আকলে আম কীভাবে হাসিল করব?
الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد!
বিভিন্ন লেখা ও আলোচনায় عقلِ عام শব্দটি বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো বলা হয়েছে, তলাবায়ে কেরামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, মাদরাসী তালেবে ইলমীর যামানায় তারা তিনটি বিষয় অর্জনের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবেন-
১. কিতাবী ইস্তি‘দাদ।
২. عقلِ عام
৩. الفقہ العام للدین الاسلامی বা দ্বীনের সাধারণ বুঝ।
একাধিক তালিবে ইলম ভাই জানতে চেয়েছেন عقلِ عام ও فقہِ عام বলতে কী বেঝায়?
فقہِ عام সম্পর্কে ইনশাআল্লাহ কাছাকাছি কোনো সংখ্যায় স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধ ছাপার ইচ্ছা আছে। আর عقلِ عام সম্পর্কে কিছু কথা এখনই আরয করার নিয়ত করেছি; যদিও কমপক্ষে عقلِ عام বিষয়ে আমার কিছু না লেখা উচিত ছিল। কারণ এ বিষয়ে আমার নিজের মধ্যেও যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। তবু প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে বড়দের থেকে শোনা বা বিভিন্ন কিতাবে পড়া কিছু কথা আরয করার চেষ্টা করব। আল্লাহ তাআলা সঠিক বলার এবং সহজভাবে বলার তাওফীক দান করুন- আমীন।
আসাতিযায়ে কেরামের মুখে শুনেছি-
يک من علم را دہ من عقل باید۔
‘এক মণ ইলমের জন্য দশ মণ আকল দরকার।’
পরবর্তীতে শায়েখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর এ বাণী শুনেছি-
درهمُ مالٍ يحتاج قِنطارَ عقلٍ، ودرهمُ علمٍ يحتاج قِنطارَيْ عقلٍ.
‘এক দিরহাম মালের জন্য এক স্তূপ আকল দরকার। আর এক দিরহাম ইলমের জন্য দুই স্তূপ আকল দরকার।’
‘আকলমান্দ তালিবে ইলম’ আর ‘সাধারণ তালিবে ইলম’- এ দুইয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য। ইলম হাসিল ও ইস্তিফাদার ক্ষেত্রে এবং দিনরাতের বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মধ্যে কখনো আসমান-যমিনের পার্থক্যও হয়ে যায়।
কারো আকল যদি তার ইলমের তুলনায় বেশি হয়, তবে এটি তার জন্য একটি প্রশংসনীয় গুণ। আর কারো ইলম তার আকলের তুলনায় বেশি হয়ে গেলে, সেটা তার নিন্দার কারণ হয়ে যায়। তারীখ ও তারাজিমের কিতাবাদিতে কারো কারো জীবনীতে এ বিষয়ক আলোচনাও রয়েছে।
এটা ঠিকÑ আকল, তায়াক্কুয ও নাবাহাত এসব বিষয় ফিতরী ও স্বভাবজাত হয়ে থাকে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এসব বিষয়ে کسب ও اختیار অর্থাৎ চেষ্টা ও মেহনত করে অর্জন করার সুযোগ নেই। বরং এগুলো মৌলিকভাবে ফিতরী ও স্বভাবগত হলেও চেষ্টা ও সঠিক মাধ্যম অবলম্বনের দ্বারা অনেক বৃদ্ধি পায়। তেমনি এসব বিষয়ে খেয়াল ও গুরুত্ব না দিলে ধীরে ধীরে কমেও যায়। ইমাম বায়হাকী রাহ. সত্যই লিখেছেন-
وَالْخُلُقُ الْحَسَنُ قَدْ يَكُونُ غَرِيزَةً، وَقَدْ يَكُونُ مُكْتَسَبًا، وَإِنَّمَا يَصِحُّ اكْتِسَابُهُ لِمَنْ كَانَ فِي غَرِيزَتِهِ أَصْلٌ مِنْهُ، فَهُوَ يَضُمُّ مَا اكْتَسَبَه إِلَيْهِ مَا يَضُمُّه.
وَمَعْلُومٌ فِي الْعَادَاتِ أَنَّ ذَا الرَّأْيِ بِمُجَالَسَتِه أُولِي الْأَحْلَامِ وَالنُّهَى يَزْدَادُ رَأَيًا، وَأَنَّ الْعَالِمَ يَزْدَادُ بِمُخَالَطَةِ الْعُلَمَاءِ عِلْمًا، وَكَذلِكَ الصَّالِحُ والْعَاقِلُ بِمُجَالَسَةِ الصُّلَحَاءِ والْعُقَلَاءِ، فَلَا يُنْكَرُ أَنْ يَكُونَ ذُو الْخُلُقِ الْجَمِيلِ يَزْدَادُ حُسْنَ خُلُقٍ بِمُجَالَسَةِ أُولِي الْأَخْلَاقِ الْحَسَنَةِ، وَبِاللهِ التَّوْفِيقُ.
উত্তম আখলাক কখনো স্বভাবের মধ্যেই থাকে আবার কখনো তা অর্জন করতে হয়। তবে তা সে-ই অর্জন করতে পারে, যার স্বভাবের মধ্যে উত্তম চরিত্রের বীজ রয়েছে। অতঃপর সে মেহনত ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাতে বৃদ্ধি ঘটাতে থাকে।
আর অভিজ্ঞতার দ্বারা এটা সুপ্রমাণিত, বুদ্ধিমান ব্যক্তি যদি বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ব্যক্তির সংশ্রবে থাকে, তাহলে তার বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা বৃদ্ধি পায়। কোনো আলেম যদি অন্য আলেমদের সঙ্গে ওঠাবসা করে, তাহলে তার ইলম বাড়ে। তেমনি কোনো নেককার ও আকলমান্দ যদি অন্যান্য নেককার ও বুদ্ধিমান ব্যক্তির সঙ্গে চলাফেরা করে, তাহলে তারও একই রকম উন্নতি ঘটে। অতএব এটা অনস্বীকার্য, চরিত্রবান ব্যক্তি যদি অন্য চরিত্রবান ব্যক্তিদের সাহচর্য গ্রহণ করে, তাহলে তার আখলাক ও চরিত্র আরো সুন্দর হবে। আর তাওফীক তো আল্লাহরই হাতে। Ñশুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৬/২২৯-২৩০
বায়হাকী রাহ.-এর কথায় যেমনি এটা বোঝা যায় যে, العقل يزيد وينقص (অর্থাৎ আকল বাড়ে কমে) তেমনি এটাও জানা যায়, আকল বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল عقلاء এবং أولو الأحلام والنهى- এর সাহচর্য।
সাহচর্যের বিকল্প তো কিছুই নেই। তবে এক প্রকারের সহযোগী হতে পারে যে বিষয়টা তা হল, আহলে আকল ও উলুল আহলামি ওয়ান নুহা-এর ঘটনাবলি, তাঁদের মালফুযাত, মাকতুবাত এবং সীরাত ও জীবনী মনোযোগসহ অধ্যয়ন করা।
দ্বীন-দুনিয়ার সব বিষয়েই তো আকলের দরকার। তবে আকলেরও বিভিন্ন স্তর রয়েছে। আর ‘আকলে সালীম’ তথা সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। একজন আলেমের আকল তো এমন হওয়া চাই, যেমনটা জামালুদ্দীন ইসনাবী (৭৭২ হি.) রাহ. তাঁর শাগরিদ যাইনুদ্দীন ইরাকী (৮০৬ হি.) রাহ. সম্পর্কে বলেছিলেনÑ
إِن ذهنه صَحِيح لَا يقبل الْخَطَأ.
অর্থাৎ তার আকল সালীম ও তীক্ষè অনুভূতিসম্পন্ন; তাই কোনো ভুল কথা বা ভুল চিন্তা তার যেহেন কবুল করতে পারে না। -আযযওউল লামে, সাখাভী ৪/১৭২, ইরাকী রাহ.-এর জীবনী
এখন আমার আলোচ্য বিষয় আকলের এ উঁচু স্তর সম্পর্কে নয়। আমি বলছিলাম عقلِ عام সম্পর্কে। যেটাকে বলতে পারেন ‘কমন সেন্স’, ‘কাণ্ডজ্ঞান’ বা ‘সাধারণ বিচারবুদ্ধি’।
عقلِ عام বলতে কী বোঝায়?
