Rajab 1446   ||   January 2025

বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র ॥
সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আমরা সবাই আপোষহীন

গত ৫ আগস্ট দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ঘটে। এরপর থেকেই অবৈধ সরকার ও তাদের থেকে একতরফা সুবিধাভোগী প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা ও ষড়যন্ত্র করে আসছে। এতদিন পরও তা যেন আর থামার নাম নিচ্ছে না। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও এদেশের জনগণের বিরুদ্ধে শুধু ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক নেতা ও স্যোশাল মিডিয়াগুলোই মিথ্যাচার করে যাচ্ছে না; বরং অন্যান্য দলের কিছু নেতা ও দেশটির মূল ধারার গণমাধ্যমও এখন একেবারে ঘোষণা দিয়ে কোমর বেঁধে বাংলাদেশবিরোধী মিথ্যা প্রচারে উঠেপড়ে লেগেছে। সে দেশের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে ঢুকলেই মনে হবে, বাংলাদেশে বুঝি সকল হিন্দুকে মেরে একাকার করে ফেলা হয়েছে। রাতদিন তাদের ওপর শুধু নির্যাতন আর নিপীড়ন চালানো হয়েছে। আর তা চরম আকার ধারণ করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার ও দীর্ঘদিন ধরে এদেশে বেআইনী নানা অপতৎপরতা চালিয়ে যাওয়া ইসকনের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি ওঠার পর থেকে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরেকটি দেশ, তার রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমগুলো সংঘবদ্ধভাবে মিথ্যাচার চালিয়ে যাওয়া নজিরবিহীন ঘটনাই বলতে হবে।

ভারতের এমন আচরণের পেছনে অনেকেই তাদের হতাশাকে দেখতে পাচ্ছেন। কারণ দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় পর্যন্ত এ দেশ ও তার সরকার বাংলাদেশে নিজেদের সেবাদাসে পরিণত হওয়া হাসিনা সরকার থেকে একতরফা বিভিন্ন অবৈধ সুবিধা অর্জন করে এসেছে। এটি তাদের বদঅভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

হঠাৎ করে হাসিনার পতনের পর যেহেতু ঐ সুযোগ-সুবিধায় ভাটা পড়েছে, তাই এখন তারা অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে দিয়েছে। একদিকে বাংলাদেশে অসংখ্য ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনাকে তারা নিজ দেশে আশ্রয় দিয়ে এদেশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ষড়যন্ত্রের সুযোগ করে দিয়েছে। অন্যদিকে তারা নিজেরাও শুরু করে দিয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী ব্যাপক মিথ্যাচার। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অনেক প্রভাবশালী গণমাধ্যমই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে হয় না। এ দেশে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রয়েছে এবং সকল ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে, সে কথা তারা যথাযথভাবে প্রচার করছে না। আমাদের কিছু সংবাদ মাধ্যমের এটি পুরোনো রোগ। তারা এদেশের খেয়ে পরে মোটাতাজা হলেও তাদের মন-দিল, মুখ ও কলম সবকিছু ভারতের হয়েই কথা বলে।

ভারতের এমন আচরণ শুধু বাংলাদেশের সাথেই নয়। কেউ কি বলতে পারবেন, কোন্ প্রতিবেশীর সাথে তার সম্পর্ক ভালো আছে? নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কা, চীন ও পাকিস্তান? ছোট-বড় যে রাষ্ট্রই ধরুন, কে ভারতের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাচ্ছে? কার বিরুদ্ধে সে মোড়লগিরি, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অবৈধ হস্তক্ষেপ ও বিভিন্ন অন্যায় আচরণ করছে না? অথচ তার নিজের দেশেরই সমস্যার অন্ত নেই। সেখানে সংখ্যালঘুরা হচ্ছে চরম নির্যাতনের শিকার। শিখ ও তামিল সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সে দেশের দু দু জন প্রধানমন্ত্রীর প্রাণ গিয়েছে। আর প্রধান সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন ও তাদেরকে হত্যা, গুম, ঘরবাড়ি বে-দখল করাসহ অন্যান্য নির্দয়তার কথা তো পুরো বিশ্বই জানে। একের পর এক ধ্বংস করা হচ্ছে মুসলমানদের মসজিদগুলো। কদিন পরই একেকটি মসজিদের মাটির নিচে তাদের মন্দির আবিষ্কৃত হয়ে যাচ্ছে। এমনকি গত সপ্তাহে দেশটির উচ্চ আদালত আর কোনো ধর্র্মীয় উপাসনালয়ের মালিকানা নিয়ে মামলা দায়ের করতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। কারণ ব্যাপারটি এমন হয়ে যাচ্ছিল যে, ধীরে ধীরে ভারতের সব ঐতিহাসিক মসজিদই তারা নিজেদের মালিকানা ও দেব-দেবীদের জন্মভূমি বলে দখল করে নেওয়ার পাঁয়তারা করছিল। এ কথা কি মানুষ ভুলে গিয়েছে যে, দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে সেখানকার মুসলিমদের হত্যা-নির্যাতনের পুরস্কারস্বরূপ 'গুজরাটের কসাই' খেতাবও পেয়েছিল বিদেশিদের থেকে। তো যে দেশটির নিজেদের অবস্থা এমন, তারা কোন্ লজ্জায় অন্য দেশ ও তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায়?

আমরা সুস্পষ্টভাবে ও দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করতে চাই, আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এদেশের জনগণ কোনো আপোষ করবে না। পৃথিবীর কোনো দেশের কারোরই অধিকার নেই বাংলাদেশকে চোখ রাঙাবার বা হেয় করার। বাংলাদেশের সমস্যাগুলো তার জনগণ নিজেরাই সমাধান করবে।

ষড়যন্ত্রকারীদের বুঝতে হবে, তারা একেবারে লাজ-শরমের মাথা খেয়ে বিভিন্ন অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েও তাদের সহযোগিতা দেওয়া সরকারকে এদেশে টিকিয়ে রাখতে পারেনি। জনগণ তাদেরকে বিতাড়িত করেছে। এদেশের স্বাধীনতাও এসেছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। সুতরাং এ জাতিকে হুমকি দিয়ে কোনো লাভ নেই। নিজেদের মধ্যে যত বিভেদই থাকুক, সময়ের প্রয়োজনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাই দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হবে। সাথে সাথে আমাদেরও এদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী সকল অপপ্রয়াস ব্যর্থ করে দিতে হবে। সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু কারো জন্যই কোনো অপপ্রচারে প্রভাবিত হওয়া চলবে না; বরং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঐতিহ্য সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি সংখ্যালঘু হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরও আছে দায়িত্ব ও কর্তব্য।

আল্লাহ তাআলা এদেশকে হেফাযত করুন; এদেশের ক্ষতিসাধনে লিপ্ত যে কোনো অপশক্তির ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত করুন।

 

advertisement