অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকার
সংস্কার না ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচার : কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ
১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সামরিক শাসক এরশাদের দীর্ঘ স্বৈরশাসন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া এবং দীর্ঘ আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৯০ সালের নির্বাচন। এ নির্বাচনের আগেও ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে এরশাদ দুই দুইটি নির্বাচন করেছিলেন। সেগুলো ছিল লোকদেখানো নির্বাচন। বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে এসব নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। যদিও ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দলগুলোর সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে যোগ দিয়েছিল। সেটাকে তারা ক্ষমতার স্বাদ নেওয়ার একটা ওসীলা হিসেবে নিয়েছিল। তারাও বুঝত, এ নির্বাচনে তারা কয়েকটা আসনই হয়তো পাবে। সেই স্বাদও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তথাকথিত সংসদ নির্বাচনের পর তারা বেরিয়ে আসে।
এরশাদ ১৯৮৮ সালে আবার নির্বাচন দেন। স্বীকৃত কোনো বিরোধী দল সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। যার ফলে আন্দোলন বেগবান হয়। এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়। শেষ মুহূর্তে এসে প্রশ্ন দেখা দিল, এরশাদ পদত্যাগের পর নির্বাচন হবে কীভাবে? কার তত্ত্বাবধানে হবে? কোন্ সরকার তখন ক্ষমতায় থাকবে? সবার বিশ্বাস ছিল, এরশাদ সরকারই যদি ক্ষমতায় থাকে, তাহলে সেটা নামেই নির্বাচন হবে। তখন বিরোধীদলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় তৎকালীন ডাকসুর নেতারা তাদের নেত্রীদেরকে চাপে ফেলে একটি ফর্মুলা বের করে। গঠিত হয় একটি অস্থায়ী সরকার। সে সরকারের প্রধান বানানো হয় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে। তিনি সবার চাপে এ শর্তে রাজি হন যে, তাকে আবার পূর্বের পদে ফিরিয়ে নিতে হবে। তিনি প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। তারপর এরশাদ পদত্যাগ করেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তিনি হন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট হয়ে যে কাজটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করেন তা হল, দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরশাসক এরশাদকে বন্দি করেন।
তারপর নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে জয়ী হয়ে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। যত সময় গড়িয়েছে আন্দোলন বেগবান হয়েছে। একসময় জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য বিরোধী দলও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দেয়। তাদের একমাত্র দাবি হয়ে ওঠে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য চূড়ান্ত আন্দোলন চলে। শেষ পর্যন্ত বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এনে সংবিধান সংশোধন করতে বাধ্য হয়।
সে আইনেই ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০১৪ নির্বাচনের আগেই নিজেদের দাবিতে পাসকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয় আওয়ামী লীগ। এর পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশের আদালত পাড়ার কলঙ্ক হিসেবে খ্যাত বিচারপতি খায়রুল হক। তিনি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবলিত সংশোধনীটি বাতিল করে রায় দেন। (যার পুরস্কারস্বরূপ অবসরে যাওয়ার পরও শেখ হাসিনা তাকে রাষ্ট্রীয় ভিন্ন পদে বসিয়ে রেখে আজীবন সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। যা শেষ পর্যন্ত ড. মুহাম্মাদ ইউনুস সরকার আসার পরে সমাপ্ত হয়।) এর পরের কথাগুলো অনেকেরই জানা। এও জানা যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর তারা রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকা খরচ করে তিনটি সংসদ নির্বাচন করেছে এবং অন্যান্য আরো নির্বাচন করেছে, যেগুলোর সবই ছিল ভুয়া ও সুস্পষ্ট প্রতারণা। তো এই যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন সংস্কার কাজে হাত দিচ্ছেন, তারা কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন যে, পরবর্তীতে ক্ষমতায় যারা আসবে, তারা এসব বহাল রাখবে? অথবা বহাল রাখলেও সেগুলোকে ভুলভাবে ব্যবহার করবে না? যে দল রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্র অচল করে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান পাস করাল, সে দলই তো এটাকে বাতিল করে দিয়ে স্থায়ীভাবে থাকার বন্দোবস্ত করল। এমন আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, পিএসসি, নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনগত স্বাতন্ত্র্য তো বর্তমান সংবিধানেও স্বীকৃত আছে। কিন্তু বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়ে এসব প্রতিষ্ঠান কি তাদের আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পেরেছে বা করেছে? তাহলে কী বোঝা গেল?
