Jumadal Ula 1446   ||   November 2024

মডার্নিজম
‖ ইসলামী শরীয়ার আধুনিকীকরণের নামে বিকৃতিসাধন
ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও মৌলিক বিচ্যুতি

Mawlana Mufti Taqi Usmani

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মডার্নিজমের প্রথম পর্ব

ইসলামী বিশ্বে মডার্নিজমের প্রথম প্রকাশ ঘটে তুরস্কে। তুর্কিদের রাজনৈতিক দুর্বলতা-পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা সংস্কৃতি ইসলামকে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে। বহু মানুষ পশ্চিমা সংস্কৃতিকে স্বাগত জানায় এবং আধুনিকীকরণের নামে ইসলামের বিকৃতি সাধনের রাস্তা খোলে।

তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন তুর্কি বুদ্ধিজীবী জিয়া গোক আল্প (১৮৭৫-১৯২৪)। ইসলামী বিশ্বে মডার্নিজমের প্রথম সক্রিয় প্রচারক ছিলেন তিনি। উসমানী খেলাফত পতনের সময় তুর্কি জাতীয়তাবাদের উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৮৭৫ সালে 'দিয়ার বাকর' শহরে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় মাধ্যমিক স্কুলে তার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়।

স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন মুক্তমনা লিবারেল (Liberal)। কিছুকাল পর একজন গ্রিক শিক্ষকের প্রভাবে তার মনে ইসলামী বিশ্বাস ও পশ্চিমা যুক্তির দ্বন্দ্ব শুরু হয়। জিয়া আল্প তাসাওউফ ও ইসলামী দর্শনের সহায়তায় এই দ্বন্দ্বের সমাধান চেয়েছিলেন, কিন্তু তার দাবি, তিনি সফল হতে পারেননি; ফলে ইসলামচর্চায় মূলধারা থেকে দূরে সরে যান।

এরপর বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে, পত্র-পত্রিকায় কলাম লিখে এবং প্রবন্ধ ও পুস্তিকা রচনা করে পশ্চিমা সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানাতে থাকেন। তিনি বলতেন, পশ্চিমা সংস্কৃতি মূলত ইসলামী সংস্কৃতির বিস্তার ও সম্প্রসারণ, পশ্চিমা সংস্কৃতির বিকাশ ও বৃদ্ধিতে তুর্কি ও মুসলিমদের বিশেষ অবদান আছে, এই সংস্কৃতি গ্রহণে কোনো দ্বিধা নেই। একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-

Western civilization is a continuation of ancient Mediterranean civilization. The earliest founders of the Mediterranean civilization were Turanian peoples, such as Sumerians, Phoenicians, Scythians...

There was a Turanian Age in history before the ancient ages. The early inhabitants of Western Asia were Turks... The earliest founders of the early Mediterranean civilization were our forefathers. Much later, Muslim Arabs, Persians, and Turks again improved this civilization and became the teachers of the uncivilized Europeans. ...

We are connected with Western civilization through several contributions, and thus have a share in it.

 'পশ্চিমা সভ্যতা আসলে প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতার ধারাবাহিকতা। সুমেরীয়, ফিনিশীয় এবং সিথিয়ানের মতো তুরানী জনগোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে এই সভ্যতা প্রতিষ্ঠা পায়।...

প্রাচীন ইতিহাসে একটি তুরানী যুগের কথা পাওয়া যায়।... (তুরানীরা ছিল তুর্কি বংশধারার), পশ্চিম এশিয়ার প্রথম বাসিন্দা তুর্কিরাই। ...আমাদের এই পূর্বপুরুষরা ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতার প্রথম ধারক-বাহক ছিলেন। বহুকাল পর মুসলিম আরব এবং পার্সিয়ান ও তুর্কিরা এই সভ্যতাকে উন্নত করেছিলেন এবং সভ্যতার ছোঁয়া বঞ্চিত ইউরোপীয়দের শিক্ষক হয়েছিলেন। ...আমরা নানা অবদানের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত আছি এবং এভাবে এই সভ্যতার অংশীদার হয়েছি।' (Turkish Nationalism and Western Civilisation, Ziya Gökalp, P. 267)

পশ্চিমা সভ্যতা ধারণ করা কেন জরুরি হয়ে উঠল, এতে করে মুসলিমদের মাঝে কী পরিবর্তন আসবে এবং তুরস্কের মৃতদেহে এই সভ্যতা কীভাবে প্রাণ ফিরিয়ে আনবে; এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি লিখেছেন-

When a nation advances to the higher stages of its evolution, it finds it necessary to change its civilization too...

When they (Turks) were in the stage of ethnic-state organization, they belonged to the civilization of the Far East. When they passed to the stage of the sultanistic state, they entered into the area of Eastern civilization. And today, in their transition to the stage of nation-state, we see the rise among them of a strong movement which is determined to accept Western civilization.

'যে কোনো জাতি বিবর্তনের লম্বা পথ পাড়ি দেওয়ার পর নিজেদের সভ্যতাও পরিবর্তন করার প্রয়োজন অনুভব করে।... জাতিগত রাষ্ট্রের পর্যায়ে থাকাকালীন অর্থাৎ যাযাবর উপজাতি হিসেবে মধ্য এশিয়ায় বসবাসকালে তুর্কিরা দূরপ্রাচ্যের সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল। উসমানী সুলতানদের আমলে তারা পূর্ব এশীয় সভ্যতায় প্রবেশ করে। আজ যখন তারা জাতিরাষ্ট্রের পর্যায়ে অগ্রসর হচ্ছে, আমরা তাদের মধ্যে পশ্চিমা সভ্যতা গ্রহণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একটি শক্তিশালী আন্দোলনের উত্থান দেখতে পাই।' (Turkish Nationalism, P. 271)

এখানে প্রশ্ন ওঠে, তুরস্ক একটি মুসলিম দেশ হয়ে কীভাবে ইসলামবিরোধী বহু  অনুষঙ্গে ভরপুর পশ্চিমা সংস্কৃতি গ্রহণ করতে পারে? এর উত্তরে জিয়া আল্প 'সভ্যতা-সংস্কৃতি'কে ইসলাম থেকে আলাদা করার মতবাদ হাজির করেন। এই মতবাদকে মডার্নিজমের প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি ধরা যায়। অর্থাৎ ইসলাম কিছু বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টিমাত্র, এছাড়া জীবনের সব দিক ইসলামের আওতার বাইরে, প্রত্যেক ব্যক্তি পছন্দের লাইফস্টাইল অনুসরণ করতে পারে; ইসলাম এতে কোনো বাধা দেয় না, কেউ ইসলামী আকীদা গ্রহণ ও ইবাদত পালন করলে সে খাঁটি মুসলিম, চাই পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতি মেনে চলুক বা প্রাচ্যের। জিয়া আল্প লেখেন-

Since religion consists only of sacred institutions, beliefs, and rituals, nonsacred institutions such as scientific ideas, technological tools, aesthetic standards constitute a separate system outside of religion. Positive sciences such as mathematics, physics, biology, psychology and sociology, industrial methods, and fine arts : are not connected with religions.

Thus, no civilization can ever be called after a religion. There is neither a Christian nor an Islamic civilization. Just as it is incorrect to call Western civilization a Christian civilization, so it is equally incorrect to call Eastern civilization an Islamic civilization.

