবে হত্যা করার পর বৈরাগীর দল মসজিদের আঙ্গিনায় হোম করল ও শাঁখ বাজাল। বীর হনুমানের জয়ধ্বনি করল যে, তাঁর কৃপায় অযোধ্যা ম্লেচ্ছমুক্ত হয়েছে এবং এই আনন্দে মোহন ভোগ খেল।

মোটকথা এমন কোনো অবমাননা নেই, যা তারা বাকি রাখল। মসজিদের অদূরে উঁচু ভূমিতে একটি কবরস্থান ছিল, যাতে অনেক শহীদের কবর ছিল। একে খাজা মিটটী (বা খাজা মীঠী) বলা হত। কবরগুলি খুড়ে তছনছ করে দিল এবং একটি মাটির মূর্তি ঐ স্থানে বসিয়ে দিল। কেউ কেউ বলে, বৈরাগীরা এত শক্তি-ক্ষমতা কোথায় পাবে? এটা ছিল মানসিংয়ের লোকদের কাজ। (পৃষ্ঠা : ১৪)

মানসিংহ উপরে উপরে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের প্রতি বিশ্বস্ত হলেও মূলত সে ছিল ইংরেজদের খাস লোক, তাদের ইশারায় সে চলত। উপরের ঘটনা তাওয়ারীখে আওয়াধে এভাবে বর্ণিত আছে- বৈরাগীর দল জুতা পায়ে মসজিদে প্রবেশ করল এবং শঙ্খ বাজাল ও হোম করল। বহু ধরনের অসম্মান করল। অদূরে খাজা মীঠীর কবরস্থান ও সাইয়্যেদ সালার রাহ.-এর শহীদানের কবর ছিল। সব তছনছ করে ফেলল। বলাবাহুল্য, বৈরাগীদের এত জনবল ছিল না, কিন্তু শত শত পান্ডা, রাজা মানসিংহের পেয়াদা, রাজা কৃষ্ণদত্ত ও আশপাশের জমিদাররা বৈরাগীদের সাহায্যের জন্য অকুস্থলে উপস্থিত হলে প্রায় দশ বারো হাজার লোক একত্র হয়ে গেল। (খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১১)

এদের মোকাবেলায় মাত্র তিনশ মুসলমান মসজিদের ভিতরে ছিলেন। ইংরেজ রেসিডেন্টের আদেশাধীন বাহিনী নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল। কারণ সবকিছু তো তাদের ইঙ্গিতেই হচ্ছিল।

একটি আশ্চর্য বিষয় এই যে, এই সংঘর্ষের পর বৈরাগীরা হনুমান গাড়িতে কোনো মসজিদ থাকার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করল। অথচ ইতিপূর্বে তাদের অভিযোগ ছিল যে, আওরঙ্গযেব ঐখানে মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ বানিয়েছিলেন! তাওয়ারীখে আওয়াধের বিবরণ অনুযায়ী হনুমান গাড়ির ঐ মসজিদ অনেক মানুষ নিজের চোখে দেখেছেন বরং অনেকে তাতে নামাযও পড়েছেন। কাযী ইয়ার আলী ইবনুদ্বীনের শত শত বছরের মাহযার কাযী হাবীবুল্লাহর কাছে বিদ্যমান আছে। (প্রাগুক্ত পৃ. ১১২)

এই মসজিদ পুনরুদ্ধারের জন্য পুনরায় মুসলমানরা প্রস্ত্তত হলেন। এবার তাদের নেতৃত্বে ছিলেন মৌলভী আমীর আলী আমীঠাবী। তাঁদের যুক্তি ছিল, আজ হনুমান গাড়ির মসজিদের বিষয়ে মুসলমানরা আপোস করলে হিন্দুদের দুঃসাহস বেড়ে যাবে এবং লখনৌর একটি মসজিদও নিরাপদ থাকবে না। প্রত্যেক মসজিদে এরা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করবে। (হাদীকায়ে শুহাদা, পৃ. ১৮)

মৌলভী আমীর আলী আমীঠবী তাঁর ফেদায়ী সাথীদের নিয়ে আগে বাড়লেন। প্রথমে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের সাথে আলোচনা হল। একটি সাক্ষাতের বিবরণ ‘‘হাদীকায়ে শুহাদা’’য় এভাবে দেওয়া হয়েছে-

‘‘নবাব বললেন, আপনি এত তড়িঘড়ি করছেন কেন? আপনার চেয়ে আমাদের চিন্তা কোনো অংশে কম নয়। খোদার কসম, কাফিরদের জুলুম-অত্যাচারে যারপরনাই মর্মাহত। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বড় সাহেবের সাথেও কথা বলার সুযোগ নেই। আল্লাহর কালাম আগুনে পোড়ানোর সংবাদ শুনে কলিজা বিদীর্ণ হয়েছে, কিন্তু আপনার কি মনে নেই শেখ সাদী কী বলেছেন, দের আয়াদ দুরস্ত আয়াদ যে কাজ ধীরে সুস্থে করা হয় তা সঠিক হয়। এটা কি উস্তাদের কথা নয়? আপনি একটু চিন্তা-ভাবনা করুন এবং কিছুদিন অপেক্ষা করুন। আমরা কৌশলে মসজিদটি উদ্ধার করব এবং দুষ্কৃতিকারীদেরও শাস্তির ব্যবস্থা করব’’ (পৃষ্ঠা : ২৫)

এখানে বড় সাহেব অর্থ ইংরেজ রেসিডেন্ট। এই উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় যে, ইংরেজদের ইশারাতেই সব কিছু হচ্ছিল এবং পরিস্থিতির উপর নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এমনকি বড় সাহেবের সাথে তাঁর সাক্ষাতেরও সুযোগ ছিল না।

মৌলভী আমীর আলী নবাবের অসহায়ত্ব বুঝতে পারলেন এবং তার      প্রস্তাবকে কালক্ষেপনের বাহানা মনে করে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রসর হলেন। এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ হাদীকায়ে শুহাদা এবং তাওয়ারীখে আওয়াধ গ্রন্থে পাওয়া যাবে।

মৌলভী আমীর আলীর লড়াইয়ের ময়দানে অবতীর্ণ হওয়া, গাদ্দারদের প্রতারণা, সবশেষে ইংরেজ অফিসার বার্লোর কামানের গোলায় তাঁর শাহাদত এই সব কিছুর বিবরণ ঐ দুই কিতাবে পাওয়া যাবে। হাদীকায়ে শুহাদায় আছে যে, বার্লো বাহিনীর মুহুর্মুহু কামানের গোলায় রোয কেয়ামতের অবস্থা সৃষ্টি হল। আসমান-যমীন বিস্ফোরিত হতে লাগল এবং অসহায় মুসলমানদের ব্যাপক হত্যাকান্ডে আসমানের ফেরেশতারা ফরিয়াদ করতে লাগল।

আমীরুল মুজাহিদীন একথা বলতে বলতে শহীদ হলেন-ছারে ময়দাঁ কাফন বর দোশ দারম। (পৃষ্ঠা : ৫৭)

গোনডার তালুকদারও বার্লোর সাথে যোগ দিয়েছিল। ‘‘তাওয়ারীখে আওয়াধ’’ গ্রন্থে বলা হয়েছে-মৌলভী সাহেব তার জায়নামাযের উপর পশ্চিমমুখী হয়ে পড়ে গেলেন। শুরু থেকেই তার দুআ ছিল, আমি যেন কোনো মুসলমানের হাতে নিহত না হই (অর্থাৎ নবাবের কোনো সিপাহীর হাতে)। খোদা তাআলা তার দোয়া কবুল করেছেন। অন্য নামাযীদের লাশও তাঁর চারপার্শ্বে পড়ে রইল। তেলেঙ্গা সেপাইরা বারলুকে সংবাদ দিল, সব মুজাহিদ খতম!

এক তেলেঙ্গি মৌলভী সাহেবের মাথা কেটে আনল। ইংরেজ সেনাপতি যুদ্ধ জয়ের নিদর্শন স্বরূপ তা সরকারের উদ্দেশে পাঠিয়ে দিল। হুজুরে আলা তিরস্কার করে বললেন, কর্তিত মস্তক এখানে কেন এনেছ? তোমরা চাও, লাখনৌতেও হাঙ্গামা সৃষ্টি হোক। হুকুম হল যে, বড় সাহেবকে দেখানোর পর এই মাথা দেহের সাথে মিলিয়ে দাফন করবে। মস্তক বহনকারী সেপাইরা শঙ্কিত হল যে, ফিরতি পথে কোনো মুজাহিদ যদি দেখতে পায় তাহলে তা ছিনিয়ে নিবে এবং আমাদেরকে হত্যা করবে। তাই বড় সাহেবকে দেখানোর পর মস্তকটি কোথাও ফেলে দিল এবং সোজা বারলোর কাছে চলে গেল। (পৃষ্ঠা : ১২৬-১২৭)

দীর্ঘ বিবরণে পাঠক হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, কিন্তু এই প্রেক্ষাপট আপনাকে বাবরি মসজিদ সমস্যার গভীরে পৌঁছতে সাহায্য করবে। এবং বুঝতে কষ্ট হবে না যে, হনুমান গাড়ির রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রকৃত বিজয়ী কারা ছিল? নিঃসন্দেহে বিজয়ী পক্ষ হচ্ছে আলেকজান্ডার আর জন হোর্সে, বারলু ও আওয়াধের রেসিডেন্ট জেনারেল অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ। এরাই অযোধ্যায় মসজিদ-মন্দির বিবাদ সৃষ্টি করেছিল এবং ক্ষমতা দখলে সহযোগিতা পাওয়ার জন্য হিন্দুদের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করেছিল। অন্তত অযোধ্যার সংঘর্ষে তো তাদের পক্ষপাত ছিল একদম সুস্পষ্ট।

ইংরেজ ছত্রছায়ায় বৈরাগীরা যখন তিন-চারটি মসজিদ ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে তখন বাবরি মসজিদ ধ্বংসে কেন তারা উৎসাহিত হবে না? তারা তো ইতিমধ্যে বাবরি মসজিদে প্রবেশ করে হোমযজ্ঞ করেছে, শঙ্খ বাজিয়েছে এবং মোহন ভোগ খেয়েছে। শুধু বাকি ছিল মসজিদটি গুড়িয়ে দেওয়া এবং সে স্থানে মন্দির নির্মাণ করা। কিন্তু শত পশ্চাৎপদতা ও ব্যাপক গণহত্যার শিকার হয়েও অযোধ্যার মুসলমানরা ঈমানী তেজ ও জাতীয় চেতনাকে বক্ষে ধারণ করে রেখেছিলেন। চরম পর্যুদস্ত অবস্থাতেও তারা বৈরাগীদের মসজিদ থেকে তাড়িয়েছেন এবং মসজিদটি রক্ষায় যুক্তি-প্রমাণ এবং ধর্ম ও আইন সকল দিক থেকে হিন্দুদের সাথে অবিরাম লড়াই করেছেন। আগামী আলোচনায় পাঠক তা দেখতে পাবেন।

ইংরেজ যথারীতি হিন্দুদের পক্ষপাতিত্ব করেছে এবং তাদেরকে উসকানি দিয়েছে, কিন্তু রাম-জন্মস্থান ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণের সমসাময়িক ও নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল তারা যোগার করতে পারেনি। এজন্য মুসলমানদের উচ্ছেদ করে মসজিদের জমি হিন্দুদের অধিকারে দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবু তারা অবিরাম প্রচারণা করেছে যে, এই মসজিদ জন্মস্থান ধ্বংস করেই নির্মিত। তাদের প্রস্ত্ততকৃত গেজেটিয়ারেও এসব কথা থাকত, কিন্তু (উদ্ধৃতির অভাবে) সেসব ভাষ্য-বক্তব্য গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

ইংরেজ হুকুমত পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্ররোচনায় বৈরাগীরা কখনো মসজিদে ঢুকে পড়ত, মূর্তি স্থাপন করত, এমনকি পূজা-পাঠও করত, কিন্তু আদালতের মামলায় কখনো তারা জয়লাভ করতে পারেনি। সামনের আলোচনায় পাঠক তা দেখতে পাবেন।

এই সব প্ররোচনার পিছনে ইংরেজদের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বিবাদটি জিইয়ে রাখা এবং ভারতবর্ষের প্রধান দুটি জাতিকে এর মাঝেই লিপ্ত রাখা। বস্তুত উভয় জাতির ধর্মীয় আবেগ পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের রাজ্যক্ষমতাই নিষ্কন্টক করতে চেয়েছিল।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement