বিশেষ সম্পাদকীয়
সংস্কার ॥
রাষ্ট্রসংস্কারের কাজ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত থেকেই শুরু হোক
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে দেড় মাসের মতো হল। ভেঙে পড়া আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ বিভিন্ন জরুরি কাজে এ সরকার মোটামুটি সফলতা দেখিয়েছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের কোনো কোনো কাজে মানুষ অখুশিও হয়েছে। তবে দেড়-দুই মাস কোনো সরকারকে মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট সময় নয়। দেশের মানুষ এ সরকারকে যেকোনো মূল্যে সফল দেখতে চায়।
ইতিমধ্যে গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ প্রদান করেছেন। তাতে তিনি বর্তমান সরকারের এক মাসের কারগুজারী তুলে ধরেছেন এবং রাষ্ট্রমেরামত ও সংস্কার বিষহেয় তাঁর সরকারের দৃঢ় সংকল্পের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা এ-ও জানিয়েছেন, ছয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে প্রধান করে ছয়টি সংস্কার কমিটি গঠন করেছেন তিনি। তাঁদের প্রস্তাবনা ও সুপারিশ অনুযায়ী সামগ্রিক সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়া হবে।
রাষ্ট্র মেরামত ও সংস্কার নিয়ে যারা কাজ করবেন, আমরা একটি মৌলিক বিষয়ের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আর সেটি আমরা করতে চাচ্ছি মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেলাদাত দিবস উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া একটি বাণীর সূত্র ধরে।
১২ রবিউল আউয়াল এলেই প্রতি বছর রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা বড় বড় বাণী প্রদান করে থাকেন। সেখানে সীরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয় এবং প্রিয় নবীর আদর্শ অনুসরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে। পরিতাপের বিষয় হল, যারা এমন বাণী দিয়ে থাকেন, কার্যক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনে এর ছিটেফোঁটা নমুনাও দেখা যায় না। কিন্তু আমরা বর্তমান সরকারের প্রধান ব্যক্তির বাণীকে সেভাবে নিতে চাই না। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, তিনি বুঝেশুনে এবং বিশ্বাস করেই এ বাণী দিয়েছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার বাণীতে বলেছেনÑ ‘মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে; প্রতিটি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি বিশ্ব মানবতার জন্য অনিন্দ্য সুন্দর অনুসরণীয় শিক্ষা ও আদর্শ রেখে গেছেন; যা প্রতিটি যুগ ও শতাব্দীর মানুষের জন্য মুক্তির দিশারি হিসেবে পথ দেখাবে।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে বিশ্বজগতের হেদায়েত ও নাজাতের জন্য ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ তথা সারা জাহানের রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। নবী করিম (সা.) সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেনÑ
‘হে নবী, আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য কেবল রহমতরূপে প্রেরণ করেছি’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)।
মুহাম্মদ (সা.) এসেছিলেন তওহিদের মহান বাণী নিয়ে। সব ধরনের কুসংস্কার, অন্যায়, অবিচার, পাপাচার ও দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে মানবসত্তার চিরমুক্তি, শান্তি, প্রগতি ও সামগ্রিক কল্যাণের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। বিশ্ববাসীকে তিনি মুক্তি ও শান্তির পথে আসার আহ্বান জানিয়ে অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়েছিলেন এবং সত্যের আলো জ্বালিয়েছেন।
আজকের দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় বিশ্বে মহানবীর (সা.) অনুপম জীবনাদর্শ, তাঁর সর্বজনীন শিক্ষা ও সুন্নাহর অনুসরণ এবং (আল্লাহর) ইবাদতের মাধ্যমেই বিশ্বের শান্তি, ন্যায় এবং কল্যাণ নিশ্চিত হতে পারে বলে আমি মনে করি।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ধর্মীয় ও পার্থিব জীবনে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর সুমহান আদর্শ ও সুন্নাহ বিশ্ববাসীর জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ, উৎকৃষ্টতম অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় এবং এর মধ্যেই মুসলমানদের অফুরন্ত কল্যাণ, সফলতা ও শান্তি নিহিত রয়েছে।’