'ধর্ম যেহেতু পবিত্র প্রতিষ্ঠান, বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে গঠিত, তাই যেসব প্রতিষ্ঠান ও কাঠামো ধর্মীয় পবিত্রতার অধিকারী নয়, যেমন বৈজ্ঞানিক ধারণা, প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম, এ্যাস্থেটিক স্ট্যান্ডার্ডস (শিল্পকর্ম, সঙ্গীত, ফ্যাশন, স্থাপত্য কিংবা প্রকৃতির সৌন্দর্য, শৈল্পিকতা ও রুচি মূল্যায়নের মানদণ্ড) এগুলো ধর্মের বাইরে আলাদা সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানসহ ইতিবাচক বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা, শিল্প-কারখানায় অনুসৃত পদ্ধতি ও চারুকলা; ধর্মের সাথে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই।

তাই কোনো সভ্যতাকেই ধর্মীয় অভিধা দেওয়া যায় না। পশ্চিমা সভ্যতাকে যেমন খ্রিস্টীয় সভ্যতা বলা ঠিক নয়, প্রাচ্যের সভ্যতাকেও ইসলামী সভ্যতা বলা ভুল।' (Turkish Nationalism, P. 271-272)

লক্ষ করুন, পশ্চিমা সংস্কৃতি ধারণের উন্মাদনায় কীভাবে ইসলামকে শুধু বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি আখ্যা দেওয়া হয়েছে, ইসলামের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দ্বীন হওয়ার বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে, খ্রিস্টধর্মের সাথে ইসলামকে তুলনা করে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়েছে! অথচ ইসলামের একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা রয়েছে। ইসলাম কেবল ইবাদতের পদ্ধতিই শেখায়নি, বরং ইসলামী আইন ও শরীয়তের তিন-চতুর্থাংশই লেনদেন, সমাজবদ্ধ জীবনে চলাফেরার রীতি-নীতি ও জীবনঘনিষ্ঠ সমস্যার সমাধানে নিয়োজিত।

এই ছিল সে সময়ের মুক্তমনা যুবকদের কন্ঠস্বরে পরিণত হওয়া জিয়া গোক আল্পের চিন্তাধারা। এসব চিন্তায় প্ররোচিত হয়ে মুস্তফা কামাল পাশা তুরস্কে এক ভয়াবহ বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, যার তিক্ত স্মৃতি আজও মুসলিমদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করে। কামাল পাশা এই বিপ্লবে সফল হয়ে একনায়কতন্ত্র ও কতৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রয়োগ করেন। তিনি দেশের ইসলামপ্রিয় ধর্মানুরাগী শ্রেণিকে কঠোরহস্তে দমন করে তাদের সঙ্গে উদারতাবাদী লিবারেল গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ও বৈরিতার অবসান ঘটান, যার দরুণ রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিল।

কামাল আতাতুর্কের তথাকথিত সংস্কারের পর তুরস্ক সত্যিই বস্তুগত উন্নতি লাভ করে এবং একটা পর্যায় পর্যন্ত স্থিতিশীল হয়। এখান থেকে পাশা মুসলিম বিশ্বের লিবারেল গোষ্ঠীর জন্য অনুসরণীয় নমুনা হয়ে ওঠেন। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কামাল পাশার মতো আর কেউ নেই, যিনি অতি নগণ্য যোগ্যতা ও চরম নৈতিক অবক্ষয়ের পরও মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন।

এর পেছনে একটি বড় কারণ ছিল, তুরস্ক অস্তিত্বের সঙ্কটে থাকাকালীন পাশা দেশটিকে বহিঃশক্তির থাবা থেকে রক্ষা করেছিলেন। সারা বিশ্বে সাধারণ মুসলিমরা সম্মান ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অস্থির হয়ে ছিল। তাই কোনো মুসলিম দেশকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিলে যে কোনো নেতাই তাদের কাছে 'হিরো' বনে যেত, যদিও লক্ষ্য পূরণে সেই নেতা দেশের নৈতিক আত্মা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সমূলে ধ্বংস করে দেন।

যাইহোক, তুরস্ককে মুসলিম দেশগুলো মডেল রাষ্ট্র মনে করতে থাকে। ইসলামী বিশ্বের সর্বত্র সেই স্লোগানগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, যা তুরস্কে জিয়া গোক আল্প, জিয়া পাশা, আহমেদ মিদহাত আফেন্দি এবং কামাল আতাতুর্ক দিয়েছিলেন।

সভ্যতা-সংস্কৃতিকে ধর্ম থেকে পৃথক করার যে ধারণা জিয়া আল্প পেশ করেছিলেন, একই ধারণা আরব দেশগুলোতে শায়খ আলী আবদুর রাজ্জাক الإسلام وأصول الحكم বইয়ে তুলে ধরেন এবং এই ধারণা পুঁজি করে ভারতবর্ষে মৌলভী চেরাগ আলী অগ্রসর হন।

পৃথিবী জুড়ে মুক্তবুদ্ধিপ্রিয় লোকেরা এই ধারণা ও স্লোগান আওড়াতে লাগল। এক তুর্কি একথাও লেখে-

We want to construct a Turkish Islam, which will be ours, relevant to and integrated with our (new) society.

'আমরা একটি টার্কিশ ইসলাম নির্মাণ করতে চাই, যা হবে আমাদের নিজস্ব, আমাদের নতুন সমাজের সঙ্গে মানানসই ও প্রাসঙ্গিক।' (Islam in Modern History, Prof. Wilfred Cantwell Smith, p. 193)

ভারতবর্ষে মডার্নিজমের বিকাশ

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আধিপত্য মজবুত হয়ে উঠেছিল। ইংরেজরা আধুনিক বিজ্ঞান, আধুনিক প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট উপায়-উপকরণ ও শিল্পপণ্য সঙ্গে নিয়ে আসে। অপরদিকে ১৮৫৭-এর হাঙ্গামায় ভারতীয় মুসলিমদের মর্যাদা ও স্বকীয়তা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা আহত ও ভগ্নহৃদয় ছিলেন। ফলে সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পরপরই মডার্নিজমকে কেন্দ্র করে কয়েকটি নতুন ধারার বিকাশ ঘটতে শুরু করে।

১৮৬৩ সালে কলকাতায় 'মুসলিম লিটারারি সোসাইটি' (Mohammadan Literary Society) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ভিত্তি স্থাপন করেন নবাব খান বাহাদুর আব্দুল লতিফ। পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় মুসলিমদের মেলবন্ধন গড়ে তোলাই সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল।

এর প্রতিষ্ঠাতারা মত ব্যক্ত করেন, ব্রিটিশ সরকার অধিক শক্তিশালী হওয়ায় তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব নয়, কিন্তু বহুমুখী উন্নত ও সমৃদ্ধ ব্রিটিশ সভ্যতা  সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা মুসলিমদের অগ্রগতির পথে বাধা। (Modern Islam in India : A Social Analysis, Wilfred Smith, p. 5)

সংগঠনটি ধর্ম, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিসহ সব কিছু পশ্চিমায়নের পরামর্শ দেয়।

কয়েকজন বিশিষ্ট আলেম তাদের এই চিন্তার প্রতিবাদ করেন এবং ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্য অবৈধ ঘোষণা দেন। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় সংগঠনটির তরফ থেকে দাবি করা হয়, ভারতবর্ষ 'দারুল ইসলাম' হওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ করার প্রশ্নই ওঠে না। হকপন্থী আলেমগণ এই ভ্রান্ত দাবি কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.-

كيا ہندوستان دار الحرب ہے؟

-(ভারতবর্ষ কি দারুল হারব?) নামক পুস্তিকা লেখেন।

ভারতবর্ষে মডার্নিজমের প্রথম ধ্বজাধারী হিসেবে পরিচয় পাওয়া এই সংগঠন কী উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এর পেছনে কী ধরনের মনোভাব কাজ করছিল; এর উত্তরে (ফোরম্যান ক্রিশ্চিয়ান কলেজ লাহোরের ইসলামিক হিস্ট্রির লেকচারার ও প্রসিদ্ধ মার্কিন প্রাচ্যবিদ) প্রফেসর উইলফ্রেড স্মিথ লিখেছেন-

The class of men here represented was necessarily loyal to the British to whom they owed their existence. Their religion, if it was to mean anything to them, must be consonant with this position.