ভালো-মন্দ, সঠিক-ভুল, উপযোগী-অনুপযোগী, উপকারী-ক্ষতিকর ইত্যাদি বোঝার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে একটি সাধারণ বোধশক্তি ও বিচারশক্তি দান করেছেন। এর দ্বারা একটা পর্যায় পর্যন্ত মানুষ ভালো-মন্দ ও সঠিক-ভুলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে। তেমনি কোন্টা উপযোগী আর কোন্টা অনুপযোগী এবং কোথায় কী করতে হবে আর কী না করতে হবেÑ এ ধরনের অনেক বিষয় মানুষ তার সাধারণ বিচারবুদ্ধি দিয়েই নির্ধারণ করতে পারে। মানুষের এ স্বাভাবিক ও সাধারণ বিচারবুদ্ধিকেই বলা হয় عقلِ عام।
দ্বীনী বিষয়েও عقلِ عام জরুরি
দ্বীন-দুনিয়া উভয় ক্ষেত্রেই عقلِ عام-এর দরকার হয়। দ্বীনী ক্ষেত্রে সেটা আরো বেশি প্রয়োজন হয়। হক-বাতিল ও সত্য-মিথ্যা চেনার অনেক বড় একটি মাধ্যম عقلِ عام। সেজন্য কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা মানুষের আকলকে খেতাব করে অনেক কিছু বলেছেন, যাতে তারা তাদের আকল ব্যবহার করেই প্রকৃত সত্য অনুধাবন করতে পারে। তাওহীদ, শিরক, রিসালাত, আখিরাত ইত্যাদি বিষয়ের সত্যতা বোঝার জন্য আল্লাহ তাআলা মানুষকে আকল ব্যবহারের আদেশ করেছেন। অর্থাৎ মানুষকে যে সাধারণ বিবেক ও বিচারবুদ্ধি দেওয়া হয়েছে, সেটা ব্যবহার করলেই তার সামনে এসবের সত্যতা স্পষ্ট হয়ে যাবে। কুরআন মাজীদে এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। নিম্নে কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হলÑ
তাওহীদ ও শিরক অনুধাবনে আকলে আম
আল্লাহ তাআলা বলেন-
لَوْ كَانَ فِیْهِمَاۤ اٰلِهَةٌ اِلَّا اللهُ لَفَسَدَتَا، فَسُبْحٰنَ اللهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا یَصِفُوْنَ.
যদি আসমান ও যমিনে আল্লাহ ছাড়া আরো মাবুদ থাকত, তবে (আসমান-যমিন) উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ২২
আরো বলেন-
مَا اتَّخَذَ اللهُ مِنْ وَّلَدٍ وَّ مَا كَانَ مَعَهٗ مِنْ اِلٰهٍ اِذًا لَّذَهَبَ كُلُّ اِلٰهٍۭ بِمَا خَلَقَ وَ لَعَلَا بَعْضُهُمْ عَلٰی بَعْضٍ، سُبْحٰنَ اللهِ عَمَّا یَصِفُوْنَ.
আল্লাহ কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি এবং তাঁর সঙ্গে অন্য কোনো মাবুদও নেই। সে রকম হলে প্রত্যেক মাবুদ তার সৃষ্টি নিয়ে আলাদা হয়ে যেত আর তারা একে-অন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার করত। ওরা যা বলে, তা থেকে আল্লাহ পবিত্র। -সূরা মুমিনুন (২৩) : ৯১
মানুষের সাধারণ বিবেক-বুদ্ধিতেও যে একাধিক মাবুদ থাকা সম্ভব নয়, উপরের দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সে বিষয়টিই স্পষ্ট করলেন।
তাওহীদ-শিরক বিষয়ে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার কওমের সঙ্গে যেসব বিতর্ক করেছেন সেগুলোর বর্ণনা কুরআন কারীমে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের যুক্তি-প্রমাণকে ‘হুজ্জাতুনা’ বলে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ করেছেন-
وَ تِلْكَ حُجَّتُنَاۤ اٰتَیْنٰهَاۤ اِبْرٰهِیْمَ عَلٰی قَوْمِهٖ.
আর এটা ছিল আমার যুক্তি-প্রমাণ, যা আমি ইবরাহীমকে তার জাতির মোকাবেলায় দান করেছিলাম। -সূরা আনআম (৬) : ৮৩
ওইসমস্ত বিতর্কে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আকলে আমকেই দলীল হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ দেখুন সূরা বাকারার ২৫৮ নং আয়াত, সূরা আনআমের ৭৪-৮২ নং আয়াত এবং সূরা আম্বিয়ার ৫১-৬৭ নং আয়াত।
মূর্তির অসারতা ও ভ্রষ্টতা স্পষ্ট করার জন্য তিনি যে পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, এর দ্বারা আসলে তিনি মুশরিকদের বিবেক ও সাধারণ বিচারবুদ্ধিকেই জাগ্রত করার চেষ্টা করেছিলেন। সবশেষে তিনি বলেছিলেন-
قَالَ اَفَتَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لَا یَنْفَعُكُمْ شَیْـًٔا وَّ لَا یَضُرُّكُمْ، اُفٍّ لَّكُمْ وَ لِمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ، اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ.
তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর উপাসনা কর, যা তোমাদের উপকারও করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না? ধিক্ তোমাদের ও তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের উপাসনা কর তাদের! তোমরা কি বোঝ না? -সূরা আম্বিয়া (২১) : ৬৬-৬৭
খোদ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে ইহুদীদের দাবি, তিনি ইহুদী। আর নাসরানীদের দাবি, তিনি নাসরানী। আল্লাহ তাআলা তাদের এ মিথ্যা দাবির খণ্ডনে তাদেরকে সাধারণ বিচারবুদ্ধি কাজে লাগানোর আদেশ করেছেন। কারণ ইহুদী বা নাসরানী হওয়ার জন্য তো ইবরাহীম আলাইহিস সালামের আবির্ভাব তাওরাত-ইনজীলের পরে হতে হবে। অথচ তিনি তাওরাত-ইনজীলের আগেই আবির্ভূত হয়েছেন। সুতরাং এটা একদম স্পষ্ট, তিনি ইহুদীও নন, নাসরানীও নন। সূরা আলে ইমরানে ইরশাদ হয়েছে-
یٰۤاَهْلَ الْكِتٰبِ لِمَ تُحَآجُّوْنَ فِیْۤ اِبْرٰهِیْمَ وَ مَاۤ اُنْزِلَتِ التَّوْرٰىةُ وَ الْاِنْجِیْلُ اِلَّا مِنْۢ بَعْدِهٖ، اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ.
হে কিতাবীরা! তোমরা ইবরাহীম সম্পর্কে কেন বিতর্ক কর, অথচ তাওরাত ও ইনজীল তো তার পরে নাযিল হয়েছিল। তোমাদের কি বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। -সূরা আলে ইমরান (৩) :
রিসালাতের সত্যতা অনুধাবনে আকলে আম
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওতপ্রাপ্তির আগে চল্লিশ বছর মক্কায় অবস্থান করেছেন। মক্কার অধিবাসীরা তাঁকে দেখেছে, তাঁর কথাবার্তা, চালচলন ও সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছে। তারা প্রত্যক্ষভাবে জানত, তিনি উম্মী; লেখাপড়া শেখেননি। তাঁর সততা, সত্যবাদিতা, আমানতদারি ইত্যাদি গুণ তারা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে। ফলে তারাই তাঁকে الأمين খেতাবে ভূষিত করেছে। কাবাগৃহে হাজারে আসওয়াদ স্থাপনের ঘটনায় তারাই সমস্বরে বলে উঠেছিল-
هَذَا الْأَمِينُ! قَدْ رَضِينَا بِمَا قَضَى بَيْنَنَا.
(দালায়িলুন নুবুওয়াহ, ইমাম বায়হাকী ২/৬২ )
অথচ তিনি যখন নবুওতপ্রাপ্তির ঘোষণা দিলেন এবং এক আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিলেন তখন তারাই তাঁকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দিল। আল্লাহ তাআলা তাদের এ অপবাদের খণ্ডনে নবীজীকে বলতে বললেন-
قُلْ لَّوْ شَآءَ اللهُ مَا تَلَوْتُهٗ عَلَیْكُمْ وَ لَاۤ اَدْرٰىكُمْ بِهٖ، فَقَدْ لَبِثْتُ فِیْكُمْ عُمُرًا مِّنْ قَبْلِهٖ، اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ.
(হে নবী!) আপনি বলে দিন, আল্লাহ চাইলে আমি এ কুরআন তোমাদের পড়ে শোনাতাম না এবং তিনিও তোমাদের এ সম্বন্ধে অবহিত করতেন না। আমি তো এর আগেও জীবনের একটি (বড়) সময় তোমাদের মাঝে অতিবাহিত করেছি। তবে কি তোমরা বোঝ না? -সূরা ইউনুস (১০) : ১৬
আরো ইরশাদ করেছেন-
وَ مَا كُنْتَ تَتْلُوْا مِنْ قَبْلِهٖ مِنْ كِتٰبٍ وَّ لَا تَخُطُّهٗ بِیَمِیْنِكَ اِذًا لَّارْتَابَ الْمُبْطِلُوْنَ.