[দৈনিক ইত্তেফাক (অনলাইন সংস্করণ), ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪]
প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ের এ কথাগুলোর সূত্র ধরেই আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংস্কার ও মেরামতের কাজটি এখান থেকেই শুরু করা হোক। গণমানুষের অধিকার, শিক্ষা-দীক্ষার সর্বোচ্চ গুরুত্ব, নারীমুক্তি ও শিশুঅধিকার, বিচারে স্বচ্ছতা ও ন্যায়পরায়ণতা, সুষ্ঠু বিচারকার্য সম্পাদনে বিচারকের পূর্ণ স্বাধীনতার কথাগুলো বলুন অথবা ধনী-দরিদ্রের সীমাহীন বৈষম্যের অবসান, সকল মানুষের অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থানের সমাধান, ধর্ম-বর্ণ, অঞ্চল ও ভাষা নির্বিশেষে সকল মানুষের জান-মাল, ইজ্জতের হেফাজতের গুরুত্ব বলুনÑ এসবের কী নেই মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাত ও তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শে।
আমাদের রাষ্ট্র গঠনে সেই যুগান্তকারী শিক্ষা ও আদর্শগুলোর যতটুকুই আমরা গ্রহণ করব, নিঃসন্দেহে তা আমাদেরকে সফলতার পথে এগিয়ে নেবে।
আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুনÑ আমীন।
মূর্তি ও পূজা ॥
যত ইচ্ছা মূর্তি বানানোর উৎসাহ প্রদান এবং মাদরাসা ছাত্রদের পূজায় স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ : কী হচ্ছে এসব?
হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের পরিস্থিতি ছিল বেশ অস্থিতিশীল। সারা দেশের থানা ও পুলিশ প্রশাসন ছিল নিষ্ক্রিয়। স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন মহল কর্তৃক দেশে অরাজকতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির সমূহ আশঙ্কা ছিল। কিছু কিছু জায়গায় তারা এসব করেছেও। তখন দেশের কোনো কোনো স্থানে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উপাসনালয় বিশেষত হিন্দুদের মন্দির মুসলমানরা পাহারা দিয়েছে। যেন কেউ কোনো অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে। পাহারাদাতাদের মধ্যে কিছু মাদরাসা ছাত্রের কথাও গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ পেয়েছে।
সেটি ছিল একটি ক্রান্তিকালীন সময়। ভেতরের বিতর্কে না গিয়েও এ বিষয়টিকে তখন কেউ দোষ হিসেবে ধরেননি; বরং দেশ-বিদেশে এটা প্রশংসিত হয়েছে। বিশেষত যখন পাশর্^বর্তী হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুরা প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত-নিপীড়িত হচ্ছে, মুসলমানদের মসজিদগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। অথচ এ দেশে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে। এদেশের মানুষ যে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেÑ আবারো তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এর মাধ্যমে।
কিন্তু সেই যে শুরুÑ বিষয়টি যেন আর থামছে না। এখন তো বরং কোনো কোনো ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন সংস্থার নেতারা হিন্দুদের রক্ষাপূর্বক তাদের মূর্তি বানানোর জন্য উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। পত্রিকার খবরগুলোতে যা এসেছে, তা তো বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয় না। এটাও নাকি বলা হচ্ছে, আপনারা যত ইচ্ছা মূর্তি বানান, আমরা পাহারা দেব! ভাবটা এমন, যেন মূর্তি বানানো মুস্তাহাব-নফল বা অতীব উত্তম কোনো কাজ।
অথচ এ ধরনের নেতারাই একসময় মূর্তির বিরোধিতা করে জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। ওই মূর্তিগুলোকে তো সেগুলোর নির্মাতারা ভাস্কর্য বলত। তারা এ অজুহাতও দিত যে, ‘এগুলো তো আমরা উপাসনা বা ইবাদতের জন্য বানাই না; তাদের সম্মান প্রদর্শনের জন্য বানাই।’ সেগুলো ছিল তাদের নেতাদের মূর্তি। যদিও ইসলামে সব মূর্তিই মূর্তি এবং সব মূর্তিই হারাম। কিন্তু শুধু পূজা-উপাসনার জন্য যে মূর্তি তৈরি করা হয়, আজ তা বানানোর জন্যও উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে! এ যেন শিরকের একেবারে নির্জলা পক্ষপাতিত্ব। অথচ শিরক সবচেয়ে বড় পাপ, যাকে কুরআন কারীমে সবচেয়ে বড় জুলুম বলা হয়েছে।
সকল প্রকার ভেজালের গোড়া হল শিরক; সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার সাথে অন্য কাউকে শরীক করা, অন্য কারো উপাসনা করা, ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক করা। আর সেই শিরকের হাতিয়ারÑ মূর্তি বানানোর উৎসাহ দিচ্ছেন এক শ্রেণির আলেম!
হয়তোবা তারা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এসব বলছেন। কিন্তু কৌশলগতভাবেও এ ধরনের কথা বলার কি শরীয়তে সুযোগ আছে?
এটা কি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? ভাবতেও তো কেমন লাগে! কিন্তু এটাকে এখন ফ্যাশন বানানো হচ্ছে। গণমাধ্যমও হয়তো বেশ খুশির সাথেই এর প্রচারণা দিচ্ছে। যত বেশি প্রচারণা দিচ্ছে, তারা মনে করছে, এর মাধ্যমে তাদের র্যাঙ্ক বাড়ছে! হয়তো কেউ কেউ ওই নেতাদের বোঝাচ্ছে যে, এর দ্বারা আপনাদেরও র্যাঙ্ক বাড়বে। এজন্য তারা আরো স্পষ্ট ভাষায় আরো কাঁচা শব্দে এগুলো বলছে।
এই দুষ্টুচক্র থেকে অবশ্যই বের হয়ে আসা উচিত। যারা এমনটি করছেন এবং বলছেন, তাদেরকে যেন বোঝানো হয়Ñ এটা কিন্তু আগুনের সাথে খেলা হচ্ছে! তারা বলছে মাদরাসার ছাত্র দিয়ে মন্দির পাহারা দেওয়ার কথা। এমনকি নিজেরাও পাহারা দেবে বলছে! অথচ রাতদিন মাদরাসাগুলোতে শিরকের বিরুদ্ধে পড়াশোনা হচ্ছে! মানুষকে ওয়াজ করা হচ্ছে! এমনকি যে মূর্তির পূজা করা হয় না, সে মূর্তির বিরুদ্ধেও জান বাজি রাখা হয়েছে! এর বিরোধিতা করে জেল-জুলুম পর্যন্ত খাটা হয়েছে। অথচ এখন শিরকের মূর্তি, পূজার মূর্তিÑ এসব ক্ষেত্রে এসে বলা হচ্ছে, যার ইচ্ছা, যত ইচ্ছা মূর্তি বানান!
আরেকটা বিষয় দেখা যাচ্ছে, সরকারের একজন উপদেষ্টা, তিনি যেখানে যাচ্ছেন, অনেক জায়গায় নাকি এসব কথাবার্তা বলছেন! বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবরগুলো আসছে। তিনি প্রথম দিকে তো মন্দির পাহারা দেওয়ার বিষয়ে বলেছেন, মুসলমানরা মন্দির পাহারা দিয়েছে, পাহারা দেবে। এখন আবার দৈনিক কালবেলার এক খবরে দেখা গেল, তিনি বলেন, “মাদ্রাসার ছাত্ররা বলেছেন পূজা কমিটি যদি চায় তারা স্বেছাসেবক হিসেবে কাজ করতে সম্মত আছেন।” ঐ সভায় আরো বিভিন্ন কথা বলেছেন। আগের সরকার পূজায় কী কী সুবিধা দিত, কত অনুদান দিত, মন্দিরগুলোতে তাঁরা আগের চেয়ে অনুদান কী পরিমাণ বৃদ্ধি করছেনÑ এসব কথা। তো তিনি সে সব দিতে থাকুন, এটা তার নিজস্ব ব্যাপার।
কিন্তু এই উপদেষ্টা মহোদয়কে মাদরাসার ছাত্রদের পূজার স্বেচ্ছসেবক বানাবার দায়িত্ব দিল কে? তাকে কি দেশের মাদরাসাগুলোর দায়িত্বশীলগণ একথা বলে এসেছেন? যারা নিজেদের সন্তানকে মাদরাসায় পড়তে দিয়েছেন, তারা কি তাকে এ অনুমতি দিয়েছেন? তারা তো এক আল্লাহ্য় বিশ্বাস করেন বলেই তাদের সন্তানদের মাদরাসায় দিয়েছেন। তারা শিরকের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং শিরক বিশ্বাস করেন না বিধায়ই মুসলমান হয়েছেন; তারা নিজেদের সন্তানকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য মাদরাসায় দিয়েছেন। যে মাদরাসায় রাতদিন এই মূর্তিপূজা ও শিরকের ক্ষতিগুলো পড়ানো হয়, সে মাদরাসার ছাত্ররা নাকি এখন ঐ মহা শিরক অনুষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবক হবে!
নিজ পদের কৌশল হিসেবে হয়তো তিনি এসব বলছেন। এভাবে কি নিজেদের নীতি-আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে না। তাঁর কি মনে পড়ে না আগের কালের মুরব্বি আলেমরা পূজা দেখতে যাওয়া মুসলিমদের ঈমান ও বিবাহ পর্যন্ত (সতর্কতামূলক) নবায়ন করে দিতেন।
যাহোক, তাঁদের কিছু কিছু জিনিস তো মানুষ সহনীয়ভাবে নিচ্ছে; কিন্তু মন্দির পাহারা ও পূজার স্বেচ্ছাসেবক হওয়া! এ যেন বিগত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর কথাÑ ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’Ñ তারই প্রতিধ্বনি! এসব বক্তব্যের অর্থ জাতি বুঝতে পারছে না।
দেশের দ্বীনদার শ্রেণি, আলেম-উলামা খুব অবাক হয়ে এসব কথা শুনছেন। এ ধরনের খবর পড়ছেন। এগুলো দেখে তাদের দুঃখ-কষ্ট শুধু বাড়ছেই! আমাদের মনে হয়, যারা এখনো ‘মন্দির মন্দির’ করছেন, মূর্তি মূর্তি জিগির তুলছেন, তাদের এগুলো বাদ দিয়ে নিজেদের জরুরি কাজগুলো করা উচিত।
সংখ্যালঘুরা আপনাদের দায়িত্ব দেয়নি। তাদের ঠ্যাকা পড়েনি যে, মাদরাসাওয়ালাদের ডেকে বলবে, আপনারা আমাদের মন্দির পাহারা দিন, আমাদের পূজার স্বেচ্ছাসেবক হোন। যুগ যুগ ধরে এ দেশে মন্দির চলছে, পূজা হয়েছে, কোথাও কখনো মাদরাসাওয়ালাদের কোনো পূজায় কাজ করতে হয়নি। যুগ যুগ ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মূর্তি বানিয়ে আসছে। কোনো আলেমের বলতে হয়নি, আপনারা যত ইচ্ছা মূর্তি বানান!
এখানে আরেকটি কথা স্পষ্ট হওয়া দরকার। তা হচ্ছে, ইসলামে সংখ্যালঘুর অধিকার। দ্বীনী বিষয়ে পড়াশোনা আছে এমন সকলেই অবগত যে, ইসলাম ভিনধর্মী সংখ্যালঘুদের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তাসহ যাবতীয় মানবিক অধিকার প্রদান করেছে। এমনকি নিজেদের গণ্ডিতে থেকে ধর্ম-কর্ম পালনেরও অনুমতি দিয়েছে। অন্যদের মতো তাদের ঘরবাড়ির নিরাপত্তা যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তেমনি তাদের উপাসনালয়গুলো নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়লে তার বিহিত করাও সরকারের কর্তব্য। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে সরকার তা সম্পাদন করবে। সাধারণ মুসলিম জনগণ অথবা আলেম-উলামা ও দ্বীনদার শ্রেণি সে কাজ করবেÑ এমন কথা না ইসলামে আছে, না রাষ্ট্রীয় নিয়মে আছে। সুতরাং দুটি বিষয়কে গুলিয়ে ফেলা খুবই দুঃখজনক ও ...।
ষড়যন্ত্র ॥
‘মেয়েরা রাত দখল করো’ কর্মসূচিতে অদ্ভুত সব দাবি : এদের পেছনে কারা?