'যে শ্রেণির লোকেরা এই সংগঠনে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, তারা স্বভাবতই ব্রিটিশ সরকারের অনুগত ছিলেন, কারণ তাদের অস্তিত্ব ও টিকে থাকা ব্রিটিশদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এই নতজানু মানসিকতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ধর্মচর্চাকেই তারা অর্থবহ মনে করতেন।' (Modern Islam in India, p. 6)

কিন্তু মডার্নিজম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে আবির্ভূত হওয়া এই সংগঠন তেমন কোনো সফলতা অর্জন করতে পারেনি। মুসলিম জনসাধারণ একে ঘৃণার চোখেই দেখত। ফলে এর প্রভাব অনেক সীমিত ছিল।

স্যার সৈয়দ আহমদ খান

এরপর মডার্নিজমের হাল ধরেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। তার জনপ্রিয়তা এই ইজম প্রচারে নতুন প্রাণ এনে দেয়।

স্যার সৈয়দ ১৮১৭ সালে দিল্লির একটি সম্ভ্রান্ত ও সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন। তার জীবনী পড়লে জানা যায়, জীবনের শুরু থেকেই তিনি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। নিজ পরিবারের বিরোধিতা সত্ত্বেও ২১ বছর বয়সে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সাথে ব্রিটিশ সরকারের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। এই সময়ে তিনি সাহিত্যমূলক লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকতেন।

মুসলিমরা নিদারুণ দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও হারানো সম্মান ও স্বাধীনতা অর্জনে ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশ বিরোধী চূড়ান্ত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। স্যার সৈয়দ এই সংগ্রামের বিরোধিতা করে উল্টো ব্রিটিশদের সমর্থন দেন। তার লেখা বইগুলোতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের 'বিদ্রোহী' 'বিশ্বাসঘাতক' আখ্যা দেন।

এই সংগ্রামের প্রেক্ষিতে তিনি মুসলিমদের প্রতি কতটা ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং ব্রিটিশদের প্রতি কতটা অনুগত ছিলেন; তার লিখিত-

سرگذشت سركشئ بجنور

(বিজনৌর বিদ্রোহের ইতিবৃত্ত) বই দেখলে তা স্পষ্ট হয়। বইটি কিছুদিন আগে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।

'৫৭-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে ১৮৬৯ পর্যন্ত স্যার সৈয়দের কর্মকাণ্ড একটি বিষয় স্পষ্ট করে। তিনি মুসলিমদের নেতৃত্বে পরিচালিত 'ইংরেজ খেদাও' আন্দোলনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে এর ক্ষতি পূরণ করতে চেয়েছিলেন। ১৮৬০ সালে ÔThe Loyal Mohammedans of IndiaÕ (ব্রিটিশদের অনুগত ভারতীয় মুসলিম) নামে একটি বই লেখেন। বইয়ে তিনি এই শ্রেণির অবদানের প্রশংসা করেছিলেন।

সেই সময় তিনি খ্রিস্টান ও মুসলিমদের মাঝে সমন্বয় সাধনের প্রয়াসে উভয় ধর্মের মৌলিক ঐক্য ও মিল দেখাতে উদ্যোগী হন। এই লক্ষ্যে তিনি নানা প্রবন্ধ-নিবন্ধ তৈরি করেন। প্রফেসর স্মিথ লিখেছেন-

He published a study of the Bible, beginning a sympathetic commentary on it, and holding that it had not been corrupted.

'স্যার সৈয়দ বাইবেলের একটি খ্রিস্টান-'দরদী' ভাষ্যগ্রন্থও প্রকাশ করেন। এতে তিনি বাইবেল বিকৃতিমুক্ত হওয়ার দাবি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন।' (নাউযুবিল্লাহ!)(Modern Islam in India, p. 8)

এই সময়ে তিনি পশ্চিমা ধাঁচের বিভিন্ন স্কুল ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

১৮৭০ সালে ব্রিটেন সফরে যান। সেই সময় তিনিই ছিলেন ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে সফর করা প্রথম বিখ্যাত 'মুসলমান'। ব্রিটেনে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়, লন্ডনের বিশিষ্ট মহলগুলোতে তিনি উচ্চাসন লাভ করেন, রাজকীয় নিমন্ত্রণগুলোতে অংশগ্রহণ করেন, Athenaeum Club-সহ অন্যান্য উঁচু শ্রেণির সংগঠন তাকে সম্মানসূচক সদস্যপদ প্রদান করে, Society of Civil Engineers -এর বৃহৎ ঐতিহাসিক সভা ও ডিনারেও অংশ নেন, যেখানে তিনি চলমান বা শেষ হওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প সম্পর্কে জানতে পারেন। (আলতাফ হুসাইন  হালী কৃত حيات  جاويد, চতুর্থ অধ্যায়, ১/১৩০-১৪৪)

এই সফরে তিনি পশ্চিমা সভ্যতার  কেন্দ্রস্থল সরাসরি প্রত্যক্ষ করে মারাত্মক প্রভাবিত হন। Modern Islam In India বইয়ে প্রাচ্যবিদ উইলফ্রেড স্মিথ স্যার সৈয়দের জীবনে পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাব সম্পর্কে বলেন-

The third period in his life, the 1870's, begins from his voyage to England, when he suddenly saw European civilization in full swing, and was overwhelmed with it, dazed like a young child.

Whereas before he had emphasized adherence to Britain politically, from now on his interest is also and enthusiastically in the cultural contribution; he saw his task as that of persuading his community not only to accept British rule, but also to acquire Western culture.

'ব্রিটেন সফরের পর স্যার সৈয়দের জীবনের তৃতীয় অধ্যায় শুরু হয়। ইউরোপীয় সভ্যতাকে উন্নতির চরম শিখরে দেখতে পেয়ে তিনি বিমোহিত হয়ে যান, অল্পবয়েসী শিশুর মতো আবেগী হয়ে পড়েন। আগে তিনি ব্রিটিশদের কাছে রাজনৈতিক আত্মসমর্পণে জোর দিয়েছিলেন। এখন তার আগ্রহ আরও গভীর হল, তিনি পশ্চিমা সভ্যতার অংশীদার হওয়ার চিন্তা করলেন। তিনি মনে করলেন, তার কাজ শুধু ব্রিটিশ শাসন মেনে নেওয়ার প্রচারেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং মুসলিম সমাজকে পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতি গ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করাও তার দায়িত্ব।' (Modern Islam in India, p. 9)

এই সফরের পর স্যার সৈয়দের মনে পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি যেমন শ্রদ্ধা বেড়ে গেল, দেশবাসীর প্রতি অবজ্ঞাও তৈরি হল। লন্ডন থেকে ফিরে তিনি যে লেখাগুলো প্রকাশ করেছেন, তাতে এই পরিবর্তন স্পষ্ট দেখা গেছে। লন্ডনে পৌঁছে ১৫ অক্টোবর ১৮৬৯ সালে তিনি আলীগড় সায়েন্টিফিক সোসাইটিকে এক চিঠিতে লেখেন-

High and low, merchants and petty shopkeepers, educated and illiterate, when contrasted with the English in education, manners, and uprightness, are as like them as a dirty animal is to an able and handsome man.

'ভারতীয় সমাজের উঁচু কিংবা নিচু শ্রেনি, ব্যবসায়ী হোক বা সাধারণ দোকানদার, শিক্ষিত-অশিক্ষিত; এই সব শ্রেণির লোকদেরকে শিক্ষা, আদবকেতা ও নৈতিকতায় ইংরেজদের সাথে তুলনা করলে ভারতীয়দের নোংরা পশুর মতো মনে হবে আর ইংরেজদের মনে হবে সক্ষম ও সুদর্শন মানুষ।' (Modern Islam in India, p. 9)

প্রফেসর স্মিথ স্যার সৈয়দের আরো বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন-

He said that now not only did he understand why the Englishman in India treated the 'natives' with contempt, but also he thought that they well deserved it.