(হে নবী!) আপনি তো এর আগে কোনো কিতাব পড়েননি এবং নিজ হাতে কোনো কিতাব লেখেনওনি। সে রকম কিছু হলে ভ্রান্তপথ অবলম্বনকারীরা অবশ্যই সন্দেহ করতে পারত। -সূরা আনকাবুত (২৯) : ৪৮
নবীজীর প্রতি তাদের আরেকটা জঘন্য অপবাদ এই ছিল- তিনি নাকি মক্কার এক অনারব লোকের কাছ থেকে কুরআন শিখে এরপর সেটাকে আল্লাহর নাযিলকৃত বলে চালিয়ে দিয়েছেন। নাউযু বিল্লাহ! কত বড় মিথ্যাচার! আল্লাহ তাআলা বললেন, এটা কীভাবে সম্ভব? ওই লোকের ভাষাই তো ভিন্ন। অথচ কুরআন হল স্পষ্ট আরবী ভাষার কিতাব। সূরা নাহ্লে ইরশাদ করেন-
وَ لَقَدْ نَعْلَمُ اَنَّهُمْ یَقُوْلُوْنَ اِنَّمَا یُعَلِّمُهٗ بَشَرٌ، لِسَانُ الَّذِیْ یُلْحِدُوْنَ اِلَیْهِ اَعْجَمِیٌّ وَّ هٰذَا لِسَانٌ عَرَبِیٌّ مُّبِیْن.
আমার ভালো করেই জানা আছে, ওরা বলে, ‘তাকে তো একজন মানুষ শিক্ষা দেয়।’ (অথচ) যার প্রতি ওরা ইঙ্গিত করে তার ভাষা আরবী নয়। আর এটা (অর্থাৎ কুরআনের ভাষা) স্পষ্ট আরবী ভাষা। -সূরা নাহ্ল (১৬) : ১০৩
মোটকথা দ্বীন ও শরীয়তের অনেক বিষয়ই এমন بديهي ও স্পষ্ট। আকলে আম তথা সাধারণ বিবেক-বুদ্ধির আলোকে এসব স্পষ্ট ও বাদীহী বিষয় জানা ও বোঝা জরুরি। এর ফলে ব্যক্তি ইনশাআল্লাহ সেসব বিষয়ে ওয়াসওয়াসা বা সংশয়ের শিকার হবে না; বরং কেউ ওয়াসওয়াসা দিতে চাইলে সে নিজেই তা রদ করে দিতে পারবে।
দুনিয়াবী বিষয়ে আকলে আমের অনিবার্যতা
দ্বীনী বিষয়ের মতো দুনিয়াবী বিষয়েও আকলে আম জরুরি। কারো মধ্যে আকলে আমের ব্যবহার না থাকলে সে নিজেও যেমনি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বে, তেমনি অন্যদেরও বিরক্তি ও কষ্টের কারণ হবে। তার চারপাশের মানুষজন তার দ্বারা কষ্ট পেতে থাকবে, অথচ সে টেরই পাবে না। সেজন্য এসব বিষয়েও শরীয়ত عقل ব্যবহারের আদেশ করেছে। এসব ক্ষেত্রে যারা আকল কাজে লাগায় না, কুরআন মাজীদে তাদের নিন্দা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
اِنَّ الَّذِیْنَ یُنَادُوْنَكَ مِنْ وَّرَآءِ الْحُجُرٰتِ اَكْثَرُهُمْ لَا یَعْقِلُوْنَ، وَ لَوْ اَنَّهُمْ صَبَرُوْا حَتّٰی تَخْرُجَ اِلَیْهِمْ لَكَانَ خَیْرًا لَّهُمْ، وَ اللهُ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ.
(হে নবী!) আপনাকে যারা হুজরার বাইরে থেকে ডাকে, তাদের অধিকাংশেরই বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। যদি তারা ধৈর্যধারণ করত আপনি বের হয়ে তাদের কাছে আসা পর্যন্ত, তবে সেটাই তাদের জন্য উত্তম হত। আর আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম মেহেরবান। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ৪-৫
তাই কথাবার্তা ও আচার-আচরণে সতর্কতা ও সাবধানতা কাম্য, যাতে নিজেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে না পড়ে এবং অন্যেরও বিরক্তির কারণ না হয়। এটা আকলে আমের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।
ইসলামের একটি বড় সৌন্দর্য এটাও যে, ইসলাম মানুষকে عقلِ عام-এর বিষয়গুলো হাতে-কলমে শিখিয়ে দিয়েছে। ইসলামের বিধিবিধান ও আদব-কায়দাগুলো অনুসরণ করলে এমনিই আকলে আমের ব্যবহার হয়ে যাবে। এছাড়া একটি সাধারণ মূলনীতি তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেই দিয়েছেন-
الْمُسْلِمَ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِه وَيَدِه.
