স্বৈরতন্ত্রের পতন জাতিকে যে বার্তা দিল
৫ই আগস্ট ২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাসে সংযোজিত হয় এক নতুন অধ্যায়। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান এবং তাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে এদিন পতন ঘটে সুদীর্ঘ স্বৈরশাসনের। থেমে যায় অত্যাচার ও দুর্নীতির সুদীর্ঘ ধারা। কবর রচিত হয় জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা একটি অবৈধ সরকারের। পালাতে বাধ্য হন সে সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেন। আসে বাংলাদেশের নতুন বিজয় ও স্বাধীনতা। যারা ক্ষমতার জোরে দেশকে তাদের অত্যাচার ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন, তাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। অনেকে গ্রেপ্তার হন। নিষ্ঠুর নেত্রী ব্যাপক গণহত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার ফন্দি আঁটলেও মহান আল্লাহর ফয়সালার সামনে তার সকল অপকৌশল ও অশুভ পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ে। বিপদের দিনে তিনি যাদের সাহায্যের আশা করেছিলেন, ব্যাপক গণহত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কাজে যাদেরকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, তারা ‘ছাত্র-জনতার এই মহাজাগরণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ বলে সাফ জানিয়ে দেন। এভাবে তারা নেত্রীর ক্ষমতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেন। জুলুমের ধারাকে তারা আর দীর্ঘায়িত হতে দিতে সম্মত হননি।
ইতিহাস বলে, জুলুম করে সাময়িকভাবে পার পাওয়া গেলেও মহান আল্লাহর কঠিন পাকড়াও থেকে বাঁচা সম্ভব হয় না। তিনি জালেমকে দুনিয়া ও আখেরাতে পাকড়াও করেন। এটাই কুরআনের সত্য। ইতিহাসের সত্য। তবে তিনি জালেম শক্তিকে কিছুকাল অবকাশ দেন। তারপর তাঁর নির্ধারিত সময়ে তিনি মজলুমদের সাহায্য করেন এবং জালেম শক্তিকে এমনভাবে পাকড়াও করেন, যা তারা কল্পনাও করতে পারে না। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সুদীর্ঘ স্বৈরশাসনের হোতাদের করুণ পরিণতিও সমগ্র মানব জাতিকে নতুন করে এ বার্তাই দিচ্ছে যে, জুলুম ও সীমালঙ্ঘন করে কেউ রেহাই পাবে না। পতিত স্বৈর-শাসকগোষ্ঠী যে দেশকে নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তি বলে ধরে নিয়েছিল, প্রাণে বাঁচতে সে দেশ ছেড়ে যেতে হবেÑ তা কি তারা কেউ কোনোদিন ভেবেছিল? অতীতেও সীমালঙ্ঘনকারীদের পরিণতি এমনই হয়েছিল। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইহুদীদের বনু নাযীর গোত্র সম্পর্কে বলেনÑ
مَا ظَنَنْتُمْ اَنْ یَّخْرُجُوْا وَ ظَنُّوْۤا اَنَّهُمْ مَّانِعَتُهُمْ حُصُوْنُهُمْ مِّنَ اللهِ فَاَتٰىهُمُ اللهُ مِنْ حَیْثُ لَمْ یَحْتَسِبُوْا وَ قَذَفَ فِیْ قُلُوْبِهِمُ الرُّعْبَ .
তোমরা কল্পনাও করনি যে, তারা বের হয়ে যাবে। এবং তারা মনে করেছিল, তাদের দুর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহ থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু আল্লাহর শাস্তি এমন এক দিক থেকে আসল, যা ছিল তাদের ধারণাতীত। এবং আল্লাহ তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন। Ñসূরা হাশর (৫৯) : ০২
পবিত্র কুরআনের এ মহাবাণীর আরেকটি নিদর্শনই যেন এবার বাংলাদেশে দেখা গেল। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলার দরবারে মুক্তিকামী অগণিত মানুষের সকাতর আহাজারি ছিল দেশময়। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে সমবেত লাখ লাখ ঈমানদার মানুষের ওপর পরিচালিত বর্বর হামলা ও গণহত্যাসহ অসংখ্য জুলুমের বিচার বা প্রতিকারের কোনো পথ ছিল না। গুম খুন গ্রেপ্তার আতঙ্কে দেশের মানুষ ছিল অসহায়। কোনো দল বা গোষ্ঠী ঐ নিষ্ঠুর শক্তিকে পরাস্ত করার কোনো উপায় খুঁজে পায়নি। বারবার প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিজেদের জন্য ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা হচ্ছিল। অবশেষে মহান আল্লাহ তাঁর কুদরতে এমন এক উপায় বের করলেন, যা কারোর কল্পনায়ও ছিল না। তিনি দেশের নিরস্ত্র ছাত্রসমাজকে হিম্মত দান করলেন। প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে জালেমের অস্ত্র ও গুলির মুখে বুক পেতে দেওয়ার সাহস দিলেন। আর অল্প দিনের মধ্যে এক অসাধারণ ইতিহাস রচিত হয়ে গেল। কেউ কি কল্পনা করতে পেরেছিল, এমনটি ঘটবে? ক্ষমতাগর্বী নেতৃবর্গ কি কল্পনা করতে পেরেছিলেন, এত দ্রুত এত বড় একটা বিপ্লব ঘটে যাবে? তাদের কৃতকর্মের এই করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে? নিজ দলের ক্ষমতা রক্ষায় বেপরোয়া সশস্ত্র ঘাতকরা কি অনুমান করতে পেরেছিল, এত দ্রুত তাদের দিন ফুরিয়ে যাবে? কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর নির্ধারিত সময়ে জাতির পরিত্রাণের পথ করে দিয়েছেন। তিনি সব দেখেছেন এবং নির্ধারিত সময়ে তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি মোটেও উদাসীন ছিলেন না। পবিত্র কুরআনে তিনি ইরশাদ করেনÑ
وَ لَا تَحْسَبَنَّ اللهَ غَافِلًا عَمَّا یَعْمَلُ الظّٰلِمُوْنَ.
তুমি কখনো মনে করো না যে, জালেমরা যা করে, সে বিষয়ে আল্লাহ গাফেল। Ñসূরা ইবরাহীম (১৪) : ৪২
দুই.
ক্ষমতাগর্বী সেই স্বৈরশাসকরা আজ কোথায়? তাদের সাজানো সুখের বাগান থেকে তারা আজ কত দূরে! রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করে গড়া প্রাসাদ-অট্টালিকা ও গাড়ি-বাড়ি আজ বিবর্ণ পড়ে আছে। সম্পদের পাহাড় গড়েও তারা আজ অসহায়। কীভাবে দিনগুজরান করছেন এখন তারা? মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে অতীতের জালেমদের পরিণতির কথা কত সুন্দর করে বলে দিয়েছেনÑ
كَمْ تَرَكُوْا مِنْ جَنّٰتٍ وَّ عُیُوْنٍ، وَّ زُرُوْعٍ وَّ مَقَامٍ كَرِیْمٍ، وَّ نَعْمَةٍ كَانُوْا فِیْهَا فٰكِهِیْنَ، كَذٰلِكَ وَ اَوْرَثْنٰهَا قَوْمًا اٰخَرِیْنَ.
তারা ছেড়ে গেছে কত উদ্যান ও প্রস্রবণ; কত শস্যখেত ও সুরম্য প্রাসাদ! কত বিলাস-উপকরণ, যা নিয়ে তারা আনন্দিত হত। এরূপই ঘটেছিল, এবং আমি এই সমুদয়ের উত্তরাধিকারী করেছিলাম ভিন্ন সম্প্রদায়কে। Ñসূরা দুখান (৪৪) : ২৫-২৮
অনাচারীদের পরিণতি প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ আরো ইরশাদ করেনÑ
فَكَاَیِّنْ مِّنْ قَرْیَةٍ اَهْلَكْنٰهَا وَ هِیَ ظَالِمَةٌ فَهِیَ خَاوِیَةٌ عَلٰی عُرُوْشِهَا وَ بِئْرٍ مُّعَطَّلَةٍ وَّ قَصْرٍ مَّشِیْدٍ، اَفَلَمْ یَسِیْرُوْا فِی الْاَرْضِ فَتَكُوْنَ لَهُمْ قُلُوْبٌ یَّعْقِلُوْنَ بِهَاۤ اَوْ اٰذَانٌ یَّسْمَعُوْنَ بِهَا فَاِنَّهَا لَا تَعْمَی الْاَبْصَارُ وَ لٰكِنْ تَعْمَی الْقُلُوْبُ الَّتِیْ فِی الصُّدُوْرِ.
আমি ধ্বংস করেছি কত জনপদ, যেগুলোর বাসিন্দা ছিল জালেম, এসব জনপদ তাদের ঘরের ছাদসহ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল এবং কত কূপ পরিত্যক্ত হয়েছিল এবং কত সুউচ্চ প্রাসাদও। তারা কি দেশভ্রমণ করেনি? তাহলে তারা জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তি সম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারত। বস্তুত চক্ষু তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়। Ñসূরা হজ¦ (২২) : ৪৫-৪৬
ইতিহাস প্রমাণ করে, পৃথিবীতে কোনো মানবগোষ্ঠী যখন সীমালঙ্ঘন করে তখন মহান আল্লাহর গযব ও শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করে।
পৃথিবীতে অনেক শক্তিশালী জাতি সীমালঙ্ঘনের কারণে ধ্বংস হয়েছে। মহান আল্লাহ আদ ও ছামুদ জাতিকে ধ্বংস করেছেন। শাদ্দাদ, নমরূদ, ফেরাউন ও আবরাহার মতো প্রবল প্রতাপী জালেমদের তিনি ধ্বংস করেছেন। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় হল, ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি না। অথচ মহান আল্লাহ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য পবিত্র কুরআনে বারবার তাকীদ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনÑ
فَاعْتَبِرُوْا یٰۤاُولِی الْاَبْصَارِ.
সুতরাং হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিরা! তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো। Ñসূরা হাশর (৫৯) : ২
তবে সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে মহান আল্লাহ একটা সময় পর্যন্ত অবকাশ দেন। তাদের অনাচার যখন চূড়ান্তে পৌঁছে তখন তিনি তাদেরকে পাকড়াও করেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ আদ, ছামুদ ও এ ধরনের জাতিসমূহের ধ্বংসের দিকে ইঙ্গিত করে ইরশাদ করেনÑ
وَ تِلْكَ الْقُرٰۤی اَهْلَكْنٰهُمْ لَمَّا ظَلَمُوْا وَ جَعَلْنَا لِمَهْلِكِهِمْ مَّوْعِدًا.
এবং আমি সেসব জনপদবাসীদের ধ্বংস করেছি যখন তারা অনাচার করল এবং আমি তাদের জন্য স্থির করেছিলাম এক নির্দিষ্ট ক্ষণ। Ñসূরা কাহ্ফ (১৮) : ৫৯
তিন.
ক্ষমতার দম্ভে যারা যাচ্ছেতাই করতেন, তারা আজ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত। আবর্জনার মতোই জাতি তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলেছে। জুলুমবাজ নেতা-নেত্রী ও তাদের সহযোগীরা অনেকেই আজ পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন। অনেকে আজ পালানোর পথও খুঁজে পাননি। অনেকে পালাতে গিয়ে লজ্জাজনকভাবে ধরা পড়েছেন। কেউ কারাগারে বা কেউ রিমান্ডে আছেন। এককথা তারা আজ তাদের কৃতকর্মের করুণ পরিণতি ভোগ করছেন। জুলুম দুর্নীতি ও স্বৈরশাসনের হোতাদের পতন ও করুণ পরিণতি জাতিকে এ বার্তাই দিচ্ছে যে, এসকল অপরাধ করে কেউ রক্ষা পাবে না, তাই রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্বশীল থেকে নিয়ে সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীল প্রতিটি ব্যক্তিকে জুলুম ও দুর্নীতি থেকে বেঁচে থাকতে হবে। নিষ্ঠা ও ন্যায়নীতির সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে। নয়তো আখেরাতের কঠিন শাস্তি তো অবধারিত আছেই; দুনিয়াতেও এ ধরনের ভয়ঙ্কর অপমানজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। স্বৈরতন্ত্রের পতন এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে সকল পর্যায়ের পদস্থ ও দায়িত্বশীলদেরই শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে এবং নেওয়া উচিত। সামাজিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিবর্গেরও এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। জুলুম, স্বেচ্ছাচারিতা, একনায়কসুলভ আচরণ, আত্মস্বার্থচর্চা, আমানতের খেয়ানত, দায়িত্ব পালনে অবহেলা, অন্যের হক ও মর্যাদার ক্ষতি সাধন, নিজের সুযোগ সুবিধা পূর্ণমাত্রায় ও অবিলম্বে আদায় করে নেওয়া এবং অন্যের হক প্রদানে কার্পণ্য, গড়িমসি ও টালবাহানা ইত্যাদি অপরাধ সমাজ জীবনকে কলুষিত করে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। এসব অপরাধ করেও একটা সময় পর্যন্ত পদে ও ক্ষমতায় সদর্পে টিকে থাকা সম্ভব হলেও একপর্যায়ে কুদরতি ফয়সালা অনুসারে পতন ঘটে এবং পাপ ও অপরাধের কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হয়। যদিও পদ ও ক্ষমতায় থাকাকালে সে বিষয়টি কারো মাথায় আসে না। ইতিহাসে এর ছোট-বড় হাজারো দৃষ্টান্ত রয়েছে। সকল পর্যায়ে একথাও আমাদের মনে রাখতে পারলে ভালো হবে যে, সমাজবদ্ধ জীবনে কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি নিজের স্বার্থ ও সুবিধাকেই গুরুত্ব দেন এবং অন্যের স্বার্থ ও সম্মানকে অবজ্ঞা করেন, অথবা ব্যক্তিস্বার্থে নীতিহীনতার আশ্রয় নেন, তাহলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে একসময় লাঞ্ছিত হতে হয়। যদিও তিনি সমাজের কোনো নামিদামি ও সম্মানিত ব্যক্তি হন।
প্রকৃতপক্ষে জুলুম করা মানে নিজের পায়ে নিজে কুঠারাঘাত হানা, যা চরম নির্বুদ্ধিতার কাজ।
চার.
দায়িত্ব একটি আমানত এবং এটি একটি ব্যাপকার্থক শব্দ। এর অসংখ্য ক্ষেত্র রয়েছে। আমরা সকলেই কোনো না কোনো পর্যায়ে দায়িত্বশীল। প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে। এ প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ
كُلُّكُمْ رَاعٍ فَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهٖ، فَالأَمِيرُ الَّذِي عَلى النَّاسِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُمْ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلى أَهْلِ بَيْتِه وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُمْ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلى بَيْتِ بَعْلِهَا وَوَلَدِهٖ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ، وَالْعَبْدُ رَاعٍ عَلى مَالِ سَيِّدِه وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ، أَلاَ فَكُلُّكمْ رَاعٍ وَكُلُّكمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهٖ.
তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমরা তোমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। জনগণের আমীর তাদের বিষয়ে দায়িত্বশীল, তাকে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। পরিবারের কর্তাব্যক্তি তার পরিবারের দায়িত্বশীল, তাকে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘরের পোষ্যদের বিষয়ে দায়িত্বশীল, তাকে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। গোলাম তার মনিবের সম্পদের রক্ষক, তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।
ওহে! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমরা তোমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ২৫৫৪
আনাস রা. বলেনÑ
قَلَّمَا خَطَبَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَّا قَالَ: لَا إِيمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهٗ، وَلَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهٗ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন ভাষণ খুব কমই দিয়েছেন, যাতে তিনি একথা বলেননিÑ ‘যার আমানতদারি নেই, তার ঈমান নেই এবং যার প্রতিশ্রুতি ঠিক নেই, তার দ্বীন নেই।’ Ñমুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৫৬৭
সমাজ জীবনে সততা, আমানতদারি এবং নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের গুরুত্ব কতখানি তা বোঝার জন্য এ দুটি হাদীসই যথেষ্ট।
পাঁচ.
অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করা এমন একটি মহাপাপ, যা মহান আল্লাহর অভিশাপ বয়ে আনে। এ প্রসঙ্গে আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনÑ
سِتَّةٌ لَعَنْتُهُمْ وَلَعَنَهُمُ اللهُ، وَكُلُّ نَبِيٍّ مُجَابٌ: الزَّائِدُ فِي كِتَابِ اللهِ، وَالْمُكَذِّبُ بِقَدَرِ اللهِ، وَالْمُسَلِّطُ بِالْجَبَرُوتِ ليُذِلّ بِذلكَ مَنْ عَزَّ اللهُ، وَلِيُعِزَّ بِه مَنْ أَذَلَّ اللهُ، وَالْمُسْتَحِلُّ لِحَرَمِ اللهِ، وَالْمُسْتَحِلُّ مِنْ عِتْرَتِي مَا حَرَّمَ الله، والتارك لسنتى.
ছয় ব্যক্তির প্রতি আমি লানত [অভিসম্পাত] করি এবং আল্লাহ্ও তাদের প্রতি লানত করেন। আর প্রত্যেক নবীর দুআই কবুল করা হয়ে থাকে :
১. যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবে কিছু যোগ করে।
২. যে আল্লাহর তাকদীর ও নির্ধারিত ভাগ্যলিপি অবিশ্বাস করে।
৩. যে ব্যক্তি জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে। অতঃপর আল্লাহর দৃষ্টিতে যে অপদস্থ, লাঞ্ছিত তাকে সে করে সম্মানিত। আর যে সম্মানের যোগ্য তাকে করে অপদস্থ।
৪. যে ব্যক্তি আল্লাহর হরমে যা নিষিদ্ধ, তা হালাল মনে করে।
৫. আমার বংশধরদের ব্যাপারে আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তা যে ব্যক্তি হালাল মনে করে।
৬. যে আমার সুন্নাহ প্রত্যাখ্যান করে। Ñসহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৭৪৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৫৪; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ১০২; শরহু মুশকিলিল আছার, তহাবী, হাদীস ৩৪৬০
প্রায় এক যুগ ধরে আমরা লক্ষ করেছি, পতিত স্বৈরাচার বারবার জোরপূর্বক দেশের ক্ষমতা দখল করেছে এবং মহান আল্লাহর সম্মানিত নায়েবে রাসূলগণকে ও এদেশের ঈমানদার জনতাকে নানাভাবে নাজেহাল করেছে। হককথা বলার কারণে দীর্ঘকাল কারারুদ্ধ রেখেছে অনেক আলেম ও প্রতিবাদী মানুষকে। আর আল্লাহর শত্রুদেরকে দেশে আমন্ত্রণ করে এনে তাদেরকে সম্মানিত করেছে। এভাবে তারা নিজেদের জন্য মহান আল্লাহর অভিশাপ বয়ে এনেছিল। অবশেষে মহান আল্লাহর কুদরতি চড় তাদেরকে লাঞ্ছনা ও পরাজয়ের অন্ধকার কূপে নিক্ষেপ করেছে।
মহান আল্লাহ আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকদেরকে এবং সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলগণকে স্বৈরশাসকদের করুণ পরিণতি থেকে যথাযথ শিক্ষাগ্রহণ করার তাওফীক দান করুনÑ আমীন।