গত ৯ আগস্ট ২০২৪ ঈ. তারিখে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতায় একজন শিক্ষানবিশ নারী চিকিৎসককে পাশবিক নির্যাতনের পর নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। ভারতসহ সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ এর তীব্র নিন্দা জানায়। বাংলাদেশেও বিভিন্নভাবে বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে ভারতের বিক্ষোভরত মানুষদের প্রতি সংহতি জানানো হয়। আমরাও এর তীব্র নিন্দা জানাই। পৃথিবীর যেখানেই এধরনের জুলুম-নির্যাতন হবে, শান্তিপ্রিয় মানুষদের তার প্রতিবাদ ও সম্ভাব্য প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে।
এরই মধ্যে গত ১৬ আগস্ট ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ কর্মসূচি নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক একটি সমাবেশে জড়ো হয়েছিলেন। সেখানে নাকি সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাও উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে দাবি-দাওয়া দিতে আহ্বান করেছেন এবং সেগুলো পুরো করার আশ্বাসও দিয়েছেন। তখন তারা ১৩ দফা দাবি পেশ করে। সরকারের একজন উপদেষ্টা (মন্ত্রী পদমর্যাদার) কর্তৃক দাবি-দাওয়া চাওয়া এবং ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক তৎক্ষণাৎ তা দিয়ে দেওয়া দেখে স্বাভাবিকভাবেই অনুমেয় হতে পারেÑ বিষয়গুলো ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। ওই সময় তারা যে ১৩ দফা দাবি প্রদান করেছেন, তার কয়েকটি তো এমন, যা কোলকাতার ঘটনার সাথে প্রাসঙ্গিক ও সত্য-ন্যায়ের পথে থাকা সকল মানুষেরই দাবি। যেমন, পাশবিক নির্যাতনের পর বিভিন্ন সময় যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, সুষ্ঠু তদন্ত করে সেসব ঘটনার বিচার চাওয়া হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে। এছাড়া আরো দুয়েকটি দাবি এমন আছে, যেগুলো পুরো না মানলেও এর আংশিক যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু এগুলোর সাথে তারা আরো যে কয়েকটি দাবি দিয়েছে, তা দেখে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে, এদের আসলে উদ্দেশ্য কী?
এ সময়ে কেন চরম বিতর্কিত কিছু পুরোনো বিষয় সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। এটা কি দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার পাঁয়তারা, নাকি কিছু মতলববাজ লোককে ব্যবহার করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমস্যায় ফেলার একটি ষড়যন্ত্র?
তা না হলে ধর্ম, গোত্র, বর্ণের ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রতিটি লিঙ্গের মানুষের সম্পত্তিতে সমানাধিকার, ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড ও গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ করার মতো দ্বীনÑধর্ম ও স্বীকৃত সভ্যতা পরিপন্থী দাবিগুলোর ঠিক এ সময়ে কেন অবতারণা করা হল?
যে দেশের ৯০%-এর বেশি মানুষ মুসলমান, ব্যক্তিজীবনে এদের সকলে দ্বীন-ধর্মের সমান অনুশীলন না করলেও মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবং তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল, নারী সমাজ ও সমগ্র মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বীন-ইসলামকে তারা সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। তাই তো পারিবারিক জীবনের বিধি-বিধানগুলো সকল শ্রেণির মুসলমানরা মেনে চলে। ব্রিটিশ সরকার এদেশে দীর্ঘ সময় শাসন করেছিল এবং তারা পূর্বের ইসলামী আইন-কানুনের পরিবর্তে নতুন নতুন নিয়ম-কানুন তৈরি করেছিল; কিন্তু মুসলমানদের পারিবারিক আইনে তারাও হাত দেয়নি। প্রত্যেক ধর্মের পারিবারিক আইন তার নিজের মতো করে ছিল। এখন একদল মতলবি লোক ‘ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড’ তথা অভিন্ন পারিবারিক আইন বানানোর দাবি করে যাচ্ছে। কিছু ধর্মবিমুখ লিবারেল মানুষ এটিকে বাস্তবায়নের জন্য দেশে দেশে তৎপরতা চালাচ্ছে। মানুষকে ধর্মবিমুখ করার এটি একটি আন্তর্জাতিক অপকৌশল। আর সে দাবিটিই এ সময়ে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সামনে Ñসংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী তারই উৎসাহেÑ পুনর্ব্যক্ত হল। সকল লিঙ্গের লোককে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সমান হিস্যা দেওয়ার বিষয়টিও একই প্রকারের দাবি।
প্রশ্ন হচ্ছে, ষোলো কোটি মুসলমান তার উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন ও পারিবারিক আইন পরিবর্তনের জন্য এদেরকে কি প্রতিনিধি বানিয়েছে? ওরা কয়জন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। আজকে যদি জরিপ করা হয়, তাহলে তাদের পক্ষে দেশের কত শতাংশ মানুষের ভোট নিতে পারবে? ইসলামের শাশ্বত বিধানগুলোর বিরুদ্ধে আইন বানাতে কতজন লোকের সমর্থন পাবে তারা?