স্পষ্ট- আকলে আম কাজে না লাগালে এ হাদীসের ওপর যথাযথভাবে আমল একদম অসম্ভব।
এবার আসুন, যদি একজন সাধারণ মুসলিমের জন্যই আকলে আম এত জরুরি হয়, তাহলে একজন তালিবে ইলমের জন্য তা কতখানি জরুরি! সে তো নিজেকে দ্বীনের তরজুমান হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করছে। ইলমে ওহীর ওয়ারিস হিসেবে নিজেকে তুলে ধরছে। তাই -আল্লাহ না করুন- তার দ্বারা আকলে আমের খেলাফ কিছু ঘটলে, এর মাধ্যমে গোটা আহলে মাদারিস ও দ্বীনী ঘরানার প্রতি এবং দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের প্রতি সমাজে বিরূপ ধারণা তৈরি হবে। তাই তালিবে ইলমদের এ বিষয়ে আরো বেশি সতর্ক হতে হবে।
শুধু ‘কথা’-কে কেন্দ্র করেই কত বিপত্তি! বেফাঁস কথা বলা, আন্দাজে কথা বলা, মুরব্বি ও উস্তাযদের মজলিসে আগে বেড়ে কথা বলা, যে কথার উপযুক্ত আমি নই এমন কথা মুখে উচ্চারণ করা- এই সবই আকলে আমের বিপরীত। অথচ শায়েখ আবদুল কাদের জিলানী রাহ. পূর্ববর্তী মনীষীদের এ বাণী আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন-
لسان الجاهل أمام قلبه، ولسان العاقل العالم وراء قلبه.
জাহেলের যবান থাকে কলবের আগে আর আকলমান্দ আলেমের যবান থাকে কলবের পেছনে। -আলফাতহুর রাব্বানী ওয়াল ফায়যুর রাহমানী, জিলানী, পৃ. ১৭৪, ৪২তম মজলিস
বিশিষ্ট তাবেয়ী মুহাল্লাব ইবনে আবু সুফরাহ (৮২ হি.) রাহ. বলেন-
يُعْجِبُنِي فِي الرَّجُلِ أَنْ أَرَى عَقْلَهٗ زَائِداً عَلَى لِسَانِهٖ.
আমার কাছে পছন্দনীয় হল, ব্যক্তির কথার তুলনায় তার আকল বেশি থাকবে। -সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, যাহাবী ৪/৩৮৪
রাস্তায় ময়লা ফেলা, রাস্তায় বা দেয়ালে পিক বা থুথু ফেলা, মানুষের সামনে নাক ঝাড়া, ইস্তিঞ্জার সময় কুলুখ নিয়ে আপত্তিকরভাবে মানুষের সামনে হাঁটতে থাকা, হাম্মাম ব্যবহারের পর তা অসুন্দর ও অপরিচ্ছন্ন রেখে চলে আসা, উঁচু হাম্মামের ক্ষেত্রে বসার জায়গা ভেজা রেখে দেওয়া (অথচ কর্তব্য ছিল ব্যবহারের পর টিস্যু বা শুকনো কাপড় দিয়ে পুরো বসার জায়গাটি মুছে দেওয়া), মাদরাসায় যখন আমভাবে ঘুমের সময় তখন শব্দ করে পড়ে বা কথা বলে কিংবা বাতি জ্বালিয়ে অন্যদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানো, নিজের ভেবে আরেকজনের জুতা নিয়ে যাওয়া, পরে এসে সারি ভেঙে আগে যাওয়ার জন্য ধাক্কাধাক্কি করা, মুসাফাহার জন্য হুড়োহুড়ি করা এবং যার সঙ্গে মুসাফাহা করা হবে তার অবস্থার প্রতি খেয়াল না করা- এ সবই আকলে আম ব্যবহার না করার নতীজা। এ ধরনেরই আরেকটা বিষয় হল, ওযু করে বা হাত ধুয়ে চারপাশ না দেখে হাত ঝাড়া দেওয়া; ফলে ব্যবহৃত পানির ছিটা মানুষের চোখে-মুখে, খাবারে বা কিতাবের ওপর এসে পড়ে।
এগুলোর দ্বারা অন্যদেরও কষ্ট হয় এবং নিজের ব্যক্তিত্বও নষ্ট হয়।
একথা সবসময় মনে রাখতে হবে, একজন তালিবে ইলমের ব্যক্তিত্ব কেবল তার নিজের ব্যক্তিত্ব নয়। তার মধ্যে দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের নিসবত রয়েছে। তাই তার ব্যক্তিত্বের দ্বারা যেমন দ্বীনের اعزاز ও تكريم হয়, তেমনি তা খর্ব হওয়ার দ্বারা দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের اہانت-ও হয়।
তবে এটাও মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিত্বের নামে অহংকারে লিপ্ত হওয়া এবং অন্যদের হেয় করা- এটাও আকলে আম না থাকার দলীল। হাদীস শরীফে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلهِ إِلَّا رَفَعَهُ اللهُ.
আল্লাহর জন্য যে-ই বিনয়ী হবে, আল্লাহ তাকে সমুন্নত করে দেবেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮৮
যাইহোক, এ ধরনের বিষয়গুলো আপাত দৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও এগুলোর দালালাত সাধারণ নয়। এগুলো দ্বারা বোঝা যায়, ব্যক্তির মধ্যে আকলে আমের অনুপস্থিতি বা অভাব রয়েছে। তাই এসব বিষয়ে আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি।
আকলে আম কীভাবে অর্জন করব
১. اسوۂ رسول اکرم صلی اللہ علیہ وسلم
পুরো সীরাতে নববিয়্যা আকলে আম ও আকলে সালীমের اعلی থেকে اعلی ترین নমুনা। আকলে আমের ছোট থেকে ছোট বিষয়েও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করতেন। যেমন-
যে মজলিসে তিনজন রয়েছে, তাতে একজনকে রেখে বাকি দুইজনের কানে কানে কথা বলা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। কারণ এতে তৃতীয়জন বিব্রত বোধ করতে পারে। অবশ্য তিনজনের বেশি হলে অবকাশ আছে।
দরজায় কড়া নাড়ার পর ‘কে’ জিজ্ঞেস করলে অনেকেই নাম না উচ্চারণ করে বলে ‘আমি’। নবীজী এটা অপছন্দ করেছেন। কারণ স্বরের অস্পষ্টতা বা সাদৃশ্যের কারণে অনেক সময় শুধু ‘আমি’ বলার দ্বারা কোন্ ব্যক্তি- তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়।
এক রাতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শোয়া থেকে উঠলেন। পাশে ছিলেন উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.। নবীজী একদম আস্তে কোনো শব্দ না করে উঠলেন, চাদর নিলেন এবং জুতা পরলেন। এরপর অতি সন্তর্পণে দরজা খুলে বের হলেন এবং সাবধানে দরজা বন্ধ করলেন। উম্মুল মুমিনীনের ভাষায়-
فَأَخَذَ رِدَاءَهٗ رُوَيْدًا، وَانْتَعَلَ رُوَيْدًا، وَفَتَحَ الْبَابَ فَخَرَجَ، ثُمَّ أَجَافَه رُوَيْدًا.
নবীজী এত সতর্কতা অবলম্বন করলেন, যাতে উম্মুল মুমিনীনের ঘুমে ব্যাঘাত না হয় এবং ঘুম থেকে উঠে কামরায় নবীজীকে না দেখে শঙ্কিত না হন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
وَظَنَنْتُ أَنْ قَدْ رَقَدْتِ، فَكَرِهْتُ أَنْ أُوقِظَكِ، وَخَشِيتُ أَنْ تَسْتَوْحِشِي.
আমি মনে করলাম, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ। তাই তোমাকে জাগাতে চাইনি। এবং আমার আশঙ্কা হল, (আমাকে কামরায় না দেখে) তুমি হয়তো দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৭৪
একবার নবীজীর কাছে কিছু মেহমান এলেন। নবীজীর হুজরার পাশেই তাদের থাকার ব্যবস্থা। রাতের বেলা যখন নবীজী তাদের পাশ দিয়ে যেতেন, এভাবে সালাম দিতেন-
فَيُسَلِّمُ تَسْلِيمًا لَا يُوقِظُ نَائِمًا، وَيُسْمِعُ الْيَقْظَانَ.
অর্থাৎ এমনভাবে সালাম দিতেন, যাতে ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম না ভাঙে এবং জাগ্রত ব্যক্তি শুনতে পায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৫৫
এ ধরনের অনেক দৃষ্টান্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতে রয়েছে।
২. سیر السلف الصالحین
সালাফে সালেহীনের জীবনীতেও এ বিষয়ক অনেক দৃষ্টান্ত ও নির্দেশনা রয়েছে।
আর এমনটি তো হবেই। কারণ তারা সঠিক অর্থেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়ারিস ছিলেন এবং তাঁর সুন্নাহর অনুসারী ছিলেন। ইমাম আবু হানীফা রাহ. সম্পর্কে একথাটি তো ইতিহাসে খুব প্রসিদ্ধ-
كَانَ أَبُو حنيفة يَتَبَيَّنُ عقلُه في منطِقه، ومِشْيَتِه، ومَدخَلِه، ومَخرَجِه.
