Shaban 1446   ||   February 2025

শবে বরাত : কিছু ভ্রান্তি নিরসন

Mawlana Muhammad Abdul Malek

আলকাউসারের শাবান ১৪২৬ হি. (সেপ্টেম্বর ’০৫ ঈ.) সংখ্যায় ‘বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শাবান ও শবে বরাত’ শিরোনামে, শাবান ১৪২৭ হি. (সেপ্টেম্বর ’০৬ ঈ.) সংখ্যায় ‘উলামায়ে সালাফের উক্তির আলোকে শাবান শবে বরাত’ শিরোনামে এবং রজব ১৪২৮ হি. (আগস্ট ’০৭ ঈ.) সংখ্যায় ‘অজ্ঞতা ও রসম-রেওয়াজের কবলে শাবান-শবে বরাত : নববী নির্দেশনাই মুক্তির উপায়’ শিরোনামে শাবান ও শবে বরাত সম্পর্কে অনেকগুলো প্রয়োজনীয় কথা পাঠকের সামনে এসে গেছে। ওয়াল হামদু লিল্লাহি তাআলা আলা যালিকা হামদান কাছীরা।

এ সংখ্যায় (আগস্ট ’০৮ ঈ.) শুধু কিছু ভুল ধারণা চিহ্নিত করে দিতে চাই। কেননা এগুলো সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন এসে থাকে।

প্রশ্ন ১ : আমি এক কিতাবে পড়েছি যে, শবে বরাত বিষয়ক সকল হাদীস ‘মওযূ’। ইবনে দিহইয়ার উদ্ধৃতিতে কথাটা ওই কিতাবে লেখা হয়েছে।

উত্তর : এটা একটা ভুল কথা। ইবনে দিহইয়া কখনো এমন কথা বলতে পারেন না। যিনি তার উদ্ধৃতিতে এ কথা লিখেছেন তিনি ভুল লিখেছেন। ইবনে দিহইয়া শুধু এটুকু বলেছেন যে, শবে বরাতে বিশেষ নিয়মের নামায এবং  সে নামাযের বিশেষ ফযীলতের যে কথাগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত, তা মওযূ। তাঁর মূল আরবী বক্তব্য তুলে দিচ্ছি

أحاديث صلاة البراءة موضوعة.

শবে বরাতের বিশেষ নামায সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো মওযূ।’ (তাযকিরাতুল মাওযূআত, মুহাম্মাদ তাহের পাটনী, পৃ. ৪৫)

আল্লামা লাখনৌবী রাহ. ‘আলআসারুল মারফূআহ ফিল আখবারিল মাওযূআহ’ (পৃ. ৮০-৮৫)-এ পরিষ্কার লিখেছেন, ‘শবে বরাতে রাত জেগে ইবাদত করা এবং যেকোনো নফল আমল, যাতে আগ্রহ বোধ হয়, তা আদায় করা মুস্তাহাব। এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। এ রাতে মানুষ যত রাকাত ইচ্ছা নামায পড়তে পারে, তবে এ ধারণা ভুল যে, এ রাতের বিশেষ নামায রয়েছে এবং তার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। যেসব বর্ণনায় এ ধরনের কথা পাওয়া যায় সেগুলো ‘মওযূ’। তবে এ রাত একটি ফযীলতপূর্ণ রজনী এবং এ রজনীতে ইবাদত-বন্দেগী করা মুস্তাহাব এ বিষয়টি সহীহ হাদীস থেকেও প্রমাণিত।

মোটকথা, এ রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করা যেমন ভুল, তদ্রূপ মনগড়া কথাবার্তায় বিশ্বাসী হওয়াও ভুল।’

আল্লামা শাওকানীও ‘আলফাওয়াইদুল মাজমূআ’য় (পৃ. ৫১) এই ভুল ধারণা সংশোধন করেছেন।

প্রশ্ন ২ : একজন আলেমের কাছে শুনেছি, শবে বরাতে কবরস্থানে যাওয়া ‘মাসনূন’ নয়। আর আজকাল যেভাবে এ রাতে কবরস্থানে মেলা বসানো হয় এবং মহিলারাও বেপর্দা হয়ে সেখানে গিয়ে ভিড় করে, তা তো একেবারেই নাজায়েয।