আমরা সতর্ক করে বলতে চাই, এ ধরনের দাবি-দাওয়া সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির একটি বড় কারণ হয়ে উঠতে পারে। এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানকে এবং সাথে সাথে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে।
তাদের আরেকটি দাবি ছিল, গর্ভপাতের অধিকার দেওয়া হোক। গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ করা হোক। এটি নিয়ে আমরা তেমন কিছু বলতে চাই না; যার গর্ভ তার নিজের সমস্যা। একজন নারী বৈধ স্বামী কর্তৃক গর্ভবতী হলে কেনইবা তা ফেলে দিতে চাইবেনÑ সে প্রশ্নও থেকে যায়। তবে মনে রাখা দরকার, অযথা ও অকারণে গর্ভপাত ইসলামে নিষিদ্ধ। আর পশ্চিমা প্রভাবে প্রভাবিতদের জানা থাকা দরকার যে, আমেরিকাসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে এখন পর্যন্ত বিষয়টি বিতর্কিত ও অমিমাংসিত রয়েছে। অথচ ওসব দেশে তো বিবাহ বহির্ভূতভাবে গর্ভ এসে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রে আইন বিরোধী নয়; তাই সেটিকে ফেলে দেওয়ারও একটি প্রবণতা ব্যাপক থাকে। কিন্তু এদেশে কেন এ প্রবণতা থাকবে! এখানে কি বিবাহ বহির্ভূত সন্তান ধারণ আইনগত বৈধ? আজকে যারা গর্ভপাতকে বৈধ বানাতে চাচ্ছে, ভবিষ্যতে তারা ওসব জঘন্য ব্যাপার-স্যাপার (বিবাহ বহির্ভূত অবাধ মেলামেশা) এদেশে চালু করার কথা বলবে নাÑ এর কী গ্যারান্টি আছে?
এছাড়াও আরো বিভিন্ন দাবি তারা এমন পেশ করেছে, যেগুলোতে ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা রয়েছে। যেমন, তারা লিঙ্গ বৈচিত্র্যের কথা তুলেছেন। লিঙ্গ পরিচয়ের কথা বলেছেন। এদেশের সরকারি কাগজপত্রে তো লিঙ্গ পরিচয় লেখার নিয়ম কার্যকর আছেই। তারা নতুন কী বৈচিত্র্য প্রকাশ করতে চায়? এসব কথার আড়ালে এলজিবিটি-এর মতো মানবতা বিধ্বংসী বিষয়গুলো টেনে আনা হচ্ছে না তো?
সুতরাং দেশবাসীকে এ ধরনের জঘন্য ব্যাপারগুলোতে সতর্ক থাকতে হবে। বর্তমান বিশেষ সরকারের সুযোগ নিয়ে কেউ যেন এমন জঘন্য ও মারাত্মক ইসলাম বিরোধী ও মানবতা বিধ্বংসী কোনো কিছু আইনসিদ্ধ করে ফেলতে না পারে। সরকারের কোনো উপদেষ্টা যদি এসব ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো আদর্শ বা মতে বিশ্বাসীও হন, তাদের মনে রাখতে হবে যে, জনগণ কিন্তু তাদেরকে এহেন কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেনি। এ ধরনের দাবি-দাওয়ায় সায় দিলে দেশে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার যে সমূহ আশঙ্কা রয়েছে, তা তাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে।
কৈফিয়ত : ভেতরে কলাম না থাকা ও কিছু যৌক্তিক কারণে এবারের সম্পাদকীয় দীর্ঘ হয়ে গেছে। সম্মানিত পাঠকদের কাছে মাজেরাত। Ñসম্পাদক