অর্থাৎ ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর কথাবার্তা, চলাফেরা ও আসা-যাওয়া থেকে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা প্রকাশ পেত। -তারীখে বাগদাদ ১৩/৩৬৪; তাহযীবুল কামাল ২৯/৪৩৯; মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা ওয়া সাহিবাইহি, যাহাবী, পৃ. ৪২
৩. صحبۃ العقلاء الصالحین
আকলমান্দ নেককার ব্যক্তিদের সোহবত।
৪. مطالعۃ کتب الآداب الاسلامیہ
ইসলামী আদব ও শিষ্টাচার সম্পর্কিত কিতাবাদি অধ্যয়ন। যেমন-
ক. আদাবুল মুআশারা, হযরত হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.।
খ. মিন আদাবিল ইসলাম, শায়েখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.।
গ. আদাবুদ দুন্য়া ওয়াদ দ্বীন, ইমাম আবুল হাসান মাওয়ারদী রাহ. (৩৬৪-৪৫০ হি.)।
ঘ. আলআদাবুশ শারইয়্যাহ, ইমাম ইবনে মুফলিহ মাকদিসী রাহ. (৭০৮-৭৬৩ হি.)।
ঙ. আকাবিরের খুতুবাত, মালফুযাত ও মাকতুবাত। বিশেষভাবে হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ.-এর মালফুযাত।
চ. যিকির ও ফিকির, হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম।
৫. اپنی عقل کا استعمال
নিজের আকল-বুদ্ধি ব্যবহার করা। আকলে আম হাসিলের জন্য এটা অনেক জরুরি শর্ত।
অনেক সময় দেখা যায়, কারো এক বিষয়ে আকল কাজ করছে, কিন্তু আরেক বিষয়ে কোনো খেয়াল নেই। সেজন্য সব বিষয়েই লক্ষ রাখার চেষ্টা করতে হবে। এভাবে খেয়াল করে আকল ব্যবহার করতে থাকলে একসময় তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
সবশেষে আকলের নিদর্শন সম্পর্কে ইমাম ইবনুল জাওযী (৫৯৭ হি.) রাহ.-এর একটি বক্তব্য উল্লেখ করছি। বক্তব্যটি যদিও ব্যাপক, তবে আকল বৃদ্ধির মেহনতটা এখান থেকেই শুরু করা যায়। ইবনুল জাওযী রাহ. বলেন-
يُسْتَدلّ على عقلِ الْعَاقِلِ بسكوتِه، وسكونِه، وخَفضِ بَصَرِه، وحَرَكاتِه فِي أماكِنِها اللائقةِ بهَا، ومُراقَبَتِه للعَواقِبِ، فَلَا تَستَفِزُّه شَهْوَةٌ عاجِلةٌ عُقباها ضَرَرٌ، وتراه ينظر فِي القضاء، فَيتَخَيَّر الْأَعْلَى والأحمدَ عَاقِبَةً، من مَطعَمٍ، ومَشرَبٍ، ومَلبَسٍ، وَقَولٍ، وَفعلٍ، وَيتْرك مَا يخَاف ضَرَرَه، ويَستَعِدُّ لِما يجوزُ وُقُوعُه.
অর্থাৎ আকলমান্দ ব্যক্তির নীরবতা ও ধীরস্থিরতা এবং তার অবনমিত দৃষ্টি ও যথোপযুক্ত নড়াচড়াই বলে দেয়, তিনি একজন আকলমান্দ। পরিণামদর্শিতা আকলমান্দ মানুষের বিশেষ একটি গুণ। তাই ক্ষণিকের যে আকাক্সক্ষা পরবর্তীতে ক্ষতি বয়ে আনতে পারে, এমন কোনো আকাক্সক্ষায় সে উদ্বেলিত হয় না। পানাহার, পোশাক-আশাক, কথাবার্তা, কাজকর্ম ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রথমে সে চিন্তা করে, এরপর পরিণতির বিচারে যেটা উত্তম ও প্রশংসনীয় সেটা গ্রহণ করে। কোথাও ক্ষতির আশঙ্কা করলে সেটা থেকে বেঁচে থাকে আর সামনে যা ঘটতে পারে তার জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। -কিতাবুল আযকিয়া, ইবনুল জাওযী, পৃ. ২৬
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আকলে সালীম দান করুন এবং আমাদের সবাইকে আকলে আম হাসিল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
(প্রবন্ধটি লেখা শুরু হয়েছিল যিলহজ্ব ১৪৩৪ হিজরীতে। তখন কেবল প্রারম্ভিকা লেখা হয়েছিল; বাকিটুকু লেখা হয়েছে যিলহজ্ব ১৪৪৫ হিজরীতে।)