Rajab 1446   ||   January 2025

মডার্নিজম ॥
ইসলামী শরীয়ার আধুনিকীকরণের নামে বিকৃতিসাধন : ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও মৌলিক বিচ্যুতি

Mawlana Mufti Taqi Usmani

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 

মডার্নিজম চর্চায় প্রাচ্যবিদদের উৎসাহ প্রদান

আমরা কয়েকজন প্রাচ্যবিদের বক্তব্য তুলে ধরছি, যা থেকে আপনি বুঝতে পারবেন; কীভাবে পশ্চিমারা মডার্নিজমের উত্থানের পেছনে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে এবং পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।

মুসলিম দেশগুলোতে আধুনিকীকরণের নামে ইসলামী শরীয়াহকে বিকৃত করার যত চিন্তা গড়ে ওঠে, প্রাচ্যবিদরা শুধু সেগুলোর সমর্থন ও উৎসাহ প্রদানেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং  'যথোপযুক্ত' নির্দেশনাও দেয়। ভারতবর্ষের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা আন্দোলন নিয়ে প্রাচ্যবিদ উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের লেখা বই Modern Islam in India A Social Analysis থেকে বেশ কিছু উদ্ধৃতি পাঠক (গত কিস্তিতে) পড়েছেন। বইটিতে তিনি (ভারতবর্ষে গড়ে ওঠা) প্রতিটি মডার্ন চিন্তাকে সমর্থন করলেও ইসলামী পুনর্জাগরণের কোনো আন্দোলনের প্রসঙ্গ আসলে তার ভাষায় নাক সিঁটকানো ভাব প্রকাশ পেয়েছে।

তিনি সৈয়দ আহমদ শহীদ রাহ. ও হযরত শাহ ইসমাইল শহীদ রাহ.-এর জিহাদ আন্দোলনকে 'ওহাবী' বলে অভিহিত করে লেখেন

The first reactionary movement does not fall within the scope of our study. It began in the early nineteenth century, flourished fully only among the lower classes, and was a protest, vehement and well-organized, but without a constructive programme against the exceedingly low level to which society had been reduced. The movement is often called `Wahhabi`.

'প্রথম প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনটি আমাদের অধ্যয়ন পরিধির বাইরে। ঊনিশ শতকের সূচনাতে এর উত্থান হয়েছিল এবং সমাজের নিম্নশ্রেণির লোকদের মাঝেই পরিপূর্ণ বিকশিত হয়েছিল। এটি একটি সুসংগঠিত তীব্র প্রতিবাদ ছিল, তবে যে গভীর সমস্যাগুলো সমাজকে ক্রমান্বয়ে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, তার মোকাবেলায় এই আন্দোলনের কোনো গঠনমূলক কর্মসূচি ছিল না। একে 'ওহাবী' আন্দোলন বলা হয়।' (Modern Islam in India A Social Analysis, Intruduction, p. 1)

ডক্টর ইকবাল রাহ.-কে স্মিথ মডার্নিজমের প্রবক্তা বলে দাবি করেছেন আবার প্রাচীনপন্থীও আখ্যা দিয়েছেন এবং প্রাচীনপন্থী চরিত্রের সমালোচনা করেছেন। এমনকি তিনি সায়্যেদ আবুল আলা মওদুদী সম্পর্কে লেখেন

(মূল ইংরেজি পাঠের অনুসরণে অনুবাদ) 'সায়্যেদ আবুল আলা মওদুদী আধুনিক যুগের শিক্ষার্থীদের সামনে একটি সেকেলে সিস্টেমের প্রস্তাব দিচ্ছেন, বরং বলা যেতে পারে, তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। এই সিস্টেম কিছুটা আধুনিকরূপে উপস্থাপন করা হলেও এতে ভালবাসা নেই, সৃজনশীলতা নেই, শিক্ষার্থী যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়তার সমাধানে কোনো অবদান নেই। বোঝাই যায়, তিনি পুরোনো ধাঁচের অজ্ঞ, অসহিষ্ণু ও দমনমূলক ধর্মীয় গোষ্ঠীর একজন সাধারণ প্রতিনিধি।' (Modern Islam in India, p. 151)