প্রশ্ন এই যে, যতটুকু নাজায়েয তা তো অবশ্যই নাজায়েয, কিন্তু যদি মহিলারা বেপর্দা না হয় এবং কোনো গুনাহের কাজও সেখানে না হয়, তবুও কি এ রাতে কবর যিয়ারত মাসনূন বলা যাবে না? হাকীমুল উম্মত ‘ইসলাহুর রুছূম’ কিতাবে একে ‘মাসনূন’ লিখেছেন।

উত্তর : মহিলাদের জন্য যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কবরস্থানে যাওয়া এমনিতেও নিষেধ। এরপর যদি পর্দাহীনতা ও অন্যান্য আপত্তিকর বিষয় এর সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে তা আরো কঠিন হয়ে যায়। আর কবরস্থান যদি নিকটবর্তী হয় এবং তা মাযার না হয় আর সেখানে শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর কাজকর্ম না হয়, তাহলে পুরুষের জন্য এ রাতে সেখানে গিয়ে যিয়ারত করার বিধান কী? হাকীমুল উম্মত রাহ. প্রথমে একে মাসনূন লিখেছিলেন। পরে আরো চিন্তা-ভাবনা ও উলামায়ে কেরামের সঙ্গে মতবিনিময় করার পর ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করেন এবং লেখেন, আমি কবরস্থানে যাওয়া থেকে বারণ করাকেই অধিক সতর্কতার বিষয় মনে করি। (ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/২৮)

শরীয়তের নীতিমালার আলোকে হযরত থানভী রাহ.-এর দ্বিতীয় মতই অগ্রগণ্য।

প্রশ্ন ৩ : সুনানে ইবনে মাজাহ্য় (হাদীস ১৩৮৮) পনেরো শাবান রাত সম্পর্কে এই হাদীসটি উল্লেখিত হয়েছে

قُوْمُوْا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا.

এই রাত জেগে ইবাদত কর এবং দিনে (অর্থাৎ পনেরো শাবান) রোযা রাখ।

এই হাদীসটি থানভী রাহ. ‘খুতুবাতুল আহকাম’-এ উল্লেখ করেছেন এবং ‘ইসলাহুর রুসূম’-এ পনেরো শাবান-এর রোযাকে মাসনূন বলেছেন। কিন্তু এক ব্যক্তি আমাকে বলেছেন যে, শায়েখ আলবানী রাহ. এই হাদীসটিকে মওযূ বলেছেন। এরপর হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম-এর ‘ইসলাহী খুতুবাত’-এ দেখলাম, সেখানে এই হাদীসটিকে ‘যয়ীফ’ লেখা হয়েছে এবং এই রোযাকে ‘সুন্নত’ মনে করা ভুল বলা হয়েছে। প্রকৃত বিষয়টি বুঝে আসছে না। আশা করি সাহায্য করবেন।

উত্তর : ইবনে মাজাহর উপরোক্ত হাদীসটি ‘মওযূ’ তো কখনোই নয়। তবে সনদের দিক থেকে ‘যয়ীফ’। যেহেতু ফাযায়েলের ক্ষেত্রে ‘যয়ীফ’ গ্রহণযোগ্য, তাই আলেমগণ শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে এ হাদীস বয়ান করে থাকেন।

শায়েখ আলবানী রাহ. ‘সিলসিলাতুয যয়ীফা’য় (৫/১৫৪) এই বর্ণনাকে ‘মওযূউস সনদ’ লিখেছেন। অর্থাৎ এর ‘সনদ’ মওযূ। যেহেতু অন্যান্য ‘সহীহ’ বর্ণনা উপরোক্ত বর্ণনার বক্তব্যকে সমর্থন করে, সম্ভবত এজন্যই শায়েখ আলবানী রাহ. সরাসরি ‘মওযূ’ না বলে ‘মওযূউস সনদ’ বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। তথাপি শায়েখ আলবানীর এই ধারণা ঠিক নয়। সঠিক কথা এই যে, এই বর্ণনা ‘মওযূ’ নয়, শুধু ‘যয়ীফ’। ইবনে রজব রাহ. প্রমুখ বিশেষজ্ঞদের এই মতই আলবানী সাহেব নিজেও বর্ণনা করেছেন।

এ প্রসঙ্গে আলবানী সাহেব যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তা এই যে, এ বর্ণনার সনদে ‘ইবনে আবী ছাবুরা’ নামক একজন রাবী রয়েছেন। তার সম্পর্কে হাদীস জাল করার অভিযোগ রয়েছে। অতএব এই বর্ণনা ‘মওযূ’ হওয়া উচিত। তবে এই ধারণা এজন্য সঠিক নয় যে, ইবনে আবী সাবুরাহ সম্পর্কে উপরোক্ত অভিযোগ ঠিক নয়। তার সম্পর্কে খুব বেশি হলে এটুকু বলা যায় যে, যয়ীফ রাবীদের মতো তার স্মৃতিশক্তিতে দুর্বলতা ছিল। রিজাল শাস্ত্রের ইমাম আল্লামা যাহাবী রাহ. পরিষ্কার লিখেছেন যে, ‘স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণেই তাকে যয়ীফ বলা হয়েছে।’ (দেখুন সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৭/২৫০)

সারকথা এই যে, উপরোক্ত বর্ণনা মওযূ নয়, শুধু যয়ীফ।

পনেরো শাবানের রোযা সম্পর্কে থানভী রাহ. যে ‘মাসনূন’ বলেছেন তার অর্থ হল মুস্তাহাব। আর ইসলাহী খুতুবাতের আলোচনা মনোযোগ দিয়ে পড়া হলে দেখা যায় যে, তা এ কথার বিপরীত নয়। ওই আলোচনায় ‘যয়ীফ’ হাদীসের ওপর আমল করার পন্থা বিষয়ে একটি ইলমী আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে। হযরত শায়খুল ইসলাম পনেরো তারিখের রোযা রাখতে নিষেধ করেননি। তিনি শুধু এটুকু বলেছেন যে, একে শবে বরাতের রোযা বলবে না। শুধু শেষের দুই দিন ছাড়া গোটা শাবান মাসেই রোযা রাখা মুস্তাহাব। তাছাড়া প্রতি মাসের ‘আইয়ামে বীয’ (চাঁদের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ) রোযা রাখা মুস্তাহাব। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ দিনের রোযা রাখা হলে ইনশাআল্লাহ সওয়াব পাওয়া যাবে।

প্রশ্ন ৪ : আমি একটি পুস্তিকায় পড়েছি, শবে বরাত সম্পর্কে যেসব রেওয়ায়েত পাওয়া যায়, তন্মধ্যে সনদের বিবেচনায় সবচেয়ে উত্তম রেওয়ায়েতটিই হল ‘যয়ীফ’, তাহলে অন্যগুলোর অবস্থা খুব সহজেই অনুমেয়। এ কথা কি সঠিক?

উত্তর : এ কথাটা একেবারেই ভুল। শবে বরাত সম্পর্কে বেশ কয়েকটি হাদীস এসেছে। তার মধ্যে একটি হাদীস ‘সহীহ’, কিছু হাদীস ‘হাসান’ আর কিছু ‘যয়ীফ’। এজন্য শবে বরাতের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস যয়ীফ একথা ঠিক নয়। সনদের বিচারে সবচেয়ে উত্তম বর্ণনা সেটা, যা ইবনে হিব্বান ‘কিতাবুস সহীহ’-এ (হাদীস ৫৬৬৫) বর্ণনা করেছেন।

عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: يَطَّلِعُ اللهُ إِلَى خَلْقِه فِيْ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، فَيَغْفِرُ لِجَمِيْعِ خَلْقِهِ، إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ.

মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতঃপর শিরককারী ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া তার সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন।

হাদীসটি অনেক নির্ভরযোগ্য হাদীসের কিতাবেই নির্ভরযোগ্য সনদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান তার ‘কিতাবুস সহীহ’-এ (যা সহীহ ইবনে হিব্বান নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ, ১৩/৪৮১৩) এই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। এটি এই কিতাবের ৫৬৬৫ নং হাদীস। এছাড়া ইমাম বাইহাকী রাহ. ‘শুআবুল ঈমান’-এ (৩/৩৮২, হাদীস ৩৮৩৩), ইমাম তবারানী ‘আলমু‘জামুল কাবীর’ ‘আলমু‘জামুল আওসাত’-এ বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়াও আরো বহু হাদীসের ইমাম তাদের নিজ নিজ কিতাবে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।

হাদীসটির সনদ সহীহ। এজন্যই ইমাম ইবনে হিব্বান একে ‘কিতাবুস সহীহ’-এ বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ হাদীসটিকে পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘হাসান’ বলেছেন। কিন্তু হাসান হাদীস সহীহ তথা নির্ভরযোগ্য হাদীসেরই একটি প্রকার।

ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব, নূরুদ্দীন হাইসামী, কাস্তাল্লানী, যুরকানী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ এই হাদীসটিকে আমলযোগ্য বলেছেন। দেখুন, আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব ২/১১৮; ৩/৪৫৯; লাতায়েফুল মাআরিফ ১৫১; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫; শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা ১০/৫৬১

বর্তমান সময়ের প্রসিদ্ধ শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. সিলসিলাতুল আহাদীসিস্ সাহীহায় (৩/১৩৫-১৩৯) এই হাদীসের সমর্থনে আরো আটটি হাদীস উল্লেখ করার পর লেখেন

وَجُمْلَةُ الْقَوْلِ أَنَّ الْحَدِيثَ بِمَجْمُوع هذِهِ الطرق صحيح بلا ريب، والصحة تثبت بأقل منها عددًا، مَا دَامَتْ سَالِمَةً مِنَ الضَّعْفِ الشَّدِيدِ، كَمَا هُوَ الشَّأْنُ فِي هَذَا الْحَدِيثِ.

এ সব রেওয়ায়াতের মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে এই হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ প্রমাণিত হয়।” এরপর শায়েখ আলবানী রাহ. ওইসব লোকের বক্তব্য খণ্ডন করেন, যারা কোনো ধরনের খোঁজখবর ছাড়াই বলে দেন যে, শবে বরাতের ব্যাপারে কোনো সহীহ হাদীস নেই।

আরো একাধিক হাদীসে এ বিষয়টি এসেছে। যেগুলোর সনদ ‘হাসান লিযাতিহী বা হাসান লিগাইরিহী।’ যথা মুসনাদে আহমাদ-এর ৬৬৪২ নং হাদীস এবং মুসনাদুল বাযযার (হাদীস ২০৪৫)-এ আবু বকর সিদ্দীক রা. থেকে বর্ণিত হাদীস।

এছাড়া এ রাতের আমল সম্পর্কে ‘শুআবুল ঈমান’ বায়হাকীর নিম্নোক্ত হাদীসটি লক্ষণীয়।

আলা ইবনুল হারিছ রাহ. থেকে বর্ণিত, আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে, আমার ধারণা হল, তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি  তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা, তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন?

আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না।

নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো, এটা কোন্ রাত?

আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন

هذِهِ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَطَّلِعُ عَلَى عِبَادِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، فَيَغْفِرُ لِلْمُسْتَغْفِرِينَ، وَيَرْحَمُ الْمُسْتَرْحِمِينَ، وَيُؤَخِّرُ أَهْلَ الْحِقْدِ كَمَا هُمْ.

এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত।) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। শুআবুল ঈমান, বাইহাকী ৩/৩৮২-৩৮৩

ইমাম বাইহাকী রাহ. এই হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন هذا مرسل جيد

এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামায পড়া, যাতে সিজদাও দীর্ঘ হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য।

এধরনের বেশ কয়েকটি সহীহ ও হাসান হাদীস বিদ্যমান থাকা অবস্থায় কি এ কথা বলা উচিত যে, এ বিষয়ে সর্বোত্তম হাদীসটি সনদের বিচারে যয়ীফ? ভালোভাবে না জেনে কথা বলা থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নিরাপদ রাখুন।

প্রশ্ন ৫ : লোকেরা বলে, এ রাতের ফযীলত শবে কদরের সমান। কুরআন মাজীদে ‘লাইলাতিন মুবারাকা’ বলে শবে বরাত বোঝানো হয়েছে। এ কথাটা কি সঠিক?

উত্তর : দুটো কথাই ভুল। শবে বরাতকে শবে কদরের সমান মনে করা ভুল। কুরআন-হাদীসে শবে কদরের যত ফযীলত এসেছে, শবে বরাত সম্পর্কে আসেনি। বিশেষত কুরআন মাজীদ নাযিল হওয়ার মতো বরকতময় ঘটনা শবে কদরেই সংঘটিত হয়েছে। এই ফযীলত অন্য কোনো রজনীতে নেই।

লায়লাতিন মুবারাকা’ বলে শবে কদরকেই বোঝানো হয়েছে, যা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে সূরা কদরে। এজন্য এখানে শবে বরাত উদ্দেশ্য হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সব ধরনের প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত হয়ে সঠিক অবস্থানে দৃঢ়পদ থাকার তাওফীক দান করুন।

ইমাম ইবনে রজব রাহ.-এর ভাষায়

মুমিনের কর্তব্য এই যে, এ রাতে খালেস দিলে তওবা করে যিকির, দুআ ও ইস্তেগফারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। যত্নের সঙ্গে নফল নামায পড়বে। কেননা কখন মৃত্যু এসে যায় বলা যায় না। তাই কল্যাণের মওসুম শেষ হওয়ার আগেই তার মূল্য দেওয়া কর্তব্য। আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে সওয়াব লাভের আশা নিয়ে পনেরো তারিখের রোযাও রাখবে। তবে অত্যন্ত জরুরি বিষয় হল, ওইসব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, যেগুলো এ রাতের সাধারণ ক্ষমা ও দুআ কবুল হওয়া থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে দেয়। যথা : শিরক, হত্যা, হিংসা-বিদ্বেষ। এগুলো সবগুলোই কবীরা গুনাহ। আর হিংসা-বিদ্বেষ তো এতই গর্হিত বিষয় যে, এটা অধিকাংশ সময়ই মানুষকে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

যে কোনো মুসলমান সম্পর্কেই বিদ্বেষ পোষণ করা অত্যন্ত মন্দ প্রবণতা। তবে সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীন সম্পর্কে অন্তরে হিংসা ও বিদ্বেষ বিদ্যমান থাকা অত্যন্ত ভয়াবহ ও গর্হিত অপরাধ। এজন্য মুসলমানদের কর্তব্য হল সর্বদা অন্তরকে পরিষ্কার রাখা এবং হিংসা-বিদ্বেষ থেকে পাক-পবিত্র রাখা। বিশেষত উম্মাহর পূর্বসূরি ব্যক্তিদের সম্পর্কে অন্তর পুরোপুরি পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য, যাতে রহমত ও মাগফিরাতের সাধারণ সময়গুলোতে বঞ্চিত না হতে হয়।’ লাতাইফুল মাআরিফ, পৃ. ১৫৫-১৫৬ 

(আগস্ট ২০০৮ থেকে পুনঃমুদ্রিত, ঈষৎ পরিবর্ধিত)

 

advertisement