Rajab 1446   ||   January 2025

প্রয়োজন হিকমাহ ও সহীহ ইলম ॥
মাকসূদ ও মাধ্যমের পার্থক্য

Mawlana Muhammad Abdul Malek

أَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ، بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ.

یُّؤْتِی الْحِكْمَةَ مَنْ یَّشَآءُ وَمَنْ یُّؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ اُوْتِیَ خَیْرًا كَثِیْرًا وَمَا یَذَّكَّرُ اِلَّاۤ اُولُوا الْاَلْبَابِ.

সহীহ ইলম অনেক বড় জিনিস। সহীহ হলেই কেবল ইলম বলা হয়। যা সহীহ নয়, তাকে ইলম বলা যায় না।

ইলমে ওহী, ইলমে নবুওত এবং ফিকহ ফিদ্ দ্বীন (দ্বীনের সমঝ), হিকমাহএগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটা ছাড়া কোনো মুমিন-মুসলিমের যিন্দেগী চলতে পারে না। ঈমানী যিন্দেগী, ইসলামী যিন্দেগী ইলম ছাড়া চলতে পারে না। সেজন্য ইলম ফরয। ইলম তলব করা ফরয। মৌলিক অংশ ফরযে আইন আর ইলমের বাকি অংশ ফরযে কিফায়া।

মাদরাসায় যারা ভর্তি হয়, তারা ফরযে আইন ইলম তো শিখবেই, কারণ এ পরিমাণ ইলম শেখা মাদরাসায় যারা ভর্তি হবে, যারা ভর্তি হবে নাসবার জন্যই ফরযে আইন; মাদরাসার ছাত্ররা তো এ স্তর অতিক্রম করে ফরযে কিফায়ার বড় অংশ হাসিল করবে, ইনশাআল্লাহ।

তো আমরা যারা মাদরাসার তালেবে ইলম, আমাদের ফরযে আইন ইলমও হাসিল করতে হবে। এ পরিমাণ ইলম হাসিল করতে যদি দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত দেরি হয়, তাহলে তো গুনাহ হয়ে যাবে। কারো ফরযে আইন পরিমাণ ইলম হাসিল হতে যদি দাওরা এসে যায়, এর আগে তার ফরযে আইন ইলম শেখা হয়নি, তাহলে তা কি ঠিক হবে? ফরযে আইন ইলম তো হেদায়াতুন্নাহু-কাফিয়া জামাতে পৌঁছতে পৌঁছতেই পুরা হয়ে যাওয়া দরকার। এটা আমাদের হিসাব নেওয়া দরকার। কাফিয়া জামাতে পৌঁছে গেলাম, শরহে জামী জামাতে পৌঁছে গেলাম, ফরযে আইন ইলম এখনো হাসিল হল নাএটা আপত্তিকর। কীভাবে হাসিল হবে? আসাতিযায়ে কেরামের রাহনুমায়ী নিতে হবে, তাঁদের রাহবারী গ্রহণ করে এটা হাসিল করতে হবে। সবকিছু নেসাবে থাকা জরুরি নয়। হেদায়াতুন্নাহু পর্যন্ত নেসাবে ফরযে আইন ইলম সব নেই, থাকার দরকারও নেই। ফরযে আইন ইলম নেসাব দিয়ে শেখার বিষয় নাকি? ফরযে আইন ইলম নেসাব দিয়ে শেখার বিষয় না। তা নিজ উদ্যোগে শিখে নিতে হবে।

যাইহোক, বলছিলাম ফরযে আইন ইলম তো বটেই, ফরযে কিফায়ার বড় একটা অংশ মাদরাসার তালেবে ইলমদের শিখতে হবে। আর বাকি অংশ যিন্দেগীভর শিখতে থাকবে।

যেখানেই ইলমের অভাব হবে, সেখানেই মুসিবত। আমি শুধু একটা মাসআলা বলব। তালেবে ইলম ভাইদের সাথে আরো কথা আছে। আরো কথা বলব ইনশাআল্লাহ।

ঘুরে ঘুরে শেখা, মুখে মুখে শেখা এটা কি ইলম শেখার সুন্নত পদ্ধতি?

ইলম শেখার পদ্ধতি কী? ইলম শেখার সুন্নত পদ্ধতি কী? গাশত-তাশকীলের মাধ্যমে খুরুজ হয়ে তিন দিনের জন্য, দশ দিনের জন্য, চিল্লার জন্যএভাবে খুরুজ হয়ে ইলম শেখা সুন্নত! মুখে মুখে শেখা, ঘুরে ঘুরে শেখাএটাই সুন্নত; এমন কথাও কেউ কেউ বলে থাকেন!

আচ্ছা, কোনো দলীল কি আছে যে, ইলম শেখার সুন্নত পদ্ধতি হল মুখে মুখে শেখা, ঘুরে ঘুরে শেখা?

মুখে মুখে শেখাএটা বলার তো একটা হালকা ভিত্তি আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কি সাহাবায়ে কেরাম আমাদের মতো কিতাব নিয়ে বসতেন? কিতাব নিয়ে বসতেন না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, তাঁরা শুনতেন, শিখতেন। তাহলে মুখে মুখে শেখা সুন্নতএটা বলার একটা সূত্র আছে; কিন্তু এই সূত্র দ্বারা এটি সুন্নত সাব্যস্ত হয় নাএটা আমি পরে বলব।

কেন ইলম শেখা প্রয়োজন?

এজন্যই বলি, ইলম দরকার। বুঝুনমুখে মুখে ইলম শেখা সুন্নত, এটা সাহাবায়ে কেরামের তরীকা ছিলএকথা বললে তো সবাই বলবে, হাঁ, কথা তো ঠিক। অথচ এর ভিত্তিতে আপনি মুখে মুখে শেখা সাহাবায়ে কেরামের তরীকা ছিলএটা বলতে পারেন, কিন্তু মুখে মুখে শেখা সুন্নত, এটা ইলম শেখার সুন্নত পদ্ধতিএকথা বলতে পারেন না। কেন পারেন না? এটার জন্যই ইলম দরকার।

যার কিছু তথ্য জানা আছে, সে বলবে, সাহাবায়ে কেরাম মুখে মুখে ইলম শিখতেন। কিন্তু এটা সুন্নত না ওয়াজিব, ফরয না মুস্তাহাব, নাকি মুবাহএকথা মুফতী সাহেব বলবেন। একথা জীবনচিল্লার সাথী বলতে পারবে না। ইলমকে এত সস্তা মনে করেন কেন? একটা তথ্য এক জায়গায় শুনলাম, এক জায়গায় পড়লাম, একজনের কাছ থেকে জানলাম, ব্যস! এটুকু দিয়ে মাসআলা বলে দিলাম! এটাকে বিধানের রূপ দিয়ে দিলাম! এটা অনেকের একটা বদ অভ্যাস।

না জেনে কিছু বলব না

আমাদের তালেবে ইলম ভাইদেরও এটা বুঝতে হবে

وَ لَا تَقْفُ مَا لَیْسَ لَكَ بِهٖ عِلْمٌ.

(যে বিষয়ে তোমার ইলম নেই তার পেছনে পড়ো না।)

আমি বলছিলাম, মুখে মুখে ইলম শেখা সুন্নতএটা বলা ভুল। মুখে মুখে ইলম শেখাএকটা তরীকা, একথা বাস্তব; কিন্তু এটা সুন্নতএকথা বলা ঠিক না। উস্তাযের কাছ থেকে মুখে মুখে ইলম শেখাও একটা তরীকা, উস্তাযের কাছ থেকে কিতাবের মাধ্যমে ইলম শেখাএটাও একটা তরীকা। তরীকা অর্থে সুন্নত বললে উভয়টাই সুন্নত আর না হয় উভয়টা মুবাহ। এটাও একটা পদ্ধতি, ওটাও একটা পদ্ধতি।

সুন্নত না কেন? সুন্নত বলতে যেটাকে মানুষ বুঝে থাকে, তা হলসুন্নতে মুআক্কাদাহ, সুন্নতে গাইরে মুআক্কাদাহ, মুস্তাহাবওই সুন্নতের কথা আমি বলছি। ওই অর্থে সুন্নত না। কেন?

তালিবুল ইলম ভাইদের এটা বোঝা দরকার। না হয় তোমরা সবসময় ধোঁকা খেতে থাকবে। তোমরাও মনে মনে বলবে, আরে কথা তো ঠিক। ওটাই তো আসল পদ্ধতি। ওটাই পুরোনো পদ্ধতি। ওটাই তো ভালো। আমাদেরটা তো দ্বিতীয়, নতুন।

মাকসূদ ও মাধ্যম বুঝতে হবে

আচ্ছা যাক, কথা লম্বা হয়ে যাচ্ছে। আমি বলছিলাম, মুখে মুখে শেখা কেন সুন্নত নয়এটা বুঝতে হবে। এটা বোঝা বেশি কঠিন না। সহজ মেছাল শুনুন। এর আগে উসূল বুঝুন।

একটা হল মাকসূদ (যা করতে চাই এবং করতে হবে), আরেকটা হল এই মাকসূদের মাধ্যম। অনেক ক্ষেত্রে শরীয়ত মাকসূদের নির্দেশ দেয় আর মাধ্যমকে মুক্ত ছেড়ে দেয়। আর কখনো মাধ্যমও নির্ধারণ করে দেয়। মাধ্যম নির্ধারিত হলে আমরা যেমন মূল আমল (মাকসূদ)-এর মুকাল্লাফ, তেমনিভাবে এই নির্দিষ্ট মাধ্যমেরও মুকাল্লাফ। যেমন, মসজিদের জামাতে নামাযে শরীক হওয়ার জন্য ডাকাএটা মাকসূদ; কিন্তু এর মাধ্যম শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর তা হল আযান। এর কোনো বিকল্প খোঁজা যাবে না।

পক্ষান্তরে যদি মাধ্যম নির্ধারিত না হয়ে বরং শরীয়ত তা মুক্ত রেখে থাকে, তাহলে সে বিষয়ে যুগোপযোগী যে কোনো মুবাহ মাধ্যম অবলম্বন করা জায়েয। এক্ষেত্রে নবীযুগের উপযোগী মাধ্যমকে সুন্নত বলা আর নতুন মুবাহ মাধ্যমকে সুন্নত পরিপন্থী বলা ভুল।

যেমন, কোনো বিষয়ে মানুষকে জমা করতে চাই; এটা আগের যামানায় লোক পাঠিয়ে বা ঘোষক দিয়ে ঘোষণা করে বা الصلاة جامعة বলে এলান করে করা হত। এখন তা মাইকে এলান করেও করা যায়। যেহেতু এখানে মাধ্যম উন্মুক্ত, তাই এই নতুন পদ্ধতিকে খেলাফে সুন্নত বলা যাবে না আর আগের পদ্ধতিকে সুন্নত বলে মানুষকে এটার তাকিদ করা যাবে না। এমনকি 'শরয়ী মুস্তাহাব' বলে তারগীবও দেওয়া যাবে না। ব্যস, এটাও মুবাহ, ওটাও মুবাহ; হালাত হিসেবে যা মুনাসিব হয় তা-ই করবে।

এবার একটি মেছাল শুনুনএখানে পাকা হাম্মাম রয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় জরুরত কীভাবে পুরা করা হত? তখন যেই পদ্ধতিতে জরুরত পুরা করা হত সেটা কি সুন্নত? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম দিকে, বিশেষ করে সফরে এভাবে জরুরত পুরা করেছেন

كَانَ إِذَا ذَهَبَ أَبْعَدَ فِي الْمَذْهَبِ.

অনেক দূরে যেতেন। অনেক দূরে গিয়েও আড়াল তালাশ করতেন। এটাকে সুন্নত বলবেন? এখন যে পাকা টয়লেট, চারদিক বন্ধ, এটাকে কি সুন্নত পরিপন্থী বলবেন? এটা বুঝতে হবে। একটা হল যামানার পরিপ্রেক্ষিতে, হালাতের কারণে কোনো কাজ করা। ওটা মুবাহ। ওটাকে সুন্নত বলে না।

আবার দেখুন, তিনটা পাথর ব্যবহার করতে বলা হয়েছেثلاثة أحجار ছোট পাথর। ইস্তিঞ্জা করার জন্য পানি ব্যবহার করার আগে তিনটা পাথর ব্যবহার করবে। ওখানে কি মাটির কুলুখের কথা বলেছে? না, বরং পাথরের কথা বলেছে। তাহলে আপনি এখন পাথর ব্যবহার করেন! সেটা ব্যবহার করার পর কমোডে ফেলেন! মাটিরটাই ফেলেন না! মাটিরটা তো ব্যবহার করা হত আগে যেসব হাম্মাম ছিল চারদিকে বেড়া, নিচে খোলা, সেসব হাম্মামে। কিন্তু এখনকার হাম্মামে তো ঢিলা ব্যবহার করতে পারছেন না। হাঁ, যদি এর জন্য আলাদা কোনো ঝুড়ি রাখা হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। অসুন্দর হলেও কোথাও এমন দেখা যায়।

 এখন টয়লেট পেপার ব্যবহার করা হয়। তো টয়লেট পেপার ব্যবহার করাএটা কি সুন্নত পরিপন্থী? সুন্নত পরিপন্থী নয়। কেন নয়? এটা বুঝতে হবে। বুঝতে হবেকোন্টা সুন্নতে মাকসূদাহ, অর্থাৎ এই কাজটাই উদ্দেশ্য। একটা হল উদ্দেশ্য, আরেকটা হল মাধ্যম। মাধ্যমটা সুন্নত না, মাধ্যমটা যুগোপযোগী। কাজটা সুন্নত। যেটা উদ্দেশ্য সেটা সুন্নত। তাহলে জরুরত পুরা করার পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা অর্জন করাএটা সুন্নত; যার একটা স্তর ফরয পর্যায়ের, আরেকটা সুন্নতে মুআক্কাদা/গাইরে মুআক্কাদাহ স্তরের। এটা আদায় করা হবে কীভাবে? ওই যামানায় পাথর দিয়ে হতএরপর মাটির ঢিলা দিয়ে হত, এখন টয়লেট পেপার দিয়ে হয়। তাহলে পরিষ্কার করা ও পবিত্রতা অর্জন করা সুন্নত আর মাধ্যমটা হল যুগোপযোগী। একসময় পাথর দিয়ে, আরেক সময় মাটির ঢিলা, কোনো সময় টুকরো কাপড় ব্যবহার করত। দর্জিদের থেকে টুকরো কাপড় নিত। ওগুলো পকেটে রাখত। এখন টয়লেট পেপার। ভবিষ্যতে অন্য আরো ব্যবস্থাও আসতে পারে, সেটা আল্লাহ্ই ভালো জানেন।

একটা ঘটনা

জরুরত পূরণ করা মানুষের স্বাভাবিক একটা বিষয়। বুখারী শরীফের এক হাদীসে এসেছে। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর বর্ণনা। পঞ্চম বা ষষ্ঠ হিজরীর ঘটনা। অর্থাৎ ইফকের ঘটনা যে বছর হয়েছে। তখনো ঘরের কাছে হাম্মামের প্রচলন হয়নি। আয়েশা রা.-এর জরুরত পূরণের প্রয়োজন। রাতের বেলা। বাইরে যেতে হবে। উম্মে মিসতাহ তাকে নিয়ে বের হলেন। দূরে যাবেন। উম্মুল মুমিনীন অসুস্থ। তখন তিনি বলেন

وَأَمْرُنَا أَمْرُ العَرَبِ الأُوَلِ فِي التَّبَرُّزِ قِبَلَ الغَائِطِ، فَكُنَّا نَتَأَذَّى بِالكُنُفِ أَنْ نَتَّخِذَهَا عِنْدَ بُيُوتِنَا.

আমাদের তরীকা আগের আরবদের তরীকার মতো, ঘরের আশেপাশে ইস্তেঞ্জার ব্যবস্থা থাকবে, এটা কষ্টকর। ঘরের ভেতরে থাকার তো প্রশ্নই আসে না। আশেপাশেই কষ্টকর। এজন্য দূরে যেতে হল। কিন্তু পরবর্তীতে আরবেও ঘরের আশপাশে হাম্মাম বানানোর প্রচলন শুরু হয়েছে। এখন তো একেবারে কামরার সাথে এটাচ্ড।

যেখানে তারা হাম্মাম ঘরের আশেপাশে থাকাটাও অপছন্দ করতেন! সেখানে আপনি এটাচ্ড বানাচ্ছেন। এই এটাচ্ড বাথরুমকেও তো সুন্নত পরিপন্থী মনে করছেন না! এরপর তা পাকা হওয়া, লো-কমোডের স্থলে আবার হাইকমোড!

অনেকে মনে করে, লো-কমোড এটা সুন্নত আর হাই-কমোড খেলাফে সুন্নত! অথচ এর কোনোটাই সুন্নত না। হাঁ, উভয়টাই জায়েয। যার যেটা প্রয়োজন বা যার জন্য যেটা মুনাসিব, সে সেটা ব্যবহার করবে।

সময় জানা দরকার, তা কতভাবেই তো হতে পারে; বর্তমানে যে ঘড়ির মাধ্যমে আমরা সময় জেনে থাকি, তা খাইরুল কুরূনে ছিল না। তাই কি এটা সুন্নত পরিপন্থী হবে? কখনোই না। আরো কত উদাহরণ।

বলছিলাম, ইলম কীভাবে শিখবে সেই পদ্ধতির কথা। যামানার হালত হিসেবে তখন মুখে মুখে মানুষ শিখতেন। তখন তো কিতাব-পত্রের খুব বেশি প্রচলন ছিল না। তাই মুখে মুখে শেখা হত।

তবে তা এজন্য না যে, মুখে মুখে শেখা সুন্নত, সেটাতে ফযীলত বেশি। কিতাবের মাধ্যমে শেখা আর মুখে মুখে শেখা উভয়ের ফযীলত একই। উদ্দেশ্য হল, শেখা। কিতাবের মাধ্যমে পড়ে শেখেন আর মুখে মুখে শুনে শেখেন, শিখতে হবে, হাসিল করতে হবে।

এই বিষয়টা ভালো করে বুঝুন!

মূল হল, হাসিল ঠিকমতো হওয়া। মুখে মুখে শুনলাম, কিন্তু আমার স্মৃতিশক্তি, ধারণ ক্ষমতা তত মজবুত নাএমনও তো হতে পারে। উস্তায দরসে একবার বললেন, শুনলাম, কিছু বুঝলাম, কিছু বুঝলাম না। কিছু মনে আছে, কিছু ভুলে গেলাম। পরদিন সেটা আরেক জায়গায় গিয়ে বললাম। এখন কি এখানে অর্ধেক বলব। বাকি অর্ধেক বাদ দিব বা নিজ থেকে আন্দাযে বানিয়ে বলব!? এটা জায়েয আছে?

মুখে মুখে শিখতে গিয়ে যদি এমন আন্দাযে, অনুমাননির্ভর বলা হয়ে যায়, তখন তো সেটা হারাম হয়ে যাবে।

সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে প্রচলন ছিল যে, তারা যা শুনতেন, বুঝে মুখস্থ করে নিতেন। তাদের হুবহু মুখস্থ হয়ে যেত।

আপনারও যদি এমন যেহেন থাকে, স্মৃতিশক্তি তাদের মতো মজবুত হয় যে, আপনিও একবার শুনে বুঝেও ফেলেন, মুখস্থও হয়ে যায়, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু মুখে মুখে শেখার নামে আপনি কিছু শুনলেন, কিছু ছুটে গেল, গলদ-ছলত বুঝলেন, কিছু বুঝলেন, কিছু বুঝলেনই না, কিছু মনে রাখলেন, কিছু ভুলে গেলেন, পরে আরেক জায়গায় গিয়ে অনুমান করে বলে দিলেন! এটা তো জায়েয নেই।

অন্যদিকে আমি কিতাব থেকে শিখলাম। মুখস্থ না করতে পারলেও কিতাবে লেখা আছে, উস্তায বুঝিয়ে দিয়েছেন, এরপর আবার কিতাব দেখে পড়লাম। কিতাবটাও এখন আমার কাছে সংরক্ষিত। আমি সেখান থেকে আরো একবার দেখলাম। এরপর তাকরার করলাম, পুনরায় মুতালাআ করলাম। ভালোভাবে আত্মস্থ হল। এখন আরেক জায়গায় গিয়ে শোনালাম। নির্ভুল বলতে পারলাম। আগেরটার চেয়ে এটা ভালো কি না?

নাকি মুখে মুখে পড়া সুন্নত হওয়ার দাবি করে না বুঝে, না শুনে আন্দাযে শুধু মুখে মুখে পড়ব?

তাঁদের স্মৃতিশক্তি : একটি ঘটনা

সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতিশক্তি কেমন ছিল? সাহাবায়ে কেরাম তো সাহাবায়ে কেরাম। তাদের পর তাবেয়ীদের যুগ এসেছে। মুরব্বি তাবেয়ীদের যামানার কথাও বাদ দিলাম। এরপর যারা ছিলেন, অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামের যুগে যারা কম বয়সী ছিলেন। যেমন, মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব যুহরী রাহ.। তিনি হাদীস, ফিকহ ও তাফসীরতিন ফনেরই অনেক বড় ইমাম ছিলেন। ইমামুল আইম্মা। ইমাম মালেক রাহ., ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর মতো মানুষ তাঁর শাগরেদ ছিল। তিনি একবার হাদীস শোনালেন। এক শাগরেদ বললেন, আবার একটু বলেন!

ইবনে শিহাব যুহরী রাহ. বললেন, আবার কেন বলতে হবে? আমি তো আমার কোনো উস্তাযকে কখনো বলিনি যে, আবার বলেন।

চিন্তা করেন! এই হল, যুহরী রাহ.। এমন ছিলেন তাঁরা!

বুখারী শরীফে দেখেন, ইমাম যুহরী রাহ. থেকে কত দীর্ঘ দীর্ঘ হাদীস বর্ণিত হয়েছে! অথচ তিনি বলেনআমি আমার কোনো উস্তাযকে কখনো বলিনি যেহাদীসটা আবার একটু বলেন। (দ্র. সুনানে দারেমী, খ. ১, পৃ. ৯৯, বর্ণনা ৪৫৯)

তিনি আরো কী বলেছেন?

একটা হাদীস আবার শোনানো, আবার বলাএটা যে কত কঠিন, তা কি তোমরা বোঝ? পাথর বহন করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়া যত কঠিন, একটা হাদীস পুনরায় বলা তার চেয়েও কঠিন

إعادة الْحَدِيْث أشد من نقل الصخر. (رواه عن الزهري ابن أبي خيثمة في تاريخه، صـ ৩৮৬-৩৯০)

এমন যেহেন আজ কার আছে? অথচ বলে, মুখে মুখে শেখা সুন্নত! কীভাবে বলে এ কথা! পূর্বযুগের আকাবিরের মতো এমন স্মৃতিশক্তি থাকতে হবে, এমন মেধা থাকতে হবে।

মুখে মুখে শেখা সুন্নত, নাকি শেখাটা হল বিধান! মুখে মুখে পড়ে শেখা একটা পদ্ধতি। মুবাহ পদ্ধতি। কিতাবের মাধ্যমে উস্তাযের কাছে পড়া আরেকটা মুবাহ পদ্ধতি।

সাহাবায়ে কেরামের যামানায়ও কিতাব ছিল

এটা আরেকটা  ভুল তথ্য যে, সাহাবায়ে কেরামের যামানায় কিতাব ছিল না। সাহাবায়ে কেরামের যামানায় অনেক কিতাব ছিল।

এক তো কুরআন কারীম। তারা কুরআন কারীম সহীফা আকারে সংরক্ষণ করতেন। কুরআন কারীমেই আছে

یَتۡلُوۡا صُحُفًا مُّطَہَّرَۃً.

নবী পবিত্র সহীফা তিলাওয়াত করেন।

এখান থেকেও বোঝা যায়, সাহাবায়ে কেরামের যামানায় কুরআন কারীম সহীফা আকারে ছিল এবং তাদের অনেকেই লিখিত সহীফা থেকে কুরআন শিখতেন। উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় পড়ে দেখুন না

وقال لأخته: أعطيني هذه الصحيفة، التي سمعتكم تقرؤن آنفا، أنظر ما هذا الذي جاء به محمد، وكان عمر كاتبا...

আবার অনেক সাহাবী হাদীসও লিখেছেন।

আপনারা নাম জানেন শুধু আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রা.-এর

الصحيفة الصادقة.

অনেকেই শুধু একটা নাম জানেন। কেন? কারণ ইতিহাস পড়া হয় না।

সাহাবায়ে কেরামের যামানায় শুধু এই এক সহীফা না, বরং অনেক সহীফা ছিল হাদীসের। 

তখন তো কিতাব হিসেবে এই দুইটাই থাকবে, কুরআন আর হাদীস। একেবারে লিখিত আকারে ছিল। অনেকে সেই লিখিত কিতাব থেকে পড়ে শোনাতেন। মুখস্থ রাখার জন্য উস্তাযের কাছ থেকে লিখে নিতেন। সেটা আবার উস্তাযকে দেখাতেন। এটাও ছিল সাহাবায়ে কেরামের যামানায়, তাবেয়ীদের যামানায়।

কিন্তু সাধারণত লিখতেন কম, বর্তমানের মতো কিতাবের ব্যাপক রেওয়াজও ছিল না তখন। সাধারণত তারা মুখে মুখে শুনতেন, ইয়াদ হয়ে যেত। এটা একটা পদ্ধতি ছিল।

কিন্তু মুখে মুখে শুনে ইলম শেখা আর কিতাবের মাধ্যমে শেখা, এই দুই পদ্ধতির মধ্যে সওয়াবের দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই।

কিতাবের মাধ্যমে মানে শুধু একা একা নিজে নিজে কিতাব পড়ার কথা বলছি না। উস্তাযের কাছে গিয়ে কিতাবের মাধ্যমে পড়া বুঝিয়েছি। (ইলম ও হিকমতের বেজমেন্ট তৈরি হয়ে গেলে তখন নিজে নিজেই কিতাব পড়ুন। প্রয়োজনে পরামর্শ নিন। এতে আপত্তি নেই।)

যাইহোক, কেউ যদি বলে ওটা সুন্নত, এটা সুন্নত না বা সুন্নত পরিপন্থী, তাহলে তার কথা ভুল। উসূলে ফিকহ, ইলমুল ফিকহ সম্পর্কে না জানার কারণে এমনটা বলে।

আল্লাহ তাআলা বলেন

یُّؤۡتِی الۡحِکۡمَۃَ مَنۡ یَّشَآءُ.

[তিনি যাকে চান প্রজ্ঞা দান করেন। সূরা বাকারা (০২) : ২৬৯]

তো যারা এমন বলে, তাদের হিকমাহ নেই, ফিকহ ফিদ দ্বীন নেই। তারা মনে করে, আহদে রেসালাত বা খাইরুল কুরূনের যে কোনো কাজ, যে কোনো পদ্ধতিই সুন্নত, মুবাহ বলতে কিছু নেই!

উদাহরণ : এক

একটু আগে আমি সাফ করে দিলাম যে, এই ধারণা ঠিক না। যেটা সুন্নতে মাকসূদাহ, অর্থাৎ কাজটাই উদ্দেশ্য, সেটা সুন্নত। আর যেটা শুধু মুবাহ পদ্ধতি বা মাধ্যম, সেটা কিন্তু সুন্নত না।

যেমন, ঢিলা-পাথর। এগুলো সুন্নতে মাকসূদাহ না। মাটির ঢিলা বা পাথর ব্যবহার করার দ্বারা সুন্নত আদায় হয়ে গেছে; কিন্তু পদ্ধতিটা মাকসূদ না। এখন এর বদলে টয়লেট পেপার (مناديل الحمام) ব্যবহার করলে এর দ্বারাও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে।

হাঁ, যেটা সুন্নতে মাকসূদাহ সেটাতে কোনো ধরনের কোনো পরিবর্তনের অবকাশ নেই।

যেমন, হাম্মামে বাম পা আগে দিবে। এটা সুন্নতে মাকসূদাহ। এটা কি পরিবর্তন হয়েছে যে, এখন তো আমাদের টয়লেট এত সুন্দর টাইলস লাগানো, পরিষ্কার, বাইরের জায়গা থেকে ওই জায়গাটা আরো সুন্দর! এখন এখানে আমি বাম পা দিয়ে ঢুকব কেন, ডান পা দিয়ে ঢুকব! এমন করা যাবে না।

ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করুন।

উদাহরণ : দুই

আরেকটা উদাহরণ দেখুন

হাম্মামে প্রবেশের পূর্বে দুআ পড়া। এটা সুন্নতে মাকসূদাহ। এটা কি পরিবর্তন হয়েছে যে, এখন আর দুআর প্রয়োজন নেই। কারণ, আগের যুগে টয়লেটের মধ্যে হয়তো ময়লা থাকতো, দুর্গন্ধ আসত, সেখানে নানা ধরনের দুষ্ট জিন থাকত, এজন্য দুআ পড়া লাগত

الَلّهمَّ إِنِّي أعُوذُ بِكَ مِنَ الْخُبثِ وَالْخَبَائِثِ.

বর্তমানের হাম্মাম তো একেবারে ঘরের সাথে এটাচ্ড; এখন কি আর দুআ পড়তে হবে?

এ ধরনের কথা কি কেউ বলেছে? কারো কি এ কথা বলার অবকাশ আছে?

এই যে পার্থক্য, এর জন্য মুফতী সাহেবদের দ্বারস্থ হতে হবে। কোন্টা সুন্নতে মাকসূদাহ [অর্থাৎ কাজটাই উদ্দেশ্য এবং কিয়ামত পর্যন্ত যাতে কোনো ধরনের কোনো পরিবর্তন হবে না] আর কোন্টা অন্য কোনো সুন্নত আদায়ের স্রেফ পদ্ধতি বা মাধ্যম। সরাসরি সুন্নত না, মুবাহ।

উদাহরণ : তিন

আবার দেখুন, মসজিদ। মসজিদে নামায পড়া, সেখানে ফরয নামাযের জামাত হওয়া মসজিদের একটি জরুরি আমল। কিন্তু মসজিদ টাইলস করলে, তাতে সৌন্দর্য বর্ধন করলে সেটা কি সুন্নত পরিপন্থী হবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদ তো এরকম ছিল না? উপরে পাকা ছাদও ছিল না? আমাদের বর্তমান মসজিদগুলো তো ওরকম না।

এই যে, তাবলীগের মারকাজ মসজিদ বর্তমানে যেমন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদও কি তেমন ছিল?

বর্তমানে মসজিদে নববী যে হালতে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় কি ওই হালতে ছিল? এখন বলুন, এটা পরিবর্তন করা কি সুন্নত পরিপন্থী হয়েছে? হয়নি। কেন? কারণ, মসজিদের ফ্লোর পাথরের হওয়া সুন্নতে মাকসূদাহ না; বরং মুবাহ। অর্থাৎ মসজিদ নির্মাণের এটাও একটা পদ্ধতি। এজন্য প্রথমে খালি যমীন ছিল, তারপর পাকা হয়েছে, পরে মুজাইক হয়েছে, এখন টাইলস হচ্ছে। টাইলসের পর আবার নতুন কোন্ পদ্ধতি আসে, আল্লাহ্ই ভালো জানেন।

আরেক প্রকার : কাজও মাকসূদ, মাধ্যমটাও মাকসূদ

কোনো কোনো সুন্নত এমন আছে যে, কাজটাও সুন্নত, আবার মাধ্যমটাও সুন্নত। অর্থাৎ উভয়টাই মাকসূদাহ বা উদ্দেশ্য।

সেখানে কিন্তু মাধ্যমটাতেও কোনো পরিবর্তন হবে না। আগে আযানের কথা উল্লেখ করেছি।

আরেক উদাহরণ শুনুন, নামাযের জন্য ওযু, ওযুতে কখনো কোনো পরিবর্তন হবে না। অথচ ওযু হল নামাযের জন্য মাধ্যম। কিন্তু খোদ ওযুও একটা স্বতন্ত্র ইবাদত। এবং নামাযের জন্য তা শরীয়তের পক্ষ থেকে নির্ধারিত মাধ্যম। স্বীকৃত ওযর থাকলে ওযুর পরিবর্তে তায়াম্মুমের বিধান রয়েছে। তাই ওযুুর বিধানে কোনো পরিবর্তন আসবে না। তেমনিভাবে তায়াম্মুমের বিধানে কোনো পরিবর্তন আসবে না। নামায সহীহ হওয়ার জন্য ওযু করা আর ওযরের ক্ষেত্রে তায়াম্মুম করা ফরয। এতে কোনো পরিবর্তনের সুযোগই নেই।

পার্থক্য বুঝুন!

বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে হবে যে, আহদে রেসালাতের কোন্ বিষয়টা সুন্নতে মাকসূদাহ, কোন্টা মাকসূদাহ না, বরং একটা তরীকা। শুধুই তরীকা।

এভাবে পার্থক্য যদি না বোঝেন, তাহলে আপনি বলবেন, যে ভাইয়েরা মুখে মুখে শেখে (অথচ তারা অনেক ক্ষেত্রে উস্তায ছাড়াই মুখে মুখে শেখে) সেটাই হল সুন্নত। আমরা কিতাবের মাধ্যমে উস্তাযের কাছে শিখি; এটা সুন্নত না। যদি আপনার মধ্যে ফিকহ না থাকে, দ্বীনের সমঝ না থাকে, আপনি একথা মনে করতে পারেন।

ঘুরে ঘুরে শেখা কি সুন্নত?

আচ্ছা, এটা তো হল মুখে মুখে শেখা। কিন্তু ঘুরে ঘুরে শেখা, এটা কী? এটা কোন্ তরীকা? এমন প্রশ্নও তো আসতে পারে। কারো ধারণা, ঘুরে ঘুরে শেখাএটাই সুন্নত।

অথচ বর্তমানের প্রচলিত পদ্ধতিতে ঘুরে ঘুরে শেখা তখন ছিলই না।

সাহাবায়ে কেরাম যে কারণেই সফরে বের হতেন, শিখতেন-শেখাতেন। ব্যবসার সফরে গেলেও শিখতেন-শেখাতেন। জিহাদের সফরে গেলেও শিখতেন-শেখাতেন। তেমনি হিজরতের সফরে যাচ্ছেন সেখানেও শেখা-শেখানোর কাজ চলত। ঘরে থাকা অবস্থায় যেমন শিখতেন-শেখাতেন, সফরে গেলেও শিখতেন-শেখাতেন। এটা হল এক বিষয়।

আরেকটা হল, একটু শিখতে চাচ্ছেন, একটু শেখার দরকার হয়েছে। এখন ঘরে বসে, মহল্লায় থেকে (বা মাদরাসায় অবস্থান করে) শিখলে তো হবে না; বের হয়ে শিখতে হবে, চলতে থাকা জামাতে বের হয়ে শিখতে হবেএটা কোথায় পেলেন?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তেইশ বছরের নববী জীবন। মক্কী যিন্দেগীর তেরো বছর, মাদানী জিন্দেগীর দশ বছর; এই তেইশ বছরের একটা ঘটনাও যদি কেউ আমাকে দেখাতে পারেহাদীস শরীফ থেকে, সীরাতের কিতাব থেকে, ইতিহাসের কিতাব থেকেএকটা ঘটনা দেখিয়ে দেবে যে, কোনো সাহাবী দ্বীন শিখতে এসেছেন আর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন যে, যাও ওই মসজিদে রোখ নাও।  কারণ, শিখতে হলে ঘুরতে হবে। জায়গায় বসে শেখা যাবে না। শেখার সুন্নত তরীকা হল, বের হও। বের হয়ে এক মসজিদে যাও। ওখানে আবার বেশিদিন থাকতে পারবে না। এখানে গাশত করে তাশকিল করে আরো কিছু সাথী নিয়ে আরেক মসজিদে চলে যাও। এটা হল ইলম শেখার সুন্নত তরীকা। ব্যাস, এমন একটি বর্ণনা দেখিয়ে দিন।

সারিয়্যাহ ও গযওয়া তো জিহাদের সফর ছিল। জিহাদের সফরে সাহাবায়ে কেরাম শিখতেন। সেটা ছিল মদীনার দশ বছরে, কিন্তু মক্কার তেরো বছরে তো কোনো সারিয়্যাহ-গযওয়া কিছুই হয়নি। কোনো জিহাদের সফর হয়নি? ওই তেরো বছর সাহাবায়ে কেরাম কীভাবে শিখেছেন?

জামাত নিয়ে মসজিদে মসজিদে যাওয়ার এ তরীকা কি তখন ছিল? (এমনকি মাদানী যিন্দেগীতেও কি ছিল?) তাহলে ওই তেরো বছর কি সাহাবায়ে কেরাম ইলম শেখেননি? অথচ কুরআনের কত বড় অংশ এ সময় অবতীর্ণ হয়েছে। তখন তারা কোথায় বসে শিখেছেন? মক্কায় বসে শিখেছেন, দারুল আরকামে শিখেছেন।

দারুল আরকামে অবস্থান করাটাও তো একেবারে শুরুতে ছিল না; পরে হয়েছে। এর আগেও অনেক সাহাবী মুসলমান হয়ে গেছেন। আর দারুল আরকামে তো খুব বেশি দিন থাকা হয়নি; তাহলে তারা কোথায় ইলম শিখেছেন? ঘরে শিখেছেন। পাহাড়ের পাদদেশে বসে শিখেছেন। আপনি কীভাবে বলেন যে, ঘুরে ঘুরে শেখা সুন্নত?

মুমিন যখনই সফরে যাবে, এটা কোনো এক জায়েয কাজের জন্য হবে। তার ঘোরাটা হয়তো দ্বীনের কাজে হবে, না-হয় দুনায়াবী কোনো জায়েয কাজের জন্য হবে। কিন্তু ঘুরতে গেলেও সে কুরআন তিলাওয়াত করবে, কুরআন শিখবে, একজন আলেমের সাথে বা এমন কারো সাথে, যে কিছু জানে তবে যা জানে, ঠিকভাবে জানে, তার সঙ্গে আছে, তো শিখতে থাকবে। সাহাবায়ে কেরাম তো ব্যবসার সফরে গিয়েও শিখতেন। যে কোনো সফরেই তারা শিখতেন, শেখাতেন।

সফরে গিয়ে সময় কাজে লাগানোর জন্য শেখা এক জিনিস, আরেক হল, শেখার জন্য সফর করা! ঘরে বসে শেখা যাবে না, বাইরে গিয়ে শিখতে হবে!

দেখুন, ইলমের সফর আরেক জিনিস; যেটাকে বলা হয় 'রিহলাহ', যা অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমল। সেটা হল, যেমন কেউ পড়তে গিয়েছেন, গিয়ে এক জায়গায় স্থির হয়েছেন। এটা ইলমের সফর। ইলমের সফর প্রচলিত গাশতী সফর না। ইলমের সফর হল, নিজ এলাকা থেকে এমন কোথাও সফর করা, যেখানে কোনো মুহাক্কিক আলেম আছেন, হাদীস, তাফসীর, ফিকহ অথবা অন্য কোনো শাস্ত্রের মুহাক্কিক আছেন, তাঁর কাছে যাবেন। তাঁর মহল্লায় গিয়ে আপনি স্থির হবেন। সেখানে তার সোহবতে থেকে শিখতে থাকবেন। এবার হতে পারে তাঁর ইলমী মজলিস কোনো জামে মসজিদে হত অথবা কোনো বাড়িতে বা বাড়ির আঙ্গিনায় হত কিংবা কোনো মাদরাসায় হত। হাঁ, এটা হতে পারে যে, এখান থেকে শেষ করে আরেক শাস্ত্র পড়ার জন্য অন্য আরেক শায়েখের কাছে যাবেন।

এটি শেখার একটা নতুন পদ্ধতি

জামাত নিয়ে এক মসজিদ থেকে আরেক মসজিদে যাওয়া, এটা সীমিত পর্যায়ে দাওয়াতের একটা নতুন পদ্ধতি। এমনিভাবে সীমিত পর্যায়ে এটি শেখারও একটা নতুন পদ্ধতি। যদি সহীহ তরীকায় শেখেন, তাহলে এটা শেখার নতুন এক পদ্ধতি।

এটাকে আপনি বলবেন যে, সাহাবায়ে কেরাম এভাবে শিখতেন। কারণ ইলম শেখার এবং শেখানোর সুন্নত পদ্ধতিই হল খুরুজ বা গাশতী জামাতওয়ালা সফর। যেমনটা কোনো সাহেব দমে দমে, কথায় কথায় বলতে থাকেন। এটা মিথ্যা কথা।

তেরো বছর সাহাবায়ে কেরাম সাধারণত নিজ মহল্লায় থেকে শিখেছেন। বাকি দশ বছরের মধ্যে কয়টা সফর হয়েছে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে গযওয়ার সফর করেছেন, জিহাদের সফর করেছেন বা সাহাবীদেরকে পাঠিয়েছেন; দুই ধরনের সফরই মিলিয়ে দেখেন, সব সফরের দিনগুলো একসাথে যোগ করলে সব মিলিয়ে তিন বছরের একটু বেশি হবে হয়তো।

বড় একটি সফর ছিল বিদায় হজ্বের সময়। হজ্বের সফর। কতদিনের জন্য ছিল?

তাবুকের সফর জিহাদের জন্য লম্বা সফর। সেটাও আসা-যাওয়া মিলিয়ে কতদিনের ছিল?

সবই তো ইতিহাসে আছে। আপনি গুনে দেখেন। বাড়িয়ে ধরলাম, চার বছর। যদি চার বছরও হয়, বাকি আরো ছয় বছর তো মদীনাতেই ছিলেন। তখন কি তারা কিছু শেখেননি? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কিছু শেখাননি? আজীব কথা!

নবীজীর কাছে মানুষ শিখতে আসত

কথা আরো আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বিভিন্ন ওয়াফ্দ আসত। উফূদের বিষয়টির প্রতি কুরআন কারীমেও ইঙ্গিত আছে

وَ رَاَیْتَ النَّاسَ یَدْخُلُوْنَ فِیْ دِیْنِ اللهِ اَفْوَاجًا.

[এবং তুমি মানুষকে দেখবে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে। সূরা নাসর (১১০) : ০২]

এই যে কাফেলা দূর-দূরান্ত থেকে, আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মদীনায় চলে আসত; আগে ইসলাম গ্রহণ করেছে, এখন এসেছে দ্বীন শিখতে।

কেউ আসতেন, ইসলামের দাওয়াত পেয়েছে, কিন্তু এখনো দিলে পূর্ণ দ্বীন-ইসলাম বসেনি, আনুষ্ঠানিক ইসলাম গ্রহণও করা হয়নি। তাই ইসলাম কবুল করার জন্য আসতেন।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তারা দ্বীন-ঈমান শিখতেন, নামায-রোযা শিখতেন, ফরয শিখতেন। কিছুদিন থেকে যেতেন। কেউ বিশ দিন। কেউ দশ দিন। কেউ পনেরো দিন। কেউ আরো বেশি, কেউ কম।

এটা হল, ঈমান শেখা, দ্বীন শেখা এবং ফরয ইলম শেখার জন্য সফর। তারা সফর করে আসতেন মদীনায়।

আচ্ছা, যদি ইলম ঘুরে ঘুরে শিখতে হয়, তাহলে এই লোকদেরকে তাশকীল করে করে বের করা দরকার ছিল কি না মদীনা থেকে

বলছিলাম, একটা ঘটনা দেখান। ব্যস! আমি সূত্র ধরিয়ে দিলাম যে, কীভাবে তাহকীক করবেন।

একটি ঘটনা

কাফেলা এসেছে, ওয়াফদে আবদুল কায়েসের লোকেরা এসেছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারী সাহাবীদের বললেন, দেখ এরা তোমাদের মতোই। নিজেরা চলে এসেছে। ঈমান নিয়ে এসেছে। নিজেদেরকে পেশ করেছে। এদের খেদমত করো, মেহমানদারী করো।

একটা রাত অতিবাহিত হল। পরদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাক্ষাতে জিজ্ঞেস করলেন

كَيْفَ رَأَيْتُمْ كَرَامَةَ إِخْوَانِكُمْ لَكُمْ، وَضِيَافَتَهُمْ إِيَّاكُمْ؟

তোমাদের ভাইয়েরা কেমন ইকরাম করল? কেমন মেহমানদারী হয়েছে? কেমন মেহমানদারী পেয়েছ?

তাঁরা বললেন

خَيْرَ إِخْوَانٍ، أَلَانُوا فِرَاشَنَا، وَأَطَابُوا مَطْعَمَنَا، وَبَاتُوا، وَأَصْبَحُوا يُعَلِّمُونَا كِتَابَ رَبِّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى، وَسُنَّةَ نَبِيِّنَا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.

তাঁরা তো আমাদের শানদার মেহমানদারী করেছে। জবরদস্ত মেজবান। আমাদেরকে নরম বিছানায় শুইয়েছে। সুস্বাদু খাবার খাইয়েছে। রাতে ও সকালে আল্লাহর কালাম শিখিয়েছে। নবীর সুন্নত শিখিয়েছে।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা কে কী শিখলে?

একজন আত্তাহিয়্যাতু শিখেছে। একজন দুরূদ শরীফ শিখেছে। একজন একটা সুন্নত শিখেছে। আরেকজন দুইটা সুন্নত শিখেছে। একজন সূরা ফাতেহা শিখেছে। একজন এক সূরা শিখেছে। আরেকজন দুই সূরা শিখেছে।

এভাবে কিছুদিন অবস্থান করে তারা বিদায় নিল। তাদেরকে তো বাইরে বেরোনোর জন্য তাশকীল করা হয়নি। কোনো মসজিদে রোখ দেওয়া হয়নি! তারা মদীনায় থেকেই এসব কিছু শিখেছেন।

আরেকটি ঘটনা

মালেক ইবনে হুওয়াইরিছ রা.। তিনি তার সাথীদের নিয়ে মদীনায় এসেছেন। এসে বিশ দিন অবস্থান করলেন।

বিশ দিন পার হওয়ার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝেছেন যে, এদের এখন বাড়িতে যাওয়া দরকার। মন ছুটে গেছে বাড়ির দিকে। বললেন, যাও। এবার তোমরা তোমাদের বাড়িতে যাও। নিজ নিজ এলাকায় যাও। হাদীসের শব্দ হল

فَأَقِيمُوا فِيهِمْ.

সুবহানাল্লাহ! কী শব্দ এসেছে দেখ! আসলে আল্লাহ তো সব জানেন। কুরআন-হাদীস তো ওহী।

আল্লাহ জানেন, কোন্ যামানায় কী ফেতনা হবে। এই শব্দের প্রয়োজন চৌদ্দ শ বছর পর হতে পারে। না-হয় তখন কিন্তু এই শব্দের দরকার ছিল না।

এভাবে তো বলার কোনো দরকারও নেই। বরং এভাবে বললেই হত যে, তোমরা যাও, যা শিখলে, ঘরে গিয়ে শিখিয়ো।

এটা বললেও তো হত। কিন্তু একেবারে এই শব্দে বললেন

فَأَقِيمُوا فِيهِمْ.

তোমরা তোমাদের বাড়িতে যাও, ওখানে অবস্থান করো। মানুষকে শেখাও এবং যখন নামাযের সময় হয় আযান দেবে। তোমাদের মধ্যে বয়সে যে বড়, সে ইমামতি করবে। এটা বলা হয়নি, নিজ এলাকায় আগে সাথীদের নিয়ে খুরুজ করবে; যা শিখেছ, তাদের শেখাবে।

হাদীসের আরবী পাঠ

أَتَيْنَا النَّبِيَّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَحْنُ شَبَبَةٌ مُتَقَارِبُونَ، فَأَقَمْنَا عِنْدَه عِشْرِينَ لَيْلَةً، وَكَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَفِيقًا، فَلَمَّا ظَنَّ أَنَّا قَدِ اشْتَهَيْنَا أَهْلَنَا -أَوْ قَدِ اشْتَقْنَا- سَأَلَنَا عَمَّنْ تَرَكْنَا بَعْدَنَا فَأَخْبَرْنَاهُ، قَالَ: ارْجِعُوا إِلَى أَهْلِيكُمْ، فَأَقِيمُوا فِيهِمْ، وَعَلِّمُوهُمْ وَمُرُوهُمْ، -وَذَكَرَ أَشْيَاءَ أَحْفَظُهَا أَوْ لاَ أَحْفَظُهَا،- وَصَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي، فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلاَةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أَحَدُكُمْ، وَلْيَؤُمَّكُمْ أَكْبَرُكُمْ.

(দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৭২৪৬)

এই যে তারা এসে বিশ দিন মদীনায় ছিলেন, সেখানে কয় মসজিদে তাশকীল হয়েছে? এটা প্রমাণ করেন! এটা হলে না তখন এমন দাবি করার একটা বাহানা বের হত যে, গাশত ও খুরুজের পদ্ধতি সুন্নত আর মাদরাসার পদ্ধতি রেওয়াজ।

মাদরাসার পদ্ধতি কি রেওয়াজ?

মাদরাসার পদ্ধতিকে কিন্তু তারা নিছক রেওয়াজ বলে। তালীমের সুন্নত তরীকা তাদেরটা। দাওয়াতের সুন্নত তরীকাও তাদেরটা। তারা বলে, মাদরাসার তরীকা রেওয়াজ, তাবলীগের তরীকা সুন্নত! তাবলীগের তরীকা সাহাবায়ে কেরামের তরীকা আর মাদরাসার তরীকা রেওয়াজ! বেদআতে হাসানাহ বা পরবর্তীকালের রেওয়াজ!

তাদেরটা তাবলীগের সুন্নত তরীকা আর মাদরাসার পদ্ধতি নিছক রেওয়াজ। নাউযুবিল্লাহ!

সুন্নত আর রেওয়াজ বলার ইলম কি তোমাদের আছে? এটা তো মুফতী সাহেবরা বুঝবেন, তারা বলবেন, কোন্টা সুন্নত আর কোন্টা রেওয়াজ। জানেই না যে, প্রচলিত তাবলীগ জামাতের পদ্ধতি সুন্নতে মাকসূদা বিলকুল নয়। এটি একটি নেক রেওয়াজ। উসূল মতো হলে অনেক উপকারী। কিন্তু বিশেষ এই পদ্ধতিটি সুন্নতে মাকসূদা নয় বিলকুল।

এবার বুঝুন, ইলম কত বেশি প্রয়োজন!

ইলম কোন্টা? কিছু তথ্য জানার নাম ইলম? আমার কাছে কিছু তথ্য আছে, শুধু এটাই ইলম? আল্লাহ তাআলা বলেন

یُّؤْتِی الْحِكْمَةَ مَنْ یَّشَآءُ وَ مَنْ یُّؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ اُوْتِیَ خَیْرًا كَثِیْرًا  وَ مَا یَذَّكَّرُ اِلَّاۤ اُولُوا الْاَلْبَابِ.

[তিনি যাকে চান প্রজ্ঞা দান করেন, আর যাকে প্রজ্ঞা দান করা হল, তার বিপুল পরিমাণে কল্যাণ লাভ হল। উপদেশ তো কেবল তারাই গ্রহণ করে, যারা বুদ্ধির অধিকারী। সূরা বাকারা (০২) : ২৬৯]

অর্থাৎ সেই ইলম, যে ইলমের সাথে হিকমাহ আছে। যে ইলমের সাথে ফাকাহাত এবং ফাতানাত আছে, ওই ইলম প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা সবাইকে কবুল করুন।

وَآخِرُ دَعْوَانَا أَنِ الْحَمْدُ لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ.

শ্রুতিলিখন : মুহাম্মাদ গালিব আনোয়ার

 

advertisement