বিধিবিধান, আইন যথেষ্ট নয়। এর মানে এ-ও নয় যে, আমরা সংস্কারবিরোধী। বর্তমান সরকার যে সংস্কার পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং ছয়টি সংস্কার কমিটি গঠিত হয়েছে, বর্তমানে এর পরিধি আরো বাড়ানো হচ্ছে- এ সবই ভালো পদক্ষেপ। উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে দিয়ে সংস্কার প্রস্তাব এনে জনগণের মতামত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা হলে রাষ্ট্রের জন্য ভালো হতে পারে। কিন্তু এ সরকারের প্রধান কর্ম কী হওয়া উচিত? প্রথম অগ্রাধিকারে কী থাকা দরকার? নিশ্চয় সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে নিজের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ও গোষ্ঠীগত সম্পদ বানিয়ে ফেলা ফ্যাসিবাদের দোসর ও সহযোগীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা।
দেখা যাচ্ছে, সরকারের খুব কম উপদেষ্টাই এ নিয়ে কথা বলছেন। রাষ্ট্রের ও সরকারের বিভিন্ন জায়গায় ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসর-সহযোগীদের বিচারের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে- সেটিও কিন্তু দৃশ্যমান হচ্ছে না। কেবলমাত্র উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সাহেব এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি বরাবরই এ বিষয়ে সোচ্চার বক্তব্য রাখছেন। তিনি যথার্থই বলে যাচ্ছেন, 'তাহলে কি শেখ হাসিনা একাই দায়ী।' কিন্তু একজন উপদেষ্টার দাবিতে কি আর কাজ হবে? এমনিতে তো যত সময় গড়াবে মানুষের মোহ কেটে যাবে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সরকারের প্রতি জনসমর্থন কমে যাওয়া এবং সাধারণ মানুষের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কাই বাড়তে থাকবে। বর্তমানে দ্রব্যমূল্য যেভাবে দিন দিন আকাশচুম্বী হচ্ছে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও যথাযথ উন্নয়ন হয়নি, তাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখার জন্য বিগত সময়ের জালেমদের এবং তাদের সহযোগীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই। এটা তো জানা কথা যে, রাষ্ট্রের সকল ভালো ও মন্দ কাজের মূল প্রশংসা ও দায় রাষ্ট্রের প্রধান ক্ষমতাধর ব্যক্তির ওপর গিয়েই ঠেকে। কিন্তু তার সকল কাজই মূলত বাস্তবায়ন করে থাকে সহযোগীরা। ফ্যাসিবাদী হাসিনা দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় থেকে জুলুম-নির্যাতন, অভূতপূর্ব দুর্নীতি ও একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে মেরুদণ্ডহীন করে দিয়ে গিয়েছেন এবং রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন, তা তো তিনি করতে পেরেছেন তার মতো অনেকগুলো দুষ্ট ও মন্দ স্বভাবের লোকদের সরাসরি সহায়তা পাওয়াতেই।
উদাহরণস্বরূপ, যদি ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪-এর নির্বাচন কমিশন ভুয়া নির্বাচনে সম্মত না হত, যদি তারা প্রতিবাদ-স্বরূপ ইস্তফা দিয়ে দিত, তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াত? যদি উচ্চ আদালতের কিছু দালাল ধরনের বিচারপতি তাদের নিয়োগদাতা প্রভুর মর্জি মোতাবেক রায় দিয়ে তাদেরকে সহযোগিতা না করত, তাহলে কি হাসিনা এত বড় ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে পারতেন? যদি বেনজীর আহমেদ, আবদুল্লাহ আল-মামুন, বিপ্লব কুমার, বনজ কুমার ও আসাদুজ্জামানের মতো পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তা এবং আজিজ আহমেদের মতো আর্মি অফিসাররা হাসিনার যাবতীয় অপকর্মের সহযোগী না হত, তাহলে কি তিনি সাধারণ মানুষের ওপর এত জুলুম-নির্যাতন করে যেতে পারতেন? যদি এইচটি ইমামের মতো সাবেক ও বর্তমান আমলারা সরকারের যাবতীয় দুর্নীতি ও অপকর্মের নিরঙ্কুশ সমর্থন ও সহযোগিতা না করত, যদি গোয়েন্দা সংস্থার অসৎ ও মতলববাজ ব্যক্তিরা স্বৈরাচারের পক্ষ হয়ে নিরপরাধ লোকদের হেনস্তায় অগ্রণী ভূমিকা পালন না করত, তাহলে কি ফ্যাসিবাদের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম এত বেশি অগ্রসর হতে পারত? আর রাজনৈতিক লোকদের কথা তো সকলেরই জানা। যারা মন্ত্রিত্বের ও এমপিত্বের স্বাদ নিয়েছেন শুধু তারাই তো নয়; জেলা, উপজেলা, নগর এলাকাগুলো এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত যারা বিভিন্ন স্তরে ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছে, তাদের স্বৈরাচারের সহযোগী হওয়ার বিষয়টি তো সকলের কাছে স্পষ্ট।
বর্তমান সরকার যদি এইসকল দোসরদের বিচারের আওতায় না আনে এবং সে বিচার দ্রুত সম্পন্ন করে তাদেরকে কঠোর শাস্তি না দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ বর্তমান থেকেও আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সমাজের খারাপ লোকদের কাছে তখন ভুল বার্তা যাবে। তারা ধরে নেবে, অপরাধ করে এবং অন্যায়ের সহযোগিতা করে পার পেয়ে যাওয়া কোনো বিষয় নয়। কখনো বিপদে পড়লে মূল ক্ষমতাধর ব্যক্তিই পড়বে। আমরা আবার নতুন ক্ষমতাসীনদের সহযোগী হয়ে যাব। এই যে কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল, আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীকে গ্রেফতারের কয়েকদিনের মধ্যেই জামিন দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তো বর্তমান সরকারের কাছে বা তার উকিলদের কাছে কি ফ্যাসিবাদী সরকারের মন্ত্রী হওয়া- পৃথক কোনো অপরাধ নয়? এগুলো কীসের আলামত? একথা সত্য যে, সকল দোসর ও সহযোগীদেরকে একসাথে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা কঠিন হবে। কিন্তু প্রত্যেক সেক্টর থেকে যদি বাছাইকৃত কিছু লোককেও দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা যায়, পুলিশ, র্যাব, বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগ, বিজিবি, সামরিক বিভাগ, সচিবালয়ের কঠোর দলবাজেরা, বিচার বিভাগের প্রকাশ্য দলবাজেরা, দুর্নীতিবাজ, পিএসসি ও বেশরম বিভিন্ন নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা, যাদের অন্যায় পক্ষপাতিত্ব ও সরকারের অপকর্মগুলোতে সহযোগিতার এবং নিজ হাতে বাস্তবায়নের বিষয়গুলো সকলেরই জানা। তাদেরকে যদি কঠোর শাস্তির আওতায় আনা যায়, তবে সেটি নিশ্চয় এ সরকারের একটি যুগান্তকারী কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। হত্যা নির্যাতন, গুম-খুন, সীমাহীন দুর্নীতি এবং স্থায়ীভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার পাঁয়তারা- এ কাজগুলোতে যারাই ফ্যাসিবাদের প্রধান দোসর ও সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রেখেছে, সে যে পদেই থাকুক, যত বড় প্রভাবশালীই হোক অবশ্যই তাকে বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন।
প্রসঙ্গ : উলামায়ে কেরামের ওপর নির্যাতনকারীদের বিচার
এখানে আমরা একথাও জোর দিয়ে বলতে চাই, বিগত পতিত সরকারের যে সকল দোসররা দেশের আলেম সমাজের ওপর অকথ্য জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে, হত্যাযজ্ঞ করেছে এবং বহু আলেমকে মিথ্যা অজুহাতে গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতন করেছে, তাদের গায়ে মিথ্যা তকমা লাগিয়েছে এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে রিমান্ডে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে বছরকে বছর জেলে পুরে রেখেছে (যাদের অনেকেই স্বৈরাচার পতনের পর জামিনে মুক্ত হয়েছেন) সে জালেমদেরও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তথাকথিত কাউন্টার টেরোরিজমের মনিরুলদের বিচার কার্যক্রমও শেষ করতে হবে দ্রুততার সাথে।
এর জন্য যদি বিদ্যমান কোনো আইন সংশোধন করার প্রয়োজন হয়, তাহলে অধ্যাদেশের মাধ্যমে তাও করে নেওয়া দরকার। আমরা তো বলব, একাধিক বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে এ বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া দরকার। তবেই সমাজে একটি ভালো বার্তা যাবে। অপরাধী অন্যায় করে পার পায় না, কোনো না কোনো সময় তাকে শাস্তি পেতেই হয়- এ ধারণা সমাজে বদ্ধমূল করাতে পারলে অপরাধ প্রবণতা কমার সাথে সাথে ভবিষ্যতেও কেউ কোনো স্বৈরাচারের অন্যায় নির্দেশ বাস্তবায়ন করার আগে দুবার ভেবে দেখবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষদের জন্য স্বস্তি ও সুখের একটি উপকরণ হবে। অন্যথায় কাগুজে কিছু আইন-কানুন ও সংস্কার বড় কোনো কাজে দেবে না। দলীয় সরকারগুলো এসে যার যার মতো করে হয়তো সেগুলো সংশোধন করে ফেলবে, না হয় আইনের জায়গায় আইন থাকবে, তারা চলবে তাদের মতো করে। তাই সংস্কার কাজ এবং পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচার ও শাস্তি পাশাপাশি চলুক। ড. মুহাম্মদ ইউনুস সরকারের ব্যক্তিরা নিজেরাই বলছেন, তাদের হাতে বেশি সময় নেই। অতএব তাদেরকে তো কম সময়েই অনেক ভালো কাজ করে যেতে হবে। ইতিমধ্যেই তাদের কিছু সিদ্ধান্ত মানুষের প্রশংসা পেয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে, একজন ব্যক্তি ও একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে অযথা বিভিন্ন জাতীয় দিবসের প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোকে বাতিল করা এবং জাতীয় পার্টিকে (যেটি আসলে রাজনৈতিক ময়দানে ফ্যাসিবাদকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম সহযোগী গোষ্ঠী ছিল) সংলাপে না ডাকা।
প্রসঙ্গ : ছাত্রলীগ নিষিদ্ধকরণ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্প্রতি আরেকটি ভালো সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা। এই ছাত্রলীগ ৭১ পূর্ববর্তী ছাত্রলীগ না। এটা সবাই জানে, বিগত বছরগুলোতে ছাত্রলীগের ভূমিকা কী ছিল। মানুষ জানে, ছাত্রলীগের ট্যাগ ধারণ করে পুলিশসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে গিয়ে তারা কী কী ঘটিয়েছে। কত কী খেতাব পেয়েছে! কসাই বাহিনী, হেলমেট বাহিনীসহ আরো কত জঘন্য শব্দ তাদের নামের সাথে ব্যবহৃত হয়েছে! ছাত্রলীগ শব্দ তো সাধারণ জনগণ তাদের ক্ষেত্রে খুব কমই ব্যবহার করত।
হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণে সেঞ্চুরিসহ কোন্ অপকর্মে তারা শীর্ষে ছিল না? দেশের বড় বড় শিক্ষাকেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ভীতিকর জায়গায় পরিণত করেছিল। তাদের ভয়ে সবাই তটস্থ থাকত। কতজন এমন ছিল, যারা নিজেদের নাম-পরিচয় বাদ দিয়ে ভয়ে 'তাদের' নাম-পরিচয় নিয়ে শিক্ষাজীবন পার করেছে এত বছর।
ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা অবশ্যই এ সরকারের একটা ভালো পদক্ষেপ। তবে শুধু নিষিদ্ধ করলেই হবে না, ছাত্রলীগ নামধারী যারা যেখানে এতদিন অপকর্মগুলোর সাথে জড়িত ছিল, চাই তারা কেন্দ্রে থাকুক বা অন্য কোনো অঞ্চলে, অবশ্যই তাদেরকে গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
স্বৈরাচারের অন্য সহযোগী
প্রসঙ্গক্রমে আরো দু-তিনটি কথা আরজ করতে চাই। একটি হচ্ছে, যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তথাকথিত সেই জাতীয় দিবসগুলো বাতিল করে ভালো একটা নজির সৃষ্টি করেছেন, সে প্রসঙ্গ টেনে আমরা আরো বলতে চাই-
এখনো কিন্তু এ দেশে ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। বিগত সময়ে যারা স্বৈরাচারকে সরাসরি সহযোগিতা দিয়েছে, যারা এদেশের আপামর জনসাধারণের বিশ্বাস ও আবেগের বাইরে অবস্থান নিয়ে বিদেশী সংস্কৃতি ও ভিনদেশী চিন্তাধারা এবং গোলামীর আবহ তৈরির প্রয়াস দীর্ঘদিন যাবৎ চালিয়ে আসছে! তাদের অনেকেই আছে মুখোশধারী। এখনো কিন্তু তারা টিকে আছে। তারা নিজেদের প্রধান ও পত্রিকার মূল দায়িত্বশীলদের পাঠিয়ে, কখনো নিজেরা গিয়ে সরকারপ্রধান ও অন্যান্য দায়িত্বশীলদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। এভাবে তারা এমন একটা ভাব ধরছে, মনে হয় তারা খুব নিরপেক্ষ লোক।
কিন্তু এখনো তাদের কলাম ও রিপোর্ট দেখলে কারোই বুঝতে বাকি থাকবে না, এরা কারা? এখনো এ সরকারের আসলে ভেতরের দুশমন কারা, কারা এ সরকারকে অস্থিতিশীল করতে চায়, কারা এ সরকারের সুফল দেখতে চায় না? তারা কিন্তু এখনো চেতনার গান গেয়ে বেড়ায়। এখনো সাকিবের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে দিনের পর দিন কলাম-ফিচার লিখতে থাকে। যে ব্যক্তি বিশ্বকাপ ছেড়ে লাফিয়ে দেশে এসেছিল, নিজের এমপি পদ পাকা করার জন্য। এসমস্ত মুখোশধারীরা তার গুণগান গেয়ে যাচ্ছে, তার প্রতি মায়া ও দরদ দেখাচ্ছে, তাদের মায়াকান্না- কেন উপদেষ্টা তাকে দেশে আসতে দিলেন না, তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেন জোরদার করা হল না, কতরকম ভাব তারা দেখাচ্ছে!
তাদের মতলবটা বুঝতে হবে। তারা আসলে কী চায়? কী চেয়ে এসেছে তারা এতদিন? বাংলাদেশের পক্ষে, বাংলাদেশের জনগণের চিন্তা-চেতনার সাথে এদের মিল ছিল কি না, নাকি এরা অন্য কিছু করতে চেয়েছে, এ বিষয়গুলো তাদের লেখা ঘাঁটলেই বেরিয়ে আসবে। নিশ্চয়ই অনেকের মনে থাকবে, বিগত স্বৈরাচারের নির্বাচনের পরদিন তাদের পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, যার কলাম এখন আর দেখা যায় না, হয়তো কিছুদিনের জন্য পত্রিকা থেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন। তিনি কীভাবে তখন প্রকাশ্যে লিখে দিয়েছিলেন, 'নির্বাচন হয়নি' 'দুর্নীতি হয়েছে' এমন আরো হাস্যরস করেছেন। কিন্তু শেষদিকে একটা কথা যুক্ত করে দিয়েছিলেন, 'নির্বাচন ঠিকঠাক হয়নি। তবে হলেই বা কী হত? আরেকটা দল আসত। তাদের মাধ্যমে আমাদের কতটুকু সুযোগ-সুবিধা মিলত?'
সেই পাতা খুললে এখনো সবাই দেখতে পাবেন- 'দেশের উন্নয়ন হবে, যে বসে আছে সে যদি আমাদের কাজ করে...' এটা হল তাদের আসল চেহারা। তারা ওপরে দেখায় নিরপেক্ষভাব। ভেতরে গণবিরোধী। তারা জনগণের চিন্তা-চেতনা-বিশ্বাস ইত্যাদির বিরোধিতা করে। তারা এবং আমাদের আধিপত্যবাদী পড়শী রাষ্ট্র কখনোই আমাদের কল্যাণ চায়নি।
তাদের পক্ষে এদেশের জনমত গঠন করার পেছনে এরা কিন্তু যুগ যুগ থেকে ভূমিকা রেখে এসেছে। আমরা একেবারে নাম ধরে বলতে চাই না যে, তারা 'র'-এর এজেন্ট কি না? সেটা তারা নিজেরাই ভালো বলতে পারবে। কাজ কিন্তু সেরকমই করছে।
সুতরাং আমরা আশা করব, সরকার ও সরকারের লোকেরা এসমস্ত লোকের ব্যাপারে সচেতন থাকবেন। এদেরকে নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করবেন, সেটা তারাই চিন্তা করবেন। তারা এদেশের জনগণের পক্ষে কখনো ছিল না, এখনো নেই। যারা তাদের পত্রিকাগুলো নিয়মিত পড়েন, তারাও কিন্তু এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করবেন না।
আমরা বলছিলাম চেতনার কথা। তারা কিন্তু এখনো 'চেতনা', 'চেতনা' নিয়ে আছে। এই স্বাধীনতার চেতনা, তথাকথিত চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- এরকম আরো মিথ্যা চেতনা নিয়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জিজ্ঞেস করলে- তারা কিন্তু আরেকজনকে গলা টিপে ধরা, দেশের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা, দেশের জনগণকে বিভক্ত করা, পক্ষের শক্তি-বিপক্ষের শক্তি নাম দিয়ে বিভক্ত করার কথা নিশ্চয় বলবেন না। বহু সেক্টর কমান্ডার গত হয়েছেন। যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা এখনো বেঁচে আছেন, তাদের লেখা তো আমরা পড়ি। তাদের মধ্যে কেউ তো প্রকাশ্যেই ধার্মিক ছিলেন ও আছেন, আবার কেউ প্রকাশ্যে ধর্মের কথা বলেন না, কিন্তু তাদের লেখায়ও দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভেতরে বানিয়ে বানিয়ে যেসব কথা বলা হয়, তারা সেসব কথা বলেননি; বরং তারা অস্বীকার পর্যন্ত করেছেন। কখনো ওরা বলে, মুক্তিযুদ্ধ সেক্যুলারিজমের জন্য হয়েছিল; কখনো বলে, ধর্ম ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরোধিতা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ছিল- এমন কারণ ইতিপূর্বেই বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারগণ নাকচ করে দিয়েছেন। এই চেতনাধারীরা কখনো বসে থাকেনি এবং এখনো তারা বসে নেই। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে এই মুখোশধারী কিছু মিডিয়া ।
এসব বন্ধ হওয়া দরকার। সামনেও যেন তারা এসব বিক্রি করতে না পারে, এসব নাম দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত না করতে পারে, এ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। ইতিমধ্যে সরকার গণমাধ্যম কমিশন গঠন করেছেন। সেখানে যারা দায়িত্বশীল আছেন, তারাও এসব বিষয় নিয়ে ভাববেন বলে আমরা আশা করি।
প্রসঙ্গ : জাতির জনক
আরেকটি প্রশ্ন 'জাতির জনক' বিষয়ে। যা সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, সরকার তাকে 'জাতির জনক' মনে করে না। আসলে সরকারের মনে করার কিছু নেই। সরকার তো মনে করবেই না; জনগণও মনে করে না।
একথা খুব স্পষ্ট হওয়া দরকার, জনগণ কেন তাকে জাতির জনক মনে করবে? এ জাতির কি আগে জন্ম হয়নি? বাঙালি জাতির ইতিহাস কবে থেকে? তাদের কি ৭১-এ জন্ম হয়েছে? তিনি কীভাবে জনক হলেন? তিনি তো স্রেফ ৭ই মার্চ-এ ভাষণ দিয়েছেন। এরপর ২৫ তারিখ পর্যন্ত তিনি চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, যেন তাকে পুরো পাকিস্তাানের প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়। ৭-ই মার্চের ভাষণের পর ২৫ তারিখ পর্যন্ত কোনোদিন, এমনকি তার বন্দি হওয়ার আগেও কখনো স্বাধীনতা বিষয়ে কিছু বলেননি। এরপর যখন তাকে করাচি নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে বন্দি ছিলেন। যদি তাকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হত এবং তা যদি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কোনো সময়ই দেওয়া হত, তিনি কি বলতেন- না আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হব না; আমার দেশ স্বাধীন হয়ে আলাদা হয়ে যাবে। এমনটা কি কখনো বলতেন? তিনি তো ২৫ তারিখে বন্দি হয়েছেন। এরপর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। পরের বছর ১০ জানুয়ারিতে তিনি দেশে ফিরেছেন। তো ৭১'-এ তার এ ভূমিকার জন্য তিনি কীভাবে জাতির জনক হয়ে গেলেন?
বাংলাদেশের জনগণ কখনোই আসলে তাকে 'জাতির জনক' মনে করেনি। পুরোটা সময় এভাবেই পার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই বিষয়টা বিগত কয়েক বছরে পুনরায় বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের এক-দুইজন উপদেষ্টা কেন, সকলের বক্তব্য ও চিন্তা স্পষ্ট থাকা দরকার। রাষ্ট্রপতির দফতরে এখনো শেখ মুজিবের ছবি দেখা যায়। অবশ্যই তা সেখান থেকে সরানো দরকার। যখন টাকা নতুন করে ছেপে আসবে, সেগুলো থেকে অবশ্যই ব্যক্তি বিশেষের ছবি সরিয়ে ফেলা দরকার। কেন রাষ্ট্র ব্যক্তিপূজা করবে? এ রাষ্ট্রে তো একজনের অবদান নয়, বহু মানুষের অবদান আছে।
এসব বিষয়সহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়, বিভিন্ন নীতি সরকার সংস্কার করতে চায়। আমরা আশা করি, এ সমস্ত বিষয়ে সরকারের নীতি স্পষ্ট থাকবে। শুধু একজন উপদেষ্টা না, পুরো সরকারই এ নীতি পোষণ করবেন। জনগণ কিন্তু সরকারের কাছে এ প্রত্যাশাই করে।
একথা ঠিক যে, এত বছরের জঞ্জালে আবদ্ধ বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি পরিচালনা করা সরকারের জন্য অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ। বিশেষত যখন জনগণের প্রত্যাশা তাদের ওপর অনেক বেশি। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, তাদেরকে কোনোক্রমেই ব্যর্থ হওয়া চলবে না। অবশ্যই কিছু ভালো নজির রেখে যেতে হবে। বিভিন্ন স্তরের সংস্কারের পাশাপাশি সেই ভালো কাজের অগ্রাধিকারে থাকুক ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের জঘন্য মন্দ লোকদের কঠোর শাস্তি সুনিশ্চিত করা।
মহান রাব্বুল আলামীন এই দেশ ও জাতির প্রতি সদয় হোন। আমাদের রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের সুপথে পরিচালনা করুন। যথাযথ অগ্রাধিকার নির্ণয় এবং সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার তাওফীক দান করুন।