Jumadal Ula 1432   ||   April 2011

শেয়ার বাজার : প্রসঙ্গ কথা-৩

Mufti Abul Hasan Muhammad Abdullah

প্রশ্ন : সম্প্রতি শেয়ারবাজারকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ফান্ড গঠনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এর দ্বারা শেয়ারবাজার কতটুকু প্রভাবিত হবে বলে মনে করেন? 

উত্তর : বাংলাদেশ ফান্ড নিয়ে ইতিমধ্যেই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। ৫ হাজার কোটি টাকার এ ফান্ড শেয়ারবাজারের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি ভালো কোনো বার্তা বয়ে আনবে বলে অনেকেই মনে করেন না। শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক ভয়াবহ ধস সামাল দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে  বাংলাদেশ ফান্ড গঠনের বিষয়টি তার অন্যতম। বলা হচ্ছে, বাজারের তারল্য সংকট লাঘবের জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অথচ কে না জানে যে, মাত্রাতিরিক্ত তারল্যই শেয়ারবাজারের উর্ধ্বমুখিতা লাগামহীন করে তুলেছিল এবং মার্চেন্ট ব্যাংকের লোন, বুক বিল্ডিং, অস্বাভাবিক প্রিমিয়াম, মিউচুয়াল ফান্ড আর বিভিন্ন ব্যাংকের কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে একেকটি শেয়ারের মূল্য উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল অযৌক্তিক পর্যায়ে, যা গত বছরের শেষ দিকে (ডিসেম্বর ২০১০) এসে মারাত্মকভাবে হোঁচট খায় এবং কুচক্রি মহল সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। কয়েক মাস হয়ে গেলেও শেয়ারবাজারের বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি এখনো কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। আর ভবিষ্যতেও যে বাস্তবভিত্তিক কোনো রিপোর্ট আদৌ প্রকাশিত হবে কি না তা এখনই বলে দেওয়া যায়। কারণ শেয়ার বাজারের নেপথ্য নায়করা সহজে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে আসার পাত্র নন। যাই হোক, আমাদের মতে অন্তত দুটি কারণে বাংলাদেশ ফান্ড গঠনের সিদ্ধান্তটি অযৌক্তিক : এক. ৫০০০ কোটি টাকার এ ফান্ড বাস্তবায়িত হলে অধিক তারল্য প্রবাহের কারণে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। বাজারে শেয়ারের যে যোগান রয়েছে সে তুলনায় চাহিদার পরিমাণ এখনো অনেক বেশি রয়েছে। সে অবস্থায় নতুন কোনো যোগান ছাড়াই ৫০০০ কোটি টাকা বাজারে এলে তা আরেকটি বিপর্যয়ের প্রাথমিক কারণ হতে পারে। দুই. ৫ হাজার কোটি টাকার এ ফান্ডের মূল উদ্যোক্তা হচ্ছে সরকার এবং এ টাকার বড় অংশ যোগান দিবে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংকসহ সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ঝুঁকিপূর্ণ বাজারে ঢেলে দেওয়ার পর আরেকটি বিপর্যয় হলে এর দায় কে বহন করবে? সাধারণ নাগরিকদের উপর আরোপিত ট্যাক্সের টাকা দিয়ে তখন এ ভর্তুকি সামাল দিতে হবে। সুতরাং ৫ হাজার কোটি টাকার বাংলাদেশ ফান্ডকে বলা যেতে পারে এমন একট ব্যথানাশক ঔষধ, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কিডনীই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।  

প্রশ্ন : আরেকটি কথা শোনা যাচ্ছে, বাই ব্যাক নামক একটা কিছু আসছে শেয়ারবাজারে ...। 

উত্তর : শুধু বাই ব্যাক নয়, পুঁজিবাদী স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আরো যা যা দরকার সব কিছুই ধীরে ধীরে দেখতে পাবেন এ বাজারে। বাইব্যাক অর্থ হচ্ছে, পুনঃক্রয়। প্রথমে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম বাজারে কমে গেলে ঐ কোম্পানিকে তাদের শেয়ার বাজার থেকে পূর্বের মূল্যে পুনরায় ক্রয় করতে বাধ্য করা হবে। কিন্তু অনেকেই বিষয়টিকে হাস্যকর ও বাস্তবতা বহির্ভূত আখ্যা দেওয়ার পর এখন বাই ব্যাক বিষয়টি নিয়ে আরো চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। বিদেশের অনেক শেয়ারবাজারে চালু থাকা বাই ব্যাক হচ্ছে মূলত শেয়ার হোল্ডারদেরকে টাকা ফেরত দিয়ে কোনো কোম্পানির পেইড আপ ক্যাপিটাল তথা পরিশোধিত মূলধন হ্রাস করার নাম। এর জন্য থাকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও আইন-কানুন। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন, কঠোর বিধি-বিধান ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বাইব্যাক চালু হলে তা কারসাজির নতুন দ্বার উন্মোচন করবে এবং বাজার থেকে বড় পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার আরেকটি সুযোগ সৃষ্টি হবে। 

আর শরীয়তের দৃষ্টিতে চিন্তা করলে আমরা বলতে পারি যে, কোনো কিছু বিক্রির সাথে বাইব্যাক বা পুনঃক্রয়ের শর্তারোপ করা নিষিদ্ধ বেচা-কেনার অন্তর্ভুক্ত এবং অনেক ক্ষেত্রে সুদী লেনদেনের শামিল। যেহেতু এখনো বাইব্যাক-এর বিস্তারিত নিয়ম-পদ্ধতি ঠিক হয়নি তাই এ সম্পর্কে পুরোপুরি শরঈ বিশ্লেষণেরও সময় হয়নি।

আসলে আমাদের মধ্যে বিদেশপ্রীতি এত প্রকট যে, ভিন দেশে কোনো কিছু দেখলেই আমরা তা লুফে নিতে চেষ্টা করি। আমাদের দেশের পরিস্থিতির সাথে তা আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ কি না তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করি না। এ প্রসঙ্গে একটি কথা মনে পড়ছে। একবার ঢাকা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে কাজের ধীর গতিতে যাত্রীগণ খুব বিরক্ত। এমন সময় এক প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মরত অফিসারকে বেশ বকা-ঝকা করলেন যে, ইউরোপ-আমেরিকায় তো এ সব কাজ মুহূর্তেই হয়ে যায়। কিছুক্ষণ লোকটির বক্তব্য শোনার পর বয়োবৃদ্ধ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা বললেন, আপনি ইউরোপ-আমেরিকাকে এখানে টেনে আনছেন কেন? আমরা কি তাদের মতো প্রশিক্ষণ পাই? আমাদের অবকাঠামো ও প্রযুক্তি কি তাদের মতো? সুতরাং আপনি সেখানকার সেবা এখানে পাওয়ার আশা করেন কোন যুক্তিতে? প্রবাসী ভদ্রলোক একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। লাইনে দন্ডায়মান যাত্রীরা এতক্ষণ বিরক্ত হলেও ইমিগ্রেশন অফিসারের কথাকেই যৌক্তিক মনে করলেন।

সুতরাং বিদেশের স্টক এক্সচেঞ্জের কোনোকিছু দেখলেই তা বাছ-বিচার ছাড়া এখানে চালু করে দেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই আত্মঘাতী হতে পারে।

আমি আবারো বলব যে, হালাল-হারাম বেছে চলতে আগ্রহী মুসলমানদের জন্য বর্তমান শেয়ারবাজার থেকে দূরে থাকা আবশ্যক।

প্রশ্ন : তাহলে কি ইসলামী নীতিতে স্টকএক্সচেঞ্জ বা শেয়ারবাজার পরিচালনা একেবারেই সম্ভব নয়?

উত্তর : কেন নয়। অবশ্যই সম্ভব। তবে সেটা হতে হবে শরীয়ত সমর্থিত স্বতন্ত্র নীতিমালার ভিত্তিতে এবং তাতে শুধু শরিয়া পরিপালনে অঙ্গিকারাবদ্ধ হালাল পন্থায় ব্যবসাকারী কোম্পানিগুলোর শেয়ার লেনদেনের সুযোগ থাকবে এবং সে বাজারকে সকল প্রকারের কৃত্রিমতা, প্রতারণা ও কারসাজি থেকে মুক্ত রাখতে হবে।

মূলত করণীয় কাজ ছিল এটিই। প্রচলিত শেয়ারবাজারে শর্তযুক্ত বিনিয়োগের হীলা-কৌশল না বলে যদি শুরু থেকেই স্বতন্ত্র  ইসলামসম্মত স্টক এক্সচেঞ্জের চিন্তা করা হত তাহলে হয়ত একটি রাস্তা বেরও হতে পারত। কিন্তু সুদ, জুয়া ও প্রতারণাভিত্তিক পুঁজিবাদের কারবারগুলোকে জোড়াতালি দিয়ে জায়েয বলার প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রেই মুসলমানদের ইসলামের মূল আদর্শ, সৌন্দর্য ও কল্যাণ থেকে পিছিয়ে পড়ার ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ হয়ে যায়।

ইসলামী পন্থায় শেয়ারবাজার চললে সেখানে যেমন রাতারাতি কারো আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার সুযোগ থাকবে না তেমনি কাউকে সর্বস্ব হারিয়ে পথেও বসতে হবে না।

 

advertisement