'এখন আমি বুঝতে পেরেছি, ইংরেজরা ভারতীয়দের প্রতি কেন অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। আমি তো মনে করি, ভারতীয়রা আসলে এর উপযুক্ত।' (Modern Islam in India, p. 9)

স্যার সৈয়দের জীবনের এই ঘটনাগুলো আমি কিছুটা বিস্তারিত উল্লেখ করেছি, যাতে আপনি তার চিন্তা পরিবর্তনের পটভূমি গোড়া থেকে উপলব্ধি করতে পারেন; কীভাবে তিনি পশ্চিমা সভ্যতায় মজে গিয়েছিলেন। সেইসাথে তার মানসিক অবস্থাটাও ধরতে পারেন, যা তাকে ভারতবর্ষে মডার্নিজম চর্চা বেগবান করতে উৎসাহ জুগিয়েছিল।

ইংল্যান্ড সফরের আগে তিনি ইসলামী শরীয়তে অন্যায় হস্তক্ষেপ ও অস্ত্রোপচার শুরু করেননি। সফর থেকে ফিরে তিনি মনে করলেন, ভারতবর্ষে পশ্চিমা সভ্যতার প্রসার অবশ্যপ্রয়োজনীয়। কিন্তু পশ্চিমা রীতি ও সভ্যতার অনেক উপাদান তো ইসলামী নীতি ও আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক। এই বাধা দূর করতে তিনি খোদ ইসলামী নীতিমালার বিকৃতিসাধনের পথ বেছে নেন।

'তাহযীবুল আখলাক' নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন। এই পত্রিকা ছিল মডার্ন চিন্তাধারার প্রথম আনুষ্ঠানিক মুখপত্র। পত্রিকাটিতে এমন অনেক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল, যাতে ইসলামের বহু মূলনীতি সংশোধন ও বিকৃত করা হয়েছিল। পর্দার বিধান প্রায় অস্বীকার করা হল, কাফেরদের বিরুদ্ধে 'ইকদামী জিহাদ'-এর বিধান ও দাসপ্রথাকে অবৈধ বলা হল। পশ্চিমা সভ্যতার সাথে ইসলামের যত বিষয় সাংঘর্ষিক ছিল, সেসব সংশোধন করা হল। এমনকি হাদীস অস্বীকার করারও দুঃসাহস দেখানো হল।

এই প্রসঙ্গে প্রফেসর স্মিথ একটি আশ্চর্য পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন-

The prophetic Makkah āyahs were quoted more and more, the legalist Madīnah ones less.

'স্যার সৈয়দ তার লেখায় প্রচুর মাক্কী আয়াত উদ্ধৃত করেছেন, মাদানী আয়াত যেখানে বেশিরভাগ বিধিবিধান উল্লেখ রয়েছে খুব কম উদ্ধৃত করেছেন।' (Modern Islam in India, P. 14)

স্যার সৈয়দ নবীজীর সীরাত ও কুরআনের তাফসীর সম্পর্কেও কলম ধরেন। সীরাতে নববী ও কুরআনের যেসব বিষয়ে পশ্চিমারা আপত্তি তুলেছিল, তিনি জবাব দিতে গিয়ে সেসবের মূল বাস্তবতাই পাল্টে দিলেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি মুজেযার প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দাঁড় করান, মুজেযাকে যুক্তিসীমার বাইরে বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার অতীত কিংবা কারণ-নিরপেক্ষ আলৌকিক ঘটনা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন।

সমকালীন অন্যান্য মডার্নিস্ট

তৎকালীন ভারতবর্ষের উচ্চবিত্ত সমাজের (Upper Class) অনেকেই স্যার সৈয়দের মতো পশ্চিমা সভ্যতার বাঁধভাঙা স্রোতে ভেসে গিয়েছিলেন। তারা পশ্চিমা জীবনধারা আপন করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় বিধি-নিষেধ থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। স্যার সৈয়দ 'তাহযীবুল আখলাক' পত্রিকা চালু করলে তাদের মনের আশা পূরণ হয়। এই পত্রিকাকে তারা মডার্ন চিন্তা প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গ্রহণ করেন এবং স্যার সৈয়দের পথ ধরে ইসলামের স্বীকৃত মূলনীতিগুলো বিকৃত করতে কলম চালাতে থাকেন।

এই মডার্নিস্টদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন মৌলভী চেরাগ আলী। লেখনীর মাধ্যমে তিনি মডার্নিজম চর্চায় ভিন্নমাত্রার গতি সঞ্চার করেছিলেন। ইসলামের বিধি-নিষেধের সীমারেখা থেকে বেরিয়ে আসতে তিনিও জিয়া গোক আল্পের এই চিন্তা অবলম্বন করেন; ইসলাম কেবল ইবাদত ও আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম, ইবাদত করার পর যে কোনো সভ্যতা বেছে নেওয়ার উন্মুক্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে, জীবনের সব ক্ষেত্রে যেমন খুশি তেমন করার অধিকার আছে। চেরাগ আলী সাহেব এই মতবাদ- The Proposed Political, Legal and Social Reforms In The Ottoman Empire And Other Mohammadan States (উসমানী সালতানাত ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে রাজনৈতিক, আইনি ও সামাজিক সংস্কার প্রস্তাবনা)- শীর্ষক বইয়ে প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীতে اعظم الكلام নামে বইটির উর্দু অনুবাদ প্রকাশিত হয়।

বইয়ের ভূমিকায় তিনি স্পষ্ট লিখেছেন-

I have shown here as well as in the second part of this book that Islam as a religion is quite apart from inculcating a social system. The Mohammadan polity and social system have nothing to do with religion.

'বইয়ের দ্বিতীয় অংশে আমি দেখিয়েছি, ইসলাম ধর্ম হিসেবে কোনো পৃথক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলে না, মুসলিমদের রাজনীতি ও সমাজনীতি ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।' (The Proposed Political..., Intruduction, p. xxxiv)

জিয়া গোক আল্পও এই ধারণা  পেশ করেছিলেন। তবে কুরআনের আয়াত বা নবীজীর হাদীস পেশ করতে পারেননি। কিন্তু মৌলভী চেরাগ আলীর 'উর্বর মস্তিষ্ক' এই ধারণার সমর্থনে একটি হাদীস খুঁজে পেয়েছিল। দেখা যাক; এই দলীল উপস্থাপন কতটা বুদ্ধিদীপ্ত ছিল!

মদীনায় সাহাবীরা খেজুর গাছে ফল পেতে পরাগায়ন করতেন। নবীজী তাদেরকে এমনটি না করার পরামর্শ দেন। কিন্তু মদীনার গাছপালা এই পদ্ধতি ছাড়া ফল দেয় না; এটা জানতে পেরে নবীজী অনুমতি দিয়ে বললেন-

أنتم أعلم بأمور دنياكم

'তোমরা তোমাদের দুনিয়ার বিষয়গুলো ভালো জানো।'

সাধারণ বুদ্ধির মানুষও জানেন, একজন পদাধিকারী ব্যক্তির দায়িত্বশীলের ভূমিকা ছাড়া ব্যক্তিগত অবস্থানও থাকে। যেমন, রাষ্ট্রীয় পদ হিসেবে প্রেসিডেন্টের আদেশ তার পিতার জন্যও মানা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সাধারণ মানুষ হিসেবে প্রেসিডেন্ট তার পরিবার, আত্মীয় বা বন্ধুকে কোনো পরামর্শ দিলে তা মানা তাদের জন্য আবশ্যক নয়। তিনি যদি বন্ধুকে বলেন, 'আমি তো তোমার ভাই, আমার সব কথা মানতে তুমি বাধ্য নও', তাহলে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি কি কথাটির এই অর্থ নিতে পারেন; প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেওয়া নির্দেশও মানা বাধ্যতামূলক নয়?

স্বাভাবিকভাবে এখানে বোঝানো হচ্ছে, আমার ব্যক্তিগত বক্তব্য অনুসরণ করা তোমার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। নবীজীর উক্ত বক্তব্যের অর্থও এটিই ছিল। সাধারণ বোধসম্পন্ন মানুষও এই অর্থ বোঝেন এবং আজ পর্যন্ত সকল মুসলমান তা-ই বুঝেছেন।

কিন্তু যখন পশ্চিমা রীতি প্রচার করার জন্য সভ্যতা-সংস্কৃতির অধ্যায় ইসলাম থেকে আলাদা করার তীব্র প্রয়োজন দেখা দিল এবং এই কাজটির বৈধতা তালাশ করতে গিয়ে মৌলভী চেরাগ আলীর সুযোগ-সন্ধানী চোখ পড়ল নবীজীর বক্তব্যটির ওপর, তিনি কোনোরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই ব্যাখ্যা করে দিলেন; নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুনিয়াবি বিষয়ক নির্দেশ মানতে আমরা বাধ্য নই, চাই নবীজী তা ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে বলেন বা শরীয়াহ ও আইন হিসেবে পেশ করেন! (নাউযুবিল্লাহ!)

এই অসার ব্যাখ্যার প্রতিবাদ করার ভাষা আমাদের জানা নেই। মির্জা গালিব বলেন-

خامہ انگشت بدنداں کہ اسے کیا لکھيئے

ناطقہ سر بہ گریباں ہے اسے کیا کہيئے

কলম অক্ষম, কী লিখব,

বাকশক্তি অসহায়, কী বলব!

মৌলভী চেরাগ আলী সাহেবের মতো লোকদের 'ইজতিহাদ'চর্চার এটি একটি নমুনা। ইসলামকে যুগোপযোগী করতে গিয়ে তারা এমন বিকৃতি করতেও পিছপা হননি। তিনি ছাড়া সৈয়দ মেহেদী আলী, মুস্তফা খান ও সালাহউদ্দিন খোদা বখশও এই মিশনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন এবং 'তাহযীবুল আখলাক'-এর প্ল্যাটফর্মটির সর্বোচ্চ 'সদ্ব্যবহার' করেছিলেন।

এভাবে ইসলামের অস্ত্রোপচার চালিয়ে যেতে থাকলেও মুসলিম জনসাধারণের বিরোধিতায় তাদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।

তবে পশ্চিমারা খুশি হয়ে তাদের বাহবা দিচ্ছিল। প্রফেসর উইলফ্রেড সি. স্মিথ স্পষ্ট স্বীকারোক্তি দিয়েছেন-

Such is Khudā Baksh. We can not leave him pointing out the hearty reception which his thinking received in the West. One after another of the Western writers on modern Islām (and not least the missionaries) have welcomed him as the last word in Muslim modernization, and have praised his liberalism to the skies. Therein they but betray to what class they themselves belong.

'পশ্চিমা বিশ্বে খোদা বখশের চিন্তাধারা যে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছিল, তা উল্লেখ না করে আমরা তার আলোচনা শেষ করতে পারি না। 'মডার্ন ইসলাম' নিয়ে লেখালেখি করা পশ্চিমা কলমবাজেরা, বিশেষ করে মিশনারিরা খোদা বখশকে 'মুসলিম মডার্নাইজেশন'-এর চূড়ান্ত প্রতিনিধি হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন, তার 'লিবারেলিজম'-এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এভাবে তারা নিজেরা কোন্ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, তা প্রকাশ করে দিয়েছেন। (Modern Islam in India, p. 30-31)

মুসলিমদের মাঝে মডার্নিজম চর্চা যে পশ্চিমাদের সমর্থনেই হয়েছিল, এই 'মূল্যায়ন' দেখার পরও কি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে? জিগার মুরাদাবাদীর ভাষায় মডার্নিস্টদের অবস্থা ছিল-

پیتا بغیرِ اذن، یہ کب تھی مری مجال

در پرده چشم يار كى شہ پاکے پى گيا

বিনা অনুমতিতে পান করার সাধ্য কি ছিল আমার,

প্রিয়তমার সম্মতি পেয়েই তো পান করলাম!

মডার্নিজমের দ্বিতীয় পর্ব

এখন পর্যন্ত আমরা যে মডার্নিস্টদের কথা বলেছি, তারা পশ্চিমা সংস্কৃতি গ্রহণের পক্ষে এভাবে যুক্তি দিতেন; ইসলাম মূলত ইবাদতের ধর্ম, পৃথিবীর যে কোনো সংস্কৃতি গ্রহণে ইসলাম বাধা দেয় না। এটি ছিল মডার্নিজম চর্চার শুরুর ধারণা।

কিন্তু মুসলিম জনসাধারণ কখনোই ইসলামকে এত সংকীর্ণ ও সীমিতরূপে মেনে নিতে পারে না। মুসলিম বিশ্বের সবখানে এই ধারণার তীব্র বিরোধিতা হল, সবাই এটি স্পষ্ট ভুল মনে করতে লাগল।

এই পরিস্থিতিতে মডার্নিজম বড় ধরনের বিপদের সম্মুখীন হল। কিছুদিনের মধ্যেই মডার্নিস্টরা বুঝে গেল, ইসলামকে এত সীমাবদ্ধ করে তাদের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে, জনমতও তাদের বিপক্ষে যাচ্ছে, ফলে এই ধারণা বেশিদিন টিকবে না।

এভাবে ইসলামকে শুধু ইবাদত ও আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ রাখার চিন্তা দমে গেল, তার পরিবর্তে জোরদার নতুন আওয়াজ উঠল 'কোন্ নির্বোধ ইসলামকে এত সংকীর্ণ মনে করে? ইসলাম সংকীর্ণ নয়। ধর্মের এমন অবমাননা আমরা সহ্য করতে পারি না। ইসলাম তো শ্রেষ্ঠ সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক, আর তা হচ্ছে ইংরেজ সভ্যতা। কিছুকাল এই সভ্যতা ত্যাগ করার অর্থ এই নয়, এটি ইংরেজদের নিজস্ব হয়ে গেছে। ইংরেজ সভ্যতাই নিখাদ ইসলামী সভ্যতা। উন্নতি করতে চাইলে এই সভ্যতা গ্রহণ করার বিকল্প নেই।'

দেখুন, কীভাবে আওয়াজ বদলে গেল? তার মানে উদ্দেশ্য একটাই, পশ্চিমা সভ্যতা প্রচার করো, যতটা 'সুন্দর' করে পারো!

জালাল লাখনোভীর ভাষায়-

شب کو مے خوب سی پی صبح کو توبہ کر لی

رند کے رندر ہے،  ہاتھ سے جنت نہ گئی

'রাতে মনভরে পান করলাম, সকালে তওবা করে নিলাম,

শরাবের মাস্তিতেও মজে রইলাম আবার জান্নাতও হাতছাড়া হল না'

১৮৯১ সালে জনাব আমীর আলী Spirit Of Islam বইটি লেখেন, ফলাফল বিচারে, স্যার সৈয়দ ও মৌলভী চেরাগ আলীর মতামতই এখানে উপস্থাপন করেন। তবে পশ্চিমা বয়ান ও আপত্তির মুখোমুখি হওয়ার পদ্ধতিতে তাদের মাঝে পার্থক্য ছিল।

পর্দার বিধান নিয়ে পশ্চিমাদের অভিযোগ ছিল, ইসলাম পর্দার আদেশ দিয়ে নারীদেরকে ঘরবন্দি করে রেখেছে। স্যার সৈয়দ ও মৌলভী চেরাগ আলী বলেছিলেন, ইসলাম নারীদের পর্দা করার আদেশ নয়, বরং পরামর্শ দিয়েছে মাত্র; নতুবা ইসলাম শুধু ইবাদতের ধর্ম।

জনাব আমীর আলী বললেন, ইসলাম পর্দার আদেশ দিয়েছে- একথাও  ভুল; আবার পর্দা সম্পর্কে কোনো আইনগত নির্দেশ দেয়নি- একথাও ভুল। আসলে ইসলাম নানা প্রকারের জুলুমের হাত থেকে যেমন নারীকে রক্ষা করেছে, পর্দার কয়েদ থেকেও মুক্তি দিয়ে নারীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলামপ্রদত্ত এই অনন্য স্বাধীনতা পশ্চিমারা গ্রহণ করে সফল হয়ে গেছে আর মুসলিমরা ত্যাগ করে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হয়েছে।

ইসলামে যুদ্ধবন্দিদের দাসত্বের বিধান সম্পর্কে পশ্চিমাদের অভিযোগ ছিল, ইসলাম দাসপ্রথা বৈধ রেখে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। স্যার সৈয়দ জবাব দিয়েছেন, ইসলাম শুধু ইবাদতের ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছে, শাসনপদ্ধতির ক্ষেত্রে মুসলিমরা স্বাধীন, চাইলে বন্দিদের দাস বানাতে পারে বা মুক্ত করে দিতে পারে।