প্রাচ্যবিদদের মধ্যে স্মিথকে সবচেয়ে নিরপেক্ষ মনে করা হয়, তিনিও মডার্নিস্টদের উৎসাহ প্রদানে ক্ষান্ত হননি, তাদের মতামতের পক্ষে যুক্তিও হাজির করেছেন। লাহোর সংলাপ অনুষ্ঠানে তিনি যে প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন, তাতে বলেন

'এখন মানুষের দায়িত্ব পূর্বপুরুষদের বা অতীতের লোকদের ভুল সংশোধন করা। (বর্তমান) মুজতাহিদের দায়িত্ব হল যুগসেবা করা, যেমন পূর্বপুরুষরা যুগসেবায় অবদান রেখেছিলেন, মানুষ এখনো তাদের কৃতিত্বের মূল্যায়ন ও প্রশংসা করে।'

সাধারণত এই দাবির ওপর আপত্তি তোলা হয়; আমরা পূর্বপুরুষদের মতো ইজতিহাদের যোগ্য নই! এর জবাবে স্মিথ বলেন-

'আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো কাজ করছি না; এটা বলা কাজ থেকে পিছিয়ে থাকার অজুহাত হতে পারে না। বিংশ শতাব্দীতে তৈরি হওয়া আইন অবশ্যই ঊনবিংশ শতাব্দীর তুলনায় আমাদের সময়ের জন্য অধিক উপযুক্ত হবে। এই যুক্তি (সংস্কার)-কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট।' (ইসলাম মেঁ কানূন আওর ইজতেহাদ ইসলামে আইন ও ইজতিহাদশীর্ষক প্রবন্ধ, পৃ. ৬-৭)

আরো পরিষ্কারভাবে আরেক প্রাচ্যবিদ রুডি প্যারেট (Rudi Paret) 'আধুনিক যুগে ইসলামী শরীয়াহ' শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন

'বর্তমান ইসলামী শরীয়ত আধুনিক জীবনের চাহিদার সাথে সবদিক থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।'

এরপর সমাধান হিসেবে তিনি মডার্নিজম চর্চায় জোর দিয়ে লেখেন-

'(ইসলামী শরীয়াহর) বিবাহ ও ওয়াকফ আইনে কিছু সংশোধনী কেন আনা যাবে নাএটা বুঝে আসে না; অথচ এসব সংশোধনীর পক্ষে যৌক্তিক কারণ আছে এবং তা জনকল্যাণের জন্যই। তাছাড়া কোনো আইনই চিরদিনের জন্য তৈরি হয়নি।'

কয়েকটি মুসলিম দেশ কিছু বিষয়ে 'শরীয়াহ-বিকৃতি'কে সংশোধনী আখ্যা দিয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। এসব উদ্যোগকে তিনি অত্যন্ত আনন্দের সাথে স্বাগত জানিয়ে লেখেন

'ইসলামী বিশ্বে নবজাগরণ ও পুনর্গঠনের যুগ শুরু হয়েছে; এসব সংশোধনী বাস্তবায়ন এই কথারই প্রমাণ। আমরা বিংশ শতাব্দীর প্রাচ্যবিদরা ভাগ্যবান, এই নতুন দিনের সূর্যোদয় দেখার জন্য জীবিত আছি। আমরা গভীর বিস্ময় নিয়ে এমন একটি বিষয় বাস্তবে রূপ নিতে দেখছি, পঞ্চাশ বছর আগে যা কল্পনাও করা যেত না।'

পাকিস্তানে এ ধরনের সংশোধনী দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন

'এই সংস্কার আন্দোলন এগিয়ে যাচ্ছে এবং অনেক সম্ভাবনা আছে যে, বয়সে সবচেয়ে ছোট, কিন্তু জনসংখ্যায় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানে শীঘ্রই ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংশোধনের বিষয়টি চিন্তা করা হবে।'

বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ ভেরা মাইকেলস ডিন লিখেছেন

Islam has never experienced a process of intellectual change comparable to the Reformation in Europe. It must go through such a reformation in our time if it is not to be rejected by the younger elements of Arab countries who want modernization.

'ইউরোপে যে ধরনের সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল, ইসলাম তেমন কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কখনো যায়নি। আধুনিকায়নের আকাক্সক্ষায় উদ্দীপ্ত আরব দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে ইসলামকে প্রাসঙ্গিক রাখতে চাইলে, আমাদের যুগে ইসলামের সংস্কার প্রয়োজন।' (The Nature of The Non-Western World, Vera Micheles Dean, A Mentor Book, Revised Edition, p. 61, as quoted by Prof. Khurshid Ahmed in his articale Islam and the West, p. 59-60)

প্রাচ্যবিদদের এই ধরনের মন্তব্যের বড় সংগ্রহ আমাদের কাছে আছে, যা দিয়ে গোটা একটি বই লেখা সম্ভব। সর্বশেষ একটি উদ্ধৃতি দেখুন।

ড. ফ্রিল্যান্ড অ্যাবট (Freeland Abbott), যিনি একজন বিখ্যাত আমেরিকান প্রাচ্যবিদ এবং পাকিস্তানের ধর্মীয় আন্দোলনগুলো নিয়ে একটি বই লেখার জন্য আড়াই থেকে তিন বছর পাকিস্তানে অবস্থান করেছেন, তার একটি প্রবন্ধে লিখেছেন

'বাস্তবতা হল, মডার্নিজমের প্রবক্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কুরআনের বিষয়বস্তুগুলোকে (কুরআনের দ্ব্যর্থহীন নির্দেশনা ও সর্বজনস্বীকৃত ব্যাখ্যা এড়িয়ে) পৃথক পৃথক অংশ হিসেবে বিবেচনা করা না হলে (Unless Quran is treated in fragments) বা কুরআনের মুক্তমনা ব্যাখ্যা করা না হলে বর্তমান সময়ে ইসলামকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে না, কুরআনের বড় অংশ অর্থহীন মনে হবে বা এর অর্থ কেবল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ের আরবদের জন্য প্রযোজ্য মনে হবে। তাই ইসলাম যুক্তিনির্ভর হওয়ার প্রবক্তাদের জন্য কুরআনে উল্লেখিত সাধারণ নীতিগুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। সংক্ষেপে বললে, এই কাজটিই (মডার্নিস্ট) খলিফা আবদুল হাকীম করার চেষ্টা করেছিলেন এবং গোলাম আহমদ পারভেজ চেষ্টা করছেন। এই প্রবণতা সচেতন বা অসচেতনভাবে পাকিস্তানের বেশিরভাগ মুসলিমের মাঝে দেখা যায়।

যতদিন রক্ষণশীল মুসলিমরা ইসলামের মডার্নাইজেশন বা আধুনিকায়নের চিন্তাকে পশ্চিমা প্রভাবের বিকৃত রূপ বলে প্রত্যাখ্যান করবে, তারা ব্যর্থ হতে থাকবে, সেইসঙ্গে তারা ইসলামের সেই বুদ্ধিবৃত্তিক লিগ্যাসি বা উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, যা স্বভাবতই অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত।' (মাসিক চেরাগে রাহ, 'নযরিয়ায়ে পাকিস্তান' সংখ্যা, প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ১৯৬০, তারতীব : খুরশীদ আহমেদ ও মাহমুদ ফারুকী, পৃ. ৩৭১-৩৭২)

এই বক্তব্যে ড. অ্যাবট স্পষ্ট করে পছন্দের চিন্তাধারা উল্লেখ করেছেন এবং মডার্নিস্টদের সামনে বিকৃতিসাধনের বিশাল ক্ষেত্র উন্মুক্ত করেছেন। তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন, (সুন্নাহ্ ও জামাআহর অনুসরণ করে) কুরআনকে সামগ্রিকরূপে গ্রহণ করার পরিবর্তে এর আয়াতগুলোকে পৃথক পৃথক নজরে দেখা উচিত।

পাঠক, এই চিন্তার ওপর ভিত্তি করে কুরআন বিকৃতির ইমারত সহজেই গড়ে উঠতে পারে। একটি আয়াতকে অন্য সকল আয়াত বা হাদীস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখালে আয়াতটির উদ্দেশ্যমূলক ভিন্ন ব্যাখ্যা করা সহজ হয়ে যায়।

اَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتٰبِ وَ تَكْفُرُوْنَ بِبَعْضٍ.

'তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশ মানো আর কিছু অংশ অস্বীকার করো?' (—সূরা বাকারা, আয়াত ৮৫)-এর ভাষ্যমতে এই চিন্তা অবলম্বন করার পরিণতি ভয়াবহ।

কিন্তু ড. অ্যাবট মোটেও উদ্বিগ্ন নন। তার দুঃসাহস দেখুন, তিনি পাকিস্তানের মুসলমানদেরকে কাছ থেকে দেখার পরও মন্তব্য করেছেন, তাদের অধিকাংশের ঝোঁক নাকি গোলাম আহমদ পারভেজের (যে কিনা হাদীস অস্বীকারকারী মুলহিদ ছিল) চিন্তার প্রতি!

অ্যাবটের বক্তব্যের আলোকে বুঝুন, এই যে প্রাচ্যবিদরা দিনরাত নিরপেক্ষ ও 'নিষ্পাপ' হওয়ার দাবি করেতার বাস্তবতা কী! আপনি দেখেছেন, তারা কী বিপুল উৎসাহের সঙ্গে মডার্ন চিন্তাগুলোকে জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছে। কিন্তু কেন? তারা কি ইসলামকে সত্য ধর্ম মনে করে আর তাই এই ধর্মের উন্নতির জন্য চিন্তিত? যদি তা-ই হয়, তাহলে এটা ভাবনার বিষয় যে, কেন তারা নিজেরা আগে এই সত্য ধর্ম গ্রহণ করে তারপর তাতে পরিবর্তন আনার চিন্তা করছে না? কারণ একটাই, তা হল, মডার্নিস্টরা আসলে পশ্চিমাদের চিন্তা-ভাবনার প্রচার-প্রতিনিধি মাত্র; যা ওরা পশ্চিমে বলে। মডার্নিস্টরা সেটা গোটা প্রাচ্যে ছড়িয়ে দেয়।

যাইহোক, আমরা এই প্রাচ্যবিদদের ধন্যবাদ জানাই, তারা মুসলিমদের এই অনুভূতি স্বীকার করেছেনমডার্নিজমের জন্ম মুসলিম মাটিতে নয়, এটি পশ্চিম থেকে আমদানি করা চিন্তা। মডার্নিস্টদের বাস্তব অবস্থা আকবর ইলাহাবাদী মরহুমের কবিতায় উঠে এসেছে

انہی کے مطلب کی کہہ رہا ہوں ، زبان میری ہے بات ان کی

انہی کی محفل سنوارتا ہوں ، چراغ میرا ہے رات ان کی

'তাদের মতলবেই কথা বলছি, কথা তো তাদেরই, ভাষাটা কেবল আমার।

তাদেরই মজলিস সাজাই, রাত্রি তো তারাই উদযাপন করবে, আমি কেবল প্রদীপ জ্বালাই।'

মডার্নিজমের মৌলিক বিচ্যুতি

মডার্নিজম প্রসারে যারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে কিছু লোকের অবস্থা কুরআনের ভাষায় এমন

رَضُوْا بِالْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ اطْمَاَنُّوْا بِهَا.

তারা দুনিয়ার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট এবং তাতেই নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে। সূরা ইউনুস (১০) : ০৭

তবে কিছু মানুষ আছেন, যারা আসলে ভুল বুঝে এই ইজমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আমরা তাদের প্রতি সহানুভূতি রেখে আন্তরিকতার সঙ্গে মডার্নিজমের মৌলিক কিছু বিচ্যুতি তুলে ধরছি।

এক. পূর্বে মডার্নিজমের বিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে; মডার্নিস্টরা পশ্চিমা সভ্যতায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে, তারা একে উন্নতির সর্বোত্তম সোপান মনে করে। তাদের বিশ্বাস, পশ্চিমা মূল্যবোধ গ্রহণ না করলে কোনো জাতির টিকে থাকা অসম্ভব। যেমন, ড. ফজলুর রহমান

جدید افکار اور معاشرتی اقدار کی طرف سے اسلام کو چیلنج

—(মডার্ন চিন্তাধারা ও সামাজিক মূল্যবোধ : ইসলামের প্রতি চ্যালেঞ্জ) শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন

یہ مصلح ( یعنی تجدد پسند ) ان اقدار کو (یعنی مغربی اقدار کو) خیر مطلق سمجھتے تھے ، اور ان کی ترقی پسندانہ نوعیت پر یقین رکھتے تھے، اس کے ساتھ ساتھ انہیں اسلام پر بھی گہرا اعتقاد تھا، اسلام اپنے عہد زریں میں ایک ترقی پسند قوت تھی ، اور چونکہ یہ اقدار جو آج ترقی کے ليے بنیادی حیثیت رکھتی ہیں اور معاشرتی خیر کی حامل ہیں، انہیں نہ صرف اسلام کی روح کے مطابق ہونا چاہئے بلکہ حقیقت میں اس کے معاشرتی پیغام کا حامل اور علمبر دار ہونا چاہئے ۔

(অর্থাৎ) আমি এই পশ্চিমা মূল্যবোধগুলোকে চূড়ান্ত কল্যাণের উৎস মনে করতাম এবং এর উৎকর্ষশীল চরিত্রে বিশ্বাস করতাম। পাশাপাশি ইসলামের প্রতিও আমার গভীর ভক্তি ছিল। সোনালী যুগে ইসলাম একটি উৎকর্ষশীল শক্তি ছিল। যেহেতু এই মূল্যবোধগুলো বর্তমানে উন্নতির চাবিকাঠি এবং সামাজিক কল্যাণের প্রতীক, কাজেই এগুলো ইসলামের স্পিরিটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তো বটেই, বরং ইসলামের সামাজিক বার্তারও বাহক। (পৃ. ২)

পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি এই বাড়াবাড়ি রকমের ভক্তি স্যার সৈয়দের সময়ে হলে কিছুটা শিথিলযোগ্য ছিল। তখনো পশ্চিমা সভ্যতা শৈশবকালে ছিল এবং এর কুফল ভয়াবহ রূপে হাজির হয়নি। কিন্তু আজ পশ্চিমা ব্যবস্থার জৌলুস ম্লান হয়ে গেছে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পশ্চিমা ব্যবস্থা চরম ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে, খোদ পশ্চিমারা আক্ষেপ ও হতাশায় চিৎকার করছে। প্রত্যেকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, প্রাচ্যের কবি ইকবালের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে

تمہاری تہذیب اپنے خنجر سے آپ ہی خود کشی کرے گی

جو شاخ نازک پہ آشیانہ بنے گا ناپائیدار ہوگا

'তোমাদের সভ্যতা নিজ খঞ্জর দিয়ে আত্মহত্যা করবে,

নড়বড়ে ডালে পাখির বাসা ভঙ্গুর হয়।'

এই বাস্তবতা এখন আর কোনো জ্ঞানী মানুষের কাছে অজানা নয়। এখানে একটি উদ্ধৃতি পেশ করছি।

সম্প্রতি প্রসিদ্ধ ব্রিটিশ চিন্তক ও দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের (Bertrand Russell) একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যা প্রত্যেক মুসলমান এবং বিশেষ করে প্রাচ্যের প্রতিটি মানুষের জন্য গভীর উপলব্ধির উৎস হতে পারে। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল Reflections on The Re-Awakening East। (প্রাচ্যের পুনর্জাগরণ : কিছু ভাবনা)। রাসেল বলেন, 'পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণের প্রবণতাই প্রাচ্যের উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এটি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি প্রাচ্যের মানুষদের নিজস্ব সামাজিক রীতি-নীতির যে উৎকৃষ্ট নমুনা আছে, তা মূল্যায়ন করার আন্তরিক পরামর্শ দিচ্ছি। তারা যেন সেই ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি না করে, যা পশ্চিমকে ধ্বংসের খাদে নিয়ে গেছে।' (মাসিক টাইমস অফ পাকিস্তান, জুলাই সংখ্যা, ১৯৫৬)

এই কথা আমরা বললে একে 'ধর্মীয় গোঁড়ামি' বলে প্রত্যাখ্যান করা হত। কিন্তু এটি এমন ব্রিটিশ দার্শনিকের কথা, যার মানবতাবাদ, নিরপেক্ষতা এবং পরিস্থিতি-বোঝাপড়ার গুণ রাশিয়া-সহ পুরো পৃথিবীতে স্বীকৃত। এরপরও যদি কেউ পশ্চিমা ব্যবস্থার প্রতি অনুরাগী হয়ে থাকে, তাহলে এই রোগ নিরাময়যোগ্য নয়।

দুই. কেউ পশ্চিমা সভ্যতা গ্রহণ করতে চাইলে সে যেন ইসলামকে ব্যবহার না করে। মডার্নিজমের প্রবক্তারা এই ভুলটি করে থাকেন। তারা ইসলামকে পশ্চিমা সভ্যতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দেখাতে চান। অথচ ইসলামী নেযাম ও পশ্চিমা ব্যবস্থা মৌলিকভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই উভয় ব্যবস্থার ঐকমত্য হওয়া সম্ভব নয়। মূল্যবোধ ও আদর্শে উভয়ের মাঝে রয়েছে বিশাল ফারাক। যেটিকে ইসলাম মূল্যবান মনে করে, তা পশ্চিমে তুচ্ছ; আবার যেটিকে পশ্চিম গৌরবময় মনে করে, তা ইসলামে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না।

ইসলামে ধর্ম হল জীবনযাপনের আইন ও পথনির্দেশ, কিন্তু পশ্চিমের দৃষ্টিতে ধর্ম কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস, বাস্তব জীবনের সঙ্গে যার সম্পর্ক নেই।

ইসলামের প্রথম ও প্রধান বিশ্বাস হল আল্লাহর প্রতি ঈমান, কিন্তু পশ্চিমা সমাজের (প্রভাবশালী লিবারেল অংশ) আল্লাহর অস্তিত্বই স্বীকার করে না। ইসলামের গোটা সভ্যতা-সংস্কৃতির ভিত্তি নবুওত ও ওহী। অথচ পশ্চিমে ওহীর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে এবং নবুওতের স্বীকৃতি নিয়ে সংশয় কাজ করে। ইসলামে আখেরাতের বিশ্বাস হল আইন ও নৈতিকতার ভিত্তি, কিন্তু পশ্চিমে এই ভিত্তি অনুপস্থিত।

আইনের ক্ষেত্রে ইসলাম বলে, আল্লাহ স্বয়ং আইন প্রণয়নকারী, তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আইনের ব্যাখ্যাকারী আর মানুষ অনুসরণকারী। কিন্তু পশ্চিমা ব্যবস্থায় আইন প্রণয়নে ধর্মের স্থান নেই; সেখানে আইন প্রণয়নের কাজ একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে শাসনব্যবস্থার মূল হল, আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন। কিন্তু পশ্চিমের লক্ষ্য জাতীয়তাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা। ইসলাম জাতি ও বর্ণভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানবজাতির ঐক্যের আহ্বান জানায়, অথচ জাতীয়তাবাদই পশ্চিমাদের গন্তব্য।

অর্থনীতিতে হালাল উপার্জন, যাকাত প্রদান এবং সুদ নিষিদ্ধ করার প্রতি ইসলাম জোর দেয়, কিন্তু পশ্চিমা অর্থব্যবস্থা সুদনির্ভর। নৈতিকতার ক্ষেত্রে ইসলামের লক্ষ্য আখেরাতে সফলতা অর্জন, কিন্তু পশ্চিমের লক্ষ্য কেবলই পার্থিব সাফল্য। সমাজব্যবস্থায় ইসলাম পরিশুদ্ধতা, চারিত্রিক পবিত্রতা ও আত্মত্যাগের শিক্ষা দেয়, যেখানে পশ্চিমা ব্যবস্থা অশ্লীলতা, লজ্জাহীনতা আর স্বার্থপরতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

আসলে ইসলাম এবং পশ্চিমা সিস্টেম সম্পূর্ণ বিপরীত দুটি দিকে যাত্রা করা দুই নৌকার মতো। কেউ এক নৌকায় বসে অন্য নৌকায় পা দেওয়ার চেষ্টা করলে সে নিশ্চিত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।

তিন. মডার্ন চিন্তার অন্যতম মৌলিক বিচ্যুতি হল এই ধারণাইসলামের মৌলিক ও প্রাচীন ব্যাখ্যা এখন আর অনুসরণযোগ্য নয়। কিন্তু এটি একটি অবাস্তব চিন্তা, যা পশ্চিমা প্রোপাগান্ডায় মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।

বিংশ শতাব্দীর এমন কোনো বাস্তব প্রয়োজন নেই, যা ইসলামের যথাযথ অনুসরণ করে সঠিকভাবে পূরণ করা সম্ভব নয়। বর্তমান যুগ যদি শিল্প ও কারিগরি উন্নতির যুগ হয়, তাহলে ইসলাম এতে অগ্রসর হতে বাধা দেয় না; বরং উৎসাহ প্রদান করে। বর্তমান যুগ যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের সময় হয়, তাহলে ইসলাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে নিষেধাজ্ঞা দেয় না; বরং এর কার্যকর ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়। যদি নতুন গবেষণা ও আবিষ্কারের আগ্রহ থাকে, তাহলে ইসলাম সেই আগ্রহের প্রশংসা করে এবং এর উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত করে। যদি শহুরে রুচিশীলতা ও নান্দনিকতার প্রতি ঝোঁক থাকে, ইসলাম এতে বাধা দেয় না; বরং এর যুক্তিসঙ্গত সীমা নির্ধারণ করে দেয়।

তাহলে বলুন, ইসলামের প্রাচীন ও মৌলিক ব্যাখ্যা অনুসরণ করলে সময়ের কোন্ চাহিদা পূরণ হওয়া অসম্ভব? হাঁ, যদি আপনার কাছে 'যুগের চাহিদা' মানে হয়মিউজিক বা গান-বাদ্য, খোলামেলা লাইফস্টাইল ও বেপর্দা চলাফেরা, অশ্লীলতা, পুঁজিবাদ আর মুভি আসক্তি; তাহলে ইসলাম অবশ্যই এসব থেকে বিরত রাখে। তবে ভেবে দেখুন, এগুলো কি সত্যিই যুগচাহিদা? যুগচাহিদা তো এগুলো নিষিদ্ধ করা, কারণ এইসবের ধ্বংসাত্মক প্রভাব বর্তমান যুগে যতটা স্পষ্ট হয়েছে, ইতিহাসের কোনো যুগে ততটা হয়নি।

তাই ইসলামের মৌলিক ও প্রাচীন ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে 'যুগচাহিদার সাথে অসঙ্গতি'র অভিযোগ আনা হলে আমাদের একথা বলা ছাড়া উপায় থাকে না

وہ بات سارے فسانے ميں جس کا ذکر نہ تھا

وہ بات اُن کو بہت ناگوار گزري ہے

'পুরো গল্পে যেই বিষয়ের উল্লেখই ছিল না,

সেটিই তাদের সবচেয়ে অপছন্দ হল।'

চার. মডার্নিস্টদের চতুর্থ বড় বিচ্যুতি হল, ইসলামবিষয়ক তাদের অধিকাংশ জ্ঞান ও তথ্যের মূল সূত্র প্রাচ্যবিদদের বক্তব্য, তাদের প্রায় প্রতিটি কথার অন্ধ অনুসরণ। অথচ ইসলাম সংরক্ষণের বিষয়ে প্রাচ্যবিদদের কর্মকাণ্ড অত্যন্ত সন্দেহজনক, যা কেবল 'শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়া'র সাথেই তুলনা করা যায়।

এখানে আমরা প্রাচ্যবিদদের স্বরূপ উন্মোচনে তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পেশ করছি।

[ভাষান্তর : মাওলানা আবু আনাস মুহাম্মাদ সালমান]

 

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement