Rajab 1446   ||   January 2025

আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও ঐক্য ॥
ধর্মীয় ঐক্যের ভুল ব্যবহার অন্যায়

Mawlana Muhammad Abdul Malek

 

আমাদের দেশের বর্তমান হালত খুবই নাযুক। ভেতর ও বাহির থেকে দেশের বিরুদ্ধে বহুমুখী ষড়যন্ত্র চলছে। দেশের হেফাজত, দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য চেষ্টা-মেহনত এবং এদেশের সীমানা সংরক্ষণএসব কেবল রাষ্ট্রীয় বিষয় নয়; বরং ঈমানী দায়িত্ব। কারণ দেশ যদি অস্থিতিশীল হয়, দেশে যদি নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে আমার আমল-ইবাদত, মসজিদ-মাদরাসা, জাগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প প্রতিষ্ঠান সবকিছু অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।

আল্লাহ তাআলার ইবাদত করার জন্যও তো আমার নিরাপত্তা প্রয়োজন। এজন্য দেশের হেফাজত ঈমানী দায়িত্ব। এটি কোনোভাবেই কেবল রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় বিষয় নয়। কারণ এই দেশ সকলের নিকট আমানত। একটা মুসলিম ভূখণ্ড আল্লাহর পক্ষ থেকে নিআমত এবং আমানত। কাজেই তার হেফাজতও ঈমানী দায়িত্ব।

এই নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করার জন্য অনেক ধরনের ষড়যন্ত্র চলে।

ষড়যন্ত্রের একটি ধরন

মুসলিম দেশে অনেক অমুসলিম নাগরিকও বসবাস করে থাকে। তাদেরকে বিভিন্নভাবে উসকে দেওয়া হয়। তাদের কাউকে ব্যবহার করে বা অন্য কাউকে ব্যবহার করে অমুসলিমদের কোনো উপাসনালয়ে একটা সমস্যা ঘটিয়ে দেওয়া হল। কারো ঘর-বাড়িতে একটা ঝামেলা তৈরি করে দেওয়া হল। তারপর ব্যস, মিডিয়া তো আছেই; তিলকে তাল বানিয়ে প্রচার শুরু করে দিল। ফলে পরিবেশ-পরিস্থিতি হয়ে গেল উত্তপ্ত!

পেশাদারত্বের গুণ আছে, এমন মিডিয়া আমাদের দেশে কয়টা আছে, আল্লাহ্ই ভালো জানেন! পেশাদারত্ব না থাকা তো এক অপরাধ। এর চেয়ে বড় অপরাধ এদের অনেকেই দেশ ও মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি করার জন্য লেগে থাকে। সবার কথা বলছি না; বরং এদের অনেকেই দেশ ও মুসলিম উম্মাহর শত্রু। এরা সবসময় উসকানি আর অপপ্রচারে লিপ্ত থাকে। এদের কাজই তথ্যসন্ত্রাস করা। তথ্যের বিকৃতি করে দেশের পরিবেশ নষ্ট করা। খামোখা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। আর শত্রু দেশগুলোর কাজ হল, এসবকে সুযোগ হিসেবে লুফে নেওয়া।

এক্ষেত্রে কেবল মুসলিমদের সকল দল, মত, ফিরকা ও ঘরানার এক হওয়া যথেষ্ট নয়; বরং দেশে যত ধর্মের লোক বসবাস করে, সবারই এক হওয়া উচিত। তবে সেটা কোন্ ইস্যুতে? দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ইস্যুতে। দেশে যেন কেউ কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারেসেই ইস্যুতে। এই ইস্যুগুলোতে সকল ধর্মের নাগরিকদের এক হওয়া জরুরি।

হিন্দুরাও কাউকে কোনো সুযোগ দেবে না যে, কেউ তাদের ভুল বোঝাবে। কেউ যেন তাদের ভুল বুঝিয়ে দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে নামিয়ে দিতে না পারে! এ বিষয়ে সবাই ওয়াদাবদ্ধ হবে এবং সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে। তদ্রƒপ অন্যান্য ধর্মের লোকদের ক্ষেত্রেও একই কথা। মুসলিম-অমুসলিম সকল ধর্মের লোকেরা ওয়াদাবদ্ধ হবে যে, আমরা সবাই মিলে দেশের হেফাজত করব এবং দেশের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্রের আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করব। কোনো ষড়যন্ত্রকে কোনো প্রশ্রয় দেব না, ইনশাআল্লাহ!

এই ধরনের ঐক্য ইসলাম সমর্থন করে। হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় এসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ধরনের একটা ঐক্য গঠন করেছেন। সেখানে মুসলিমদের সঙ্গে মদীনার ইহুদীরাও ছিল। হিজরত করে মদীনায় যাওয়ার কিছুদিন পরেই এই ঐক্যটা হয়েছে। তার বিস্তারিত বিবরণ মদীনা সনদে রয়েছে। সে ঐক্যের মধ্যে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল না; বরং মদীনা সনদে ধর্মনিরপেক্ষতার স্পষ্ট বিপরীত বিভিন্ন দফা রয়েছে।

দেখুন :

 دستور المدينة المنورة والدستور الأمريكي والبريطاني  والأوروبي: دراسة توثيقية تحليلية مقارنة، تأليف الدكتور حسن محي الدين القادري

ঐক্যের ভুল ব্যবহার অনেক বড় অন্যায়

আবারো বলছি, এই ঐক্য আপন জায়গায় ঠিক আছে। তবে এই ঐক্যের ভুল ব্যবহার অনেক বড় অন্যায়। বরং ক্ষেত্র বিশেষে হারাম ও কুফর।

ঐক্যের ভুল ব্যবহার বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন একটা ভুল ব্যবহার হল, `হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই!`

রাষ্ট্রের হেফাজত ও নিরাপত্তার বিষয়ে দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে আমরা সবাই একএকথার অর্থ কিনাউযুবিল্লাহ, ধর্মও সবার এক? সুতরাং সেখানে `হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই`একথা কেন আসবে? এটি ভুল কথা; বরং মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই! হাঁ, সবাই যেহেতু আদম-সন্তান, তাই রক্ত হিসেবে সবাই ভাই হতে পারে! এক বাবার দুই ছেলের একজন মুসলিম আরেকজন হিন্দু, তারা পরস্পর ভাই নয় কি? সুতরাং ওই হিসেবে ভাই ভাই হতে পারে, কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব, আদর্শ ও চিন্তা চেতনাগতভাবে ভাই ভাই হয় কীভাবে? সেটি কখনোই সম্ভব নয়।

মোটকথা, প্রত্যেকটা জিনিসকে তার সীমার মধ্যেই রাখতে হবে। নতুবা ঈমান হেফাজত বড় মুশকিল হয়ে যাবে। দেখুন, দেশের হেফাজতের ব্যাপারে যেমন কোনো আপস চলে না, ঈমান হেফাজতের ব্যাপারেও কোনো আপস চলে না। বিষয়টা খুব ভালো করে বুঝতে হবে। দেশের হেফাজতের ক্ষেত্রে আমরা সবাই এক, কিন্তু নিজেদের ঈমান-আকীদা, আমল ও আদর্শে আমরা অটল-অবিচল। এক্ষেত্রে কারো সঙ্গে কোনো আপস হবে না।

তদ্রƒপ দেশের হেফাজতের জন্য আন্তঃধর্মীয় ঐক্য প্রসঙ্গে কেউ এসে যদি এটাও বলে যে, `ধর্ম যার যার, উৎসব সবার!` তার কথা সঠিক তো নয়ই; বরং গোমরাহীমূলক ও কুফুরী কথা।

আচ্ছা, আপনি যে ঐক্যের চিন্তা করছেন, সেটি ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও তো সম্ভব। তাহলে উৎসবকে এক বানাবার দরকারটা কী? আপনি নিজেই বললেন, 'ধর্ম যার যার...; তো ধর্ম আলাদা হওয়ার পরও তো ঐক্যটা হচ্ছে! তাহলে `উৎসব`কে এক বানানোর দরকার কী? বরং ধর্ম যার যার, উৎসবও তার তার! তথাপি একটা বিশেষ ইস্যুতে সবার ঐক্য। বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে সবাই এক, বাংলাদেশের হেফাজতের জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ এবং ওয়াদাবদ্ধ। আমরা দেশের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের কোনো ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করব না এবং কাউকে এর সুযোগও দেব নাএটা হল ঐক্যের ইস্যু এবং এই ঐক্য যথাযথ।

কিন্তু এই ঐক্যের অর্থ কখনো এই নয় যে, আমার আকীদার মধ্যে আমি কোনো অংশ ছেড়ে দেব নাউযুবিল্লাহঅথবা হিন্দুদের বা অন্য কোনো ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনাগুলোর প্রতি মনের দুর্বলতা লালন করব বা প্রকাশ করব। তারা নিজেদের গণ্ডিতে তাদেরটা করুক, আখেরাতে আল্লাহর কাছে তাদের হিসাব তারা দেবে। কিন্তু আমাদের তো তাদের সেখানে দখল দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার মনোভাব যদি এমন হয় যে, হাঁ, সেটাও একটা কাজ এবং ভালো। সেটাও চলতে পারে। অথবা সব ধর্মের মূলকথা একই বা কাছাকাছি। এমন মনোভাব লালন করলে কি নিজের ঈমান থাকবে?

তাওহীদের উৎসব আর শিরকের উৎসব এক হয় কীভাবে?

বিষয়টা আমাদের কাছে সাফ হওয়া জরুরি। আরে ভাই, উৎসব তো সবার এক হতে পারে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গিয়েছেন

إِنَّ لِكُلِّ قَوْمٍ عِيدًا، وَهذَا عِيدُنَا.

সব জাতির উৎসব আছে, আমাদের উৎসব হল এই পবিত্র ঈদ। আমাদের দ্বীন পবিত্র, আমাদের উৎসবও পবিত্র। আমাদের উৎসব ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা। তাকবীরে তাশরীক দিয়ে শুরু হয়, যার মর্মকথা হল তাওহীদ। তাওহীদ দিয়ে শুরু হয়, তাওহীদ দিয়েই সমাপ্ত হয়। সুতরাং শিরকের উৎসব আর তাওহীদের উৎসব এক হয় কীভাবে? যখন এক উৎসবে থাকে শিরক আরেক উৎসবে থাকে তাওহীদ, আপনি উৎসবকে এক বানাবেন কীভাবে?

এক উৎসবের মধ্যে কেবল এক আল্লাহরই ইবাদত হয়। ঈদের নামাযেও তিলাওয়াত করা হয়

اِیَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُ.

[আমরা শুধু আপনারই ইবাদত করি এবং আপনার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি! সূরা ফাতেহা (০১) : ০৪]

ঈদের নামাযের মাসনূন কেরাতে সূরা আ'লা পড়া হয়; যাতে রয়েছে

وَ ذَكَرَ اسْمَ رَبِّهٖ فَصَلّٰی.

[এবং নিজ প্রতিপালকের নাম নিয়েছে ও নামায পড়েছে। সূরা আ`লা (৮৭) : ১৫]

মানে সকাল থেকে আল্লাহর যিকির করেছে, তাকবীরে তাশরীক পড়েছে— `আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ`।

তাকবীরে তাশরীক পড়তে পড়তে ঈদগাহে গিয়েছে। গিয়ে দুই রাকাত সালাত আদায় করেছে। যার পুরোটাই খালেস ও নিখাদ ইবাদত।

সালাতের পরে দুআ ও প্রার্থনা করেছে, সেটিও কেবল একমাত্র আল্লাহর দরবারে।

তাছাড়া ঈদের নামাযের পরে আর জুমার নামাযের আগে যে খুতবাদুটো পাঠ করা হয়, সেখানেও সম্পূর্ণ তাওহীদের কথা

نَحْمَدُه.

(আমরা আল্লাহর হামদ ও প্রশংসা করছি!)

وَنَسْتَعِيْنُه.

(আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি!)

وَنَسْتَغْفِرُه.

(তাঁর কাছেই ক্ষমা প্রার্থনা করছি!)

وَنُؤْمِنُ بِه.

(তাঁর ওপরই ঈমান আনছি!)

وَنَتَوَكَّلُ عَلَيْهِ.

(তাঁর প্রতিই ভরসা করছি!)

এভাবে পুরো খুতবাই তাওহীদ। সুতরাং যে জাতির উৎসব পুরোটাই তাওহীদ আর অন্য জাতির উৎসব আগাগোড়া শিরক, সেখানে শিরকের উৎসব আর তাওহীদের উৎসব দুটো এক হবে কীভাবে? কাজেই এভাবে উদারতা দেখিয়ে বলে দেওয়াধর্ম যার যার, উৎসব সবারএটি হতে পারে না। এমনকি এটি অন্য ধর্মের মধ্যেও নেই। যেসব ধর্মের কোনো দলীল নেই, গোড়া ও মূল নেই, বরং বানানো বা বিকৃত ধর্ম, তাদের ধর্মের মধ্যেও একথা নেই যে, উৎসব সবার!

ইসলামের সাথে সকল বাতিল ধর্মের মৌলিক পার্থক্য

একমাত্র ইসলাম দলীলের ধর্ম। ইসলাম সকল বাতিল ধর্মের বিরোধিতা করে কী বলে জানেন? সকল বাতিল ও বিকৃত ধর্মের বিরুদ্ধে ইসলামের বড় চ্যালেঞ্জ

مَا اَنْزَلَ اللهُ بِهَا مِنْ سُلْطٰنٍ.

[আল্লাহ এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি। সূরা নাজম (৫৩) : ২৩]

কুরআন কারীমের আয়াত

اِنْ هِیَ اِلَّاۤ اَسْمَآءٌ سَمَّیْتُمُوْهَاۤ اَنْتُمْ وَ اٰبَآؤُكُمْ مَّاۤ اَنْزَلَ اللهُ بِهَا مِنْ سُلْطٰنٍ اِنْ یَّتَّبِعُوْنَ اِلَّا الظَّنَّ وَ مَا تَهْوَی الْاَنْفُسُ  وَ لَقَدْ جَآءَهُمْ مِّنْ رَّبِّهِمُ الْهُدٰی.

এগুলো কিছু নামমাত্র, যা তোমরা ও তোমাদের পূর্ব-পুরুষরা রেখে নিয়েছ, আল্লাহ এর সপক্ষে কোনো দলীল-প্রমাণ নাযিল করেননি। প্রকৃতপক্ষে তারা (অমুসলিমরা) কেবল ধারণা ও মনের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে। অথচ তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে তাদের কাছে এসে গিয়েছে পথনির্দেশ। সূরা আননাজম (৫৩) : ২৩

অর্থাৎ, তাদের এত এত দেব-দেবী যে, নাম বলে শেষ করা যাবে না। আল্লাহ তাআলা বলেনএসবই তোমাদের বানানো। এমন নাম, যার পেছনে কোনো বাস্তব কিছু নেই। একটা নাম যে রেখে দিয়েছে, অথচ তার পেছনে কোনো দলীল নেই।

মানুষ কোনো কিছুর নাম রাখে এজন্য যে, নাম কোনো কিছুকে বোঝায়। কেবল হিন্দু নয়, বরং পৃথিবীতে যত মুশরিক জাতি রয়েছে, তাদের যত উপাস্য রয়েছে, সবগুলো উপাস্যই কেবল নামসর্বস্ব। নামের ভেতরে কোনো বাস্তবতা নেই; বরং শূন্য। এগুলোর পক্ষে আল্লাহ তাআলার নিকট হতে কোনো দলীলই আসেনি, বরং তারা নিজেরা নিজেরা কাল্পনিকভাবে সবকিছু বানিয়ে নিয়েছে এবং একেকটা নাম ঠিক করেছে আর সেগুলোর উপাসনা করছে!  ফলে তাদের যাবতীয় উপাসনা ও প্রার্থনা সবই বাতিল ও বিফল।

শিরকের একটি কুরআনী উপমা

আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বলেন

لَهٗ دَعْوَةُ الْحَقِّ.

একমাত্র তা-ই `যথার্থ` দুআ, যা তাঁর দরবারে পেশ করা হয়।

অর্থাৎ, যে প্রার্থনা কাজে আসবে, সেটি একমাত্র ওই প্রার্থনা, যা একমাত্র আল্লাহর দরবারে করা হয়। যে প্রার্থনার হাত ওঠে আল্লাহর দরবারে, যে প্রার্থনা একমাত্র আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়, সেটাই দুআ এবং সেটাই কাজে আসবে। বাকি সবই বৃথা ও নিষ্ফল।

আল্লাহ ছাড়া যার কাছেই তুমি প্রার্থনার হাত ওঠাবে, তার অবস্থা কী? আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বলেছেন

وَ الَّذِیْنَ یَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهٖ لَا یَسْتَجِیْبُوْنَ لَهُمْ بِشَیْءٍ اِلَّا كَبَاسِطِ كَفَّیْهِ اِلَی الْمَآءِ لِیَبْلُغَ فَاهُ وَ مَا هُوَ بِبَالِغِهٖ  وَ مَا دُعَآءُ الْكٰفِرِیْنَ اِلَّا فِیْ ضَلٰلٍ.

তাঁকে ছেড়ে তারা যাদেরকে ডাকে, তারা তাদের ডাকে কোনো সাড়া দেয় না। তাদের দৃষ্টান্ত সেই ব্যক্তির মতো, যে পানির দিকে দুহাত বাড়িয়ে আশা করেতা আপনিই তার মুখে পৌঁছে যাবে, অথচ তা কখনো নিজে নিজে তার মুখে পৌঁছাতে পারে না। আর কাফেরদের ডাক কেবল বৃথাই যায়। সূরা রা`দ (১৩) : ১৪

অর্থাৎ, কূপ থেকে পানি ওঠানোর জন্য হয় বালতি, রশি ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয় অথবা আজকাল মানুষ পাম্প বা অন্য কোনো আধুনিক ব্যবস্থাপনায় ওঠায়। কিন্তু এক লোক কূপ থেকে পানি নিতে গিয়েছে, অথচ তার কাছে না আছে বালতি, না আছে রশি, আর না আধুনিক কোনো ব্যবস্থাপনা। কিছুই নেই। বরং সে কূপের পাড়ে বসে হাত লম্বা করে পানি কামনা করছে! এতে কি পানি এসে যাবে? তার হাতও পানি পর্যন্ত পৌঁছে না, পানিও ওপরের দিকে উথলে ওঠে না।

আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ ছাড়া মানুষের বানানো যত উপাস্য, তাদের কাছে প্রার্থনা করা এমন, যেমন কূপের পাড়ে বসে পানির জন্য হাত লম্বা করে দেওয়া। না তার হাত পানি পর্যন্ত যায় আর না পানি তার হাত পর্যন্ত আসে! সারাদিন বসে থেকেও এক ফোঁটা পানি পাবে না। গাইরুল্লাহর কাছে প্রার্থনাও ঠিক এমনই। সারা জীবন উপাসনা করেও মৃত্যুর পর কিছুই পাবে না। প্রার্থনা করাও সম্পূর্ণ বৃথা ও বিফল।

কাজেই যাদের উপাসনা ও প্রার্থনা সবকিছু বৃথা ও অযথা এবং যার কোনো অস্তিত্ব নেই, বরং সবই বায়বীয় ও হাওয়া, তাদের উৎসব আর তাওহীদওয়ালাদের উৎসব এক হয় কীভাবে? তাদের উপাসনা আর তাওহীদওয়ালাদের ইবাদতে কোনো মিল হতে পারেএজন্য মুমিনের হৃদয়ে অমুসলিমদের কোনো আচার-অনুষ্ঠান, তাদের ধর্মীয় কোনো নিদর্শনের প্রতি ন্যূনতম কোনো দুর্বলতা থাকতে পারে না। তাদের সকল কুফর-শিরকের প্রতি ঘৃণা থাকতেই হবে। তাওহীদ ও ঈমানের ওপর মজবুত থেকে কোনো জাতীয় বিষয়ে ঐক্য, সেটি ঠিক আছে। হতে পারে। কিন্তু এই ঐক্যের কারণে যদি নিজের দ্বীন-ঈমান, তাওহীদ, ইবাদত, নিজের আমল, শরীয়ত ও সুন্নতের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে ছাড় পোষণ করা হয় এবং অন্যদের প্রতি যদি ন্যূনতম দুর্বলতা আসতে থাকে বা ঈমান-আকীদার বিষয়ে আপস শুরু করা হয়, তবে তো ঈমানই শেষ! এটা আমাদেরকে খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে। এখন দেখবেন বর্তমান সরকার এবং দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অনেক বেশি হওয়ার কারণে এই ধরনের আন্তঃধর্মীয় সভা-সমাবেশ, সেমিনার ও ঐক্যের ডাক আসতে থাকবে। সেগুলো যদি সঠিক পন্থায় হয়, তবে খুব ভালো এবং খুব প্রয়োজনীয়। কিন্তু যদি এমন হয় যে, ঈমান ও তাওহীদ নিয়ে টান দিচ্ছে, তাহলে আমাদের মতো নির্বোধ আর কেউ নেই।

এধরনের ঐক্যের আরেকটি আত্মঘাতী অন্যায় ব্যবহার হচ্ছেযে কোনো ধর্মের অনুসরণ করেই আখেরাতে মুক্তি পাওয়া যাবে, জান্নাত লাভ করা যাবে। এটি স্পষ্ট কুফরী বিশ্বাস। কুরআন-সুন্নাহ এবং ইসলাম ও ইসলামী শরীয়ত পরিপন্থী কথা। নাজাত একমাত্র ইসলাম কবুল করে মুসলিম হওয়া এবং ইসলামী শরীয়ত গ্রহণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু আল্লাহ তাআলা অমুসলিমদের বাধ্য করে মুসলিম বানানোর বিধান দেননি, অধিকারও দেননি। এর অর্থ এই নয় যে, তাদেরকে আল্লাহ তাআলা অমুসলিম থাকার বৈধতা দিয়েছেন। বৈধতা একেবারেই দেননি। বরং ইসলাম কবুল করা সবার ওপর ফরয করেছেন। এই ফরয লঙ্ঘন করলে আল্লাহ তাআলা তাদের দুনিয়াতে ছাড় দিলেও আখেরাতে কোনো ছাড় দেবেন না। আখেরাতে জাহান্নামই হবে তাদের একমাত্র ঠিকানা।

দুনিয়াতে যদি তারা জুলুম না করে, তাহলে তাদের জান-মালের নিরাপত্তা এবং তাদের সাথে সদাচারের বিধানও দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা। কিন্তু কেউ যদি আন্তঃধর্মীয় ঐক্যের অর্থ এমন মনে করে যে, ইসলাম অন্যান্য ধর্মকে সহীহ মনে করে এবং সেগুলোর অনুসরণ বৈধ মনে করে, তাহলে এটা স্পষ্ট কুফুরী চিন্তা। এই ঐক্য তো শুধু জুলুম মুক্ত এবং ইনসাফপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য; কুফরের সমর্থনের জন্য নয়। নিজেদের ঈমান-আকীদা ও শরীয়ত-সুন্নতের ব্যাপারে শিথিলতা পোষণ করার জন্যও নয়।

মাসিক আলকাউসারে (রবিউল আউয়াল ১৪৪১ হি./নভেম্বর ২০১৯ ঈ.) প্রকাশিত অধমের প্রবন্ধ `উদারতা অর্থ আকীদা ও আদর্শের বিসর্জন নয়` পড়ার অনুরোধ থাকল। ইনশাআল্লাহ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বুঝে আসবে।

আবার এটাও এক তামাশা যে, আজকাল অধিকার নিয়ে যত কথা সব সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে। সংখ্যাগরিষ্ঠদের কেউ মাজলুম হলে এটাকে কোনো বিষয়ই মনে করা হয় না। অথচ ইসলামের শিক্ষা হল, মাজলুম যেই হোক, তার পাশে দাঁড়াও আর জালেম যেই হোক, তাকে জুলুমের ক্ষেত্রে কোনো সাহায্য করা যাবে না। বরং তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখতে হবে, জুলুমের শাস্তি দিতে হবে। এটাই হল তার সাহায্য।

নিরাপত্তা দানকারী একমাত্র আল্লাহ তাআলা

সবচেয়ে বড় কথা হল, আমরা যদি নিজেদের ঈমান-আমলের নিরাপত্তা চাই, যদি দেশ ও দেশের সার্বভৌমত্বের নিরাপত্তা চাই, যদি চাই আমাদের জান-মাল ও ইজ্জত-সম্মানের নিরাপত্তা, মনে রাখতে হবে, নিরাপত্তা দানকারী একমাত্র আল্লাহ তাআলা!

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আসমায়ে হুসনা ও গুণবাচক নামগুলোর একটি হল `আলমু`মিন`।

আল্লাহর প্রতি আমরা ঈমান এনেছি বিধায় আমাদের নামও মুমিন। কিন্তু আল্লাহরও এক নাম আছে `মু`মিন`। সূরা হাশরের শেষে আছে

هُوَ اللهُ الَّذِیْ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ اَلْمَلِكُ الْقُدُّوْسُ السَّلٰمُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَیْمِنُ الْعَزِیْزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ، سُبْحٰنَ اللهِ عَمَّا یُشْرِكُوْنَ.

তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি বাদশাহ, পবিত্রতার অধিকারী, শান্তিদাতা, নিরাপত্তাদাতা, সকলের রক্ষক, মহা ক্ষমতাবান, প্রতাপশালী, গৌরবান্বিত, তারা যে শিরক করে তা থেকে আল্লাহ পবিত্র। সূরা হাশর (৫৯) : ২৩

মজার ব্যাপার হল, এখানে আল্লাহর দুটো তাৎপর্যপূর্ণ নাম একসঙ্গে! `আসসালাম` `আলমু`মিন`অর্থাৎ শান্তিদাতা ও নিরাপত্তাদাতা। সালাম অর্থ শান্তিদাতা আর মু`মিন অর্থ আম্ন ও নিরাপত্তাদাতা।

নিরাপত্তা দানকারী আল্লাহ্ই সকল ইবাদত ও উপাসনার উপযুক্ত

অন্য জাতির কথা এখন আলোচনা করছি না; মুসলিম জাতিকে আল্লাহ তাআলা কখন নিরাপত্তা দান করেন? উম্মতে মুসলিমা আল্লাহর পক্ষ থেকে আম্ন ও সালাম তথা শান্তি ও নিরাপত্তা তখনই লাভ করবে, যখন আল্লাহর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো রাখবে।

কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন

لِاِیْلٰفِ قُرَیْشٍ، اٖلٰفِهِمْ رِحْلَةَ الشِّتَآءِ وَالصَّیْفِ، فَلْیَعْبُدُوْا رَبَّ هٰذَا الْبَیْتِ، الَّذِیْۤ اَطْعَمَهُمْ مِّنْ جُوْعٍ، وَّاٰمَنَهُمْ مِّنْ خَوْفٍ.

যেহেতু (আল্লাহ তাআলা) কুরাইশের লোকদের অভ্যস্ত করে দিয়েছেন; তাদের অভ্যস্ত করেছেন শীত ও গ্রীষ্মের সফরে, অতএব তারা যেন ইবাদত করে এই ঘরের মালিকের। যিনি তাদেরকে ক্ষুধার অবস্থায় আহার দিয়েছেন এবং ভয়-ভীতি থেকে তাদের নিরাপদ করেছেন। সূরা কুরাইশ

এই সূরায় আল্লাহ তাআলা বলেছেন, সমস্ত ভয় থেকে নিরাপত্তা দানকারী একমাত্র আল্লাহ তাআলা। ক্ষুধার্তকে আহার দানকারী একমাত্র আল্লাহ তাআলা।

মক্কার কাফের-মুশরিকদের অন্যরা একটু সম্মান সমীহ করত এজন্য যে, এরা বাইতুল্লাহর পাশের লোক। বাইতুল্লাহর খেদমত করে। তাই অনেক বালা-মুসিবত থেকে কেবল বাইতুল্লাহর প্রতিবেশী হওয়ার কল্যাণে তারা বেঁচে যেত।

কথা তো সবার জন্যই। কিন্তু এখানে আল্লাহ তাআলা মক্কার মুশরিকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন

فَلْیَعْبُدُوْا رَبَّ هٰذَا الْبَیْتِ.

এই বাইতুল্লাহর বরকতে তোমরা নিরাপদে থাকছ, এই ঘরের মালিককে কি ভুলে গিয়েছ? যে ঘরের দোহাই দিয়ে তোমরা চল এবং বিভিন্ন মুসিবত থেকে বেঁচে যাও, এই ঘরের মালিককে কি ভুলে গিয়েছ? এই ঘরের রব ও কর্তা কে? সুতরাং একমাত্র সে রবেরই ইবাদত কর!

الَّذِیْۤ اَطْعَمَهُمْ مِّنْ جُوْعٍ.

ক্ষুধা যন্ত্রণায় তোমাদের দিন কাটত, তোমাদের পানাহারের ব্যবস্থা কে করে দিয়েছেন? রিযিকের ব্যবস্থা কে করে দিয়েছেন? নিশ্চয়ই আল্লাহ!

এই বাইতুল্লাহর কল্যাণে তোমাদের রিযিকের মধ্যে কত বরকত!

وَ اٰمَنَهُمْ مِّنْ خَوْفٍ.

ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সফরে যাবে, সেটা ইয়ামান হোক আর শাম, যেদিকে যাও, কত আশঙ্কা, কত বালা-মুসিবত! কখন যে কে কীভাবে শেষ করে দেয়! ভয়ে কেউ বের হতে চায় না। তখনও আল্লাহ তাআলা তোমাদের নিরাপত্তা দান করেছেন।

যে আল্লাহ নিরাপত্তা দান করেছেন, সকল ইবাদত ও উপাসনার মালিকও একমাত্র তিনি। কাজেই আল্লাহর প্রতি ঈমান, তাঁর ইবাদত এবং তাঁর বিধানের বাস্তবায়ন করা আমাদের জন্য জরুরি।

আল্লাহর সবচেয়ে বড় বিধানগুলোর অন্যতম হল আল্লাহর বান্দাদের প্রতি কোনো জুলুম না করা এবং ইনসাফ নিশ্চিত করা।

'আমন’ ও নিরাপত্তা লাভের উপায় ঈমান ও আমানত রক্ষা করা

আম্ন ও নিরাপত্তা যদি চাও, সালাম ও শান্তি যদি চাওতার উপায় হল, ঈমান ও আমানত রক্ষা কর। আরবীতে ঈমান শব্দের মূল অক্ষর বা ধাতু `আম্ন`, আমানত শব্দের মূল ধাতুও কিন্তু `আম্ন`। অর্থাৎ আম্ন ও নিরাপত্তার সঙ্গে পূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে ঈমান ও আমানতের। দুনিয়াতে কেউ যদি আম্ন ও শান্তি চায়, তাকে অবশ্যই ঈমান গ্রহণ করতে হবে, ঈমান হেফাজত করতে হবে এবং আমানত পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করতে হবে। খেয়ানত ও জুলুম কোনোভাবেই করা যাবে না। ইনসাফ ও আমানত রক্ষা করতে হবে।

যে সমাজে জুলুম ও খেয়ানত বিরাজ করে সে সমাজে কখনো শান্তি ও নিরাপত্তা আসতে পারে না।

যখন একমাত্র আল্লাহকে ভয় পাবে...

গতকাল (৫ ডিসেম্বর ২০২৪ঈ.) প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আমরা চাই যে, কেবল সম্প্রীতি রক্ষা করা বা কারো প্রতি জুলুম না হওয়া নয়; বরং নাগরিকদের কেউ যেন একেবারে কোনো ধরনের কোনো ভয়ই না পায়! কাউকে ভয় না পায়। নাগরিকদের সবাই নির্ভয়ে দেশে থাকতে পারে এবং বসবাস করতে পারে!

সুবহানাল্লাহ! আসলে কাউকে ভয় পাবে নাএটি তখনই সম্ভব হবে, যখন একমাত্র আল্লাহকে ভয় পাবে! আল্লাহকে ভয় পেলেই কেবল এটি হাসিল হবে যে, কাউকে আর ভয় পেতে হবে না। কিন্তু আল্লাহকে যদি ভয় না করা হয়, তাহলে সবাইকে ভয় পেতে হবে। কোন্ সময় কোন্ জায়গা থেকে কে হামলা করে, আক্রমণ করে, কী করে না করেএমন আশঙ্কা লেগেই থাকবে! এজন্য ভয় থেকে বাঁচতে হলে আল্লাহকে ভয় করতে হবে।

কবি সত্য বলেছেন

یہ ایک سجدہ جسے تو گراں سمجھتا ہے

ہزار سجدے سے دیتا ہے آدمی کو نجات

যে একটি সিজদা তোমার কাছে অতি কঠিন, সেটিই তোমাকে মুক্তি দেয় হাজার সিজদা থেকে ।

 

[মাসিক দ্বীনী মজলিস (অংশবিশেষ)

মারকাযুদ দাওয়াহ জামে মসজিদ

হযরতপুর, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা।

৩ জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৬ হি.

৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ঈ., জুমাবার।

শ্রুতিলিখন : মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম

নযরে ছানী ও ইযাফা :

মুহাম্মাদ আবদুল মালেক]

 

advertisement