কিন্তু জনাব আমীর আলী বললেন, ইসলাম তো দাসত্বের ধারণাই কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসলামের এই নির্দেশ পশ্চিমারা মানলেও মুসলিমরা এখনো বৈধ মনে করছে।

তো এই ধরনের বিষয়ে ইসলাম ও পশ্চিমের দ্বন্দ্বে উভয় শ্রেণির মডার্নিস্টরা পশ্চিমা জীবনরীতি বেছে নেওয়ার সমাধান দিয়েছেন। তবে সাবেক মডার্নিস্টরা বলতেন, পশ্চিমা রীতি গ্রহণে ইসলামে কোনো বাধা নেই। নতুন ধারার মডার্নিস্টরা বললেন, ইসলামই বরং পশ্চিমা জীবনধারা লালন করতে উৎসাহিত করে এবং এটাই ইসলামের মূলনীতি।

আমীর আলী সাহেবের এই চতুর টেকনিক মডার্নিজম সমর্থকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠল, এই টেকনিক অনুসরণ করে প্রবন্ধ ও আর্টিকেল লেখা শুরু হল, পশ্চিমারাও এর প্রশংসা করল। কিন্তু আমীর আলী সাহেবের একটি ত্রুটি প্রাচ্যবিদদের দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াল। আমীর আলী সাহেব হাদীসকে প্রামাণ্য মনে করতেন, আর হাদীসের প্রামাণ্যতা স্বীকার করে পশ্চিমা সভ্যতাকে পুরোদস্তুর ইসলামী সভ্যতা বলা মারাত্মক দুঃসাহসের কাজ ছিল। তাই মডার্নিজম প্রচারের এই মডেলও শিগগিরই ব্যর্থ হওয়ার প্রবল আশঙ্কা ছিল। এই আশঙ্কা প্রাচ্যবিদদের মনে কেমন দোলা দিচ্ছিল, তা মডার্নিস্টদের সম্পর্কে প্রাচ্যবিদ ক্যান্টওয়েল স্মিথের আক্ষেপ দেখে বোঝা যায়-

They have quoted Qur'an and hadith voluminously to prove that Islam is rational, but have never subjected Qur'an and ḥadīth to rational criticism.

'ইসলামকে যুক্তিসম্মত প্রমাণ করতে তারা কুরআন-হাদীসের বিপুল উদ্ধৃতি দিলেও খোদ কুরআন-হাদীসকে কখনো যুক্তির আলোকে বিচার করেননি।' (Modern Islam in India, p. 58-59)

প্রাচ্যবিদদের আশঙ্কা সঠিক প্রমাণ হল। পশ্চিমা চিন্তার আলোকে ইসলামকে পুনর্মূল্যায়ন ও নবরূপায়ণের এই মডেলটি ব্যর্থ হলে মডার্নিজম চর্চা তৃতীয় মডেলে প্রবেশ করল।

তৃতীয় পর্ব

এই পর্যায়ে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ সভ্যতার ধারক হিসেবে উপস্থাপন করে বলা হল, পশ্চিমা সভ্যতাই ইসলামের আদি সভ্যতা। আর সহজে এই উদ্দেশ্য সাধনের মতলবে হাদীসের প্রামাণ্যতা অস্বীকার করা হল। ফলে পশ্চিমা সভ্যতাকে ইসলামী সভ্যতার প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সবচেয়ে বড় বাধাটি দূর হয়ে যায়।

অবশ্য সামান্য পার্থক্য ছিল। প্রফেসর স্মিথ কুরআন-হাদীসের সরাসরি 'যুক্তিনির্ভর সমালোচনা' করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু চতুর মডার্নিস্টরা এমন কৌশল অবলম্বন করল; যাতে কুরআন-হাদীস এড়িয়ে মডার্নিজমও প্রচার পায় আবার কুরআনকে সরাসরি রদ করার অভিযোগ থেকেও বাঁচা যায়।

কারণ কুরআনকে সরাসরি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানালে কেউই তাদের কথা শুনতে রাজি হত না। তাই তাঁরা এই স্লোগানের আশ্রয় নিল-

حَسْبُنَا كِتَابُ الله.

`আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট'

তবে জানা কথা, হাদীস শরীফকে উপেক্ষা করে কুরআন মানা আর না মানা ছিল সমান কথা। কারণ হাদীস অস্বীকার করলে কুরআনের অপব্যাখ্যা ও অর্থবিকৃতির ময়দান খুলে যায়, কুরআনের যেমন ইচ্ছা অর্থ করার ফাঁক-ফোকর তৈরি হয়।

তো এই লোকেরা হাদীস শরীফের নির্ভরযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা অস্বীকার করার অপচেষ্টায় পূর্ণ শক্তি ব্যয় করল। প্রতিটি লেখায় কুরআনের অসংখ্য আয়াত উদ্ধৃত করে কুরআনের প্রতি তাদের `গভীর প্রেম ও অনুরাগ' বোঝাতে চাইল।

হাদীসকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করার এই মিশন কয়েকটি ধাপ পাড়ি দিয়ে ادارۂ طلوع اسلام (`এদারায়ে তুলূয়ে ইসলাম' বা 'ইসলামের নবউত্থান' নামক একটি প্রতিষ্ঠান)-এর অধীনে স্বতন্ত্র সংগঠিত চিন্তার রূপ নিল। একটা সময় পর্যন্ত এই চিন্তাধারা না-ওয়াকিফহাল শ্রেণি ও মুক্তচিন্তাকামী লোকদের মাঝে বিশেষ সফলতা পেতে থাকল। আকর্ষণীয় সব লেখা প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি নিজেদেরকে দ্বীনের 'সাচ্চা খাদেম' প্রমাণ করতে চাইল।

কিন্তু আলেমরা এই ফেতনার স্বরূপ প্রকাশ করলে এর মোহ ভাঙতে সময় লাগেনি। মুসলিমরা বুঝে গেলেন, হাদীস অস্বীকার করলে দ্বীন ও শরীয়ত এবং আকল-বুদ্ধির কী জঘন্য বিকৃতি ঘটে। তাই হাদীস অস্বীকার করার নীতি গ্রহণ করেও মডার্নিজম প্রচারকরা তেমন সফলতা অর্জন করতে পারেনি।

চতুর্থ পর্ব

দীর্ঘ এক শতাব্দী ধরে ইসলামের বিকৃতিসাধন চর্চার নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কৃত হওয়ায় ইতিমধ্যেই মডার্নিস্টরা ইসলাম অপারেশনে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছিল। তাই তৃতীয় ধাপ ব্যর্থ হওয়ার পর আমীর আলী সাহেবের মডেলে ফিরতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। বিকৃতিসাধনের কলা-কৌশল এত উন্নত হয়ে গিয়েছিল যে, হাদীস ও সুন্নাহকে স্বীকার করার ঘোষণা দিয়েও তারা ইসলামের নামে ইচ্ছেমতো মতবাদ চাপিয়ে দিত। এভাবে মডার্নিজম চতুর্থ ধাপে পা রাখে।

এবারে পশ্চিমা চিন্তার প্রচারকরা জনসাধারণের সামনে কুরআন-হাদীসের সামগ্রিক প্রামাণ্যতা মেনে নেওয়ার কৌশল বেছে নিল। তবে কোনো হাদীস তাদের মতের বিরোধী হলে পূর্বের ন্যায় হাদীসের অর্থ বিকৃত করতে দ্বিধা করত না; পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় এই কাজে তাদের মুন্সিয়ানাও ছিল। হাদীসটির মর্ম যদি পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন হত, বিকৃত করার কোনো উপায় বের না হত, তবে হাদীসের সূত্রে দুর্বলতা দেখিয়ে, কুরআনবিরোধী বা যুক্তিবিরোধী বলে হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করত।

এই কাজে গতি ফিরে পেতে একে অপরকে উৎসাহ দেওয়া এবং পারস্পরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের প্রয়োজন ছিল।

من ترا حاجی بگویم تو مرا حاجی بگو

'আমি তোমাকে হাজ্বী ডাকব তুমিও আমাকে হাজ্বী ডাকবে'

এই উদ্দেশ্যে লাহোরে ادارۂ ثقافت اسلامى ('এদারায়ে ছাকাফাতে ইসলামী' বা ইসলামী সংস্কৃতি পরিষদ) নামে একটি প্রতিষ্ঠান উদ্বোধন করা হয়।

এই প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক ثقافت (সাকাফাত বা সংস্কৃতি) পত্রিকা প্রকাশিত হয়, ইসলামের আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে ইতিপূর্বে স্যার সৈয়দসহ অন্যান্য মডার্নিস্ট যেসব মতামত ব্যক্ত করেছিলেন, সেগুলো প্রমাণ করতে বহু গ্রন্থ রচিত হয়।

যেমন, বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হয়, সংগীত পরিবেশন ও জন্মনিয়ন্ত্রণের বৈধতা দেওয়া হয়, ছবি তোলা ও ফটোগ্রাফি করার অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়, নারীদের মুখ খোলার রায়ও সমর্থন পায় এবং পর্দার বিধান দূরে ঠেলে দেওয়া হয়।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, স্যার সৈয়দ বা হাদীস অস্বীকারকারীদের কথাগুলোই পুনরাবৃত্তি করা হয়।

তবে একটি পার্থক্য ছিল। পুরোনো মডেলের যে মডার্নিস্টরা এই বিষয়গুলোতে কলম ধরেছিলেন, তারা বেশ সাহসিকতার সাথে ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতিকে ভালবাসি, আমাদের সমাজে এই সংস্কৃতি গড়তে চাই।'

কিন্তু নতুন মডেলের প্রচারকারীরা এই সৎসাহস দেখাতে পারলেন না। তারা বারবার দাবি করলেন, 'আমরা পশ্চিমাদের অন্ধ অনুসারী নই। পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতির নানা মন্দ দিক এবং এর বদৌলতে পশ্চিমা সমাজ কী কী অধঃপতনের শিকার হয়েছে, তা আমরাও জানি।'

কিন্তু তারা দ্বিচারিতা করলেন। তারা সেই সব মন্দ বিষয় সমর্থন করলেন, যেগুলোর কারণে পশ্চিমারা নানা বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। এই স্ববিরোধী কর্মরীতি তাদের প্রকৃত হালই প্রকাশ করে। ভাবটা এমন, 'পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুসরণের কুফল আমরা যৌক্তিকভাবে বুঝি, কিন্তু-

اپنی نظر کو کیا کروں ، مجھ کوتو وہ پسند ہیں

'কী করব, আমাদের চোখে সেটাই ভালো লাগে।'

'এদারায়ে ছাকাফাতে ইসলামী'র উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন খলীফা আবদুল হাকীম। শেষ পর্যন্ত তিনিও সরাসরি হাদীস অস্বীকারের মডেল বদলে এমন দ্বৈত রীতি গ্রহণ করেছিলেন।

আরেকজন ছিলেন জাফর শাহ ফুলওয়ারী। 'ছাকাফাত' থেকে ফুলওয়ারীর অনেকগুলো লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। সৌভাগ্য বলুন বা দুর্ভাগ্য, তার বেশ কিছু লেখা আমার পড়া হয়েছিল, কয়েকটি নিয়ে আমার পর্যালোচনামূলক প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে।

এই শ্রেণির যুক্তি কতটা 'ওজনদার', সেটার বিশদ ধারণা পেতে হলে আপনাকে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পড়তে হবে। উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনা দেখা যাক। জনাব ফুলওয়ারী কমিউনিজমের একটি মৌলিক চিন্তা প্রমাণ করতে গিয়ে দাবি করলেন, ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক জমি-জমা ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, জাতীয় সম্পত্তি, জমি কাউকে স্থায়ী মালিক হিসেবে নয়, বরং সাময়িক ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়।

এই দাবির বিপক্ষে কুরআন-হাদীসের বহু দলীল থাকা সত্ত্বেও তিনি দাবিটি প্রমাণে একটি মজার যুক্তি দেন। হাদীসে এসেছে-

جُعِلَتْ لِيَ الْأرْضُ مَسْجِدًا.

'আমার জন্য গোটা পৃথিবীকে মসজিদ বানানো হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'মসজিদ তো কারো ব্যক্তি মালিকানা নয়। যখন পুরো পৃথিবীর যমিনকে মসজিদ বলা হচ্ছে, এর মানে, জমি-জমা কারো ব্যক্তিগত সম্পদ হতে পারে না'!

এই অবান্তর যুক্তির ওপর কোনো মন্তব্য করার প্রয়োজন দেখছি না। এই শ্রেণির যুক্তি এমনই হয়।

মডার্নাইজেশনের 'বিরাট' কর্মযজ্ঞ সম্পাদনে এত নিম্নমানের যুক্তি উৎপাদন করতে থাকলে এই শ্রেণির প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি ছিল। অন্যদিকে তখন পর্যন্ত পশ্চিমা চিন্তার প্রসার ঘটানোর দুই পন্থাই পরীক্ষা করা হয়ে গিয়েছিল; হাদীস অস্বীকার করে কিংবা বাহ্যত হাদীস মেনে নিয়ে।

হাদীস অস্বীকারকারী চক্রের প্রভাব দিন দিন কমে আসছিল। পরিশেষে একটি বড় আঘাতে হাদীস অস্বীকারের ফেতনার চূড়ান্ত পতন ঘটে। এই আঘাতটি ছিল সব মত ও পথের আলেমদের ঐকমত্যপূর্ণ ফতোয়া। সকল ধারার আলেমগণ স্পষ্ট ভাষায় হাদীস অস্বীকারকারীদের কাফের ঘোষণা করেছিলেন। এই আঘাতের পর হাদীস অস্বীকারকারীদের ওপর সাধারণ মানুষের অবশিষ্ট আস্থাও বিলুপ্ত হয়ে গেল। তাই পুনরায় হাদীস অস্বীকারের মাধ্যমে মতলব উদ্ধার করা সম্ভব ছিল না।

এখন মডার্নিস্টদের প্রয়োজন ছিল ঐ লোকদের, যারা কুরআন-হাদীস মানার ঘোষণা দিয়েও এমন দলীল উপস্থাপন করতে পারে, যা শোনামাত্রই খণ্ডনযোগ্য না হয় এবং অন্তত বেখবর মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। এই কাজের জন্য বিশেষ একজন দরকার ছিল, যিনি সরাসরি পশ্চিমা কোনো ভার্সিটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং প্রাচ্যবিদদের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত্ব করতে পেরেছেন।

মুহতারাম ড. ফজলুর রহমান এই মানদণ্ডে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সন্দেহ নেই, সবদিক বিবেচনায় তিনি এই কাজের 'যোগ্য' ছিলেন। তিনি ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে ইহুদী প্রাচ্যবিদদের সংশ্রবে 'ইসলামী জ্ঞান' অর্জন করেছিলেন।

১৯৫৯ সালে করাচিতে مركز اسلامى تحقيقاتى اداره (ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র) নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়, যা মডার্নিজম প্রসারের দায়িত্ব কাঁধে নেয়। এই লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি থেকে মোট চারটি পত্রিকা চালু করা হয়, দুটি ইংরেজিতে : একটি ত্রৈমাসিক Islamic Studies অপরটি মাসিক Ummah, সন্ধান নামে একটি পত্রিকা বাংলায় এবং فکر ونظر নামে একটি পত্রিকা উর্দুতে চালু হয়।

ড. ফজলুর রহমান পাকিস্তানে এসে মডার্নিস্ট ও প্রাচীনপন্থী মূলধারা; উভয় শ্রেণি থেকে নিরপেক্ষ থাকার ঘোষণা দেন। পূর্বের মডার্নিস্টদের সমালোচনাও করেন, যার অর্থ ছিল, তিনি তাদের সাথে একমত নন।

১৯৫৭ সালে লাহোরের একটি ইসলামিক সেমিনারে উপস্থাপন করা প্রবন্ধে ড. ফজলুর রহমান মডার্নিজমের ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন-

آزاد منش جدت پسندوں نے اس قدر دیوانہ وار اور اتنے فیصلہ کن انداز میں مغرب کی معاشرتی واخلاقی اقدار کو اسلام سے اس قدر ہم آہنگ کرنے کی کوشش کی کہ پوری طرح اس بات کی وضاحت کرنے کی بھی ضرورت نہ سمجھی کہ انہیں کیوں اپنا نا چاہئے؟

'মডার্নিজমের মুক্তমনা প্রবক্তারা এত উন্মাদ হয়ে পশ্চিমের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলোকে মীমাংসিত ও সন্দেহাতীত ধরে নিয়ে সেগুলোকে ইসলামের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রবল চেষ্টা করেছিলেন যে, কেন তাদের এই নতুন মূল্যবোধগুলো গ্রহণ করা উচিত, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ারও প্রয়োজন অনুভব করেননি তারা।'

এই কথাটি তিনি বারবার জোর দিয়ে বলেন। যেমন মাসিক 'ফিকর ও নযর' পত্রিকার ১৯৬৪ সালের আগস্ট সংখ্যায় তিনি লেখেন-

قدامت پسند حضرات قرون وسطی کے نظریات کی رو سے اسلام کی تشریح کرتے ہیں ، لیکن جدت پسند اصحاب ان نظریات کے بجائے نئی توضیحات لاتے ہیں۔

'রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থীরা মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামের ব্যাখ্যা করেন। আর মডার্নিজম সমর্থকরা পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেন।' (পৃ. ৯)

তিনি আরো লেখেন-

لیکن جدت پسند بھی اسلام کا کوئی نیا ترقیاتی خاکہ نہیں پیش کرتے ، ان کی جد و جہد منفی سمت میں ہوتی ہے ، وہ اسلام کو علیحدہ یا غیر مؤثر رکھنا چاہتے ہیں، تا کہ اسلام ترقی کی راہ میں حائل نہ ہو ، ان کا خیال ہے کہ اسلامی حدود سے باہر رہ کر ہی ترقی کی منزلیں طے کی جاسکتی ہیں ، اس طرح ایک اقل اسلام کا تصور ان کے سامنے آتا ہے ، جس سے انہیں عارضی تسلی تو مل جاتی ہے لیکن یہ لادینیت کا دوسرا نام ہوتا ہے ۔

'মডার্নিজমের প্রবক্তারাও ইসলামের কোনো নতুন উন্নয়নমূলক রূপরেখা উপস্থাপন করেন না। তাদের প্রচেষ্টাও নেতিবাচক দিকে ধাবিত হয়। তারা ইসলামকে অকার্যকর বা একঘরে করে রাখতে চান, যাতে ইসলাম 'উন্নতি'র পথে কাঁটা না হয়। তাদের ধারণা, ইসলামের সীমারেখা থেকে বেরোতে না পারলে 'উন্নতি'র পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। এভাবে ইসলামের একটি সংকুচিত পরিচয় তৈরি হয়, যা তাদের সাময়িক স্বস্তি দিলেও আসলে তা ধর্মহীনতারই ভিন্ন রূপ।' (প্রাগুক্ত)

এই ধরনের লেখার মাধ্যমে ড. ফজলুর রহমান সবাইকে বুঝিয়েছেন; তিনি নিরপেক্ষ, মডার্নিস্টদের মতো পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ করতে চান না, তাই চিহ্নিত মডার্নিস্টদের কাতারে তাকে গণ্য করা উচিত নয়।

কিন্তু এখানেই প্রবল আপত্তি ওঠে; ড. সাহেবের অবস্থান যদি এমনই হয়, তাহলে যেসব বিষয়ে মডার্নিস্টরা অন্ধ অনুকরণ করেছে, সেইসব বিষয়ে ড. সাহেব তাদের সাথে একমত হলেন কেন? 'এদারায়ে তাহকীকাতে ইসলামী' (ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র)-এর কাজে এবং অতীত মডার্নিস্টদের কাজে তো কোনো পার্থক্য নেই। প্রতিষ্ঠানটির যত 'কীর্তি' এই পর্যন্ত জনসম্মুখে এসেছে, সবগুলো একথার জ্বলন্ত প্রমাণ।

পশ্চিমের অনুকরণে সাবেক মডার্নিস্টরা সুদকে বৈধ বলেছিল, ড. সাহেবও তা-ই বলছেন। তারা বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল, ড. সাহেব তা-ই করছেন। তারা পর্দাকে শরীয়তবহির্ভূত দাবি করেছিল, ড. সাহেব তা-ই করছেন। যত বিষয়ে তারা পশ্চিমের অনুকরণ করেছে, ড. সাহেব ও তার গবেষক দল তাদের থেকে এর কোনো অংশে পিছিয়ে থাকেননি। তাহলে ড. সাহেবকে সাবেক মডার্নিস্টদের থেকে আলাদা মনে করার যুক্তি কী?

সুতরাং 'মডার্নিস্টরা অন্ধ অনুসরণ করেছিল'; ড. সাহেবের এই কথার মতলব এটাই দাঁড়ায়, অতীতের লোকেরা অন্ধভাবে পশ্চিমা ধারা মেনে নিয়েছিল আর আমরা রীতিমতো 'গবেষণা' করে গ্রহণ করেছি!

তার মানে তারা কি বলতে চান, যতই গবেষণা করা হোক, প্রতিটি ক্ষেত্রে পশ্চিমা রীতিই অপরিহার্য প্রমাণ হয়?!

যাইহোক, ড. ফজলুর রহমানের কর্মরীতি থেকে স্পষ্ট, দ্বীন ও শরীয়তের পশ্চিমায়নের পুরোনো কৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি নতুন ছক এঁকেছেন, যাতে এই ধারণা দেওয়া যায় যে, কুরআন-সুন্নাহ আশ্রিত গবেষণাও পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতির পক্ষেই কথা বলে।

হাঁ, ড. সাহেব প্রকাশ্যে হাদীস অস্বীকার করেন না। তার লেখাগুলোতে কুরআনের আয়াত, নবীজীর হাদীস এবং বড় বড় দ্বীনী গ্রন্থের প্রচুর উদ্ধৃতি দেখা যায়। কিন্তু তার লেখাজোখা বিশ্লেষণ করলে আমরা বলতে বাধ্য হই, তার লেখার ভঙ্গি জটিল, গোলমেলে এবং প্রাচ্যবিদদের উপস্থাপনশৈলী দ্বারা প্রভাবিত। ফলে সাধারণ পাঠক পুরো লেখাটি পড়ে বিষয়বস্তু বুঝতে না পারলেও উদ্ধৃতির ছড়াছড়ি দেখে তার গবেষণার ধরনে মুগ্ধ হয়। পাঠক মনে করে, এত গবেষণাধর্মী লেখা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ, এতে অনস্বীকার্য সব দলীল আছে। এভাবে দলীল যাচাই না করেই পাঠক প্রভাবিত হয়ে যায়।

আর যদি আহলে ইলম মনের ওপর জোর খাটিয়ে পুরো প্রবন্ধ পড়েও ফেলেন, তবে বহু চিন্তা-ভাবনার পর ড. সাহেবের দাবিগুলো বুঝতে পারলেও গোটা লেখা থেকে দাবির পক্ষে দলীল চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। ড. সাহেব লেখায় যে পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন, তার খুব কম অংশই মূল দাবির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হয়।

পাঠক, এই ছিল মডার্নিজমের একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এবং মডার্নিস্টদের চিন্তাধারার বিবর্তনের একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা।

 

[উর্দূ প্রবন্ধে ইংরেজি উদ্ধৃতিগুলোর অনুবাদ পেশ করা হয়েছে, বাংলা অনুবাদের সময় মূল বই থেকে উদ্ধৃতিগুলো মিলিয়ে দেখা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ ইংরেজি পাঠও যুক্ত করা হয়েছে। -অনুবাদক]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement